সামরিক বাহিনী
সামরিক বাহিনী প্রাচীনকাল হতে বিদ্যমান প্রতিরক্ষা ও আক্রমণ সংক্রান্ত সংগঠিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সামরিক বাহিনীর গঠন, যথা- অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধের ধরন, যানবাহন, রসদ সরবরাহ, চাকরিতে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সব সময়ই পরিবর্তনশীল থেকেছে। সামরিক বাহিনীর আকার ও গঠন নির্ভর করত রাষ্ট্রের আকারের ওপর। আলোচনার সুবিধার জন্য নিম্নোক্ত শিরোনামে বিষয়টি বর্ণনা করা যেতে পারে: প্রাচীনকাল, মধ্যযুগ, ঔপনিবেশিক যুগ, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমল।
প্রাচীনযুগ বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাচীন যুগে সুসংগঠিত সৈন্যবাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘সেনাপতি’ অথবা ‘মহাসেনাপতি’ ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা। মহাসেনাপতির তত্ত্বাবধানে পৃথক পৃথক কর্মকর্তাগণ সৈন্যবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগ যেমন- পদাতিক বাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনী, হস্তিবাহিনী এবং নৌবাহিনী পরিচালনা করতেন। উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বের দূরবর্তী এলাকা হতে অশ্ব সংগ্রহ করা হতো। পালদের প্রায় সবকটি লিপি উৎসে উল্লিখিত ‘গৌড়-মালব-খশ-হূণ-কুলিক-কর্ণাট-লাট-চাট-ভাট’ উক্তি থেকে ধারণা করা হয় যে, তাদের রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে ভারতের বিভিন্ন এলাকা হতে মানুষ-জন সংগৃহীত হতো। লিপি উৎসে আরও কতিপয় বিশেষ কর্মকর্তার উল্লেখ পাওয়া যায় যেমন- ‘কোট্টপাল’ (দুর্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত) এবং ‘প্রান্তপাল’ (সীমান্ত অঞ্চলের রক্ষক)। পাল দলিলপত্রে উল্লিখিত কর্মকর্তাদের তালিকা থেকে আরও বেশ কিছু নাম পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলির অর্থের যথাযথ স্পষ্টতার অভাবে তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে সঠিকভাবে ধারণা করা যায় না।
চন্দ্র, বর্মন এবং সেনদের শিলালিপিসমূহে পালদের লিপি উৎসে উল্লিখিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়। অবশ্য এ সকল দলিলের কোথাও কোথাও নতুন অগ্রগতির প্রকাশও পরিলক্ষিত হয়। দুটি নতুন নাম যথা- ‘মহাব্যূহপতি’ (প্রধান সামরিক কর্মকর্তা) এবং ‘মহাপিলুপতি’ (হস্তিবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার)- চন্দ্র, বর্মন ও সেনদের তাম্রশাসনে এবং বর্মন ও সেনদের শিলালিপিতে ব্যবহূত হতে দেখা যায়।
[চিত্তরঞ্জন মিশ্র]
মধ্যযুগ বাংলার মধ্যযুগীয় সামরিক অবস্থাকে আবার সুলতানি আমল এবং মুগল আমল এই দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়।
সুলতানি আমল ভারতের অন্যান্য অংশের মতো বাংলায় মধ্যযুগীয় শাসন একেবারে শুরু থেকে সামরিক বাহিনীর শক্তির ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল ছিল। সুলতানের ছিল সুসংগঠিত সৈন্যবাহিনী। বিজিত অঞ্চলের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা (যেহেতু সমগ্র জনগোষ্ঠীর ওপর সুলতানের নিয়ন্ত্রণ ছিল না) এবং দিল্লির সুলতানদের আগ্রাসন নীতির ভীতি থেকে বাংলার সুলতানগণ পদাতিক বাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনী, গোলন্দাজ বাহিনী, হস্তিবাহিনী এবং নৌবাহিনীর সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করতেন। স্বয়ং সুলতান ছিলেন সামরিক বাহিনীর প্রধান।
ভূ-প্রাকৃতিক ও জলবায়ুগত অবস্থার কারণে বাংলায় সারা বছর অশ্বারোহী বাহিনী কার্যকর রাখা সম্ভব ছিল না। বাংলার সামরিক বাহিনীর দুর্বলতম অংশ ছিল অশ্বারোহী বাহিনী। এদেশে উন্নত মানের অশ্বের স্বল্পতার কারণে বাংলার সুলতানদের বিদেশ থেকে অশ্ব সংগ্রহ করতে হতো। ‘সর-ই-খইল’ ছিলেন অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান।
সামরিক বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল গোলন্দাজ বাহিনী। মুগল সম্রাট বাবুর এটিকে বাংলার সেনাবাহিনীর একটি কার্যকর অংশরূপে চিহ্নিত করেছেন। ডি বারোস আরাকান এবং ত্রিপুরার ওপর বাংলার সেনাবাহিনীর সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারণ হিসেবে গোলন্দাজ বাহিনীর দক্ষতার কথা উল্লেখ করেন। গোলন্দাজ বাহিনী বিভিন্ন আকারের কামান ও বন্দুক ব্যবহার করত।
এই সময়ে পাইকগণ বাংলার পদাতিক বাহিনীর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ গঠন করেছিল। কিছু কিছু সময়ে পাইকগণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণ করত। তীর, ধনুক, বন্দুক প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাংলার পদাতিক সৈন্যদের বিশেষ রণকৌশল দেখে বাবুর আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
হাতি বাংলার সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বলে মনে হয়। যুদ্ধসামগ্রী বহন ছাড়াও এ সকল হাতি সশস্ত্র যোদ্ধাদের যাতায়াতের কাজেও ব্যবহূত হতো। নদী মাতৃক বাংলায় হাতির প্রয়োজনীয়তা সামান্য হলেও একেবারে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই।
নদী তীরবর্তী বাংলায় নৌবাহিনীর প্রয়োজন ছিল অনস্বীকার্য, কেননা অশ্বারোহী বাহিনী ছয় মাস পর্যন্ত দেশের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারতো। বাকি ছয় মাস এ আধিপত্য ছিল পাইক দ্বারা পরিচালিত নৌবাহিনীর হাতে। বাংলায় নৌবাহিনীর প্রথম প্রতিষ্ঠাতা ইওজ খলজীর সময় থেকে দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রণতরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। মীর বহর ছিলেন নৌবাহিনীর প্রধান এবং তার ওপর নানাবিধ দায়িত্ব ছিল। তার সম্ভাব্য দায়িত্বের মধ্যে ছিল (ক) নদীপথে যাতায়াতের জন্য সকল প্রকার নৌকা নির্মাণ; (খ) যুদ্ধহস্তী আনা-নেওয়ার জন্য উপযুক্ত নৌকার ব্যবস্থা করা; (গ) বিশ্বস্ত নাবিক নিয়োগ করা; (ঘ) নদীর তত্ত্বাবধান করা; (ঙ) ফেরীঘাটসমূহ হতে টোল আদায় করা ইত্যাদি। সামরিক বিভাগের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও হোসেনশাহী যুগের শেষদিকে নৌবাহিনীর দক্ষতা ধীরে ধীরে কমে আসে।
একটি সুপ্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনী পরিচালনা করা ছাড়াও সুলতানগণ তাঁদের নিরাপত্তার জন্য দুর্গের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করতেন। দিল্লির সম্রাটদের বারংবার আক্রমণ হতে বাংলার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় একডালা এবং বসনকোটের মতো দুর্ভেদ্য দুর্গগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তড়িঘড়ি করে নির্মিত মাটির প্রাচীর বেষ্টিত দুর্গ ছিল যুদ্ধের সময় বাংলার প্রতিরক্ষার এক সাধারণ কৌশল। সৈন্যগণ নগদ বেতন ও ভাতা পেত। ‘আরিজ-ই-লস্কর’ এ ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিলেন।
মুগল আমল প্রদেশে নৌবাহিনীর প্রধানকে বলা হতো ‘মীর বহর’। নদী ও সমুদ্র বন্দর দেখাশোনা করা, নদীপথে নির্বিঘ্নে যাতায়াত নিশ্চিত করা এবং নৌবাহিনীকে কর্মক্ষম রাখা ছিল তার দায়িত্ব। নদীমাতৃক বাংলায় নৌবাহিনী প্রেরণের মাধ্যমে সুবাহদার এবং বখশীকে সাহায্য করার জন্য ‘মীর বহর’কে সদা প্রস্ত্তত থাকতে হতো।
প্রতিটি ‘সরকার’ একজন ফৌজদার (সামরিক গভর্নর)-এর নিয়ন্ত্রণে ছিল। উজিরের পরামর্শ্বে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত ফৌজদার রাজকীয় আইন-কানুনের যথাযথ প্রয়োগ এবং শান্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ফৌজদার কাজ করতেন সুবাহদারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। অবাধ্য জমিদার ও রায়তদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের কাজে ফৌজদার সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের সাহায্য করতেন। জনসংখ্যার প্রধান অংশ হিন্দুরা সশস্ত্র বাহিনীতে নিযুক্ত ছিল।
কেন্দ্রে মীর বখশী যে দায়িত্ব পালন করতেন প্রদেশে অনুরূপ দায়িত্ব পালন করতেন ‘বখশী’ উপাধিধারী সামরিক কর্মকর্তা। প্রদেশে সামরিক বিভাগের প্রধান হিসেবে তিনি মনসবদারগণ কর্তৃক পরিচালিত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের শৃংখলা, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ তত্ত্বাবধান করতেন। তাঁর প্রত্যয়নের ভিত্তিতেই দীউয়ান ঐসব সদস্যের প্রাপ্য বেতন প্রদান করতেন। তিনি একই সঙ্গে সুবাহদারকে সামরিক বিষয়েও পরামর্শ দিতেন। প্রয়োজনে সামরিক অভিযানের ব্যবস্থাপনার কাজও তিনি করতেন। ওয়াকিয়ানবীশের রিপোর্টসমূহ ‘বখশী’ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রেরণ করতেন। [শিরিন আখতার]
ঔপনিবেশিক যুগ আধুনিক সামরিক বাহিনীর উদ্ভবের উৎস সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। বাস্তবে এর সূত্রপাত ঘটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফ্যাক্টরি নির্মাণ থেকে। মোগল সম্রাট শাহজাহান এর ১৬৩৪ সালের একটি ফরমান এর মাধ্যমে কোম্পানি পাটনা, ঢাকা ও কলকাতায় তাদের ফ্যাক্টরি পাহারা দেয়ার জন্য কিছু সংখ্যক সিপাহি ও ইউরোপীয় সৈন্য সংগ্রহ করে। ১৬৯৬ সালে ফোর্ট উইলিয়ম স্থাপিত হয়। ১৬৯৮ সালে এই দুর্গটিকে ইউরোপীয় কায়দায় শক্তিশালী করা হয়। কলকাতার জমিদারদের স্বোপার্জন, ব্যবসা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং পার্শ্ববর্তী কিছু করদরাজ্যের রাজাদের বিদ্রোহসুলভ আচরণের কারণে ইউরোপীয় অফিসারদের নেতৃত্বে একটি নিয়মিত সৈন্যবাহিনী গড়ার কথা কোম্পানি চিন্তা করতে শুরু করে। পূর্বে দুর্গের প্রহরীরা ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল এবং তাদেরকে নিজ খরচে অস্ত্র সংগ্রহ করতে হতো। এধরনের ফ্যাক্টরিভিত্তিক সৈন্যবাহিনী অন্যান্য প্রেসিডেন্সিতেও গড়ে তোলা হয়। ধীরে ধীরে এদের সংখ্যা ও শক্তি বাড়তে থাকে এবং পরিশেষে নিয়মিত ইউরোপীয় সামরিক অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠে।
১৭১৭ সালের মধ্যে প্রত্যেকটি প্রেসিডেন্সিতে নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠিত হয়ে যায়। ১৭৪৮ সালে কোম্পানির সকল সৈন্যবাহিনীর জন্য একটি সেনাপ্রধানের পদ সৃষ্টি করা হয় এবং মেজর স্ট্রিংগার লরেন্স প্রথম প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৭৫৪ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে যেসমস্ত ভারতীয় এবং ইউরোপীয় সৈন্য ছিল, তারা সবাই কোম্পানির সৈন্যবাহিনী হিসেবে পরিচিত ছিল। ইউরোপে ইংরেজ-ফরাসি দ্বন্দেতর জের ধরে ইংল্যান্ড থেকে রাজকীয় সৈন্যবাহিনী ভারতে পাঠানো হয়, যা ১৭৫৪ সালে কোম্পানির সৈন্যবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু এই দুটি সৈন্যবাহিনী সাংগঠনিক ও ‘কমান্ড’-এর ক্ষেত্রে পৃথক ছিল। রাজকীয় সৈন্যবাহিনী, কোম্পানির ইউরোপীয় সৈন্যবাহিনী এবং কোম্পানির স্থানীয় সিপাহি বাহিনী পৃথকভাবে পৃথক ‘কমান্ড’-এর মাধ্যমে অস্তিত্ব বজায় রাখে। যুদ্ধকালীন সময়ে কোম্পানির স্থানীয় ইউরোপীয় সৈন্যবাহিনী রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর কর্তৃত্বাধীন থাকতো।
রবার্ট ক্লাইভ বাংলায় ভারতের প্রথম ব্যাটালিয়ন সংগঠিত করেন। পলাশীর যুদ্ধ এর অল্প কিছুদিন পূর্বে তা গঠন করা হয় এবং তা পরিচিতি লাভ করে ‘লাল পল্টন’ নামে। ÔPlatoonহ শব্দটি ইংরেজি বা ফরাসি ‘Peloton’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। সুতরাং ভারতীয় শব্দ ‘পল্টন’ সম্ভবত হয় ইংরেজি অথবা ফরাসি অথবা উভয় শব্দ থেকে এসেছে। পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটাতে বাধ্য করে। ১৭৯৬ সালে ইংরেজ অফিসারদের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেলে সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত করা হয়। বিদ্যমান ব্যাটেলিয়নগুলিকে সংযুক্ত করে ভারতীয় পদাতিক রেজিমেন্ট গঠন করা হয়, যা প্রথমবারের মতো ইউনিটগুলির সংখ্যা নির্ধারণ করে নাম্বারিং শুরু করে। ১৭৯৬ সাল হতে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব-এর সময়কালে অনেক এলাকা কোম্পানির দখলে আসে এবং এর ফলস্বরূপ তিন প্রেসিডেন্সির সৈন্যবাহিনী এমন আকার ধারণ করে যে, তিনটি পৃথক প্রেসিডেন্সির সৈন্যবাহিনীর অবলুপ্তি ঘোষণা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বিপ্লবের কারণে সৈন্যদলে প্রায় বৈপ্লবিক পবিবর্তন আসে। ১৮৫৭ সালের ঘটনার তদন্ত ও প্রতিবেদন পেশ করার জন্য ১৮৫৮ সালে একটি রাজকীয় কমিশন গঠন করা হয়। ১৮৫৯ সালের মার্চ মাসে কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ করে এবং এই রিপোর্টের সুপারিশের ভিত্তিতে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে ঢেলে সাজানো হয়। রাজকীয় বাহিনী ও কোম্পানির ইউরোপীয় বাহিনীর পার্থক্য দূর করা হয় এবং এরা রাজকীয় ব্রিটিশ রেজিমেন্টের এক কাতারে শামিল হয়। বাংলার সেনাবাহিনীও পুনর্গঠিত করা হয়। সিপাহি বিপ্লবের পূর্বে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী দুভাবে পরিচিত ছিল- নিয়মিত এবং অনিয়মিত। নিয়মিত সৈন্যবাহিনীতে একটি অশ্বারোহী রেজিমেন্টে ২৩ জন ইউরোপীয় অফিসার ও ১৩ জন ভারতীয় কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার এবং একটি পদাতিক বাহিনীতে ২৬ জন ইউরোপীয় অফিসার ও ২০ জন ভারতীয় কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার থাকত। সেনাবাহিনীর অন্যান্য শাখায় পদসংখ্যার তারতম্য ছিল। অনিয়মিত সৈন্যবাহিনীতে একটি রেজিমেন্টে শুধু তিন থেকে পাঁচজন ইউরোপীয় অফিসার, একজন কমান্ড্যান্ট, একজন সহকারী কমান্ড্যান্ট এবং একজন এডজুট্যান্ট থাকত।
১৮৫৭-র সিপাহি বিপ্লবের সময় গুটিকয়েক রেজিমেন্ট ব্যতীত বাংলায় প্রায় সব সৈন্যবাহিনী অনিশ্চয়তা এবং প্রতিহিংসার কারণে তাদের ছাউনি (ক্যাম্প) পরিত্যাগ করে। ১৮৬১ সালে ‘বেঙ্গল সৈন্যবাহিনী’কে অবলুপ্ত ঘোষণা করে সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠিত করা হয়। ১৮৫৮ সালে কমিশন সুপারিশ করে যে, বিভিন্ন অঞ্চল এবং গোত্রের মানুষ নিয়ে সৈন্যবাহিনী গঠন এবং সাধারণভাবে প্রত্যেক রেজিমেন্টের মধ্যে বাছবিচারহীনভাবে মিশ্রণ ঘটাতে হবে। সে অনুযায়ী চারটি ভিন্ন ব্যবস্থায় ভারতীয় রেজিমেন্টগুলি সংগঠিত করা হয়। এগুলি: সাধারণ মিশ্রণ, শ্রেণী কোম্পানি মিশ্রণ, রেজিমেন্ট মিশ্রণ এবং গ্রাম্য মিশ্রণ।
‘সাধারণ মিশ্রণ’ ব্যবস্থায় কোম্পানির রেজিমেন্ট বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয়। অর্থাৎ একটি রেজিমেন্টের প্রত্যেকটি কোম্পানি বিভিন্ন বর্ণের ও গোত্রের লোক দ্বারা গঠিত হতো। ‘শ্রেণী কোম্পানি মিশ্রণে’ রেজিমেন্টের প্রতিটি কোম্পানি নির্দিষ্ট কোন গোত্র বা বর্ণের লোক দ্বারা গঠিত হতো। ‘রেজিমেন্ট মিশ্রণ’ ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ একটি রেজিমেন্ট নির্দিষ্ট একটি বর্ণ বা গোত্রের লোক দ্বারা গঠিত হতো। ‘গ্রাম্য মিশ্রণ’ ব্যবস্থায় একটি রেজিমেন্টে কোন নির্দিষ্ট গ্রাম বা জেলার বাসিন্দাদের নিয়ে রেজিমেন্ট গঠন করা হতো। সংক্ষেপে বলা যায় যে, ব্রিটিশ সরকারের নীতির মূল লক্ষ্য ছিল বিভাজনের মাধ্যমে ভারসাম্য সংরক্ষণ (divide et impera)। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল বিভিন্ন এলাকা ও শ্রেণীর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং অতি সন্তর্পণে কোন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর আধিক্য যাতে না হয় তার প্রতি দৃষ্টি রাখা। সরকারের এহেন নীতি অনুসরণের মূল কারণ হচ্ছে ভারতীয় বাহিনীর উপর সম্পূর্ণ অবিশ্বাস। ভারতীয় শাসনকালের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই এই অবিশ্বাসের মনোভাব ইংরেজ সামরিক নীতিকে প্রভাবিত করেছে। গোলন্দাজ বাহিনীসহ সকল সৈন্য বিভাগে যেখানে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজন রয়েছে, সে সকল ক্ষেত্রে ভারতীয়দেরকে সুপরিকল্পিতভাবে বাদ দেয়া হয়েছে।
১৮৯৫ সালে তিন প্রেসিডেন্সি সেনাদলকে একটি একক ভারতীয় সৈন্যবাহিনী হিসেবে পুনর্গঠিত করা হয়। এই সৈন্যবাহিনী চারটি ‘কমান্ড’-এ বিভক্ত ছিল: পাঞ্জাব, বাংলা, মাদ্রাজ (বার্মাসহ) এবং বোম্বাই (যার অন্তর্গত ছিল সিন্ধু, কোয়েটা এবং এডেন)। এই চারটির প্রত্যেকটির দায়িত্বে একজন করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ছিলেন। এই নতুন ব্যবস্থার ফলে কেন্দ্রীয়ভাবে সকল বাহিনী ব্রিটিশ ভারতের প্রধান সেনাপতির কর্তৃত্বে চলে আসে।
১৯১৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয়রা রাজকীয় কমিশনের জন্য মনোনীত হতে পারত না। এটা ছিল সম্পূর্ণভাবে ইংরেজদের জন্য সংরক্ষিত। ইউরোপীয় কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার এবং ভারতীয় পদমর্যাদার মাঝামাঝি ছিল আরও একটি বিশেষ শ্রেণী, যা ‘ভাইসরয়ের কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার’ হিসেবে পরিচিত ছিল। এই অফিসার ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর ব্যাটালিয়নের অধিপতি হিসেবে থাকলেও তাকে রাজকীয় কমিশনপ্রাপ্ত একজন নিম্নপদাধিকারী ইংরেজ অফিসারের অধীনে থাকতে হতো এবং ১৯১৪-১৮ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিদেশের মাটিতে ভারতীয় সৈন্যদের বিশ্বস্ত সেবার স্বীকৃতি হিসেবে এবং জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ঘোষণা দেয় যে, রাজকীয় কমিশনের জন্য ভারতীয়রাও মনোনয়ন পাবে। ইংল্যান্ডের স্যান্ডহার্স্ট-এ বছরে দশটি খালি পদ ভারতীয়দের জন্য বরাদ্দ করা হয়। ১৯১৮ সালের অক্টোবরে ইন্দোরে ৫০ জন ক্যাডেটের জন্য একটি ক্যাডেট স্কুল খোলা হয়। ১৯২২ সালের মার্চ মাসে দেরাদুনে ৭০ জন ধারণ ক্ষমতায় ‘প্রিন্স অফ ওয়েলস রয়েল মিলিটারী কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়াও কিছু সংখ্যক বাছাইকৃত ‘নন-কমিশনড’ ব্যক্তিকে বিশেষ রাজকীয় কমিশন দেওয়া হয়। ইন্দোর ক্যাডেট কলেজের কিছু স্নাতকধারী ডিগ্রিপ্রাপ্তকেও কমিশন দেওয়া হয়।
১৯২৩ সালে ভারতীয়করণের এই পদ্ধতি পাল্টিয়ে একটি বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যা ‘আট-একক পরিকল্পনা’ (Eight Unit Scheme) হিসেবে পরিচিত। এই নতুন ব্যবস্থায় রাজকীয় কমিশনপ্রাপ্ত ভারতীয় অফিসারদের নিদির্ষ্টভাবে বাছাইকৃত কয়েকটি ইউনিটে নিয়োগ দেওয়া হতো। আটটি ইউনিটকে এ ধরনের ভারতীয়করণের জন্য পৃথকভাবে নির্বাচিত করা হয়। এই আটটির মধ্যে ছিল দুটি অশ্বারোহী বাহিনী, একটি ‘পাইওনিয়ার’ বাহিনী এবং পাঁচটি পদাতিক বাহিনী। ১৯২৭ সালে ভারতীয় অফিসারদের পাহাড়ি গোলন্দাজ বাহিনী, সুড়ঙ্গ খননকারী ও মাইন স্থাপনা বাহিনীসহ অন্যান্য প্রযুক্তিগত ও কারিগরি শাখায় নিয়োগের জন্য মনোনীত করা হয়। এই বাহিনীতে শুধু ভারতীয় অফিসার এবং রাজকীয় বিমানবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় আগত কিছু সংখ্যক অফিসার থাকার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া আলাদা একটি ভারতীয় বিমান বাহিনী সৃষ্টি করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৯২৭ সালে একটি ভারতীয় সামরিক কলেজ প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ফলে ১৯৩৩ সালে দেরাদুনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারতীয় স্যান্ডহার্স্ট’। প্রতিবছর এই নতুন কলেজে ৬০ জনের ভর্তি নির্ধারিত হয়। ভর্তির বয়স সীমা ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়। এই কলেজে তিন বছরের একটি শিক্ষাক্রম চালু ছিল, যার প্রথম বর্ষে থাকতো সাধারণ শিক্ষা এবং বাকি দুবছর প্রধানত সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য নির্ধারিত ছিল। ভারতীয় সরকারি কমিশন একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা পরিচালনার মাধ্যমে অফিসারদের নির্বাচন করত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিবছর ৬০ জন ভারতীয় এবং ১২০ জন ব্রিটিশ অফিসার কমিশন লাভ করতেন। যুদ্ধকালীন সময়ে এই নিয়মিত প্রবেশ বন্ধ করা হয় এবং অল্প সংখ্যক যোগ্য ব্যক্তিকে দশ মাসের প্রশিক্ষণের পর শুধু জরুরি অবস্থায় কমিশন দেওয়া হয়। ১৯৩৯ সালের অক্টোবরে মোট ৪ হাজার অফিসারের মধ্যে ভারতীয় ছিল মাত্র ৪০০ জন। অন্যদিকে ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে সর্বমোট ৪২,৯৩০ জনের মধ্যে ৮,৩৪০ জনই ছিল জরুরি অবস্থায় কমিশনপ্রাপ্ত ভারতীয় অফিসার।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতকে দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত করার সাথে সাথে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীকেও দুটি রাষ্ট্রীয় সৈন্যবাহিনীতে বিভক্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালের ৩০ জুন বড় লাটের সভাপতিত্বে দেশ বিভাগ সম্পর্কিত গঠিত পরিষদের বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীর বিভক্তি সম্বন্ধে ঐকমত্য হয়। বড় লাটের ‘চীফ অফ স্টাফ’ লর্ড ইস্মে এবং ভারতের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল স্যার ক্লোড অচিনলেক এই বাটোয়ারার নীতিমালা তৈরি করেন। দুই সৈন্যবাহিনীর শক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে সৈন্যবাহিনীকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে এবং সকল অস্থাবর রসদ, সরঞ্জামাদি এবং অন্যান্য সম্পদ বাটোয়ারা করা হয়। এই হিসেবে ভারতের ৬৪ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ৩৬ শতাংশ ভাগ নির্ধারিত হয়। [আতফুল হাই শিবলী]
গ্রন্থপঞ্জি The Cambridge History of India, Vol. VI, Cambridge 1932; AB Sen, The Bengal Native Infantry, Its Organisation and Discipline, 1796-1852, Calcutta, 1962; R Singh, History of the Indian Army, Delhi, 1963.
পাকিস্তান আমল ব্রিটিশ-ভারত সৈন্যবাহিনীর মুসলমান সৈন্যদেরকে নিয়ে পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী গঠিত হয়। সাবেক ‘উত্তর সেনা সদর’কে অচিরেই করাচিতে সরিয়ে নেওয়ার জন্যে তড়িঘড়ি করে করাচিকে অস্থায়ী সেনা সদরে পরিণত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে একটি নতুন কম্যান্ড গঠন করা হয় এবং এই উপ-এলাকার সেনা সদরের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম জি.ও.সি (জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং) মোহাম্মদ আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যমান পরিস্থিতির চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: ‘‘সেখানে কোন সেনাবাহিনী ছিল না। সব মিলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ... দুই পদাতিক ব্যাটালিয়ন; সেনা সদরে বাসস্থানের ব্যবস্থাও ছিল খারাপ- সেখানে কোন টেবিল, চেয়ার, অফিস-সরঞ্জামাদি ছিল না- বস্ত্তত আমাদের কিছুই ছিল না; এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের কোন মানচিত্রও ছিল না। পাকিস্তানের পদাতিক বাহিনী শুধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ে গঠন করা হতো। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানে একটি রেজিমেন্ট গঠন করা অত্যাবশ্যকীয় ছিল। ফলে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন বিহার রেজিমেন্ট থেকে দুটি মুসলমান কোম্পানি (নং ১২৫৬ এবং নং ১৪০৭) নিয়ে প্রথম ব্যাটালিয়ন (সিনিয়র টাইগার্স) গঠনের মাধ্যমে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই দুই কোম্পানির যে সব বাঙালি মুসলমান বার্মা সেক্টরে সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছিল, তাদেরকে মূল ব্রিটিশ-ভারত সৈন্যবাহিনীতে বহাল করা হয়। ঢাকা নতুন পূর্ব পাকিস্তান উপ-এলাকার সেনা সদর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়। বস্ত্তত মেজর আবদুল গণি এবং কর্নেল জেনারেল মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর জন্ম হয় এবং প্রসার লাভ করে। এই রেজিমেন্টের ক্রমবর্ধমান উন্নতির পেছনে এই দুই খ্যাতনামা সামরিক অফিসারের অদম্য উৎসাহ ও অসীম অবদান ছিল। [আতফুল হাই শিবলী]
বাংলাদেশ আমল ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ-এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উত্থান ঘটে। অবশ্য এর ইতিহাস নিহিত ভারতে ব্রিটিশ শাসনের দিনগুলিতে। ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈন্যদের কিছু প্রবেশ ঘটতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রধানত বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে গঠিত দুটি কোম্পানি বার্মা ফ্রন্টে অকুতোভয় যুদ্ধের মাধ্যমে বিশেষ অবদান রাখে। পরে ১৯৪৭ সালে এ দুটি কোম্পানিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর আবদুল গণী উক্ত কোম্পানি দুটিকে একটি ব্যাটালিয়ন গ্রুপে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৮টি পদাতিক বাহিনী গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল যথাক্রমে যশোর, জয়দেবপুর, রংপুর, কুমিলা এবং চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পশ্চিম পাকিস্তানে আটক অবস্থায় অবস্থান করতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গঠন ১৯৭১ সালের ২৫/২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করে। এসময় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাঁচটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ এবং সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে, যা চলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত বাঙালি অফিসার এবং জাতীয় সংসদের সদস্য কর্নেল এম.এ.জি ওসমানীকে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সদস্যদের নিয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত মুক্তিবাহিনীর প্রধান অংশটি গঠিত হয়। প্যারামিলিটারি ও সর্বস্তরের জনগণও এই মুক্তিবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট হয় এবং মুক্তিবাহিনী ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
মুক্তিবাহিনীকে এগারোটি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের প্রধান ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন করে সিনিয়র বাঙালি অফিসার। এঁদের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমান ১নং সেক্টর, মেজর খালেদ মোশাররফ ২নং সেক্টর, মেজর কে.এম শফিউল্লাহ ৩নং সেক্টর, মেজর সি.আর দত্ত ৪নং সেক্টর, মেজর মীর শওকত আলী ৫নং সেক্টর, উইং কমান্ডার এম.কে বাশার ৬নং সেক্টর, মেজর কাজী নূরুজ্জামান ৭নং সেক্টর, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ৮নং সেক্টর এবং মেজর মোহাম্মদ আবদুল জলিল ছিলেন ৯নং সেক্টর-এর প্রধান। ১০নং সেক্টর ছিল নৌকমান্ডো অভিযানের জন্য নির্ধারিত। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মংলাসহ বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকা এ সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মেজর আবু তাহের ছিলেন ১১নং সেক্টর-এর প্রধান।
যুদ্ধ এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের একটি জাতীয় সৈন্যবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মিত ইউনিটগুলির সমন্বয়ে ৩টি ব্রিগেড গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১৭ জুলাই ‘জেড’ ফোর্স নামে প্রথম ব্রিগেড গড়ে ওঠে। প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অন্তর্ভুক্ত হয়। এটির প্রধান ছিলেন লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান। চতুর্থ, নবম ও দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমন্বয়ে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে গড়ে ওঠে ‘কে’ ফোর্স নামে দ্বিতীয় ব্রিগেড। এর প্রধান ছিলেন লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ। তৃতীয় ব্রিগেডও গড়ে ওঠে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। দ্বিতীয় এবং একাদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এ ব্রিগেড ‘এস’ ফোর্স নামে পরিচিত ছিল। এর প্রধান ছিলেন লে. কর্নেল কে.এম শফিউল্লাহ। পরে ‘জেড’ ফোর্সের অধীনে দুটি গোলন্দাজ বাহিনীও গড়ে ওঠে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্প্রসারণ স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত হয় ঢাকা ক্যান্টমেন্টের পুরনো বিমান সদর দপ্তরে। ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ পুনরায় এটি স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমান অবস্থানে আসে। এখানেই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনের পূর্বেকার সদর দপ্তর। সে সময় বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তরের নতুন নামকরণ করা হয় জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স (জি.এইচ.কিউ)। প্রথমে রীতি মাফিক পদ্ধতিতে এর সম্প্রসারণ শুরু হয়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে এগারোটি পদাতিক ইউনিট গড়ে ওঠে, যার মধ্যে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আটক অবস্থায় পাকিস্তানে অবস্থান করছিল। অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে আরও আটটি ইউনিট গড়ে ওঠে।
এমতাবস্থায় সেনাবাহিনীর দ্রুত সম্প্রসারণের প্রয়োজনে জি.এইচ.কিউ দেশের ৫টি ক্যান্টনমেন্টে ৫টি পদাতিক ব্রিগেড গঠনের নির্দেশ দেয়। একটি পদাতিক ব্রিগেড গঠনের উদ্দেশ্যে ‘জেড’ ফোর্সকে সিলেট থেকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সরিয়ে আনা হয়। ইতোমধ্যে ঢাকায় অবস্থিত ‘এস’ ফোর্স একটি পদাতিক ব্রিগেড হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। অপর একটি পদাতিক ব্রিগেড গঠনের জন্য ‘কে’ ফোর্সকে চট্টগ্রাম থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়াও রংপুর এবং চট্টগ্রামে আরও দুটি পদাতিক ব্রিগেড গড়ে ওঠে। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ তিন বাহিনীর যৌথ সদর দপ্তর অবলুপ্ত হয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিন বাহিনীর পৃথক পৃথক সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।
পাকিস্তানে আটক বাঙালি অফিসার ও সৈন্যবাহিনী ইতোমধ্যে দেশে ফিরে আসে এবং ১৯৭৩ সালে তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের কিছুদিন পর গঠিত জাতীয় রক্ষী বাহিনী অবলুপ্ত এবং এর সদস্যদেরকে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়।
১৯৭৫ সালে ঢাকার শের-এ-বাংলা নগরে প্রথম পদাতিক ডিভিশন গড়ে ওঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্প্রসারণে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। অতঃপর ১৯৭৬ সালে আরও চারটি পদাতিক ডিভিশন এবং ১৯৮৮ ও ১৯৯২ সালে আরও দুটি ডিভিশন গড়ে ওঠার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সম্প্রসারণ গতি লাভ করে। এসকল পদাতিক ডিভিশন বাড়ানোর সাথে সাথে প্রতিটি ডিভিশনের সংশ্লিষ্ট ও সহযোগী ইউনিটগুলিও সম্প্রসারিত হয়।
সাংগঠনিক কাঠামো পৃথিবীর যেকোন আধুনিক সামরিক বাহিনীর মতো সাত ডিভিশন বিশিষ্ট বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীও সদর দফতর থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন ইউনিট পর্যন্ত পর্যায়ক্রমিকভাবে বিন্যস্ত। একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট হেডকোয়ার্টার থেকে সমগ্র সামরিক বাহিনী পরিচালনা করেন। মেজর জেনারেলের পদাধিকারী চারজন প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার প্রধান ও একজন ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চিফ তাকে সহযোগিতা করেন। এই পাঁচজন জেনারেল আর্মি হেডকোয়ার্টারের প্রধান পাঁচটি শাখার (জি.এস, এ.জি, কিউ.এম.জি, এম.জি.ও এবং ই-ইন-সি) দায়িত্বে থাকেন। এরাই গোটা সামরিক বাহিনীর অপারেশন, ট্রেনিং এবং প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করেন। আবার প্রতিটি ইনফেন্ট্রি ডিভিশন মেজর জেনারেল র্যাঙ্কের একজন অফিসারের কম্যান্ডে থাকে। একটি ডিভিশন ২/৩টি ইনফেন্ট্রি ব্রিগেড ও একটি গোলন্দাজ ব্রিগেড এবং সেই সাথে ইঞ্জিনিয়ার্স, সিগন্যালস, সার্ভিসেস, অর্ডিন্যান্স, মেডিক্যাল, ই.এম.ই এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ইউনিট নিয়ে গঠিত। অন্যদিকে ইনফেন্ট্রি ব্রিগেড সাধারণত ২/৩টি ইনফেন্ট্রি ইউনিট ও এর সাথে সম্পৃক্ত আরও কিছু আবশ্যিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত। ব্রিগেডের প্রধান হিসেবে দায়িত্বে থাকেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেলের অধীনে থাকে ইউনিট। একটি ইনফেন্ট্রি ইউনিট কয়েকটি রাইফেল কোম্পানি সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এবং এতে সমরাস্ত্র হিসেবে থাকে রাইফেল, হালকা ও ভারি মেশিনগান, মর্টার ও ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্র।
প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে পুনর্গঠিত ও সম্প্রসারিত করার সময় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী উপলব্ধি করে যে, সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সৈন্যদের তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্র ও দায়িত্ব সম্পর্কে উচ্চতর পেশাদার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ইনস্টিটিউট প্রয়োজন। নিম্নে এ সম্পর্কে সংক্ষেপ আলোচনা করা হলো।
স্কুল অব ইনফেন্ট্রি অ্যান্ড ট্যাক্টিকস্ (এস.আই অ্যান্ড টি) এটি ১৯৭৩ সালে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এটি সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্টে বর্তমানের জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। এর মূল লক্ষ্য সামরিক কৌশল, অস্ত্র ও বিশেষ সামরিক অপারেশন সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান। বিভিন্ন বিভাগের অফিসারদের সব ধরনের অস্ত্র সম্পর্কে স্কুলে শিক্ষা দেওয়া হয়। ইনফেন্ট্রি বিভাগের জন্য ‘স্পেশাল টু আর্মস’ কোর্সেরও প্রশিক্ষণ এখানে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ মিলিটারি এ্যাকাডেমী (বি.এম.এ) ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে যাত্রা শুরু করে এবং ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে স্থানান্তরিত হয়। এখানে প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্য হলো সামরিক বাহিনীতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দানকারী অফিসার গড়ে তোলা। এটি চারটি কোম্পানি সম্বলিত একটি ক্যাডেট ব্যাটালিয়ন নিয়ে গঠিত। বেশ কিছু বিদেশী ক্যাডেটকেও প্রশিক্ষণের জন্য এখানে পাঠানো হয়।
আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট (এ.এফ.এম.আই) ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা ক্যান্টমেন্টে প্রথম স্থাপিত হয়। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর মেডিক্যাল কোর, ডেন্টাল কোর ও আর্মড ফোর্সেস নার্সিং সার্ভিসের অফিসার ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষিত করে তোলাই এর প্রধান লক্ষ্য।
ডিফেন্স সার্ভিসেস কম্যান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ (ডি.এস.সি.এস.সি) ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এটি কাজ শুরু করে। এর মূল লক্ষ্য হলো তিন বাহিনীর নির্বাচিত অফিসারদের কমান্ড ও স্টাফ উভয় ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর দায়িত্ব গ্রহণে দক্ষ করে তোলা। কলেজটি যৌথভাবে পরিচালিত একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। এখানে একই সাথে তিনটি কোর্স পরিচালিত হয়। এগুলি হলো আর্মি স্টাফ কোর্স, নেভাল স্টাফ কোর্স এবং এয়ার স্টাফ কোর্স। বন্ধুপ্রতিম দেশের বহু অফিসার এখান থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন।
ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ (এন.ডি.সি) ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য হলো সামরিক ও বেসামরিক নির্বাচিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক অধিকতর দায়িত্ব পালন সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ প্রদান। প্রতিষ্ঠানটি চারটি শাখা নিয়ে গঠিত। এখানে দুটি প্রধান কোর্স পরিচালনা করা হয়- ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স (এন.ডি.সি) এবং আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স (এ.এফ.ডবিউ.সি)। সর্বপ্রথম এন.ডি.সি এবং এ.এফ.ডবিউ.সি কোর্স দুটি শুরু হয় যথাক্রমে ১৯৯৯ এবং ২০০১ সালে।
মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এম.আই.এস.টি) ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে যাত্রা শুরু করে। দেশ-বিদেশের সামরিক অফিসার ও সিভিল ছাত্রদের প্রকৌশলের বিভিন্ন বিষয়, কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি (সি.এস.আই.টি) এবং মাস্টার অব বিজনেস অ্যাডমিনিসট্রেশন (এম.বি.এ) বিষয়ে আন্ডার-গ্রাজুয়েট ও পোস্ট-গ্রাজুয়েট কোর্সে শিক্ষা প্রদান প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য।
আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ (এ.এফ.এম.সি) ১৯৯৯ সালের জুন মাসে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রধান লক্ষ্য সামরিক বাহিনী এবং সেই সাথে দেশের প্রয়োজনে কয়েকজনকে বিশেষভাবে বাছাই করে পাঁচ বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তোলা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং (বি.আই.পি.এস.ও.টি) ১৯৯৯ সালের জুন মাসে রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব সঠিক ও দৃঢ়তার সাথে সম্পন্ন করার জন্য এখানে অফিসার ও সৈনিকদের একক ও দলগতভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি তিন বাহিনীর অফিসার ও অন্যান্য পদের কর্মকর্তাদের এবং সিভিল পুলিশকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কার্যকরী ভূমিকা রাখার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
আর্মস/সার্ভিসেস সেন্টার অ্যান্ড স্কুল বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে কর্মকর্তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রের দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন সেন্টার ও স্কুল রয়েছে।
জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী সমগ্র বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশই সর্ববৃহৎ সামরিক বাহিনী প্রেরণকারী দেশ। বাংলাদেশ ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ (ইউ.নি.আই.এম.ও.জি) হিসেবে পরিচিত জাতিসংঘের একটি মিশনে সর্বপ্রথম ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি দল প্রেরণ করে। এরপর দ্বিতীয় মিশনটি ছিল নামিবিয়াতে কার্যরত ইউনাইটেড নেশনস ট্রাঞ্জিশন অ্যাসিসটেন্স গ্রুপ (ইউ.এন.টি.এ.জি)। প্রথম দুটি শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাদের অসাধারণ দক্ষতা স্বীকৃতি লাভ করে এবং তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। এর ফলে পরবর্তীকালে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ থেকে বৃহৎ বাহিনী প্রেরণের পথ উন্মুক্ত হয়। ২০০২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে ২৬টি অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছে। এগুলি হলো: ইউ.এন.আই.আই.এম.ও.জি (ইরাক), ইউ.এন.টি.এ.জি (নামিবিয়া), ইউ.এন.এ.এম.আই.সি এবং ইউ.এন.টি.এ.সি (ক্যাম্বোডিয়া), ইউ.এন.এম.এল.টি (ক্যাম্বোডিয়া), ইউ.এন.ও.এস.ও.এম (সোমালিয়া), ইউ.এন.ও.এম.ইউ.আর (উগান্ডা/রুয়ান্ডা), ইউ.এন.ও.এস.ও.এম-২ (সোমালিয়া), ও.এন.ইউ.এম.ও.জেড (মোজাম্বিক), ইউ.এন.ও.এ.এম.আই.আর (রুয়ান্ডা), ইউ.এন.পি.আর.ও.এফ.ও.আর (যুগোশ্লাভিয়া), ইউ.এন.ও.এম.আই.এল (লাইবেরিয়া), ইউ.এন.এম.আই.এইচ/ এম.এন.এফ (হাইতি), ইউ.এন.এস.এম.এ (আফগানিস্তান), ইউ.এন.টি.এ.ই.এস (ই. স্লোভেনিয়া), ইউ.এন.পি.আর.ই.ডি.ই.পি (ম্যাসিডোনিয়া), আই.এন.এ.ভি.ই.এম-৩ (এ্যাঙ্গোলা), ইউ.এন.এম.ও.টি (তাজিকস্তান), ইউ.এন.আই.কে.ও.এম (কুয়েত), এম.আই.এন.ইউ.আর.এস.ও (ডব্লিউ. সাহারা), ইউ.এন.ও.এম.আই.জি (জর্জিয়া), ইউ.এন.জি.সি.আই (ইরাক), ইউ.এন.এ.এম.ই.টি/ইউ.এন.টি.এ.ই.টি (ই. তিমুর), ইউ.এন.এ.এম.এস.আই.এল (সিয়েরা লিওন), ইউ.এন.এম.আই.কে (কসোভো), এম.ও.এন.ইউ.সি এবং ইউ.এন.এম.ই.ই (ইথিওপিয়া/ইরিত্রিয়া)।
বিজয় উৎসব প্রতি বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে তিন বাহিনীর কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করা হয়। ১৯৮২ সালের ২১ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী সহযোগী সংগঠনসহ ‘জাতীয় সশস্ত্র দিবস’ পালন করে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে এই দিনেই একত্রে প্রথমবারের মতো তিন বাহিনীর সদস্যগণ দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। তেমনিভাবে প্রত্যেক বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপিত হয়।
সাম্প্রতিক উন্নয়ন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সামরিক বাহিনীতে সবচেয়ে পুরাতন রেজিমেন্ট। তবে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ইনফেন্ট্রি রেজিমেন্ট নামে নতুন আর একটি রেজিমেন্ট উদ্বোধন করা হয়েছে। ২০০১ সালের ২১ এপ্রিল নতুন রেজিমেন্টের পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলিত হয়। বাংলাদেশ আর্মি ২০০০ সাল থেকে মহিলা অফিসার নিয়োগও শুরু করেছে।
২০০৩ সালে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে ১৭টি ব্রিগেডে মোট ১,২০,০০০ পদাতিক, ১০,৫০০ নৌ এবং ৬,৫০০ বিমানসেনা সদস্য রয়েছে। এ সময় প্রায় ২০০ ট্যাংক, শতাধিক ট্যাংক বিধ্বংসী কামান ও গান, ৫টি ফ্রিগেট, ১০টি মিসাইল ক্র্যাফট, ৪টি টর্পোডো ক্র্যাফট ২টি অফসোর পেট্রোল বোট, ৪টি ইনশোর পেট্রোল ৮টি কোর্সাল পেট্রোল বোট ও ৪টি মাইন সুইপারসহ বিভিন্ন রণতরী ছিল। এছাড়া বিমান বাহিনীতে ছিল মিগ-২৯ ও এফ-৭ সহ চার স্কোয়াড্রন যুদ্ধ বিমান।
[সালেহ উদ্দীন খান এবং সৈয়দ ওয়াহেদুজ্জামান]