মধুপুর গড়
মধুপুর গড় (Madhupur Tract) বাংলাদেশের কেন্দ্রভাগে অবস্থিত একটি বৃহৎ উত্থিত এলাকা। এই গড়ের দক্ষিণাংশ ভাওয়াল গড় এবং উত্তরাংশ মধুপুর গড় নামে পরিচিত। ভূতাত্ত্বিকভাবে এই অঞ্চলটি একটি সোপান এলাকা, যা সংলগ্ন প্লাবনভূমির তুলনায় এক থেকে দশ মিটার উঁচু। এই গড়ের উৎপত্তি সম্ভবত মায়োসিন সময়কালের, যখন বঙ্গীয় অববাহিকা দ্রুত ভরাট হচ্ছিল যদিও এটি প্লাইসটোসিন সময়কালে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। মধুপুর গড়ের মোট বিস্তার ৪,২৪৪ বর্গ কিমি। বরেন্দ্রভূমির মতো মধুপুর গড় কর্তিত নয়, বরং সাতটি ক্ষুদ্র বহিঃস্তূপসহ (outliers) এটি একটি বৃহদায়তনের একক ভূপ্রকৃতি। প্রধান ভাগটি উত্তরে জামালপুরের দক্ষিণ ভাগ থেকে শুরু করে দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত। ঢাকা মহানগরীর অধিকাংশই এই গড়ে অবস্থিত। সাতটি বহিঃস্তূপের মধ্যে চারটি পূর্বদিকে এবং তিনটি উত্তরে অবস্থিত। সবগুলো বহিঃস্তূপই চ্যুতি দ্বারা পৃথক। বাংলাদেশের এই অংশ একাধিকবার উত্থিত হওয়ার ফলে অসংখ্য অনুদৈর্ঘ্য চ্যুতি সৃষ্টি হয়েছে। এসকল চ্যুতির মধ্যে পশ্চিম পার্শ্ব বরাবর বিদ্যমান চ্যুতিসমূহ সর্বাধিক প্রকট। ঢাকা মহানগরীর মিরপুরে, টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের কাছে এবং আরও উত্তরে মধুপুরে এসকল চ্যুতি সুস্পষ্টরূপে লক্ষ্য করা যায়। পূর্ব পার্শ্বেও দীর্ঘ চ্যুতি বিদ্যমান। উত্তর থেকে দক্ষিণে মধুপুর গড়ের জলবায়ুতে সামান্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। শীতকালে উত্তরাংশে অধিকতর ঠান্ডা বিরাজমান থাকে। গড় তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে ২৮°সে থেকে ৩২°সে-এর মধ্যে এবং শীতকালে তা ২০°সে-এ নেমে আসে। শীতকালে তাপমাত্রা কখনও কখনও ১০°সে-এও নেমে যায়। বার্ষিক বৃষ্টিপাত পরিসর ১,০০০ মিমি থেকে ১,৫০০ মিমি পর্যন্ত। সচরাচর তীব্র ঝড়ঝঞ্ঝা সংঘটিত হয় না, তবে দক্ষিণাংশে টর্ণেডো সংঘটিত হতে দেখা যায়।
মৃত্তিকা ব্যাপকভাবে মধুপুর কর্দমের উপর গঠিত হয়েছে যা কম উর্বর এবং কিছুটা অম্ল প্রকৃতির। মৃত্তিকা লোহিত অথবা বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। অধিকাংশ স্থানে প্লাবনভূমি থেকে গড়ের পরিবর্তন সুস্পষ্ট, তবে কিছু কিছু স্থানে প্লাবনভূমি মৃত্তিকা গড়ের সুষম ঢালু অংশকে আবৃত করে রেখেছে। সংকীর্ণ অথবা প্রশস্ত উপত্যকা দ্বারা মধুপুর গড় স্থানে স্থানে কর্তিত এবং সমতল ভূপ্রকৃতিতে এই কর্তন গভীর হয়ে থাকে। নিষ্কাশন প্যাটার্ন সুস্পষ্টরূপে বৃক্ষসদৃশ। সমতল শীর্ষদেশবিশিষ্ট উঁচু স্থানসমূহকে স্থানীয়ভাবে চালা এবং উপত্যকা ভূমিসমূহকে বাইদ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে উপত্যকাসমূহে সেচের সাহায্যে বোরো ধান চাষ করা হয়। এসময় চালা জমিগুলো শুকিয়ে যায়, তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সেখানে ইক্ষু চাষ করা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ চালাতেই কাঁঠাল বাগান রয়েছে যেখান থেকে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত সারা দেশে প্রচুর পরিমাণে কাঁঠাল সরবরাহ করা হয়। দক্ষিণের কিছু কিছু এলাকায় যেমন, কালিয়াকৈর ও সাভারে আম, জলপাই, কামরাঙা, আনারস প্রভৃতি ফল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পূর্বেও মধুপুর গড় ব্যাপকভাবে বনাবৃত ছিল। বনের প্রধান বৃক্ষ ছিল শাল (Shorea robusta), যার ফলে এই বনের নামকরণ হয় শালবন। অবৈধভাবে ব্যপকহারে শাল গাছ কাটার ফলে বর্তমানে মাত্র প্রায় ৬০০ বর্গ কিমি এলাকাজুড়ে বনভূমি অবশিষ্ট রয়েছে। তবে নতুন করে বনায়ন করা হচ্ছে। অনেক স্থানে কতিপয় বিদেশী প্রজাতি যেমন, আকাশি (Acacia auriculiformis) এবং ইউক্যালিপটাস (Eucalyptus camaldulensis) গাছ লাগানোর ফলে বাস্ত্তসংস্থানের অনেক নেতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে পাখির প্রজাতি ও সংখ্যা হ্রাস। তদুপরি এর ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের জ্বালানির প্রাপ্যতাও হ্রাস পেয়েছে। এসকল প্রতিক্রিয়াসহ আরও অনেক ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ায় বন বিভাগ মধুপুর গড়ের বনায়নে উদ্ভিদ প্রজাতির কম্পোজিশন নতুনভাবে বিবেচনা করছে। মূল বনভূমির অবশিষ্টাংশের দুটি এলাকায় দুটি জাতীয় উদ্যান গড়ে তোলা হয়েছে: একটি উত্তরে মধুপুর জাতীয় উদ্যান এবং অন্যটি দক্ষিণে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান। আশা করা হয়েছিল এই দুটি জাতীয় উদ্যানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বাস্ত্তসংস্থান সংরক্ষিত হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, অবৈধভাবে বৃক্ষ নিধন এবং বন্যপ্রাণী শিকারের ফলে এই উদ্যান দুটিও মারাত্মক হুমকিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। দুই শতক পূর্বে, মধুপুর গড়ের বনভূমিতে হাতি ও গন্ডারের উপস্থিতি ছিল, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এই প্রাণীদুটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। বাঘ ও চিতাবাঘের সংখ্যাও ছিল উল্লেখযোগ্য, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বাঘের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পায় এবং পঞ্চাশ বছর পূর্বে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। চিতাবাঘ বর্তমানে বিলুপ্তির মুখোমুখি। বিভিন্ন প্রজাতির বনবিড়াল, গন্ধগোকুল (civet) প্রভৃতি প্রাণী এখনও মধুপুর বনে পাওয়া পাওয়া যায়। একসময় এই বনে প্রচুর সংখ্যক ময়ূর দেখা যেত, কিন্তু ত্রিশ বছর পূর্বে ময়ূর বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে প্রাণিবিদদের ধারণা।
কোচ এবং মান্ডা (গারো) নামক দুটি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বাস এই মধুপুর গড়ে, যারা মধুপুরের শালবনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কোচ উপজাতী বাংলাদেশের প্রাচীনতম জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। অপরদিকে মান্ডা বা গারো জনগোষ্ঠীর প্রধান কেন্দ্র ভারতের গারো পাহাড়ে অবস্থিত। সুবিস্তৃত শালবনের প্রান্তীয় এলাকায় বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে বন পরিষ্কার করে ব্যাপক সংখ্যায় বনের অভ্যন্তরে বসতি গড়ে তুলছে। বিগত ত্রিশ বছরে মধুপুর শালবনের ভূদৃশ্য এবং বাস্ত্তসংস্থানে মারাত্মক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সাভার থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত বিস্তৃত মধুপুর গড়ের পশ্চিমাংশে বাঙালি জনগোষ্ঠী এক প্রকার স্থিতিশীল কৃষি উদ্যানতাত্ত্বিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এসকল এলাকা এখনও অতি উৎপাদনশীল, বিশেষ করে প্রচুর পরিমাণে ফল এখানে উৎপন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু এই এলাকাও মহানগরী ঢাকার সম্প্রসারণের ফলে হুমকির সম্মুখীন। এভাবে মধুপুর গড়ে নগরায়ণ একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে মধুপুর গড়ের প্রধান চিত্র হচ্ছে ঢাকা মহানগরীর সম্প্রসারণ। বন্যামুক্ত উঁচুভূমি হওয়ার কারণে মধুপুর গড় এখন বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আকৃষ্ট করছে। এদের মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছে মণিপুর কৃষি খামার বা ফার্ম, যা এখন ঢাকা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষণ খামারসমূহকে আরও উত্তরে গাজীপুরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে যেখানে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। এছাড়াও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সাইট্রাস গবেষণা ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি গাজীপুরে স্থাপিত হয়েছে। আরও উত্তরে রয়েছে বাংলাদেশ তুলা গবেষণা ইনস্টিটিউট, যেখানে বিস্তীর্ণ এলাকায় বীজ তুলা উৎপাদিত হয়ে থাকে। মধুপুর গড়ের বন্যামুক্ত বৈশিষ্ট্য এই এলাকায় বিভিন্ন শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুই পার্শ্বে প্রচুর সংখ্যক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। তদুপরি, সরকার মধুপুর গড়ের সাভার উপজেলার আশুলিয়ায় রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকা গড়ে তুলেছে, যা প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। আরও পশ্চিমে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও তাদের সুবিস্তৃত ক্যাম্পাস। এর সন্নিকটে রয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীপ্রণালীর ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, বংশী, বানার এবং শীতলক্ষ্যা নদী দ্বারা মধুপুর গড় নিষ্কাশিত হয়ে থাকে। সবগুলি নদীই দক্ষিণপূর্বমুখী প্রবাহিত হয়ে সুবৃহৎ মেঘনা নদীতে পতিত হয়েছে। [হারুন-অর-রশীদ এবং হোসেন মনসুর]
আরও দেখুন ভূপ্রকৃতি।