রসায়ন
রসায়ন বিভিন্ন অংশ বা উপাদানে পদার্থের গঠন এবং নির্দিষ্ট অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সংঘটিত পরিবর্তনসমূহ সম্পর্কিত বিজ্ঞান। এই বিষয়টির বিভিন্ন শাখা রয়েছে। জৈবরসায়ন রসায়নের একটি শাখা, যা কার্বন যৌগসমূহ নিয়ে আলোচনা করে। অজৈব রসায়ন কার্বন যৌগসমূহ ব্যতীত অন্যান্য সকল উপাদান এবং তাদের যৌগসমূহের বর্ণনা, ধর্ম, প্রতিক্রিয়াসমূহ এবং প্রস্ত্তত প্রণালী সম্পর্কে আলোচনা করে। ভৌতরসায়ন রাসায়নিক প্রপঞ্চ (Phenomena) এবং প্রতিক্রিয়াসমূহের মাত্রিক ব্যাখ্যা ও এ ধরনের ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্ত পরিমাপ সম্পর্কিত আলোচনা করে। রসায়নের এই শাখাটি নির্দিষ্টভাবে অণুর গতি এবং প্রায়শই গ্যাসীয় ও তরল পদার্থসমূহের উপর তাপমাত্রা ও চাপের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করে।
ব্রিটিশ আমলে বাংলায় একটি আধুনিক বিষয় হিসেবে ১৮৪০-এর দশকের প্রথম দিকেই কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের রসায়ন বিষয়ে শিক্ষাদানের সূত্রপাত ঘটে। ঔষধ সংক্রান্ত বিজ্ঞানের একটি কোর্সের অংশ হিসেবে এটি পড়ান হতো। ১৮৭২ সালের প্রথম মানবিক বিভাগের পরীক্ষায় একটি বিষয় হিসেবে রসায়নের অন্তর্ভুক্তি ঘটে। অবশ্য রসায়ন বিষয়টি সম্পর্কে আগ্রহ সীমিত পর্যায়েই ছিল এবং শুধুমাত্র অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান বিষয়টির ওপর একটি কোর্স পরিচালনা করতো। প্রকৃতপক্ষে কলকাতা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ই ছিল একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা বিষয়টির শিক্ষা প্রদান অব্যাহত রেখেছিল। শুধুমাত্র এই প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ছাত্রছাত্রীদের নয়, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরও রসায়ন বিষয়ে শিক্ষাদানের অনুরূপ ব্যবস্থা ছিল। ড. ও’সাউঘনেসি ছিলেন ভারতবর্ষের এই প্রথমদিকের রসায়নবিদ। তিনি কেবলমাত্র রসায়ন শিক্ষাদানের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন না, উপরন্তু ভারতে তারবার্তা ব্যবস্থা প্রচলনের ক্ষেত্রেও তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। বেঙ্গল ফার্মাকোপিয়া নামক গ্রন্থের লেখক তিনি। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ঔষধসমূহের ব্যবহার ও প্রভাব সম্পর্কিত তাঁর ব্যক্তিগত অনুসন্ধান ভিত্তিক ব্যাপক প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
রসায়ন বিজ্ঞানে ১৮৬০-এর এবং ৭০-এর দশক পর্যন্ত সাধারণ ভারতীয়দের আগ্রহ সীমাবদ্ধ ছিল। বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষাদানের যথাযথ অবকাঠামোর অভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর শিক্ষাপ্রদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছিল।
রসায়ন গবেষণার বেশিরভাগই পরিচালিত হতো ঔষধ সম্পর্কিত বিজ্ঞানের প্রতি প্রচলিত আগ্রহের সূত্র ধরে। এক্ষেত্রে প্রথম দিকের গবেষকদের একজন ছিলেন কানাইলাল দে বাহাদুর, যিনি এ বিষয়টির উপর বিশেষ গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছিলেন। প্রথমে তিনি ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল এবং পরে কলকাতা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি দেশীয় গাছপালা এবং তার ঔষধি ব্যবহার সম্পর্কে গবেষণায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ১৮৮০ এবং ১৮৯০-এর দশকে ঔষধ সম্পর্কিত বিজ্ঞান সম্পর্কে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছিলেন মুদিন শেরিফ এবং রামচন্দ্র দত্ত। অবশ্য এ ধরনের রাসায়নিক গবেষণাসমূহ মূল রসায়ন বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বিষয়ভিত্তিক গবেষণার সূত্রপাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষক স্যার আলেকজান্ডার পেডলার, যিনি এ সম্পর্কিত ব্যাপক অনুসন্ধানকর্ম পরিচালনা করেছিলেন। এসবের ফলাফল সে সময়ের লন্ডনের জার্নাল অব দি কেমিক্যাল সোসাইটি এবং জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল-এর মতো খ্যাতনামা সাময়িকীগুলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের অবশ্য তখন উচ্চমানের গবেষণাকর্মে সহায়তা করার মতো প্রয়োজনীয় কোন সরঞ্জাম ছিল না। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে আচার্য প্রফুলচন্দ্র রায় প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের পর গবেষণা পরিচালনায় তাঁর উদ্যোগে অধিকতর সুসংবদ্ধ প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।
১৮৯৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন গবেষণাগারটি নতুন নির্মিত ভবনে অধিকতর প্রশস্ত স্থানে স্থানান্তরিত হয়। প্রফুলচন্দ্র ভারতে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র মাধ্যমে প্রচুর মণিক সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর এই নতুন আগ্রহের লক্ষ্য ছিল দুর্লভ দুষ্প্রাপ্য ভারতীয় ধাতুসমূহের বিশেষণ। পরবর্তীতে তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার করেন, যেটি ছিল মারকিউরাস নাইট্রেট-এর যৌগ। এই আবিষ্কার সম্পর্কিত প্রতিবেদন ১৮৯৫ সালের ডিসেম্বরে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’-এর একটি সভায় পঠিত হয়েছিল এবং পরের বছর তা প্রতিষ্ঠানটির পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই বছর জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল-এ রসায়ন শাস্ত্রের অন্য দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল: আলেকজান্ডার পেডলার এবং জ্যোতিভূষণ ভাদুড়ীর ‘নোটস অন দি অ্যাকশন অব নাইট্রিক অক্সাইড অন অ্যালকালিস’ এবং চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ী’র ‘অন ডাবল থায়ো-সালফেটস অব কপার এন্ড সোডিয়াম’।
মৌলিক গবেষণায় এসব প্রাথমিক সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আচার্য প্রফুল এবং তাঁর তরুণ গবেষক দল রসায়ন শাস্ত্রের তত্ত্ব ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাৎপর্যময় অবদান রাখতে আরম্ভ করেছিলেন। ফলত আচার্যের পরিচালনায় এবং প্রেরণায় ভারতীয় রসায়নের একটি যথার্থ চর্চার ধারা গড়ে ওঠে। তিনি এবং তাঁর সহকর্মিগণ মিলে ১৮৮৯-১৯০৬ সময়ের মধ্যে মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে সর্বমোট সাতাত্তরটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। এসময়েই তিনি ভারতের রসায়নশাস্ত্র চর্চার মূলানুসন্ধানের প্রতি আগ্রহান্বিত হয়ে উঠেছিলেন। ১৯০২ সালে এ ধরনের প্রথম প্রধান কাজ হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি-র প্রথম খন্ডটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এর মধ্যে আছে চরক ও সুশ্রুতায় বিবৃত রসায়ন, বাগভট-এর রসায়ন, ক্রান্তীয় (৮০০-১১০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং তান্ত্রিক (১১০০-১৩০০ খ্রিস্টাব্দ) যুগের রসায়ন, ‘রসার্ণবের’ রসায়ন (১৩০০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং ‘রসরত্নসমুচ্চয়ের’ রসায়ন। গ্রন্থটির দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে। প্রফুল রায়ের ভারতের রসায়ন শাস্ত্রের মূলানুসন্ধান সংক্রান্ত অভিসন্দর্ভ হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি-কে জাতীয় চেতনার একটি অত্যুত্তমধর্মী কাজ হিসেবে পরিগণিত।
১৯১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠা এবং রসায়নের প্রথম পালিত অধ্যাপক হিসেবে আচার্য প্রফুল রায়ের নিয়োগ এ বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ ও নতুন দিকের উন্মোচন ঘটিয়েছিল। ১৯৩০-এর দশকের মধ্যে ভারতীয়গণ বিষয়টির প্রায় সকল শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।
অন্যান্য অনেক দেশের মতো অজৈব রসায়ন বিষয়ক গবেষণা কিছু পরীক্ষাগারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং সীমিত সংখ্যক কর্মী এ কাজে রত ছিলেন। তা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে ভারতীয়দের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ছিল। প্রফুল রায়ের সূচনাকারী উদ্যোগ ছাড়াও কিছু সক্রিয় শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। এর মধ্যে ছিল প্রিয়দারঞ্জন রায় এবং পি.বি সরকারের পরিচালনায় কলকাতার, এইচ.বি ডানক্লিফের লাহোরের এবং আর.সি রায়ের পাটনার কেন্দ্রগুলি।
১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক এন. আর ধরের গবেষণা কর্ম ভিত্তিক ভৌত রসায়ন গবেষণার ধারাটি এই ক্ষেত্রের কয়েক জন প্রখ্যাত কর্মীর দ্বারা গৃহীত এবং আরও উন্নত হয়। এঁদের মধ্যে ছিলেন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্র নাথ মুখার্জী এবং এস.এস ভাটনগর। ভৌত রসায়নের প্রথম দিককার কর্মীরা আঠাল পদার্থের ওপর গবেষণায় ঐকান্তিকভাবে আত্মনিয়োগ করেন এবং রসায়ন শাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এসময় জৈব রসায়নের ক্ষেত্রেও অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ধর এবং তাঁর সহযোগিগণ দুধের জলীয় অংশ, রক্ত, আঠাল বৃক্ষনির্যাস ইত্যাদির মতো জৈব আঠাল পদার্থের গঠন, স্থায়িত্ব, ঘনীভবন, জলযোজন, শীতলীকৃত ঘনীভূতকরণের নীতি সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণাকার্য পরিচালনা করেছিলেন।
ধর, সেন এবং ঘোষ কর্তৃক শুলজ-হার্ডি সূত্রের পুনর্ব্যাখ্যা প্রদান এক্ষেত্রে একটি প্রধান তাত্ত্বিক অগ্রগতি সাধন করেছিল। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহ যেমন, বৈশেষিক রসায়ন (Analytical Chemistry) এবং পরবর্তীকালে প্রাণরসায়নেও তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। ১৯৩০ এবং ১৯৪০-এর দশকে ফলিত রসায়ন রসায়নশাস্ত্র শিক্ষায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন শিক্ষা কোর্স ক্রমান্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োগধর্মী বিষয়ে পরিণত হয়, যার ফলে ফলিত রসায়নকে একটি পৃথক বিভাগে উন্নীত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। এর কয়েক বছর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাসায়নিক প্রকৌশল (Chemical Engineering) বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। [মধুমিতা মজুমদার]
বাংলাদেশে রসায়ন চর্চা এ অঞ্চলে সাধারণ মানুষের জন্য রসায়ন শিক্ষার কোন আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল না, কিন্তু স্মরণাতীত কাল থেকে এখানকার মানুষ রসায়নের পদ্ধতিসমূহের ব্যবহারের সাথে পরিচিত ছিল। আরহেনিয়াস তাঁর কেমিস্ট্রি ইন মডার্ন লাইফ গ্রন্থে এ অঞ্চলে ধাতুর ব্যবহার এবং বিশেষভাবে পারদঘটিত ঔষধের ব্যবহারের কথা উলেখ করেছেন, যা পি.সি রায়ও তাঁর গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। ধর্ম প্রচারকদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটতে শুরু করে দ্বাদশ শতকে। এ সময়ে সুফিসাধকগণ মানবজাতির কল্যাণে জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য শিক্ষায়তন গড়ে তোলেন। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে তখনও আলকেমিদের বিশ্বাসই প্রবল ছিল যে, কোন অমূল্যবান ধাতুকে সোনায় রূপান্তরিত করা সম্ভব।
নথিপত্র থেকে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে ব্রিটিশরা ঢাকায় ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য সর্বপ্রথম বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে। বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত বাংলাদেশে মহাবিদ্যালয় বা কলেজ ছিল মাত্র ১১টি। এখানে স্নাতক এবং স্নাতক নিম্ন পর্যায়ে রসায়ন পড়ানো হতো। এসব কলেজের অধিকাংশতেই রসায়ন বিষয়সহ বিজ্ঞানে স্নাতক কোর্স (বি.এসসি) ছিল, এ কোর্সটি একটি সমন্বিত কোর্স। এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি ছিল প্রধানত পদার্থবিজ্ঞান, গণিত এবং রসায়ন। ১৯১২ সালে ব্রিটিশ সরকারের নাথান কমিটি ঢাকায় অক্সফোর্ড এবং ক্যাম্ব্রিজের ধরনের একটি আবাসিক শিক্ষার ব্যবস্থা সম্বলিত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে। বিভিন্ন মহলের বাঁধা-বিপত্তি এবং প্রচুর যুক্তিতর্কের পর ১৯২০ সালে ভারতীয় আইন পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ (XVIII) পাস করে। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল অধ্যাদেশটিতে সম্মতি দান করেন ঢাকায় একটি শিক্ষা ভিত্তিক ও আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে ৪ বছরের বি.এসসি (সম্মান) ডিগ্রি প্রদান শুরু করেছে। বর্তমানে ৪ বছরের বি.এসসি (সম্মান) স্নাতকদের জন্য এম.এসসি কোর্সের সময়সীমা ১ বৎসর। অতীতে সম্মান পর্যায়ে ৩ বৎসরের জন্য রসায়ন শিক্ষা কোর্স ছিল এবং প্রাক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পরে ২ বৎসরের সাধারণ স্নাতক শিক্ষা ছিল। এম.এসসি কোর্সের সময়সীমা ১ বৎসর ছিল ৩ বৎসরের বি.এসসি (সম্মান) স্নাতকদের জন্য এবং ২ বৎসর ছিল বি.এসসি (পাস) স্নাতকদের জন্য। বি.এসসি (পাস) স্নাতকদের এম.এসসির চূড়ান্ত কোর্সে অংশগ্রহণের পূর্বে এম.এসসি (পূর্বভাগ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। চিকিৎসা, প্রকৌশল এবং কৃষি শিক্ষায় ডিগ্রি অর্জনের জন্য এবং অন্যান্য অনেক বিজ্ঞান বিষয়ক কোর্সের সম্পূরক বা অপ্রধান বিষয় হিসেবেও রসায়ন প্রয়োজনীয় পঠিতব্য বিষয়। কমবেশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ শিক্ষাক্রম নিয়ে ১৯৫৬ সালে দেশের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টি রাজশাহীতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও রসায়ন শাস্ত্র শিক্ষায় একই ধরনের কোর্স পদ্ধতি অনুসরণ করে। ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি রসায়ন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের অধীনে বি.এসসি, এম.এসসি এবং পিএইচ.ডি-তে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রী ছাড়াও সেখানে রসায়ন বিষয়ে এম.ফিল ও পিএইচ.ডি কোর্সের ছাত্রছাত্রীবৃন্দ রসায়নশাস্ত্র অধ্যয়ন করছে। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসমূহে রসায়নশাস্ত্র শিক্ষায় সম্মান এবং এম.এসসি পর্যায় রয়েছে। একইভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৭টি কলেজ রসায়নে সম্মান ও এম.এসসি ডিগ্রি প্রদান করছে এবং ২১৫টি কলেজে বি.এসসি পাস কোর্সের অধ্যয়নের ব্যবস্থা রয়েছে। মাত্র একটি বা দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানের সাথে সংশিষ্ট রসায়ন শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানত প্রাথমিক প্রাণরসায়ন ও ফার্মেসি শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে বর্তমানে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের শাখা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে পরিবেশ রসায়ন শিক্ষা সংযোজিত হয়েছে।
কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে ইন্সটিটিউট অব গ্রাফিক আর্টস, টেক্সটাইল কলেজ, লেদার টেকনোলজি কলেজ, গস এন্ড সিরামিক ইন্সটিটিউশন, কৃষি কলেজসমূহ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ এবং কারিগরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় রসায়নের কিছু প্রাথমিক বিষয়ের উপর কোর্স পরিচালনা করছে, বিশেষ করে যা এ সকল কর্মমুখী শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত। উচ্চমাধ্যমিক স্তরটি প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রাক স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার পর্যায় হিসেবে রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের অধীনে অনেক ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজে উচ্চমাধ্যামিক স্তরে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের আবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে রসায়ন অধ্যয়ন করতে হয়। মাধ্যমিক স্তরে বর্তমান শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার (এস.এস.সি) জন্য রসায়নের কিছু প্রাথমিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জিসিই ও এবং এ লেভেল রসায়ন কোর্স কিছু বিশেষায়িত ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা মাধ্যম ইংরেজি। আজকাল ভিডিও এবং সিডিরম ফরম্যাটের উন্নয়নের ফলে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় পদ্ধতিতে রসায়ন শিক্ষাপ্রদান সম্ভব। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষাগারের বাইরে থেকেও ব্যবহারিক রসায়ন শিক্ষা প্রদান সম্ভব। [এস.জেড হায়দার]
রসায়ন বিষয়ক পত্রিকা এবং সাময়িকী বিজ্ঞান সমিতিসমূহ, গবেষণা সংস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বর্তমান সময়ে গবেষণা ফলাফল প্রকাশ ও গবেষণা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সমিতিসমূহ এবং গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি কর্তৃক নিয়মিতভাবে রসায়ন বিষয়ক পত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশিত হয়।
রসায়নের যে কোন শাখার উপর মৌলিক গবেষণা সম্বলিত জার্নাল অব বাংলাদেশ কেমিক্যাল সোসাইটি নামক পত্রিকাটি ১৯৮৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি ইংরেজি ভাষায় বছরে দুবার (জুন এবং ডিসেম্বর) প্রকাশিত হয়। এছাড়া বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী, বাংলাদেশ বিজ্ঞান প্রগতি সমিতি, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিজ্ঞান সমিতি রসায়নসহ বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রের মৌলিক গবেষণাকর্ম প্রকাশ করে থাকে।
রসায়ন সাময়িকীগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম একটি হলো পুরোগামী বিজ্ঞান। এই ত্রৈমাসিক বিজ্ঞান পত্রিকাটি ১৯৬৪ সাল থেকে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) প্রকাশ করে আসছে। শিশুদের জন্য আর একটি সাময়িকী বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। বিজ্ঞান বিষয়ক এই ত্রৈমাসিকটি ১৯৬৬ সাল থেকে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। পত্রিকাটিতে রসায়নসহ বিজ্ঞানের সকল শাখার লোকপ্রিয় প্রবন্ধাবলী প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি’র সাময়িকী রসায়ন প্রথম ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় এবং বছরে দুবার নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে। সাময়িকীটির প্রধান উদ্দেশ্য হলো দেশের গণমানুষের মধ্যে রসায়ন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা বিশেষ করে বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। বাংলা একাডেমী বিজ্ঞান পত্রিকা একটি অর্ধবার্ষিক বিজ্ঞান পত্রিকা। পত্রিকাটি রসায়নসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপর মানসম্পন্ন রচনা, প্রবন্ধ প্রকাশ করে থাকে। [মোঃ রবিউল ইসলাম]