বৈদেশিক সাহায্য
বৈদেশিক সাহায্য মূলধনের আন্তঃপ্রবাহ অথবা অন্যকোনো সাহায্য স্বাভাবিক বাজার শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয় না। বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের প্রধান লক্ষ্য সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে বিরাজমান ফাঁক পূরণ করা এবং আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ঘাটতি দূর করা। উন্নয়ন কর্মকান্ডে অর্থ যোগানোর একটি প্রধান উপায় বৈদেশিক সাহায্য। বৈদেশিক সাহায্যকে সাধারণত চারটি প্রধান ধরনে ভাগ করা হয়। প্রথমত, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ যা সাধারণত দশ বা বিশ বছর ধরে গ্রহীতা দেশ কর্তৃক বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ্য। দ্বিতীয়ত, নমনীয় ঋণ যা স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ্য, যার পরিশোধের মেয়াদ দীর্ঘ, অথবা যা অত্যন্ত কম সুদে পরিশোধযোগ্য। সবচেয়ে সুবিধাজনক বৈদেশিক সাহায্য হচ্ছে সরাসরি অনুদান। স্থানীয় মুদ্রায় প্রদেয় অর্থের বিনিময়ে কোন একটি দেশের উদ্বৃত্ত পণ্যের সরবরাহ, যথা পিএল ৪৮০-এর অধীনে আমেরিকার খাদ্যসাহায্য হলো তৃতীয় ধরন; এবং সবশেষে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কারিগরি সাহায্য দান হলো চতুর্থ ধরনের বৈদেশিক সাহায্য। বৈদেশিক সাহায্য মূলত সরকারি ভিত্তিতে যোগান দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে প্রচলিত মানরীতি অনুযায়ী বৈদেশিক সাহায্য বলতে কেবল রেয়াতি শর্তাবলিতে প্রাপ্ত ঋণ ও দান বোঝায়। এগুলি থেকে বাদ যায় সামরিক সহায়তার রূপে মজুত তহবিল স্থানান্তর, বিদেশি বেসরকারি সংস্থাগুলি প্রদত্ত সাহায্য, অর্থ যোগানদারের অগ্রিম ঋণ, রপ্তানি ঋণ, বৈদেশিক লগ্নি বিনিয়োগ, বৈদেশিক সরকারি বিনিয়োগ এবং শতকরা ৫% বা তদূর্ধ্ব সুদের হারে কঠিন শর্তাধীনে ঋণ অথবা বারো বছরের কম সময়ের মধ্যে পরিশোধ্য ঋণ। বাংলাদেশে বিদেশি ঋণদাতাদের মধ্যে রয়েছে বিশেষ বিশেষ দেশ, বহুজাতিক অর্থ সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক এজেন্সি ও প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যের শ্রেণিকরণ হয় সাহায্যের শর্ত, উৎস ও ব্যবহার ইত্যাদির ভিত্তিতে। নানা ধরনের বৈদেশিক সাহায্য হলো ঋণ ও অনুদান, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সাহায্য, অথবা খাদ্যসাহায্য, পণ্যসাহায্য, প্রকল্প সাহায্য এবং কারিগরি সাহায্য।
খাদ্যসাহায্য হলো দাতা দেশ ও সংস্থাগুলি থেকে খাদ্য সরবরাহ অথবা তাদের দ্বারা বাংলাদেশে খাদ্য সরবরাহকারীদের অর্থ পরিশোধ। খাদ্য সরবরাহের পরিবহণ, গুদাম ভাড়া, বিতরণ ইত্যাদি যেসব খরচ দাতা দেশগুলি নির্বাহ করে থাকে তাও খাদ্যসাহায্য হিসেবে বিবেচিত হয়। একইভাবে, পণ্যসাহায্য বলতে বোঝায় পণ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে দাতা দেশগুলির অর্থযোগান যার মধ্যে থাকে ভোগ্যপণ্য, মাধ্যমিক পণ্য এবং শিল্প কারখানার কাঁচামাল। সাহায্য ব্যবস্থার অধীনে আমদানিকৃত খাদ্য ও পণ্যসামগ্রী সরকারি কোষাগারে পরিপূরক অর্থ তহবিল গড়ে তোলে এবং সেই তহবিলের সাহায্যে পরিচালিত প্রকল্প বা কর্মকান্ডসমূহ খাদ্য ও পণ্যসাহায্য কর্মসূচির আওতায় পড়ে। পণ্যসাহায্য কর্মসূচির অধীনে বাংলাদেশে আমদানিকৃত প্রধান প্রধান সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ভোজ্যতেল, বীজ, সার ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি। প্রকল্প সাহায্য হলো প্রকল্প পরিচালনার ব্যয় নির্বাহে অর্থ যোগানোর জন্য দান ও ঋণের সুবিধা। বাংলাদেশে প্রকল্প সাহায্য অনেকাংশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পসমূহের অর্থ যোগানোর সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি প্রকল্প সম্পর্কিত যন্ত্রপাতি ও পণ্য সামগ্রীর আমদানিতে অর্থায়ন করে থাকে। কারিগরি সাহায্য যা প্রকল্প সাহায্যের অংশ হিসেবে দেখানো হয় সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যের উন্নয়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং বিশেষজ্ঞদের (বিদেশি উপদেষ্টা ও কারিগর) সেবা, ফেলোশিপসহ প্রশিক্ষণ সুবিধাদির মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ঋণ, ধার ইত্যাদি সম্বলিত আন্তর্জাতিক মূলধনের প্রবাহ অপেক্ষাকৃত আধুনিক ঘটনা। ১৮৭০-১৯১৩ বছরগুলিতে আন্তর্জাতিক তহবিলের ব্যাপক অংশ কেবল উন্নত দেশগুলিতে বেসরকারি মুদ্রা প্রবাহ নিয়ে গঠিত ছিল এবং ১৯২০ সনে এসব দেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ১০০ মিলিয়ন ডলার ধরা হয়েছিল। সাহায্য কার্যক্রম নামে যে শিল্পটি এখন পরিচালিত তা প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাংক এবং ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দ্বারা সূচিত হয়। এ দুটি সংস্থা উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে মূলধনের সরকারি প্রবাহের প্রাতিষ্ঠানিক ধারা সৃষ্টি করে। বিশ্বব্যাংক ইউরোপ ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বেসরকারি বিনিয়োগের সুবিধা সৃষ্টি করার জন্য প্রাথমিক কর্তৃত্ব লাভ করেছিল। তৃতীয় বিশ্বে বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য রেয়াতি শর্তে বিশ্বব্যাংকের প্রথম ঋণ দেওয়া হয়েছিল ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ সনে তিনটি ল্যাটিন আমেরিকান দেশে।
ব্রিটেনের সামন্ততান্ত্রিক দিনগুলিতে তার অধীন উপনিবেশের কাজ ছিল স্থানীয় রাজস্ব থেকে সরকার পরিচালনা বা উন্নয়নের খরচ মিটানো। কোন উপনিবেশকে কখনও অনুদান সাহায্য দেওয়া হলে তা ব্রিটিশ রাজকোষ নিয়ন্ত্রণ করত। এভাবে সাম্রাজ্যবাদী সরকার উপনিবেশগুলির উন্নয়ন চাহিদা দমিয়ে রাখত।
ভারত উপমহাদেশ একসময় ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রধান উপনিবেশগুলিতে সংঘটিত তীব্র স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে ব্রিটিশ শাসক ১৯২৯ সনে উপনিবেশ উন্নয়ন আইন জারি করে। এর উদ্দেশ্য ছিল পারস্পরিক সুবিধার জন্য উপনিবেশের এলাকাগুলিতে উন্নয়ন কর্মকান্ডে নিয়মিত অর্থ যোগানোর মাধ্যমে বাইরের সাহায্য সংস্থান করা। অধীনস্ত দেশের জন্য এই সাহায্য ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বজায় ছিল। কিন্তু ভারত এবং তৎকালীন বাংলা কখনও এই আইনের প্রয়োগের আওতায় আসে নি। বস্ত্তত উপনিবেশ উন্নয়ন ও ১৯৪০-এর কল্যাণ আইন দ্বারা কোনও উপকারও পাওয়া যায় নি।
সমগ্র ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু অঞ্চলের পুনর্গঠনে সহযোগিতা দানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৮ সালে দ্বিপাক্ষিক সাহায্য কর্মসূচির সূচনা করে। এই কর্মসূচির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ১৯৪৮ সনে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আইন উদ্ভূত এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রশাসন (ইসিএ) পরিচালিত ‘মার্শাল পরিকল্পনা’। ১৯৫০ সালে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রবিধান জারির মাধ্যমে ইসিএ রহিত করা হয়। এরপর অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত অঞ্চলের অধিবাসীদের সাহায্য করার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের আর্থিক সহায়তা বিষয়ক চতুর্থ সূত্র-প্রস্তাবকে কারিগরি সহযোগিতা পরিচালন ব্যবস্থার রূপ দেওয়া হয়। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নীতিতে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং ১৯৫৪-তে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় ভারত, পাকিস্তান ও নিকট প্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। নতুন উন্নয়ন সাহায্য শিরোনামে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার এইসব দেশে বিতরণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র একক বৃহত্তম সাহায্যদাতা দেশ এবং ইউএসএইড সারা পৃথিবী জুড়ে বৈদেশিক সাহায্য কর্মসূচি কার্যকর করার প্রতিষ্ঠান। উন্নয়নশীল দেশে বৈদেশিক সাহায্য দান ও মূলধন যোগানোর অপর একটি বৃহৎ সংস্থা হচ্ছে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান (ওইসিডি)। বহুপাক্ষিক বৈদেশিক অর্থ সাহায্য যোগানদার সংস্থাগুলির মধ্যে সক্রিয় আছে আইডিএ, ইডিবি, ইসি, এফাড, এনডিএফ, ইউনিসেফ ও ইউএন সিস্টেম।
বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে, যখন আফ্রিকার অনেকগুলি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং ব্রিটিশ সরকার ভারতের দিকে অধিক মনোযোগ দিতে শুরু করে, তখন ১৯৫৮ সনে মন্ট্রিলে কমনওয়েলথ বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্মেলনে এই মর্মে একটি ঘোষণা দেওয়া হয় যে, কমনওয়েলথের স্বাধীন সদস্যদের প্রতি উন্নয়ন সাহায্য প্রসারিত হবে। তখন থেকে এইসব দেশে ব্রিটিশ দ্বিপাক্ষিক সাহায্য যেতে শুরু করে। উক্ত সাহায্য প্রয়াসে অন্তর্ভুক্ত হলো: ক. বাজেট প্রণয়নের জন্য অনুদান এবং কারিগরি সাহায্য অনুদান, খ. উপনিবেশ উন্নয়ন এবং কল্যাণমূলক ঋণ ও অনুদান, গ. উপনিবেশ সরকারকে ঋণদান এবং ঘ. রপ্তানি অঙ্গীকার আইনের আওতায় ঋণদান। ব্রিটিশ সাহায্যের শর্তাবলি ছিল উৎপাদনমুখী। সম্প্রসারিত রেয়াতি কাল নিয়ে ঋণ পরিশোধের ব্যাপ্তি ছিল দীর্ঘ এবং সুদের হার ছিল কম। ব্রিটিশ সাহায্য ব্যবস্থা ক্রমশ অন্যান্য উন্নত দেশগুলির কর্ম পরিকল্পনার সঙ্গে একীভূত হয়ে যায় এবং এইভাবে কমনওয়েলথ সূত্র গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
১৯৪৭-এ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের পরে পাকিস্তান, বিশেষ করে এর পূর্ব অংশ পূর্ব পাকিস্তান প্রাচীন কৃষিপদ্ধতি নির্ভর নিম্ন উৎপাদন এবং লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, মৃত্তিকা ক্ষয় ও বন্যা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষিজমি নিয়ে এক ভঙ্গুর ও দরিদ্র কৃষিব্যবস্থার উত্তরাধিকার লাভ করে। এখানে শিল্প কারখানা ছিল না বললেই চলে এবং পূর্বস্থাপিত যে কয়টি কারখানা নতুন রাষ্ট্রের সীমানায় পড়ে সেগুলি কাঁচামালের উৎসের অভাবে কিংবা উৎপন্ন দ্রব্যের বাজার না থাকায় দুর্বল হয়ে যায়। প্রদেশটিকে প্রায় সবকিছু এমনকি, তুচ্ছ ভোগ্য পণ্যও আমদানি করতে হয়। রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে ছিল কিছু কৃষিপণ্য যেগুলির চাহিদা বিশ্ববাজারে অনিশ্চিত ছিল। শিক্ষার মান ছিল নিম্ন, সাক্ষরতা ছিল ন্যূনতম, এবং কারিগরি শিক্ষার অস্তিত্ব মূলত ছিলই না। স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ ব্যবস্থাও ছিল অপ্রতুল। পরিবহণ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল আশু সংস্কারের। এ অবস্থায় বেসামরিক প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র, ব্যাংক ও বাণিজ্যবিষয়ক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ দেশ পরিচালনার দৃঢ় প্রশাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রের মজবুত অবকাঠামো সৃষ্টি আবশ্যক হয়ে পড়ে। ফলে জাতীয় নীতি নির্ধারণের বিষয় হিসেবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সর্বাধিক গুরুত্ব পেতে থাকে।
১৯৪৮-এর দিকে, দেশের উভয় প্রদেশে এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বিভিন্ন শাখা কর্তৃক গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচি সমন্বয় করার জন্য একটি উন্নয়ন বোর্ড স্থাপিত হয়। সরকারি ও বেসরকারি শিল্প কারখানা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সাধনের জন্য ১৯৫০-এ ছয় বছর মেয়াদি একটি উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণীত হয়। স্থানীয় ও বিদেশি বিশেষজ্ঞ এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা শেষে ১৯৫৩ সনে জাতীয় পরিকল্পনা বোর্ড গঠিত হয়। এই বোর্ড জুলাই ১৯৫৫ থেকে জুন ১৯৬০ পর্যন্ত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। পরিকল্পনায় সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যয় হিসেবে ধরা হয় ১০.৮ বিলিয়ন টাকা, যার মধ্যে ৫.৭৬ বিলিয়ন টাকার উৎস ধরা হয় দেশীয় আয়, বাকি ৫.০৪ বিলিয়ন টাকা বৈদেশিক সাহায্য থেকে পাওয়া যাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৬০-১৯৬৫) উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয় ২৩ বিলিয়ন টাকা যার মধ্যে ১২.০৫ বিলিয়ন টাকা দেশজ আয় থেকে এবং ১০.৯৫ বিলিয়ন টাকা উন্নয়ন প্রকল্প সাহায্য ও ঋণ (৬.৮৫ বিলিয়ন টাকা), পণ্য সাহায্য (৩.৫ বিলিয়ন টাকা) ও বেদেশি বেসরকারি বিনিয়োগ (৬০০ মিলিয়ন টাকা) ইত্যাদির রূপে বৈদেশিক সম্পদ থেকে সংগ্রহের হিসাব করা হয়। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্থ যোগানোর ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্যের অংশ ছিল মোট ব্যয়ের ৩৮% ভাগ এবং তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এই অনুপাত ৩২% ভাগে নেমে যায়।
পাকিস্তানের প্রথম দিকের বছরগুলিতে বৈদেশিক সাহায্যের সকল প্রতিশ্রুতি কারিগরি ও প্রকল্প সাহায্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরে ১৯৫১ ও ১৯৫৩ সালে কৃষির ফলন ভাল না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে গমের সাহায্য চালান পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৪-৫৫ সনে প্রথমবার প্রকল্প বহির্ভূত সাহায্য দেয় এবং ১৯৫৪ সালের কৃষি বাণিজ্য উন্নয়ন ও সাহায্য আইনের (পিএল- ৪৮০) আওতায় অতিরিক্ত কৃষিপণ্য সরবরাহ করে। সাহায্যের পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি ছিল কারিগরি সাহায্য, প্রকল্প সাহায্য, প্রকল্প বহির্ভূত সাহায্য, খাদ্যশস্য ও জরুরি সাহায্য, যথা বন্যার্তদের জন্য ত্রাণসামগ্রী। এগুলির প্রথম দুটি হলো পুরোপুরি বিনিয়োগ সাহায্য। তৃতীয়টি মধ্য-মাধ্যমিক সামগ্রী সাহায্য, যেমন লোহা ও ইস্পাতজাতীয় দ্রব্যের যোগান দিয়ে উন্নয়নের উদ্দেশ্যে সহায়তা প্রদান।
১৯৬১ সনের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানে বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্রের ও বহুবিধ আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিপ্রাপ্ত প্রকল্প, পণ্যসামগ্রী ও কারিগরি সাহায্যের এবং বিশেষ খাদ্য ও ত্রাণ সাহায্যের পরিমাণ ছিল ১.৩৮৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেশটি ঐ সময় পর্যন্ত ৪৫৭.৫৮ মিলিয়ন ডলার পেয়েছিল।
পাকিস্তানে প্রধান প্রধান সাহায্য ও ঋণদাতা দেশের মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি, জাপান, সুইডেন, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, রাশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া এবং এজেন্সিগুলির মধ্যে ছিল বিশ্ব ব্যাংক (আইএসসি ও আইডিএ), জাতিসংঘ ও এর বিশেষায়িত সংস্থাগুলি, ফোর্ড ফাউন্ডেশন এবং যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি-রপ্তানি সংস্থা। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের উন্নয়ন কর্মসূচিতে সাহায্য করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সঙ্ঘ (কনসোর্টিয়াম) গঠন করা হয় এবং এই সঙ্ঘের প্রথম সদস্য রাষ্ট্রগুলি ছিল কানাডা, জার্মানি, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান কলম্বো পরিকল্পনার সদস্য দেশগুলি থেকে তখন বেশকিছু ক্ষেত্রে শিল্প, চিকিৎসা, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, প্রকৌশল, শিল্প, বাণিজ্য, যোগাযোগ, যাতায়াত ব্যবস্থা, সমবায় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা সংস্থা, হাসপাতাল ইত্যাদির উপকরণ সামগ্রীতে প্রশিক্ষণ সুবিধা ও পরামর্শসেবা রূপে কারিগরি সাহায্যও পেয়েছিল। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৫ সন পর্যন্ত সময়কালে পাকিস্তানের প্রাপ্ত মোট সাহায্যের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল মাত্র ৩৪% শতাংশ।
বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য গুরুতর আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে দেশটির শিল্প উৎপাদন প্রায় বন্ধই ছিল; কৃষি উৎপাদনে দারুণ অবনতি হয়েছিল এবং স্বাভাবিক বাণিজ্যিক কর্মকান্ড প্রকৃতপক্ষে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য ও বিপুল বৈদেশিক সাহায্যের ধারাবাহিক প্রবাহ ব্যতীত একটি নতুন জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করা ও টিকে থাকা ছিল প্রায় অসম্ভব।
বাংলাদেশ খাদ্যসাহায্য ও দুর্যোগকালে ত্রাণ সাহায্যরূপে ব্যাপকভাবে বৈদেশিক সাহায্য পেতে শুরু করে। দেশের উন্নয়নের প্রয়োজন আরও বেশি অনুভূত হওয়ায় সাহায্য ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং পরিমাণের বৃদ্ধি অনুসারে সাহায্যও বিভিন্নমুখী হয়ে পড়ে। ১৯৯৯-এর ৩০ জুন পর্যন্ত দাতা দেশগুলি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ছিল ৪২.৫৪ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ১৪.০৮% ভাগ ছিল খাদ্যসাহায্য, ২৪.৪২% ভাগ ছিল পণ্যসাহায্য এবং ৬১.৫০% ভাগ ছিল প্রকল্প সাহায্য। ১৯৭২-এ ২৭০.৮ মিলিয়ন ডলার সাহায্যপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সনে সাহায্যের পরিমাণ বেড়ে যায় ৯০১.৩ মিলিয়ন ডলার, ১৯৮৫-তে ১.২৭ বিলিয়ন ডলার, ১৯৯০-তে ১.৮১ বিলিয়ন ডলার এবং ১৯৯৯-তে ১.৫ বিলিয়ন ডলার। ১৯৭২ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশকে দেওয়া বৈদেশিক সাহায্যের মোট পরিমাণ ছিল ৩৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার যার মধ্যে ৪৮.২% ভাগ ছিল দান এবং ৫১.৭৮% ভাগ ছিল ঋণ। চলতি বাজার মূল্যে দেশের জিডিপি-র শতকরা হারে বিদেশি সাহায্য ১৯৭৫-এ জিডিপি-র ৯.৩%, ১৯৮৮-তে ৭%, ১৯৯৩-তে ৬.৭৬%, ১৯৯৬-তে ৪.৫৩%, ১৯৯৮-এ ৩.৬৭% এবং ১৯৯৯-এ ৪.২২%। বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থাকলেও ১৯৭২-৯৯ সময়কালে বৈদেশিক সাহায্য ও জিডিপি-র অনুপাতে হ্রাস ঘটেছিল সমসময়ে জিডিপি-র প্রবৃদ্ধির কারণে। মাথাপিছু জিডিপি ১৯৭৭/৭৮ সময়ে ১০২.৯৮ ডলার থেকে ১৯৯৮/৯৯ বৎসরে ২৮৪.১১ ডলারে উন্নীত হয়। কিন্তু দেশের মাথাপিছু ঋণের দায় ১৯৭৬/৭৭ বছরে ৬.৫৯ ডলার থেকে ১৯৯৮/৯৯ বছরে ১১৫.৯ ডলারে বেড়ে যায়। মাথাপিছু ঋণের দায় বৃদ্ধির কারণ বৈদেশিক সাহায্যে অনুদানের অংশ সংকোচন। বাংলাদেশ ১৯৯৮-৯৯ সালে মোট বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে ১০৩৫.২ মিলিয়ন ডলার এবং ২০০৭-০৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৫০.৭ মিলিয়ন ডলারে। এটা বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যের ক্রমবর্ধমান প্রবাহের চিত্র তুলে ধরে। তবে, সাম্প্রতিককালে বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহে বেশ কিছু কাঠামোগত পরিবর্তনও সাধিত হয়েছে।
১৯৭৩-এ বাংলাদেশ খাদ্যসাহায্য পেয়েছিল ১৮২.৫৫ মিলিয়ন ডলারের। এটি দুই বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং এই প্রবৃদ্ধি ১৯৮০ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এই বছরেই খাদ্যসাহায্যের নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যায় এবং এই খাতে বাৎসরিক সাহায্য প্রবাহ ২০০ মিলিয়ন ডলারের বেশ নিচে নেমে যায়। কোন কোন বছর দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্য মজুতের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় খাদ্যসাহায্য প্রবাহ অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল। এই কারণে এবং আগের বছরগুলিতে বেশি পরিমাণ খাদ্যসাহায্য পাওয়াতে ১৯৭২-৯৯ সময়কালে বার্ষিক গড় খাদ্যসাহায্য ছিল ২১৬ মিলিয়ন ডলারের। ১৯৯০-তে খাদ্যসাহায্য ছিল ১৮৭.৪৮ মিলিয়ন ডলারের। ১৯৯৫ সালে ১৩৭ মিলিয়ন ডলার এবং ১৯৯৯ সালে ১৭৬.৯৪ মিলিয়ন ডলার। ১৯৭২ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ২৭ বছরে মোট খাদ্যসাহায্য ছিল বাংলাদেশের সকল ধরনের বৈদেশিক সাহায্যের পুঞ্জীভূত পরিমাণের ১৬.৮% ভাগ। ১৯৮১/৮২ বছর থেকে ১৯৯৯/২০০০ বছর পর্যন্ত ১৯ বছরের সময়কালের পরিসংখ্যান থেকে এই ধারণা পাওয়া যায় যে, গড়পড়তাভাবে, প্রতি বছরে ২.০৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছিল এবং এর ৫০% ভাগ খাদ্যসাহায্য হিসেবে এসেছিল। ১৯৯২-২০০০ সময়কালের পরিসংখ্যান এই ধারণাও দেয় যে, গড় বার্ষিক খাদ্য আমদানির চাহিদা ছিল অনেক বেশি, যার পরিমাণ ২.৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। একই সময়ে খাদ্য আমদানিতে সাহায্যের পরিমাণ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কমে যায় এবং প্রতিবছর গড়ে মাত্র ৭৮৫০০০ মেট্রিক টন খাদ্য আমদানি করতে হয় এবং নগদ অর্থে বাংলাদেশ গড়ে অতিরিক্ত ১.৬১ মিলিয়ন মেট্রিকটন খাদ্য আমদানি করে। বাংলাদেশে খাদ্যসাহায্যের প্রায় পুরোটাই (৯৯% ভাগেরও বেশি) ছিল গম এবং সকল প্রতিশ্রুত ও প্রাপ্ত খাদ্যসাহায্যের সবটাই ছিল অনুদান। খাদ্যসাহায্য প্রদানের দাতাসংস্থা ও দেশগুলির মধ্যে রয়েছে ইউএন সিস্টেম (প্রধানত, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি), যুক্তরাষ্ট্র, ইইসি/ইইউ, কানাডা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া।
পণ্য সাহায্য ব্যবহূত হয়েছে মূলত লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণে এবং স্থানীয় মুদ্রা সরবরাহের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় মেটাতে। বাংলাদেশে ১৯৭২-৯৯ সময়কালে মোট পণ্যসাহায্যের প্রতিশ্রুতি ছিল ১০.৩৯ বিলিয়ন ডলারের, পাওয়া গিয়েছিল ১০.০৯ বিলিয়ন এবং ঐ সময়ের মধ্যে পণ্যসাহায্য ছিল মোট সাহায্যের ২৯% ভাগ। পণ্যসাহায্য ১৯৯৪ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে, তারপর এর হ্রাস ঘটে। পণ্যসাহায্যের পরিমাণ ১৯৭৩-এ ছিল ২৮৮.৯ মিলিয়ন ডলার, ১৯৮০-তে ৩৭৮.৪৮ মিলিয়ন ডলার, ১৯৯০-তে ৪৫৬.৭১ মিলিয়ন ডলার, ১৯৯৫-এ ৩৩৩ মিলিয়ন ডলার এবং ১৯৯৯-তে ৩২৪ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে পণ্যসাহায্য অনুদান ও ঋণ হিসেবে প্রায় সমানভাবে এসেছে এবং ১৯৯০-এর দশকে পণ্যসাহায্যে ঋণের গড় বার্ষিক অংশ ছিল ৪৮% ভাগ। বাংলাদেশে পণ্যসাহায্যদাতা প্রধান দেশের মধ্যে রয়েছে জাপান, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহের বৃহদাংশ হলো প্রকল্প সাহায্য। ১৯৭২-১৯৯৯ সময়কালে বাংলাদেশে ২৬.১৭ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ছিল। এর মধ্যে ১৮.৮৪ বিলিয়ন ডলার পাওয়া যায়। ঐ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে পুঞ্জীভূত বৈদেশিক সাহায্যের (৩৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার) মধ্যে প্রকল্প সাহায্যের অংশ ছিল ৫৪.১৯% ভাগ। একই সময়ে কারিগরি সহযোগিতা ছিল মোট সাহায্যের প্রায় ৪% ভাগ। গড়ে বার্ষিক প্রকল্প সাহায্যের ৬৩% ভাগ ঋণ হিসেবে পাওয়া গিয়েছিল, বাকিটা অনুদান হিসেবে। এডিবি, আইডিএ, ইফাদ ও ওপেক হলো প্রধান বহুপাক্ষিক প্রকল্প সাহায্যদাতা সংস্থা এবং জাপান দ্বিপাক্ষিক দাতাগোষ্ঠীর একক নেতা। অন্য দাতা দেশগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফ্রান্স, সৌদি আরব ও চীন।
বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক সাহায্যের মধ্যে খাদ্য ও পণ্য সাহায্যের অংশ বিগত বছরগুলিতে হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু কারিগরি সহযোগিতাসহ প্রকল্প সাহায্য বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি ছিল মূলত চাহিদার বিষয়, যদিও এতে দাতা দেশগুলি কর্তৃক পরিচালিত প্রকল্পসমূহের কিছু ভূমিকা ছিল। ১৯৭২-৭৩ এর মোট এডিপি বণ্টনের তিন-চতুর্থাংশ ছিল বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট। আশির দশকের প্রথম দুই বছরে এডিপির অর্থ যোগানের ক্ষেত্রে বৈদেশিক তহবিলের অংশ প্রায় ৬৪% ভাগ নেমে যায়, কিন্তু পরবর্তী তিন বছরে প্রায় ৮০% ভাগ বেড়ে যায়। ১৯৯০-এর দিকে অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পগুলি চালু করতে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতা অনেকটা কমে যায়। ২০০০-২০০১ সনের উন্নয়ন বাজেট এডিপি-র মোট ব্যয়ের ৪৩% ভাগ বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে অর্থ পাওয়া সাপেক্ষে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রধান দুর্বলতা হলো যথাযথভাবে প্রকল্প সাহায্যের টাকা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এর ধারাবাহিক ব্যর্থতা। বহু বছর ধরে প্রকল্প সাহায্যের অর্থ প্রতিশ্রুতি ও ছাড়করণের অনুপাত ২০% ভাগেরও কম ছিল। এটি ঘটেছে প্রকল্পের প্রণয়ন, প্রস্ত্ততি ও অনুমোদন লাভে বিলম্ব, স্থানীয় অর্থ যোগানোর ক্ষেত্রে শ্লথগতি, দুর্বল অবকাঠামো, প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা এবং দাতা দেশগুলির শর্ত পূরণে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ইত্যাদি কারণে।
স্বাধীনতা পরবর্তী তিন দশকে বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যের কাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ১৯৭১-৭৩ বছরে অনুদানের অংশ ছিল ৮৯% ভাগ এবং তা ১৯৭৯-৮০ সনে কমে গিয়ে ৫৩.২% ভাগে দাঁড়ায়, ১৯৯৮-৯৯-তে হয় ৪৩.৬% ভাগ। সাহায্যের পরিমাণে ঋণের অংশ বেড়ে যাওয়াতে ঋণ + দায় বেড়ে যায়। দ্বিপাক্ষিক সাহায্য যা ১৯৭১-৭৬ সময়কালে মোট সাহায্যের ৭৩.৯% ভাগ ছিল, ১৯৮৮-৯৯ তা ৪২.৬% ভাগে কমে যায় এবং সে অনুসারে, বহুপাক্ষিক সাহায্য ২৬.১% থেকে ৫৭.৪% তে উন্নীত হয়। মোট বৈদেশিক সাহায্যের মধ্যে খাদ্য ও পণ্য সাহায্যের অংশ হ্রাসের প্রবণতা দেখা যায়। খাদ্যসাহায্য ১৯৭১-৭২ সালে মোট সাহায্যের ৪৭.৯% ভাগ থেকে ১৯৯৮-৯৯ সালে ১১.৫% তে নেমে যায়। ঐ সময়কালে পণ্যসাহায্য ৫০.৮% থেকে ২১.১৫%-তে নেমে যায়। এছাড়া, ১৯৭১-৭২ সনে যেখানে মোট সাহায্যে প্রকল্প সাহায্যের অংশ ছিল ১.৩৫ শতাংশ, ১৯৮৮-৮৯-তে তা ৬৭.৪% ভাগে উন্নীত হয়।
বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণকারীদের মধ্যে একটি বিশেষ গোষ্ঠী হলো এনজিও যারা দাতা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে বর্ধিত হারে বিরাট পরিমাণ অর্থসাহায্য লাভ করে থাকে। এনজিও-দের অর্থ তহবিলগুলি অনেকটাই একান্তভাবে অনুদান এবং সরকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো বা দপ্তরের মাধ্যমে এগুলির প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ব্যুরোর সূত্র অনুযায়ী, ১৯৯৯-এর ৩০ জুন পর্যন্ত এনজিও কর্তৃক গৃহীত বৈদেশিক অর্থের পরিমাণ ১৮০ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যদাতা প্রধান দেশগুলির অধিকাংশই এখন একটি কনসোর্টিয়ামের সদস্য। এইড কনসোর্টিয়াম যা দাতাগোষ্ঠী (এইড গ্রুপ) নামে পরিচিত সংস্থাটি বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন পর্যালোচনা করতে প্রতিবছর মিলিত হয়। এটি বাংলাদেশের প্রয়োজন বিচার-বিবেচনা করে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। এর সদস্যদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, সু্ইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, আইডিএ, এডিবি, ইইউ, ইফাদ, ইউএন সংস্থাসমূহ, ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও এশিয়া ফাউন্ডেশন। দাতাগোষ্ঠীর বাইরের যেসব দেশ বাংলাদেশে সাহায্য দিয়ে থাকে সেগুলির মধ্যে আছে চীন, ভারত, কুয়েত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক ও ওপেক।
সাহায্য পরিকল্পনা, অনুদান হোক বা ঋণে হোক, নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে; কিন্তু এটি দেশকে উত্তরোত্তর ঋণগ্রস্তও করছে। দেশের বেড়ে যাওয়া বাণিজ্য ঘাটতি ও সঞ্চয় বিনিয়োগের পার্থক্য, রাজস্বের শ্লথ অগ্রগতি এবং সরকারি চলতি ব্যয়ের দ্রুত বৃদ্ধি সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী। বাংলাদেশের ঋণ, বিশেষ করে মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, সাধারণ দ্বিপাক্ষিক ও বহপাক্ষিক উৎস থেকে গড়ে দশ বছরের রেয়াতি সুবিধা ও বিশ বছরের মধ্যে পরিশোধ্য শর্তে সংগৃহীত হয়ে থাকে। অধিকন্তু, অপরিশোধিত তেল, জাহাজ, বিমান ও খাদ্যশস্য কেনার জন্য বিলম্বে পরিশোধ্য শর্তে আইএমএফ ও আইডিবি এবং অন্যান্য দাতার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। বাংলাদেশে ঋণ প্রধানত সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণের অংশ অকিঞ্চিৎকর। মোট সরকারি ঋণ ১৯৭৩/৭৪ বছরের ৫০১.৪ মিলিয়ন ডলার থেকে ১৯৯৮/৯৯ বছরে ১৪.৮৪ বিলিয়ন ডলারে বেড়ে গেছে। মোট সরকারি খাতের ঋণের ওপরে ঋণসেবা পরিশোধ ১৯৭৩-৭৪ বৎসরের ১৯ মিলিয়ন ডলার থেকে ১৯৯৮-৯৯ বছরে ৭৭৩.১ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে এখন বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে ক্রমাগত প্রতিযোগিতামূলক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সাহায্যপ্রার্থী দেশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে দাতাগোষ্ঠীগুলি বাজেট করার সময় প্রায়শ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর এই অবস্থা দেখা দিয়েছে। অধিকন্তু, বাংলাদেশে দাতাদের সাহায্য-সহযোগিতা নির্ভর করে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ এবং বৈদেশিক সাহায্যের দক্ষ ব্যবহার করার শর্তের ওপর। এক্ষেত্রে দাতা দেশগুলির সঙ্গে সমন্বিত সম্পর্ক আর্থিক সাহায্য সহযোগিতার সচল ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখছে। বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যায় বিচিত্র উপায়ে, যেমন উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ঘন ঘন সংলাপমূলক সভার অনুষ্ঠান করে এবং নিয়মিত আন্তঃমন্ত্রণালয় আলাপ-আলোচনা করে। যেসব প্রকল্পে একাধিক উৎস থেকে অর্থসংস্থান হয়, সেগুলি সাধারণত অধিক জটিল এবং সেগুলি একক উৎসের অর্থায়নে গড়ে ওঠা প্রকল্পের চেয়ে আরও বেশি মনোযোগ দাবি করে। [এস.এম মাহফুজুর রহমান]