স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র। বস্ত্তত, চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে এর প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়। এই কেন্দ্র থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল।
১৯৭১-এর ৩০ মার্চ পাকিস্তান বিমান বাহিনী কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র লক্ষ্য করে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। ফলে এটি অচল হয়ে যায়। কেন্দ্রটি ৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাগাফায় একটি শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটারের সাহায্যে এর দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু করে। পরবর্তীকালে দশজনের একটি সম্প্রচার দল নিয়ে এই বেতার কেন্দ্র শালবাগান ও বাগাফা হয়ে বেলুনিয়া ফরেস্ট হিলস রোডে স্থানান্তরিত হয়। নতুন পর্যায়ে বেতার কেন্দ্রটির সংগঠনে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন রেডিও পাকিস্তানের স্ক্রিপ্ট লেখক ও গায়ক বেলাল মোহাম্মদ। তাঁর অন্য সহযোগীরা ছিলেন আবদুল্লাহ-আল-ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, কাজী হাবিবউদ্দিন আহমেদ মনি, আমিনুর রহমান, রশিদুল হোসাইন, এ.এম শরফুজ্জামান, রেজাউল করিম চৌধুরী, সৈয়দ আবদুস শাকের, মুস্তফা মনোয়ার প্রমুখ। কালুরঘাট থেকে নেওয়া ট্রান্সমিটারটির কোন যান্ত্রিক গাইড বই ছিল না। দলের একমাত্র ইঞ্জিনিয়ার সদস্য আবদুস শাকের এটিকে কার্যক্ষম করে তোলেন। এই পর্বের দৈনন্দিন কর্মসূচির মধ্যে ছিল সকাল ৮.৩০ মিনিট থেকে ৯টা পর্যন্ত এবং বিকাল ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা।
মে মাসের ২৫ তারিখ কেন্দ্রটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয় এবং একই দিনে সেখানে এটি তার কার্যক্রম শুরু করে। ঢাকা থেকে আসা রেডিও-র পুরাতন স্টাফ ও নবাগতদের সমন্বয়ে ২৬ মে থেকে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র রূপে এর ৩য় পর্বের কার্যক্রম শুরু করে। আগস্ট মাসে কেন্দ্রটি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগপত্র ইস্যু শুরু করে, তবে কর্মরতদের নিয়োগ মূলত ১৯৭১ সালের জুন মাস থেকে কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতারের অত্যন্ত জনপ্রিয় দুটি অনুষ্ঠান ছিল ‘চরমপত্র‘ ও ‘জল্লাদের দরবার’। জল্লাদের দরবার-এ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অমানবিক চরিত্র ও পাশবিক আচরণকে তুলে ধরা হতো। এই ব্যঙ্গাত্মক সিরিজে তাকে ‘কেল্লা ফতেহ খান’ চরিত্রে চিত্রিত করা হয় এবং এই ভূমিকায় অভিনয় করেন রাজু আহমেদ। চরমপত্র সিরিজটি পরিকল্পনা করেন জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নান এবং স্থানীয় ঢাকাইয়া উপভাষায় এর স্ক্রিপ্ট তৈরি করেন এম.আর আখতার মুকুল, যিনি নিজেই এর উপস্থাপক ছিলেন। এই ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানটি জনগণের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়। এতে একইসঙ্গে ছিল তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ ও জাতীয়তা বোধের প্রকাশ যা জনগণের নৈতিক মনোবল দৃঢ়ীকরণে ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অস্থায়ী সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পর স্বাধীন দেশের বেতার কেন্দ্র হিসেবে এর নতুন নাম হয় ‘বাংলাদেশ বেতার’। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে আসে এবং সেদিন থেকেই স্বাধীন দেশের রেডিও হিসেবে বাংলাদেশ বেতারের সম্প্রচার কাজ শুরু হয়।
[এম সিদ্দিকুর রহমান]