স্থাপত্যশিল্প, গ্রামীণ
স্থাপত্যশিল্প, গ্রামীণ পরিকল্পনা, নির্মাণ উপকরণ এবং অবস্থানের দিক থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। নাগরিক স্থাপত্যের মতোই গ্রামীণ স্থাপত্যও সদা পরিবর্তনশীল, তবে বাংলাদেশের গ্রামীণ স্থাপত্য তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। বিশেষ করে অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্তও এই স্থাপত্যরীতি ছিল প্রায় অপরিবর্তনীয়। যুগ যুগ ধরে গ্রামীণ স্থাপত্যে স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপকরণ ব্যবহারের ঐতিহ্য অনুসৃত হয়ে আসছে। গঠন বৈচিত্র্য ও নির্মাণ উপকরণের ব্যবহারে গ্রামীণ স্থাপত্যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে কেবল উনিশ শতকের শেষদিক থেকে।
গ্রামবাংলার নিজস্ব স্থাপত্য নির্মাণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষিত, পেশাদার স্থপতিদের কোন ভূমিকা ছিল না। সাধারণত মিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি ও কামলাদের মতো স্থানীয় নির্মাণকর্মীরাই বাড়ির লোকদের ও প্রতিবেশীদের সহায়তায় এসব ইমারত নির্মাণ করতেন। অভিজ্ঞতা দিয়েই নির্মাণ-কৌশল শেখা হতো, আর মৌখিক আলোচনার ভিত্তিতে স্থির করা হতো পরিকল্পনা। পেশাদার স্থপতিদের কাজের ফসল না হলেও এসব ইমারতই দেশের বেশির ভাগ মানুষের আবাসনের চাহিদা পূরণ করে আসছিল। সে অর্থে পরিবেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে এসব ইমারত সহজলভ্য উপকরণের আলোকে ও পারিপার্শ্বিকতার চাহিদা অনুসারে গড়ে ওঠা এক মৌলিক স্থাপত্যরীতির প্রতিনিধিত্ব করে।
গ্রামবাংলার অভিবাসন ব্যবস্থায় একটি সামগ্রিক ক্রমবিন্যাস লক্ষ্য করা যায়। এর শুরু গ্রাম থেকে; সাধারণত একটি উঁচু এলাকায় এই গ্রামগুলি গড়ে ওঠে কয়েকটি পাড়া নিয়ে। প্রতিটি পাড়ায় আবার থাকে কয়েকটি ‘বাড়ি’, আর বাড়িগুলিতে থাকে কয়েকটি ঘর (বাসগৃহ) এবং এতদ্সংলগ্ন আনুষঙ্গিক কয়েকটি ঘর।
বসতি গ্রামাবংলার বেশিরভাগ বসতিকে বলা যায় ‘প্রাকৃতিক’, ‘পরিকল্পিত’ বসতির সঙ্গে এর মিল নেই; এগুলি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন পেশাদারী পরিকল্পনার ভূমিকা থাকে না। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এ রকম বেশির ভাগ বসতিই গড়ে উঠেছে প্রধানত সংশ্লিষ্ট এলাকার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সে সঙ্গে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্য উপকরণের সম্ভাব্যতার আলোকে এবং তার সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে। প্রধানত বদ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা এই দেশে ভূমির আকৃতি ও চরিত্র সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়, আর মানুষের হস্তক্ষেপ ও প্রাকৃতিক পরিবর্তনের যুগপৎ প্রভাবে বসতিগুলিও পরিবর্তিত হয়। স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশের চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে গড়ে ওঠা কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য যুগ যুগ ধরেই ব্যবহূত হয়ে আসছে।
গ্রামীণ বসতিকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা যায় - অবিন্যস্ত এবং রেখাকৃতিতে বিন্যস্ত। সাধারণত উঁচু জমিতে গড়ে ওঠা অবিন্যস্ত বসতি দেখা যায় পুরো দেশ জুড়েই। আর রেখাকৃতিতে বিন্যস্ত বসতি গড়ে ওঠে নদীতীর কিংবা কোন জলপথের ধারের প্রাকৃতিক বাঁধের ওপর দিয়ে। তবে এমনকি এই রেখাকৃতিতে বিন্যস্ত বসতিতেও প্রায়ই বিক্ষিপ্তভাবে বাড়িঘর নির্মিত হতে দেখা যায়। এটা নির্ভর করে আশেপাশের ভূমির উচ্চতার ওপর।
যেখানে উঁচু জমি পাওয়া যায় না, সেখানে পুকুর খুঁড়ে মাটি তুলে ছোটখাটো একটি ভিটা গড়ে তার ওপর বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়। কালক্রমে এই বসতি সম্প্রসারিত হলে আরও মাটি জমা করে এই ভিটার আয়তনও বাড়ানো হয়। অনেক জায়গায়ই নিচু জমির ওপর এ রকম ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়, বর্ষাকালে যেগুলিকে মনে হয় একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার ফলে বসতিগুলির মধ্যে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব হয়, কারণ সাধারণত একটি নির্দিষ্ট বাস্ত্তভিটায় আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ নির্দিষ্ট একটি গোত্রের লোকজনই বাড়িঘর তৈরি করে।
তবে এই সাধারণ পরিকল্পনার ব্যতিক্রমও আছে অনেক। উদাহরণস্বরূপ পাহাড়ি এলাকায় এবং কখনো কখনো নিচু হাওর অঞ্চলেও দেখা যায় লম্বা খুঁটির ওপর উঁচু করে বাড়িঘর নির্মিত হয়। চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় আর সিলেটের হাওর অঞ্চলে দেখা যায় বসতিগুলি কেন্দ্রীভূত, যা অন্যান্য বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলেই দেখা যায় না। পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষয়িষ্ণু বদ্বীপ কিংবা উত্তরের বরেন্দ্র এলাকাসহ কোথাও কোথাও কেন্দ্রীভূত বসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়, তবে এখানে কেন্দ্রীভবনের মাত্রা সামান্য, অর্থাৎ অর্ধ কেন্দ্রীভূত। এখানে বসতিগুলি বিচ্ছিন্নই, তবে দেখা যায় একই সঙ্গে অনেকগুলি বাড়িঘর মিলে বেশ বড় একটি বাস্ত্তভিটা গড়ে ওঠে। তুলনামূলক শুষ্ক এলাকায় বসতিগুলি অপেক্ষাকৃত ঘন হয়, বাড়িঘরগুলি নির্মিত হয় বেশি কাছাকাছি।
বাস্ত্তভিটা এবং বাড়ি' কৃষিপ্রধান গ্রাম অঞ্চলে সাধারণত বসতির একক বলতে বোঝায় বাস্ত্তভিটাকে, একটি বর্ধিষ্ণু পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা করতে যেখানে একসঙ্গে অনেকগুলি ঘর থাকে। বাস্ত্তভিটাগুলিতে সাধারণত একটি আয়তাকার ও উন্মুক্ত অঙ্গনকে কেন্দ্র করে চারদিকে ঘর নির্মিত হয়। অন্তর্মুখী এই অঙ্গনের ব্যবস্থাপনায় প্রতিফলিত হয়েছে মুসলিমপ্রধান স্থানীয় সমাজের ‘পর্দাপ্রথা’ অর্থাৎ নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় গোপনীয়তা রক্ষার ব্যবস্থা। এই অঙ্গনকে কেন্দ্র করে বিন্যস্ত ঘরগুলি অঙ্গনের দিকেই উন্মুক্ত, এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাতায়াতের ব্যবস্থাও সাধারণত এই অঙ্গনের মধ্য দিয়েই থাকে। আর এর বাইরের দিকটা থাকে বদ্ধ। বড় বাস্ত্তভিটায় সাধারণত বাস্ত্তভিটার বাইরে অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা ও আলোচনার জন্য আলাদা একটি বৈঠকখানা থাকে। হিন্দু ও উপজাতীয় পরিবারের মধ্যে এ ধরনের লিঙ্গভিত্তিক স্থান বণ্টন অতটা প্রচলিত নয়, তবে তাদের গৃহ-পরিকল্পনাও মুসলিম পরিবারের গৃহ-পরিকল্পনা থেকে খুব একটা আলাদা নয়। অঙ্গনের অবস্থানকে বলা যায় একটি আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, এর ব্যবহারও বহুমুখী। যেমন হিন্দু পরিবারের বাস্ত্তভিটায় এই অঙ্গনে ধর্মীয় আচারের প্রতীক হিসেবে তুলসি গাছ কিংবা কোন গৃহদেবতার মূর্তি সম্বলিত বেদী নির্মিত হয়। এখানে এই অঙ্গনকে প্রতিদিন সকালে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা হয় এবং কয়েকদিন পরপর নিয়মিত কাদামাটি ও গোবরের এক ধরনের মিশ্রণ দিয়ে লেপে দেওয়া হয়। অঙ্গন রক্ষণাবেক্ষণের এই হিন্দু ব্যবস্থাপনা অনেক মুসলিম পরিবারেও অনুসৃত হয়।
শুরুতে একটি বাস্ত্তভিটায় নির্মিত হয় মূল একটি শয়নকক্ষ, রান্নাঘর, শস্য রাখার জন্য গোলাঘর এবং গরু-ছাগলের জন্য গোয়ালঘর। শোয়ার ঘরে গৃহকর্তার শয়নের ব্যবস্থা থাকে, তাই এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বলে সাধারণত তা নির্মিত হয় স্থায়ীভাবে। আর সহযোগী অন্যান্য ঘরগুলি নির্মাণে অস্থায়ী উপকরণ ব্যবহূত হয়। পরিবার যত বড় হয়, এগুলি ততই বাইরের দিকে সরিয়ে নেওয়া হয়, আর তৈরি করা হয় নতুন নতুন শোয়ার ঘর। এভাবে একটি গ্রামীণ বাড়ি গড়ে ওঠে ক্রমান্বয়ে নির্মিত অনেকগুলি ঘর নিয়ে। এর আরও উপাদান থাকে, যেমন- অনেক বড় বাড়িতেই পিছনের দিকে একটি পুকুর থাকে। এই বাড়িগুলির চারদিকে গাছপালা রোপণ করা হয়। ছায়া দানের সঙ্গে এগুলি ফল এবং কাঠের চাহিদাও পূরণ করে।
বাস্ত্তভিটার ঘরগুলি সাধারণত আয়তাকার এবং একতলা বিশিষ্ট হয়। কখনো কখনো অবশ্য দ্বিতল ঘর দেখা যায়। শোয়ার ঘরগুলিতে সাধারণত একটি কক্ষ থাকে, তবে এতে তিনটি পর্যন্ত কক্ষ নির্মিত হতে পারে। কৃষক সমাজে আবাসনের পাশাপাশি শস্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর কৃষকরা যেহেতু বেশিরভাগ সময় মাঠেই কাটান, তাই বাড়িগুলি মূলত বর্ষাকালে বৃষ্টির সময়ের আশ্রয় হিসেবে আর ঘুমানোর জায়গা হিসেবেই ব্যবহূত হয়। প্রথমে নির্মিত শোয়ার ঘরটি সাধারণত বাতাসের গতির সুবিধা নিতে নির্মিত হয় দক্ষিণমুখী করে। তবে আয়তাকার অঙ্গনকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে নির্মিত অন্য ঘরগুলির বিন্যাসে কোন নির্দিষ্ট রীতি অনুসরণ করা হয় না, সুবিধামতো এগুলি তৈরি করা হয়।
ঘরগুলি সাধারণ নির্মিত হয় কাদামাটির তৈরি একটি উঁচু ভিতের ওপর। আর মেঝেটা সাধারণত কাঁচাই রেখে দেওয়া হয়। মাটির তৈরি এই উঁচু মেঝের ব্যবহার সারা বাংলাদেশেই দেখা যায় এবং এটি বাংলাদেশের স্থানীয় স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। মেঝের উচ্চতা বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। উঁচু এলাকায় ১৫ সেন্টিমিটার থেকে শুরু করে নিচু এলাকায় এটি ১২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। পার্বত্য ও জলাবদ্ধ এলাকায় মাটির তৈরি উঁচু ভিতের পরিবর্তে ঘর নির্মিত হয় বাঁশ কিংবা কাঠের লম্বা খুঁটির ওপর। এই উপকরণগুলি বেশির ভাগ বাড়ি নির্মাণে স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহূত হয়। গ্রাম্য বাড়ির দেওয়াল সাধারণত দুধরনের হয়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা নির্মিত হয় বিভিন্ন জৈবিক পদার্থ দিয়ে, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রেখে খুব কম পুরু করে। তবে কোন কোন এলাকায় তা নির্মিত হয় মাটি দিয়ে। আলোক প্রতিরোধ আর বৃষ্টির পানি ঘরে ঢোকা ঠেকাতে ঘরের দরজার সংখ্যা রাখা হয় কম এবং এগুলি সাধারণত নির্মিত হয় নিচু করে। গ্রামীণ বাড়ি নির্মাণের সবচেয়ে জটিল এবং ব্যয়বহুল দিক হচ্ছে এর আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করা। কৌণিক আচ্ছাদনের ব্যবস্থাই বেশি দেখা যায়, এর মধ্যে রয়েছে দোচালা ও চৌচালা ছাদ। একচালা ছাদ সাধারণত কম দেখা যায়, এবং এগুলি সাধারণ ব্যবহূত হয় শুধু সহযোগী ঘরগুলিতে। আচ্ছাদনের প্রকৃতি বিভিন্ন রকম হয়, তবে দক্ষিণাঞ্চলের পললভূমিতে ব্যবহূত বাঁশের দন্ডের সাহায্যে নির্মিত খড়ের চালাই সবচেয়ে পরিচিত।
তাপমাত্রার সহনীয়তাও আবাসন নির্মাণে দারুণ গুরুত্ব পায়। এর প্রলিফলন দেখা যায় আলোক ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক রং, হাল্কা নির্মাণ উপকরণ আর প্রচুর ছায়াযুক্ত এলাকায় বাড়ি নির্মাণের রীতিতে। প্রাকৃতিক উপকরণের বুনন ছাড়া দেওয়ালে অলঙ্করণও খুব একটা ব্যবহূত হয় না। আবাসন নির্মাণে গাছপালা, পানি আর ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যও বিশেষ গুরুত্ব পায় এবং সেসঙ্গে গুরুত্ব পায় জলবায়ু এবং মৌসুমও। ঘরগুলির প্রতিসাম্য ও এর আকৃতিতে প্রতিফলিত হয় প্রকৃতি আর স্বর্গীয় আবেশ।
নির্মাণ উপকরণ লৌকিক স্থাপত্যের একটি মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য নির্মাণ উপকরণের ব্যবহার। স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় এমন উপকরণের ভিত্তিতেই লৌকিক স্থাপত্যের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। অবশ্য সাম্প্রতিককালে মুদ্রা অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে এখন ইট এবং টিনের মতো আমদানিকৃত এবং কল-কারখানায় নির্মিত উপকরণ সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এ কারণে গৃহপরিকল্পনা কিংবা ঘরের অবয়বে খুব একটা পরিবর্তন না হলেও ইদানিং গ্রামীণ স্থাপত্যে দেওয়াল ও ছাদের বাহ্যিক চেহারায় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এখন সারা বাংলাদেশেই যেসব ঘর-বাড়ি নির্মিত হচ্ছে সেগুলি যদিও ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ বাড়ির মতোই পরিকল্পনা ও আকৃতি বিশিষ্ট, কিন্তু এগুলি নির্মাণে উপকরণ হিসেবে প্রাকৃতিক উপকরণের পাশাপাশি উৎপাদিত সামগ্রীও ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে।
দেশীয় নির্মাণ উপকরণের ব্যবহার বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত, বিশেষকরে আচ্ছাদনের ক্ষেত্রে স্থানভেদে উপকরণের সহজলভ্যতার ভিত্তিতে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। ইদানিং অবশ্য টিন, কংক্রিট পিলার এবং ইটের মতো ঐতিহ্যবাহী নয় এমন উপকরণের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে, আর এগুলি দখল করে নিচ্ছে প্রাকৃতিক উপকরণের স্থান। বাংলাদেশের বেশির ভাগ প্রাকৃতিক উপাদানও ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে, তবে তারপরও প্রাকৃতিক উপকরণের ব্যবহার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো বহুলভাবে প্রচলিত, যেমন: বাঁশ এখনো বাংলাদেশে বাড়িঘর নির্মাণে সর্বাধিক ব্যবহূত প্রাকৃতিক উপকরণ। পাহাড়ি এলাকা কিংবা সমতলভূমিতে সর্বত্রই এখনো ঘর নির্মাণের প্রাথমিক উপকরণ হিসেবে বাঁশই ব্যবহূত হয়।
তবে এই প্রাকৃতিক সম্পদটি ক্রমশই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে, ফলে আগের মতো নির্মাণ উপকরণ হিসেবে এর ব্যবহারও কঠিন হয়ে উঠছে। সাধারণত দুধরনের বাঁশ পাওয়া যায় - মোটা এবং সরু। মোটা বাঁশ সাধারণত খুঁটি হিসেবে এবং ছাদের কাঠামো নির্মাণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহূত হয়। সরু বাঁশ কেটে ছড়ি বানিয়ে সেগুলি হাতে বুনে শক্ত চাটাই অথবা বেড়া তৈরি করা হয়। এগুলি দেওয়াল, পার্টিশন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আচ্ছাদন হিসেবেও ব্যবহূত হয়। ছিদ্রযুক্ত, পর্দার মতো এই দেওয়াল ঘরে বাতাস চলাচল এবং তাপসহনশীলতার ব্যবস্থাও করে থাকে। বাঁশ ছাড়াও পাটকাঠি, নলখাগড়া, কাঠ এবং খেজুরপাতার মতো প্রাকৃতিক উপকরণসমূহও ব্যবহূত হয়।
নদী-তীরবর্তী এলাকায় ঘর নির্মাণে মাটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না, কারণ এসব এলাকার পলিমাটি ও কাদামাটি নির্মাণ উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। সে কারণে এ অঞ্চলে নির্মাণ উপকরণ হিসেবে জৈব পদার্থের ব্যবহারই প্রাধান্য পায়। তবে বাংলাদেশের আর্দ্র আবহাওয়া, প্রতি বছরের বন্যা এবং ব্যাপক বৃষ্টিপাত সত্ত্বেও তুলনামূলকভাবে উঁচু এলাকায় মাটির ঘর দেখা যায়। এসব ঘরে মাটি ব্যবহূত হয় দেওয়াল নির্মাণে। বিস্ময়করভাবে কোথাও কোথাও মাটির তৈরি দ্বিতল ঘরও দেখা যায়। এসব মাটির ঘরের বেশির ভাগই নির্মিত হয় স্তরে স্তরে মাটি সাজিয়ে, আর কাদামাটির প্রলেপ ব্যবহার করে। কোন কোন এলাকায় দেওয়াল তৈরিতে বড় বড় মাটির চাঁই ব্যবহূত হয়। বাঁশ বা কাঠের কাঠামোর ওপর মাটির প্রলেপ দেওয়ার পদ্ধতিও কোথাও কোথাও অনুসৃত হয়। বিশেষ করে নদীতীরবর্তী এলাকায় এ রীতির ব্যবহার দেখা যায়। এসব এলাকায় সাধারণত বাঁশের বেড়ার নিচের দিকে বন্যা প্রতিরোধের জন্য মাটির প্রলেপ ব্যবহূত হয়, আর বাতাস চলাচলের সুবিধার্থে ওপরের অংশ উন্মুক্তই রাখা হয়। বাঁশ ও কাদামাটির এই যুগপৎ ব্যবহার বাংলার স্থানীয় নির্শাণরীতির বৈশিষ্ট্য। পলিমাটির প্রাচুর্যের কারণে এদেশে প্রচুর উঁচু মানের পোড়ানো ইঁট নির্মিত হয় এবং শহুরে স্থাপত্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়।
আচ্ছাদনের উপকরণ ছাদ নির্মাণে বিভিন্ন রকম উপকরণ ব্যবহূত হয়। সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হয় বুনো ঘাস বা ছন, খড় আর খেজুর পাতা। প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন অাঁশযুক্ত উপকরণ আর কৃষিজাত পণ্যের ব্যবহারের পার্থক্য বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ। অতীতে বিভিন্ন ধরনের লম্বা বুনো ঘাস ও নলখাগড়া প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। বাংলার জলাভূমি এলাকায় ও নদীতীরে এগুলি জন্মানোর সুযোগ পেত। কিন্তু মানুষের ক্রমবর্ধমান বসতি এবং কৃষিজমির বিস্তারের ফলে প্রাকৃতিক এসব উপকরণের উৎপাদনের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে। ফলে ছন বা নলখাগড়ার মতো উপকরণের সরবরাহও কমে আসছে, আর সে কারণে বিকল্প হিসেবে আচ্ছাদনে ব্যবহূত হচ্ছে খড়। এটি এক ধরনের কৃষিজাত পণ্য, উৎপাদিত হয় ধানচাষের মাধ্যমে।
তুলনায় খড় স্বল্পস্থায়ী, কিন্তু প্রাকৃতিক উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে এখন এর ব্যবহার হচ্ছে। খড় প্রধানত ব্যবহৃত হয় গোখাদ্য এবং জ্বালানি হিসেবে, যেসব এলাকায় এ ধরনের কাজে এর চাহিদা বেশি সেখানে অনেক সময় অন্যান্য স্থায়ী কিন্তু দুষ্প্রাপ্য উপকরণের চেয়েও এর দাম বেশি পড়ে। কোথাও কোথাও কাদামাটির টালিও আচ্ছাদনে ব্যবহৃত হয়, তবে এটি কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভারত-সীমান্তবর্তী এলাকাতেই সীমিত। পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে এ ধরনের আচ্ছাদন ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ইদানিং আচ্ছাদনে এবং এমনকি দেওয়াল নির্মাণেও টিনের ব্যবহার বাড়ছে, খড়ের তুলনায় এর দীর্ঘস্থায়িত্বের কারণে। গ্রামের লোকদের কাছে এটা আভিজাত্যের প্রতীক, বেশির ভাগ গ্রামবাসীই এর স্বপ্ন দেখে।
টিন ও অন্যান্য শিল্পজাত দ্রব্যের ব্যবহার একবারে নতুন নয়, তবে গত কয়েক দশকে এর ব্যবহার ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে প্রাকৃতিক নির্মাণ উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এই পরিবর্তন গ্রামবাংলার লৌকিক স্থাপত্যের চেহারা বদলে দিচ্ছে। এখন হয়তো লৌকিক স্থাপত্যের আদি রূপ খুঁজে পাওয়াই সম্ভব হবে না। তবে তারপরও বিশেষ করে বাড়ির নকশায়, রূপে এবং এর অভ্যন্তরীণ বিন্যাসে এখনও ঐতিহ্যবাহী রীতিই টিকে আছে। [কে. ইফতেখার আহমেদ]