মীলাদ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৪৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

মীলাদ  আরবী মাওলিদ শব্দ থেকে মীলাদ। মাওলিদ মানে কোনো ব্যক্তির, বিশেষ করে নবী করীম হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মকাল, জন্মস্থান, জন্মদিন এবং জন্মোৎসব। জন্মকাল অর্থে মীলাদ শব্দের ব্যবহার হয়। এই উপমহাদেশে মাওলিদ শব্দের পরিবর্তে ‘‘মৌলুদ’’ বা ‘‘মৌলুদ শরীফ’’ আখ্যা প্রচলিত আছে। কিন্তু অধুনা মীলাদ শব্দটি বাংলাদেশে ব্যবহূত হয়। সাধারণত ১২ রবী’উল-আওয়াল তারিখে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন উপলক্ষে এই উৎসব উদযাপিত হয়। তবে, যেকোনো ব্যক্তির জন্মদিন,  বিবাহ, নতুন ব্যবসায়ের সূত্রপাত, গৃহনির্মাণ সমাপ্তি ইত্যাদি উপলক্ষেও বছরে যেকোনো সময় মীলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হতে পারে।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জাগতিক জীবন যে পরিবেশে অতিবাহিত হয় সেসব স্মৃতি-দৃশ্য মুলসমানদের নিকট সর্বদায় পবিত্রময় বিবেচিত হয়। এসব নিদর্শনের অন্যতম মক্কা নগরীর আধুনিক সূকু’ল - লায়ল মহল্লায় অবস্থিত সেই গৃহটি (মাওলিদু’ন-নাবী) যেখানে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ভূমিষ্ঠ হন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ গৃহখানির ওপর তেমন কোন গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। খলীফা হারুনূর রাশীদের মাতা খায়যুরান হিজরীর দ্বিতীয় শতকে সর্বপ্রথম এই ঘরটিকে সালাতের ঘরে রূপান্তরিত করেন। মুসলমানেরা যেভাবে মদীনায় নবী করীম (সা.)-এর রাওযা মুবারক যিয়ারত করতে যান, তেমনি তাঁর ভূমিষ্ঠ হবার স্থানে গমন করে ভক্তিশ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। এ ধরনের ভক্তিশ্রদ্ধা প্রদর্শনের হেতু কালক্রমে এ স্থানে যথাযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন প্রতিষ্ঠিত হয় (ইব্ন জুবায়র, রিহলা; পৃঃ ১১৪, ১৬৩)।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন পবিত্র দিবসরূপে উদযাপন করার লিখিত বিবরণ শুরু হয় বহুকাল পরে। সর্বপ্রথম ইব্ন জুবায়রের (মৃ ৬১৪/১২১৭) বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, নবী করীম (সা.)-এর জন্মদিনে একটি বিশিষ্ট উৎসব হতো যা’ ছিল ঘরে ঘরে অনুষ্ঠিত পারিবারিক উৎসব থেকে স্বতন্ত্র। এই উৎসবের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এই যে, মাওলিদগৃহ উৎসবের দিন আগন্তুকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেত এবং গৃহটি এই উপলক্ষে সারাদিন সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকত। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠানাদি সামগ্রিকভাবে প্রাচীন মুসলিম দরবেশদের অনুসৃত পদ্ধতি অনুসারে করা হতো।

পরবর্তীকালে মহানবী (সা.)-এর জন্মদিন উদযাপনের নবনব রীতি প্রচলিত হতে থাকে। ফলে, বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে বিভিন্নভাবে এই দিবস উদযাপিত হয়। মিসরে, ফাতিমী আমলের মাঝামাঝিকালে এবং শেষের দিকে, মাওলিদু-নবী অনুষ্ঠানের পূর্বাভাস দেখা যায়। কিন্তু মাওলিদের আদি উৎস সম্পর্কে মুসলিম গ্রন্থকারগণ যে ঐকমত্য প্রদান করেন তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মাওলিদ অনুষ্ঠান সর্বপ্রথম সুলতান সালাহু-’আদ-দীনের ভগ্নীপতি আল-মালিক আবূ সাঈদ মুজাফ্ফারু’দ-দীন কোকবুরী কর্তৃক প্রবর্তিত হয়।

৬০৪ হিজরীতে অর্থাৎ ১২০৭ খৃস্টাব্দে ইরাকের মুসেলের কাছে আরবালা নামক স্থানে ১২ই রবী’উল আউয়াল তারিখে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন উপলক্ষে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে মীলাদ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবন খাল্লিকান এই মীলাদ বা মাওলিদ অনুষ্ঠানের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। মূলত তাঁর বিবরণীর ওপর নির্ভর করে আরবালাতে অনুষ্ঠিত প্রথম মীলাদ অনুষ্ঠানের বিস্তারিত বিবরণ পরবর্তীকালে অন্যান্য লেখকও নিরবচ্ছিন্নভাবে দিয়ে আসছেন (যথা. আল-সুয়ুতী, হু‘সন আল-মাকসিদ ফী আমল আল-মাওলিদ)। আরবালাতে অবস্থানকালে কোক্বুরীর প্রস্তাবক্রমে ইব্ন দিহ্য়া তাঁর কিতাবু’ত - তানবীর ফী মাওলিদি’স সিরাজ রচনা করেন। এই গ্রন্থটি ‘মাওলিদ’ গ্রন্থরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

‘‘সালজূক’’ প্রতিক্রিয়ারূপী রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে গাযী সালাহু’-উদ-দীনের সময় মাওলিদ মিসরে প্রবর্তিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে মিসর হতে এই উৎসব উদযাপন রীতি মক্কায় প্রসারিত হয়। ফলে মক্কায় অনুসৃত এর প্রাচীন রূপের পরিবর্তন ঘটে এবং পবিত্র মক্কাতেও কতকটা একই আঙ্গিকে মসজিদে মাওলিদ উৎসব অনুষ্ঠিত হতে থাকে।

মীলাদ অনুষ্ঠানে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বর্ণাঢ্য, মহান জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয় এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থা আলোচিত হয়। পবিত্র আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতও তিলাওয়াত করা হয়। নবীজীর (সাঃ) প্রশংসামূলক না‘ত পরিবেশিত হয়। এছাড়াও ক্ষেত্র বিশেষে মৃত্যু সম্পর্কে ইসলামী মতাদর্শও আলোচিত হয়। না‘ত সাধারণত সমবেতকণ্ঠে পরিবেশিত হয়।

মাওলিদ পাঠ ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশের সর্বোৎকৃষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে বহু ব্যক্তি স্বীকৃতি প্রদান করে থাকেন। তাঁদের অভিমতে একটি ধর্মীয় প্রয়োজন মিটাবার তাকীদে এর উদ্ভব হয়েছে। সূফী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে এই চিন্তা-চেতনা প্রসার লাভ করে। তবে, সর্বযুগেই মুসলিম সমাজের আরবালাতে অনুষ্ঠিত মাওলিদের আদিকাল থেকেই এ ধারণার বিরোধিতা দেখা যায়। প্রতিপক্ষের মতে এই উৎসব একটি বিদ’আঃ অর্থাৎ নব উদ্ভাবিত প্রথা এবং সুন্নাতের পরিপন্থী। কিন্তু বহু মুসলিম রাষ্ট্রে, বিশেষ করে এই উপমহাদেশে, জনগণের ধর্মীয় জীবনে মীলাদ সুপ্রতিষ্ঠিত আসন লাভ করায় এই অনুষ্ঠানে অনেক ’আলিমের সমর্থন লাভ করে। তাঁরা এই বিদ্’আতকে নীতিগতভাবে ‘‘বিদ’আঃ হাসানা’’-রূপে স্বীকৃতি দেন। তাঁদের অভিমতে, মীলাদ সাধারণ্যে প্রচার লাভ করার ফলে কতগুলি সৎকাজ আনুষঙ্গিকভাবে সম্পন্ন হয়। যথা, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, সুন্নার আলোচনা, নবী করীম (সা.)-এর জন্ম উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশ, তাঁর উদ্দেশ্যে দরূদ ও সালাম পেশ, দান-খয়রাত ও দরিদ্রজনকে আহার্য দান। বিরুদ্ধবাদীগণের অভিমতে, মীলাদে, সমা‘, সুফীগণের নৃত্য (তুরস্কে) এবং ভাবোচ্ছ্বাসমূলক অনৈসলামিক ক্রিয়াকলাপের জন্য এ অনুষ্ঠান পরিত্যাজ্য। তাঁরা একথাও বলেন যে, এক শ্রেণীর লোক মীলাদে আবৃত্তিকে ব্যবসারূপে গ্রহণ করে এবং এমন অলৌকিক কল্পকাহিনী বর্ণনা করে যাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রকৃত সীরত অলীক ও অবাস্তব কাহিনীর আড়ালে পড়ে যায়। কিয়ামের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে দাঁড়িয়ে সমস্বরে সালামমূলক কবিতা আবৃত্তি করারও তাঁরা ঘোর বিরোধী।

মীলাদ সম্পর্কিত এই দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছিল অষ্টম-নবম শতকে, কিন্তু পরবর্তীকালে তা কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। ওয়াহ্হাবীগণের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দ্বন্দ্ব পুনরায় নবজীবন লাভ করে।

মীলাদ সম্পর্কিত মতানৈক্য সত্ত্বেও বাংলাদেশে দেওবন্দপন্থী হানাফী ব্যতীত সকল হানাফীগণ মীলাদকে অতি শুভ অনুষ্ঠানরূপে গ্রহণ করেছেন। (অবশ্য, আহল-ই-হাদীস সম্প্রদায়ও মীলাদ অনুষ্ঠানকে বিদ’আত এবং এর কিয়ামকে অসিদ্ধ মনে করেন)। ফলে ১২ই রবী’উল-আওয়াল ছাড়াও কোন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান উদ্বোধনকালে, নূতন গৃহে প্রবেশকালে, সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে, কারও মৃত্যু হলে, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্ম বা মৃত্যুদিবসে, বিবাহ অনুষ্ঠানে মীলাদ-এর আয়োজন করা হয়। রববুল ‘আলামীনের দোয়া কামনার মধ্য দিয়ে মীলাদ অনুষ্ঠান শেষ হয় এবং উপস্থিত লোকদের মধ্যে মিষ্টি বা অন্য খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করা হয়।

বাংলাদেশে সাধারণত পুরুষ ও মহিলাদের পৃথক পৃথক মীলাদ অনুষ্ঠিত হয়। তবে, মহিলারা পৃথক কক্ষে অবস্থান করে পুরুষদের মীলাদেও অংশগ্রহণ করে থাকে। মীলাদে কবি শেখ সা‘দী (র.) রচিত বিশ্ববিখ্যাত না‘ত (বালাগাল-উলা বি-কামালিহি ... ... ... সাল্লু আলাইহি ওয়ালিহি), কবি  গোলাম মোস্তফা রচিত নবীজীবনীর প্রাসঙ্গিক অংশ এবং জাতীয় কবি  কাজী নজরুল ইসলাম রচিত না’তও পরিবেশন করা হয়।  [সৈয়দ আশরাফ আলী]