সংবাদপত্র আইন
সংবাদপত্র আইন উপমহাদেশে সংবাদপত্র সম্পর্কিত প্রথম রেগুলেশন জারি হয় ১৭৯৯ সালে গর্ভনর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির শাসনামলে। ওই রেগুলেশনে বলা হয় যে, সকল সংবাদপত্রে তিনজনের নাম অবশ্যই থাকতে হবে, যথা মুদ্রাকর, প্রকাশক ও সম্পাদক। ১৮২৩ সালে গভর্নর জেনারেল এডামসের এক অধ্যাদেশ বলে সংবাদপত্রে লাইসেন্স প্রথা প্রবর্তিত হয়। ১৮৩৫ সালে লাইসেন্স প্রথা রদ হলেও ১৮৫৭ সালে পুনরায় তা চালু হয়। অতঃপর ১৮৬০ সালে জারি হয় পেনাল কোড বা দন্ডবিধি আইন। মানহানি ও অশ্লীলতার বিষয় এ আইনে স্থান পায়। ১৮৭০ সালে তাতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়ও যুক্ত হয়। ১৮৯৮ সালে শ্রেণী শত্রুতা সৃষ্টির অপরাধের বিষয় এ আইনে সন্নিবেশিত হয়। ১৮৬৭ সালে প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অব বুকস অ্যাক্ট পাস হয়। এ আইনে সকল সংবাদপত্র এবং পুস্তকের কপি নিবন্ধীকরণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৭৮ সালে পাস হয় ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট। এ আইনে সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক সকল লেখার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার লাভ করে। ১৮৯৮ সালে ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড বা ফৌজদারি কার্যবিধি জারি হয়। এ আইনের কতিপয় ধারা সংবাদপত্রকে স্পর্শ করে। ১৯০৮ সালে নিউজপেপার (ইনসাইটমেন্ট টু অফেন্সেস) অ্যাক্ট পাস হয়। হিংসাত্মক রচনা প্রকাশিত হলে কাগজ সীজ করার ক্ষমতা এ আইনে ম্যাজিস্ট্রেটকে দেওয়া হয়। ১৯১০ সালে পাস হয় প্রেস অ্যাক্ট। রাষ্ট্রদ্রোহিতা, হত্যা প্রভৃতি অপরাধে উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী কোনো লেখা প্রকাশিত হলে সংশ্লিষ্ট ছাপাখানাকে তা জমা দিতে আদেশ দেয়ার অধিকার এই আইন সরকারকে দেয়। ১৯২২ সালে প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অব বুকস অ্যাক্ট, দি কাস্টমস অ্যাক্ট এবং পোস্ট অফিস অ্যাক্ট সংশোধন করা হয়। ওই বছর ১৯০৮ ও ১৯১০ সালের আইন দুটি রদ করা হয়। ১৯২৩ সালে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট পাস হয়। এ আইনে গোপনীয় সংবাদ প্রকাশ না হওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭৩ সালে দি প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স (ডিক্লেয়ারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট পাস হয়। এই আইনবলে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি দিতে পারেন। ১৯৭৪ সালে নিউজ পেপার এমপ্লয়ীজ (কন্ডিশন অব সার্ভিস) অ্যাক্ট পাস হয়। এ আইনে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র কর্মীদের সুযোগ-সুবিধার বিধান রাখা হয়। এছাড়াও স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪, অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট ১৯২৩, কপিরাইট অ্যাক্ট, কনটেম্পট অফ কোর্ট অ্যাক্ট, চিলড্রেন অ্যাক্ট, ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড প্রভৃতি আইন বাংলাদেশের সংবাদপত্রকে কোনো না কোনো ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স .ডিক্লেয়ারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন') 'অ্যাক্ট, ১৯৭৩ এ আইনটি সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে দায়িত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, সকল মুদ্রিত সংবাদপত্রের ওপর প্রকাশক ও মুদ্রণকারীর নাম এবং মুদ্রণ ও প্রকাশের স্থান স্পষ্টভাবে মুদ্রিত করতে হবে। ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার জন্য জেলা প্রশাসক সমীপে ঘোষণা দিতে হবে। ৬ ধারায় বলা হয়েছে, সংবাদপত্রের প্রতি কপিতে সম্পাদকের নাম থাকতে হবে। ৭ ধারায় বলা হয়েছে, সংবাদপত্রের মুদ্রণকারী এবং প্রকাশককে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি ঘোষণা দিতে হবে। ওই ঘোষণার তিন মাসের মধ্যে সংবাদপত্র প্রকাশ করতে হবে। দৈনিক সংবাদপত্র যদি তিন মাসের জন্য এবং অন্য সংবাদপত্র যদি ছয় মাসের জন্য বন্ধ থাকে, তবে আবার নতুন ঘোষণার প্রয়োজন হবে। ১০ ধারায় বলা হয়েছে, ডিক্লারেশনে বর্ণিত প্রকাশের স্থান, মেয়াদকাল ও ভাষা ব্যতিরেকে অন্য কোনো ভাষায় ভিন্ন স্থান থেকে ভিন্ন মেয়াদকালে সংবাদপত্র প্রকাশিত হলে ডিক্লারেশন বাতিল বলে গণ্য হবে; তবে এই পরিবর্তন অস্থায়ী ভিত্তিতে অনধিক ত্রিশ দিনের জন্য যেকোন একবার ঘটলে এবং এমন পরিবর্তনের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জেলা প্রশাসককে বিধি মোতাবেক অবহিত করলে, এই ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে না। ১১ ধারায় বলা হয়েছে, মুদ্রাকর বা প্রকাশক ছয় মাসের অধিককাল বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করলে, বাংলাদেশ ত্যাগের পূর্বেই তার অনুপস্থিতকালীন দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তির নাম এবং ওই ব্যক্তির সম্মতিসূচক বিবরণী লিখিতভাবে জেলা প্রশাসক বরাবরে দাখিল করতে হবে; অন্যথায় সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল বলে গণ্য হবে। ২০(ক) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সংবাদপত্র অশালীন বা অশ্লীল বক্তব্য প্রকাশ করলে সরকার সেই সংবাদপত্র বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। ২৬ ধারায় বলা হয়েছে, সকল সংবাদপত্রের চার কপি বিনামূল্যে সরকারের নিকট পেশ করতে হবে।
শিশু আইন, ১৯৭৪-এ ১৬ বছরের কম বয়স্কদের ‘শিশু’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, কোনো সংবাদপত্র এই আইনের নির্দেশিত শিশুর বিষয়ে কোনো কিছু প্রকাশ করবে না। ওই শিশুর নাম, ঠিকানা, শিক্ষালয় যেগুলির দ্বারা তার পরিচিতি প্রকাশ পেতে পারে সেগুলি প্রকাশ করবে না। তার ছবিও প্রকাশ করা যাবে না। তবে এ বিষয়ে অনুমতি গ্রহণ করা যেতে পারে।
প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪ ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এ আইন পাস হয়। এ আইন অনুযায়ী প্রেস কাউন্সিল গঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ১৮ আগস্ট। কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা পনের। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে কর্মরত আছেন কিংবা যিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিযুক্ত হবার যোগ্যতা রাখেন, কেবল তিনিই প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হতে পারেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তাকে মনোনয়ন দান করেন। অপর ১৪ জনের মধ্যে তিনজন হবেন কর্মরত সাংবাদিক; তিনজন সংবাদ সংস্থার সম্পাদক; তিনজন সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার মালিক বা ব্যবস্থাপক; তিনজন হবেন শিক্ষা, বিজ্ঞান, কলা, সাহিত্য ও আইন বিশেষজ্ঞ এবং দুজন হবেন সংসদ-সদস্য। কর্মরত সাংবাদিক, সম্পাদক এবং মালিক বা ব্যবস্থাপক তাদের নিজ নিজ সংগঠন দ্বারা মনোনীত হবেন। বিশেষজ্ঞদের তিনজনের মধ্যে একজন মনোনীত হবেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক, একজন বাংলা একাডেমী কর্তৃক এবং অবশিষ্ট জন বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক। স্পীকার দুজন সংসদ-সদস্যকে মনোনয়ন দান করেন। প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪ বাংলাদেশের প্রেস কাউন্সিলের ওপর নিম্নোক্ত ১২টি দায়িত্ব অর্পণ করেছে:
১.#সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা বা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কেউ নালিশ করলে তার বিচার করা। অবশ্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও কাউন্সিল সাংবাদিকতার নীতিভঙ্গজনিত অন্যায় তদন্ত করতে পারে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সংস্থাকে কাউন্সিল তিরস্কার, নিন্দা বা হুঁশিয়ার করতে পারে;
২.#সংবাদপত্র এবং সংবাদ পরিবেশকদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে সহায়তা করা;
৩.#উচ্চ পেশাগত মর্যাদার নিরিখে সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকদের জন্য আচরণবিধি গড়ে তোলা;
৪.#সংবাদপত্রসেবী বা সাংবাদিকরা যেন তাদের কাজে উঁচু মানের রুচি বজায় রাখেন এবং সেই সঙ্গে তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকেন তা নিশ্চিত করা;
৫.#সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও জনসেবার মনোভাব সৃষ্টিতে উৎসাহ দেওয়া;
৬.#জনস্বার্থ বা জনগুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবহন ও পরিবেশনে যাতে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখা;
৭.#সংবাদপত্র ও সংবাদক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বিদেশ থেকে কোনো সাহায্য নেয়, তবে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা;
৮.#জাতীয় এবং বৈদেশিক সংবাদপত্র এবং তাদের প্রচার ও প্রভাব সম্পর্কে গবেষণার ব্যবস্থা করা;
৯.#সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্পর্কে গবেষণার সুবিধা প্রদান;
১০.#টেকনিক্যাল এবং অন্যান্য গবেষণার ব্যবস্থা করা;
১১.#সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থা পরিচালনায় নিযুক্ত সকল ব্যক্তির মধ্যে কর্মরত পেশাভিত্তিক যোগসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা চালানো;
১২.#এসকল কাজের সহায়ক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
প্রেস কাউন্সিল তার দায়িত্ব সম্পাদনকালে কতিপয় বিষয়ে দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা ও অধিকার ভোগ করে। সাক্ষীদের সমন দেওয়া, কাউন্সিলে হাজির করা, জবানবন্দি গ্রহণ, দলিল তলব করা ও সেগুলি হাজির করতে বাধ্য করা, এফিডেভিটের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণ, অফিস-আদালত থেকে পাবলিক রেকর্ড তলব করা, সাক্ষীর জবানবন্দি ও দলিল পরীক্ষা করার জন্য কমিশন দেওয়া প্রভৃতি বিষয়ে প্রেস কাউন্সিলের অধিকার দেওয়ানি আদালতের সমান। তবে প্রেস কাউন্সিল কোনো সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, সাংবাদিক বা সম্পাদককে তাদের খবরের উৎস প্রকাশে বাধ্য করতে পারে না। প্রেস কাউন্সিলের কাজকে ‘বিচার কর্ম’ হিসেবে গণ্য করা হয়। সে কারণে প্রেস কাউন্সিলের সামনে কেউ মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে তিনি দন্ডনীয় অপরাধে অপরাধী হন। বিচার চলাকালে কাউন্সিলকে কেউ বাধা প্রদান করলে কাউন্সিল তাকে শাস্তি দিতে পারে।
প্রেস কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো আপিল নেই। এ বিষয়ে আদালতে কোনো মামলা করা যায় না। প্রেস কাউন্সিলের সকল সিদ্ধান্ত চেয়ারম্যান দ্বারা সত্যায়িত হয়; আর সব কিছু সচিবের স্বাক্ষরে কাউন্সিল থেকে জারি করা হয়। প্রেস কাউন্সিল আইন সরকারকে কতিপয় নির্দিষ্ট বিষয়ে রুল প্রণয়নের, কাউন্সিলকে রেগুলেশন প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছে।
সংবাদপত্র কর্মচারী .চাকুরির শর্ত') 'আইন, ১৯৭৪ বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে এ আইন পাস হয়। এ আইন দ্বারা ১৯৬০ সালের কর্মরত সাংবাদিক (চাকুরির শর্ত) অধ্যাদেশকে রহিত করা হয়। এ আইনে সংবাদপত্র কর্মচারী বলতে কর্মরত সাংবাদিক, প্রশাসনিক কর্মচারী এবং সংবাদপত্রের মুদ্রণ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বুঝানো হয়েছে। ৩ ধারায় বিধান দেওয়া হয়েছে যে, ১৯৬৯ সালের শিল্প-সম্পর্ক অধ্যাদেশের কর্মচারী সংক্রান্ত বিধানাবলি সংবাদপত্রের কর্মচারীদের ওপর প্রযোজ্য হবে। ৪ ধারায় সকল কর্মচারীকে, নিয়োগের সময় চাকুরির প্রকৃতি, নিয়োগের তারিখ ও শর্তাবলি উল্লেখসহ নিয়োগপত্র দানের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। ৫ ধারায় ‘বোর্ড অফ ট্রাস্টি’র পরিচালনাধীন প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে। ৬ ধারায় বলা হয়েছে, সাপ্তাহিক ৪৮ ঘণ্টার বেশি কোনো কর্মচারীকে সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থায় কাজ করতে বলা যাবে না। ৭ ধারায় কর্মরত সাংবাদিকের ছুটির বিধান প্রদত্ত হয়েছে। এতে মোট কর্মদিবসের ন্যূনপক্ষে এগারো ভাগের এক ভাগ সবেতন অর্জিত ছুটি, অন্যূন আঠারো ভাগের এক ভাগ অর্ধবেতনে অসুস্থতাজনিত ছুটি এবং বছরে দশ দিন পূর্ণ বেতনে নৈমিত্তিক ছুটি প্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে। ৮ ধারায় সংবাদপত্র কর্মচারীদের চিকিৎসা সুবিধার বিধান দেওয়া হয়েছে। রুলে নির্ধারিতভাবে প্রত্যেক সংবাদপত্র কর্মচারী এবং তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গ চিকিৎসা সুবিধা পাবেন। ৯ ধারা মোতাবেক সংবাদপত্র কর্মচারীদের বেতন-হার নির্ধারণের জন্য সরকার অফিসিয়াল গেজেট-বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বেতন বোর্ড গঠন করতে পারবেন। ১০ ধারায় সংবাদপত্র কর্মচারীদের বেতনের হার নির্ধারণের নিরিখ বর্ণিত হয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয়, সরকার বা কর্পোরেশন বা বেসরকারী খাতে সমতুল্য চাকুরিতে প্রচলিত বেতনের হার, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংবাদপত্র শিল্পে বিরাজিত অবস্থা এবং অন্যান্য পরিস্থিতি বেতন-হার নির্ধারণ প্রশ্নে বিবেচনায় আসবে। ১১ ধারায় বলা হয়েছে, যে তারিখে বেতন বোর্ডের সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে সেই তারিখ থেকে এক মাসের মধ্যে বোর্ডের সিদ্ধান্ত সরকারি গেজেটে প্রকাশ করতে হবে। ১২ ধারায় বিধান দেয়া হয়েছে যে, ৯ ধারা অনুযায়ী গঠিত বোর্ড শ্রম আদালতের সমতুল্য ক্ষমতার অধিকারী হবে এবং একই কার্যবিধি অনুসরণ করবে। ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থার সঙ্গে যুক্ত সকল নিয়োগকর্তা বোর্ডের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য। বোর্ড যে বেতন নির্ধারণ করবে, কোনো নিয়োগকর্তা সংবাদপত্র কর্মচারীকে তার কম বেতন দিতে পারবে না। ১৪ ধারায় বোর্ডকে অন্তবর্তীকালীন সময়ের জন্য বেতনের হার নির্ধারণ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যে সংবাদপত্র সংস্থায় বিশ জন বা ততোধিক কর্মচারী নিযুক্ত আছেন, সেই সংবাদপত্র সংস্থার ক্ষেত্রে কর্মচারী নিয়োগ (স্থায়ী আদেশ) আইন প্রযোজ্য হবে। ১৬ ধারায় বর্ণিত হয়েছে যে, অন্য আইন বা চুক্তি যাই থাকুক না কেন এই আইনের বিধান কার্যকর হবে। তবে পূর্বের কোনো চুক্তি অনুযায়ী সংবাদপত্রের কর্মচারী যদি কিছু অধিক সুবিধা ভোগ করে আসতে থাকেন, সেক্ষেত্রে এই আইনের অধীন সুবিধা গ্রহণ দ্বারা তার ওই অধিকার নষ্ট করা যাবে না। ২০ ধারায় সরকারকে এই আইনের অধীনে বিধি প্রণয়নের অধিকার দেওয়া হয়েছে। শ্রমঘণ্টা, ছুটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠন, বেতন হার নির্ধারণের জন্য বেতন বোর্ডের কার্যবিধি প্রভৃতি বিষয়ে সরকার বিধি প্রণয়ন করতে পারবেন।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৯ ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৯ সালে এ বিষয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি হয় (১৯৭৯ সালের ২০ নং অধ্যাদেশ)। অধ্যাদেশের ৩ ধারায় এর উদ্দেশ্য কার্যকর করার জন্য সংবাদ সংস্থা প্রতিষ্ঠা এবং তার প্রকৃতি বিবৃত হয়েছে। ৪ ধারায় বিবৃত হয়েছে এর কার্যপরিসর। ৫ ধারায় সংস্থার দায়িত্বের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। দেশ এবং বিদেশ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করা, সংগৃহীত সংবাদ দেশের মধ্যে প্রচার এবং বিদেশে প্রেরণ সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলি থেকে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংগ্রহ করা, অন্যান্য দেশের সংবাদ সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের সংবাদ বিনিময়ের ব্যবস্থা করা, সকল প্রকার সংবাদ এবং ফটো বা ফিচার বাংলাদেশের ভিতরে বা বাইরে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বা অন্য দেশের সংবাদ সংস্থার সঙ্গে সংবাদ আদান-প্রদান বিষয়ে চুক্তি সই করা এবং সংবাদ সংস্থাটিকে সুশৃঙ্খল পদ্ধতির মধ্যে আনার চেষ্টা করা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার দায়িত্ব। ৭ ধারায় বলা হয়েছে, সংস্থার কার্যক্রম একটি বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হবে। বোর্ডে থাকবেন সরকার কর্তৃক নিয়োজিত চেয়ারম্যান, একজন ম্যানেজিং ডিরেক্টর, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে একজন ডিরেক্টর, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একজন ডিরেক্টর, ডাক মন্ত্রণালয় থেকে একজন ডিরেক্টর, সংবাদপত্রের সম্পাদকের মধ্য থেকে পাঁচজন ডিরেক্টর এবং সংস্থার কর্মচারীদের মধ্য থেকে একজন ডিরেক্টর। ১২ ধারায় বলা হয়েছে, সংস্থার একজন ম্যানেজিং ডিরেক্টর থাকবেন। তিনি হবেন সংস্থার প্রধান সম্পাদক। তাকে সরকার নিয়োগ করবে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর সংস্থার সার্বক্ষণিক কর্মকর্তারূপে কাজ করবেন। ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি অনুদান বা ঋণ এবং গ্রাহক প্রদত্ত ফি, দান প্রভৃতি থেকে ফান্ড সংগৃহীত হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে দুটি সংবাদ সংস্থা কাজ করছে। প্রথমটি হচ্ছে বাংলদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস), দ্বিতীয়টি ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি)। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি ইউএনবি দেশের কোম্পানি আইনের অধীন। উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সী নামে একটি সংস্থা ১৯৭০ সাল থেকে কাজ করে আসছিল। আশির দশকের শেষদিকে সেটি অবলুপ্ত হয়।
আদালত অবমাননা আইন, ১৯২৬ এই আইন অনুযায়ী বিচারাধীন মামলার নিরপেক্ষ বিচারকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে কোনো প্রকাশনা প্রকাশিত হলে তা আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে। এছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের বিচার সংক্রান্ত ব্যাপারে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় মন্তব্য যদি দায়িত্বহীনভাবে নিরপেক্ষ সমালোচনার সীমা অতিক্রম করে এবং নির্দেশিত ও পরিকল্পিত পন্থায় বিচারকাজের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা বিনষ্ট করে এবং বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমে বিচারকদের বাধাগ্রস্ত করে এবং মৌলিক অধিকার বলবৎ করার পথে বাধা প্রদান করে বা সংবিধান পরিপন্থী কর্মের মাধ্যমে বৈষম্য সৃষ্টি করে, তবে তা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। যদি কোনো ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতিকে আক্রমণ করে অযৌক্তিকভাবে কোনো প্রবন্ধ লেখে ও প্রকাশ করে তাহলে সে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী হবে। যদি দেখা যায় যে প্রবন্ধটি আদালতের মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তাহলে তা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। তবে, জনস্বার্থে বিচার কার্যের নিরপেক্ষ ও যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা আদালত অবমাননা নয়।
আদালত অবমাননার শাস্তি কারাদন্ড, যার মেয়াদ ছয় মাস পর্যন্ত হতে পারে অথবা জরিমানা, যার পরিমাণ দুই হাজার টাকা হতে পারে অথবা উভয়ই। ক্ষমা প্রার্থনা করলে অবমাননার আসামীকে মুক্তি দেওয়া যায়।
ফৌজদারি কার্যবিধি ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ (ক) (খ) (গ) (ঘ) (ঙ) (চ) ধারায় সংবাদপত্র বিষয়ে সরকারকে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকারের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতামূলক বা বিদ্রোহের উসকানিমূলক বা নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণা সৃষ্টিকারী বা ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অবজ্ঞামূলক কোনো লেখা যদি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, তবে সরকার তার প্রত্যেকটি কপি বাজেয়াপ্ত করতে পারে এবং যে স্থানে ঐগুলি থাকে সেই স্থানে ম্যাজিস্ট্রেটের পরওয়ানামূলে পুলিশ যেতে পারে; তবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এ বিষয়টি হাইকোর্ট বিভাগের গোচরে আনতে পারে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৮ ধারায় বলা হয়েছে যে ম্যাজিস্ট্রেট সেইসব ব্যক্তিকে মুচলেকা দেবার আদেশ দিতে পারেন যারা রাষ্ট্রদ্রোহীতামূলক বা শ্রেণীর সংঘর্ষ সৃষ্টিকারক বা বিচারককে ভীতি প্রর্দশনমূলক বা অবমাননাকর কোনো কিছু প্রকাশ করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট সাংবাদিককে তার নির্দেশিত স্থানে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেন।
কপিরাইট অধ্যাদেশ, ১৯৬২ কপিরাইট স্বত্ব বা অধিকার। যিনি শ্রম ও কুশলতার মাধ্যমে নতুন কিছু রচনা করেন, তিনি তার সেই কাজে কপিরাইট পান। তবে যে কর্ম সংবাদপত্র, পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী প্রভৃতিতে চুক্তিমূল্যে বা শিক্ষানবিসিকালে কোনো রচয়িতা কর্তৃক ওই কাগজে প্রকাশের জন্য সম্পাদিত হয়, সেই কর্মের কপিরাইট শুধু ওই কাগজে প্রকাশের জন্য নিয়োগকর্তার থাকে। অন্য ব্যাপারে কপিরাইটের মালিক স্বয়ং রচয়িতা।
অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ এ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ স্থানে যদি কেউ যায় বা যেতে উদ্যত হয় কিংবা ওই স্থানের কোনো নকশা বা স্কেচ তৈরি করে বা কোনো গোপন তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশ করে তবে সে অপরাধী হবে। ৩ (ক) ধারায় বলা হয়েছে যে, নিষিদ্ধ স্থানের কোনো ফটো, স্কেচ বা নক্সা কেউ প্রকাশ করতে পারবে না। ৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো বিদেশী এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে খবর সংগ্রহ করা যাবে না। ৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি গোপনে কোনো সংবাদ পেয়ে থাকলে সেই সংবাদ প্রকাশ করতে পারবে না। কোনো সংবাদপত্র যদি কোনো গোপন সংবাদ প্রকাশ করে তবে প্রতিবেদক, সম্পাদক, মুদ্রাকর এবং প্রকাশক অপরাধী হবেন। এসব কাজে সহায়তা করা অপরাধ বলে গণ্য হবে। [আমিনুর রহমান সরকার]