বঙ্গভঙ্গ রদ
'বঙ্গভঙ্গ রদ (Annulment of Bengal Partition) ‘স্বদেশী’ ও ‘বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী’ আন্দোলন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অব্যাহত বিরোধিতার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ-এর (১৯০৫-১১) বিষয়ে বাঙালি হিন্দুসম্প্রদায়ের চরম অসন্তোষ প্রতীয়মান হয়েছিল। ভাইসরয় ও গভর্নর-জেনারেল লর্ড চার্লস হার্ডিঞ্জ-এর নেতৃত্বাধীন ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার তাই শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে তা রদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ততোদিনে ব্রিটিশ প্রশাসকেরা বিশ^াস করতে শুরু করেছে যে ‘বিভক্তি ও শাসন’ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে তারা ভারতের হিন্দু ও মুসলমানদের যৌথ ও সমন্বিত রাজনৈতিক আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী প্রবণতাকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিল।
বঙ্গভঙ্গ রদ করার পূর্বে ব্রিটিশ প্রশাসকেরা মুসলমানদেরকে এই বলে আশ^স্ত করেছিল যে নবগঠিত বাংলা প্রদেশে তারাই হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাছাড়া মোর্লে-মিন্টো সংস্কার (দি ইন্ডিয়া কাউন্সিল্স অ্যাক্ট ১৯০৯)-এর মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য পৃথক ভোটের বিধান চালু করে আইনসভা ও স্থানীয় সরকার পরিষদে তাদের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থাও মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করেছিল। লর্ড হার্ডিঞ্জের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলা প্রদেশটি পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠি যেসব ভূখণ্ডে বসবাস করে সেগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হবে। এলাকাগুলো ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম রাজশাহী, প্রেসিডেন্সি ও বর্ধমান বিভাগ। আসাম অঞ্চল পূর্ববঙ্গ ও বিহার প্রদেশ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্বেকার (১৮৭৪-১৯০৫) চিফ কমিশনারেট-এর মর্যাদা ফিরে পাবে। অন্যদিকে, বেঙ্গল ডিভিশন অব দি প্রেসিডেন্সি অব ফোর্ট উইলিয়ম হতে বিহার, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুরকে পৃথক করে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হবে। অধিকন্তু, কলকাতা হবে বাংলা প্রদেশের রাজধানী, আর ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা হতে স্থানান্তরিত হয়ে দিল্লিতে যাবে।
লর্ড হার্ডিঞ্জ যখন তাঁর কাউন্সিলের সদস্যদেরকে এই পরিকল্পনার কথা জানালেন, তখন তারা এর প্রতি সমর্থন জানাল। এরপর লর্ড হার্ডিঞ্জ বিস্তারিত প্রস্তাবটি ১৯১১ সালের ১৯ জুলাই ভারতের জন্য নিয়োজিত ব্রিটিশ সেক্রেটারি অব স্টেট-এর নিকট প্রেরণ করলেন। সেক্রেটারি অতি দ্রুত ৭ আগস্ট তারিখে এর সঙ্গে একমত হয়ে টেলিগ্রাম পাঠালেন। যেহেতু বিষয়টি ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জের ভারত সফরের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, তাই রাজা দিল্লি সফরের সময় নিজেই ঘোষণাটি দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন। সেই পর্যন্ত ভাইসরয়কে বিষয়টি গোপন রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হলো। তারপর দিল্লিতে ১৯১১ সালের ১১ ডিসেম্বরে রাজার দরবার অনুষ্ঠিত হওয়ার পর রাজা পঞ্চম জর্জ ১২ ডিসেম্বর তারিখে বঙ্গভঙ্গ রদ ও ভারতের রাজধানী কলকাতা হতে দিল্লিতে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিলেন। নতুন ব্যবস্থাটি ১৯১২ সালের জানুয়ারি হতে কার্যকর হলো।
যদিও বাঙালি হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গ রদ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল, তারা ভারতের রাজধানী কলকাতা হতে সরিয়ে নেওয়ায় কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তবে সাধারণভাবে মুসলমানেরা বঙ্গভঙ্গ রদে নাখোশ ছিল। কংগ্রেস শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করায় মুসলমানদের মনে স্থির বিশ^াস জন্মেছিল যে এই দলের হাতে তাদের স্বার্থ নিরাপদ থাকবে না। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব হয় এবং তারা কংগ্রেসের পরিবর্তে মুসলিম লীগের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে দেখা শুরু করে। অতএব এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে বঙ্গভঙ্গ ও তার রদকে কেন্দ্র করেই ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। [হেলাল উদ্দিন আহমেদ]
'গ্রন্থপঞ্জি ঔড়যহ জ. গপখধহব, ‘চধৎঃরঃরড়হ ড়ভ ইবহমধষ ১৯০৫: অ চড়ষরঃরপধষ অহধষুংরং’. ঝরৎধলঁষ ওংষধস (বফ.), ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইধহমষধফবংয ১৭০৪১৯৭১, ঠড়ষ. ১ (চড়ষরঃরপধষ ঐরংঃড়ৎু), ঝবপড়হফ ঊফরঃরড়হ. উযধশধ: অংরধঃরপ ঝড়পরবঃু ড়ভ ইধহমষধফবংয, ১৯৯৭; মো. মাহবুবর রহমান। বাংলাদেশের ইতিহাস: ১৯০৫-৪৭। ঢাকা: তাম্রলিপি, ২০০৮; এ বি এম মাহমুদ, ‘বঙ্গভঙ্গ ও তৎকালীন রাজনীতি: হিন্দু-মুসলিম প্রতিক্রিয়া ও স্বদেশী আন্দোলন’। বাংলাদেশের ইতিহাস, ষষ্ঠ সংস্করণ। ঢাকা: নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৯৭।