সরকার, কবিয়াল বিজয়কৃষ্ণ
সরকার, কবিয়াল বিজয়কৃষ্ণ (১৯০৩-১৯৮৫) কবিয়াল, গীতিকার, সুরকার। বাংলাদেশের বিখ্যাত কবিয়াল ও বিচ্ছেদী গান রচয়িতা বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী ১৯০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নড়াইল জেলার সদর থানার ডুমদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের পূর্বপুরুষ বৈষ্ণব-গুরু নাটু বৈরাগী ও উদ্ধব বৈরাগী। তাঁর পিতার নাম নবকৃষ্ণ বৈরাগী। হিমালয়কুমারী বৈরাগী ছিলেন বিজয় সরকারের মাতা। নমশূদ্র সম্প্রদায়ের নবকৃষ্ণের নয়টি সন্তানের মধ্যে পাগল বিজয় সর্বকনিষ্ঠ।
বিজয় স্থানীয় স্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করে কিছুদিন টাবরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন; পরে স্থানীয় কাচারিতে নায়েবের চাকরি করেন। চাকরির অবসরে তিনি নানা ধরনের লোকসঙ্গীত চর্চা ও যাত্রাদলে অভিনয় করতেন। ১৯২৫ সালে গোপালগঞ্জের বিখ্যাত কবিয়াল মনোহর সরকারের কবিগান শুনে তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং দুর্গাপুরে গুরুগৃহে থেকে সঙ্গীতে তালিম নেন। তিনি মনোহর সরকারের নিকট দুবছর এবং অপর কবিয়াল রাজেন্দ্রনাথ সরকারের নিকট এক বছর কবিগান শেখেন। পরে ১৯২৯ সালে নিজস্ব কবিদল গঠন করে কবিগানের চর্চা করেন এবং অল্প দিনেই কবিয়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কবিয়ালদের প্রতিষ্ঠা চরমে উঠেছিল। যদিও তার পূর্বে ও পরে একাধিক শতাব্দী জুড়ে কবিগানের বিস্তৃতি ঘটে। কবিগানের উৎপত্তি সম্বন্ধে সজনীকান্ত দাস বলেন-‘‘বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত তরজা, পাঁচালী, খেইড়, আখড়াই, হাফ, দাঁড়া-কবিগান, বসা-কবিগান, ঢপ্কীর্তণ, টপ্পা, কৃষ্ণযাত্রা প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ের সংমিশ্রণে কবিগান জন্মলাভ করে। কবি বলতে এখানে বুঝানো হয় যে, অশিক্ষিত কিন্তু বেদ-পুরাণ, রাজনীতি-ইতিহাস সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল স্বভাবকবি। এই কবিকে কবিয়ালও বলা হয়। কবিগানের আসর হলো দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কবির সুর ও তাল সহযোগে তৎক্ষণাৎ পদ্যরচনা বিতন্ডা। অর্থাৎ একদল প্রথমে একটি বিষয়ে গাইবে পরে অপরদল তার গানের মধ্য দিয়ে উত্তর দিবে। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, অনুপ্রাসের ব্যবহার, সরস রাগবিস্তার, যুক্তিজাল করে অপর পক্ষকে আক্রমণ এবং আপন বক্তব্যের প্রতিষ্ঠা-প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে কবিয়ালার হারজিৎ হয়। বিতর্কের উত্তেজনা অনুসারে গানে ব্যবহূত ঢোল, কাসি, মন্দিরা, করতালের আওয়াজ ও লয়ের তারতম্য ঘটে। তখনকার দিনে কবিগান ছিল অশলীলতাযুক্ত গেঁয়ো মুর্খদের গান। যে গান নারী-পুরুষ একত্রে বসে শোনার উপযোগী ছিল না। জনসাধারণের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্ট কবিগান সে যুগের হঠাৎ কবিদের ‘সাময়িক কীর্তন’। এরা লিখিতভাবে কাব্য রেখে যাননি কারণ সভাস্থলে কবিদের ‘‘চাপান (Introduction) ও উত্তর ’’ রচনা করতে হতো। কবিয়ালরা আসরে দাঁড়িয়ে গান রচনা করতে গিয়ে শব্দ প্রয়োগে এমন দিশেহারা হয়ে উঠতেন যে, বাক্য প্রয়োগের উদ্দেশ্যও যেন তারা ভুলে যেতেন। কবিয়াল বিজয় সরকার নরসিংদীর হরিচরণ আচার্য ও রাজেস সরকারের অনুসারী হয়ে কবিগান সংষ্কারে মনোনিবেশ করেন। প্রাচীন কবিয়ালেরা যেখানে দেহলোলুপ, নায়িকা রাধার প্রতি সন্দেহভাজন; তারা অপ্রকৃত প্রেমসংগীত রচনা করতে গিয়ে সংশয়াদগ্ধ গীতি রচনা করেছেন, আধুনিক কবিয়াল সমাজের প্রতিভূ কবিয়াল বিজয় সরকার সেখানে দেহাতীত প্রেমের অপূর্ব সুষমামন্ডিত পদ রচনা করেছেন। যা তাঁর বিখ্যাত সখিসংবাদ সংগীতাংশে পাওয়া যায়-
‘‘কৃষ্ণ মিলন লাগি নিশি জাগি বাসর ঘরে
মিলন নিশি হইলো ভোর
এলো না শ্যাম কিশোর \’’
কবিয়াল হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি সংসার বিবাগী, উদাসী বা আখরাবাসী ছিলেন না। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রায় তিন হাজার ভক্তবাদী নরনারীর আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। জীবনের শেষদিকে লোকদের ধর্মীয় উপদেশ ও দীক্ষা দিয়ে সময় কাটাতেন। তবে দীক্ষার বিনিময়ে তিনি শিষ্য-শিষ্যাদের নিকট থেকে কোনো অর্থ গ্রহণ করতেন না।
বিজয়ের তিরোধানের পর ভারত থেকে জনৈক বাসুদেব গোলকার শ্রী শ্রী পাগল বিজয়ামৃত পুস্তক প্রকাশ করেছেন, সেখানে জনৈক বাঙ্গালী মুসলিম (বাংলাদেশের অধিবাসী)-এর চোখ অন্ধ হয়ে গেলে বিজয় তাঁর নিজের চোখ দু'টো দান করে তাকে দৃষ্টিদান করেন এবং নিজে চিরকালের জন্যে অন্ধত্ববরণ করেন বলে জানা যায়।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে কবিগানের উৎকর্ষ সাধন ও একে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বিজয়ের অবদান অসাধারণ। কবিগানের সময় ভাটিয়ালি সুরে রচিত তাঁর ধুয়া গান তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। সারা জীবনে তিনি মূলত দুটো ধারার গান পরিবেশন করেছেন-কবিগান ও রামায়ণ গান। মাঝেমধ্যে জারিয়ালদের সঙ্গে কবি-জারির পাল্লাও করেছেন। বাংলা সংগীত জগতে কবিয়াল বিজয় সরকার কবিগানকে বিশেষরূপে উপস্থাপন করেন। তাঁর কবিগান নিরপেক্ষ নবতর সংগীত হিসেবে শ্রোতাদের প্রাণে এক নব চেতনার উন্মেষ ঘটায়। এছাড়া বিজয়ের নিরপেক্ষ স্বরবৃত্ত ছন্দের অপূর্ব কবিগান সংগীতজগতে রেনেসাঁর সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে তাঁর একটি ভবানীবিষয়ক গানের অংশবিশেষ-
‘‘ওমা ব্রক্ষ্মময়ী তোর ব্রক্ষ্মান্ডে ধর্ম ফলে কর্মকান্ডে
প্রতি ভান্ডে অতি বিষ্ময়ের
মানুষ স্বকর্মে করে কসুর, স্বভাবের মাঝে অসুর
কর্মে মধুর সাজে নারী-নর \’’
পরে তিনি ভাটিয়ালী সুরের সঙ্গে বাউলসংগীতের অন্তর্ধর্ম মিশিয়ে এক নতুন ধরণের গান আমাদের উপহার দেন যা আমাদের লোকসংগীতের বিশাল বৈচিত্র্যময় আঙ্গিনায় একটি পৃথক ঘরানার সৃষ্টি করেছে। এই গানগুলোকে বিচ্ছেদ ভাটিয়ালী গান বলে ধরে নেওয়া হয়। বিজয়ের গানগুলো শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণীর মানুষের হূদয়ষ্পর্শী। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় পৌনে চারশত। তিনি মূলত রাধাবিচ্ছেদ, কৃষ্ণবিচ্ছেদ, বারাষিয়া, সারি, ধুয়া, অষ্টকগান, পদকীর্তন, ইসলামী গান, ডাকগান, সখি সংবাদ, গোষ্ঠগান, কবিগান প্রভৃতি রচনা করেন। কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, আববাসউদ্দীন আহমদ প্রমুখ মনীষীর সঙ্গে বিজয়ের ঘনিষ্ঠতা ছিল।
বিজয় সরকার প্রায় ৫৫ বছর সঙ্গীতসাধনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলা একাডেমী ও শিল্পকলা একাডেমীতে সঙ্গীত পরিবেশন করে বহু পুরষ্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৫ সালের ৪ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। [মোঃ এনামুল হক]