মাহমুদ, শহীদ আলতাফ
মাহমুদ, শহীদ আলতাফ (১৯৩৩-১৯৭১) সঙ্গীতশিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বরিশাল শহরে তাঁর জন্ম। তাঁর প্রকৃত নাম এ.এন.এম আলতাফ আলী। তাঁর পিতার নাম নিজাম আলী। ১৯৪৮ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি কিছুদিন বিএম কলেজে অধ্যয়ন করেন; পরে কলকাতার আর্ট স্কুলে ছবি অাঁকা শেখেন।
শৈশব থেকেই সঙ্গীতের প্রতি আলতাফ মাহমুদের অনুরাগ প্রকাশ পায়। তাঁর কণ্ঠ ছিল দরদ আর আমেজপূর্ণ। বরিশাল জেলা স্কুলে অধ্যয়নকালেই তাঁর সঙ্গীতচর্চা শুরু হয় এবং অল্প বয়সেই তিনি নিজের প্রচেষ্টায় গণসঙ্গীত আয়ত্ত করেন। বিভিন্ন জলসা-অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করে তিনি প্রশংসা অর্জন করেন। বিখ্যাত বেহালাবাদক সুরেন রায়ের নিকট তিনি সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেন।
১৯৫০ সালে আলতাফ মাহমুদ ঢাকা এসে ‘ধূমকেতু শিল্পী সংঘ’-এ যোগদান করেন। পরে তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন এবং গণজাগরণের লক্ষ্যে বহু গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ ভাষা-শহীদদের উদ্দেশ্যে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত এ বিখ্যাত গানটি বর্তমানে যে সুরে গাওয়া হয় তার রচয়িতা আলতাফ মাহমুদ। শহীদ দিবসের এ গানের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের জনগণের হূদয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
১৯৫৬ সালে ভিয়েনায় আয়োজিত শান্তি সম্মেলনে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি করাচি পর্যন্ত গিয়েছিলেন, কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করায় তিনি আর যেতে পারেননি। ওই সময় তিনি দেশে না ফিরে ১৯৬৩ পর্যন্ত করাচিতেই অবস্থান করেন। সেখানে তিনি ওস্তাদ আবদুল কাদের খাঁর নিকট উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম নেন। কিছুকাল নৃত্যশিল্পী ঘনশ্যাম ও গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সঙ্গেও তিনি কাজ করেন। করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে ১৯৬৫ সালের দিকে তিনি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ শুরু করেন এবং তানহা, ক্যায়সে কহুঁ, কার বউ-সহ উনিশটি ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এর পাশাপাশি তাঁর সাংগঠনিক তৎপরতাও অব্যাহত থাকে। এ সময় তিনি ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’সহ অনেক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বিভিন্ন সভা-সমিতিতে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন।
বাংলা সংস্কৃতির বিকাশের জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছেন, আলতাফ মাহমুদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। অঙ্কন শিল্পেও তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি দেশাত্মবোধক গান রচনা ও পরিবেশনার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী জনগণকে গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর সেসব গান তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ ও খাদ্য দিয়েও তিনি প্রত্যক্ষ্যভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করেন। ওই বছর ৩০ আগস্ট পাকবাহিনীর লোকেরা তাঁকে তাঁর ঢাকার বাসস্থান থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। দেশের সংস্কৃতিচর্চা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত করে।
[মোবারক হোসেন খান]