মথ
মথ কীটপতঙ্গদের Lepidoptera বর্গের দুটি বড় দলের একটি। নানা ধরনের শুঙ্গ (সাধারণত আগা গদাকৃতি নয়), নিশাচর বা গোধূলিচর স্বভাবের জন্য এগুলি প্রজাপতি থেকে পৃথক। অধিকাংশ মথের আছে সামনের ডানার সঙ্গে পেছনের ডানা সংযোগকারী একটি কাঁটা, ফ্রেনুলাম (frenulum)। দিবাচর, উজ্জ্বল রঙের সরু ও পাতলা প্রজাপতির তুলনায় মথরা অনুজ্জ্বল ও অনাকর্ষী, শরীর ভারী, ওড়ে গোধূলি বা রাতের বেলায়। অবশ্য লম্বাটে গড়নের উজ্জ্বল রঙের মথও আছে।
মথদের আকারে বৈষম্য রয়েছে। বৃহত্তম মথদের একটি, লুনা মথের (Attacus atlas) ছড়ানো ডানার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ সেমি, আর পাতা-খনক (leaf miner) ক্ষুদ্রতমদের ৩ মিমি। সমুদ্র ছাড়া মথেরা আছে পৃথিবীর সর্বত্র। অন্যান্য পতঙ্গের মতো মথের শরীরও মাথা, বক্ষ ও উদরে বিভক্ত। মাথায় আছে শুঙ্গ, চোখ এবং সাইফনিং ধরনের মুখোপাঙ্গ। দুচোখের মাঝখান থেকে উঁচানো এক জোড়া শুঙ্গ, প্রায়শ ফিলিফর্ম। শুঙ্গ বাতাসের রাসায়নিক পদার্থ সম্পর্কে অত্যন্ত সংবেদী। পুরুষ মথ স্ত্রী মথের শরীর থেকে নিঃসৃত ফেরোমোনের ‘গন্ধ’ অনেক দূর থেকেও টের পায়।
ফুলের পরাগায়ণে কয়েক প্রজাতির মথের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাতে যেসব ফুল ফোটে তারা পরাগায়ণের জন্য নিশাচর মথের ওপরই সাধারণত নির্ভরশীল। মানুষের উপকারী মথের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত হলো রেশম মথ, যা রেশম উৎপাদন করে। বহু প্রজাতির মথের শুঁয়োপোকা প্রতিবছর ফসল ও বনের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। কোন কোন প্রজাতি পশমবস্ত্র ও অন্যান্য পশুজ সামগ্রী খেয়ে থাকে।
-
কডলিং মথ
-
এনাইম মথ
-
টাইগার মথ
-
তিল- হক মথ
মথের প্রজাতি সংখ্যা লক্ষাধিক এবং এগুলি বিভিন্ন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। নিচে বাংলাদেশে সচরাচর দেখা যায় এমন কয়েকটি মথ প্রজাতির নাম উল্লেখ করা হলো। Pyralidae: হলুদ মাজরা পোকা (Scirpophaga incertulas), কালো মাথা মাজরা পোকা (Chilo polychrysa), পাতা গুটানো পোকা (Cnaphalocrosis medinalis), চুঙ্গিপোকা (Nymphula depunctalis) ইত্যাদি ধানের ক্ষতিকর। আখের আগার মাজরা পোকা (Sciropophaga nievella), বেগুনের কান্ড ও ফলের মাজরা পোকাও (Leucinodes orbonalis) এই গোত্রভুক্ত। ধানের মিল মথ (Corcyra cephalonica) ও ইন্ডিয়ান মিল মথ (Plodia interpunctella) ধানের গুদামের অতি ক্ষতিকর দুটি প্রজাতি।
মথের বৃহত্তম গোত্র Noctuidae-এর সদস্যরা সবাই সাধারণত ফ্যাকাশে রঙের, তবে কোন কোনটির পেছনের ডানা রঙিনও হতে পারে। এক প্রজাতির শুঁয়োপোকাকে ‘কাট ওয়ার্ম’ (Agrotis ipsilon) বলে এবং এরা কচি চারা কেটে নষ্ট করে। Helicoverpa armigera আরেকটি প্রধান ক্ষতিকর পতঙ্গ। লালচে মাজরা পোকা (Sesamia inferens) ধান, গম ও ভুট্টার ক্ষতিকর কীট। ছোট থেকে মাঝারি আকারের Arctiidae বা বাঘা মথের অনেকেরই ডানায় উজ্জ্বল রঙিন সাজ আছে। শুঁয়োপোকাদের শরীর লম্বা ও নিবিড় লোমে ঢাকা থাকে। পাটের শুঁয়োপোকা (Spilosoma obliqua), শনের মথ (Utethesia pulchella), ভেরেন্ডার মথ (Pericallia ricini) যথেষ্ট ক্ষতিকর।
Geometridae গোত্রের মথেরা পর্যায়ক্রমে শরীর ফাঁসের মতো শূন্যে তুলে সামনে চলে ও পরে সামনের পা বাড়িয়ে নিজের অবস্থান মজবুত করে। এদের কয়েক প্রজাতি দেশের বনবৃক্ষের ক্ষতিকর পতঙ্গ। Sphingidae (হক মথ/স্ফিঙ্কস মথ) গোত্রের মথেরা অধিকাংশ বেশ বড়, ভারি, গোধূলিচর বা নিশাচর। ওড়ে খুব দ্রুত। তামাক ও টমেটোর হর্ন ওয়ার্ম, তিলের হক মথ (Acherontia styx) ও Herse convolvuli হলো বাংলাদেশের হক মথকুলের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। Bombycidae গোত্রের রেশম মথ (Bombyx mori) থেকে বাণিজ্যিক রেশম উৎপন্ন হয়। এর লার্ভা কেবল তুঁতের পাতা খায় ও রেশমগুটি বোনে।
Saturniidae গোত্রে আছে অনেক বড় আকারের মথ। এদের ডানায় প্রায়শ স্বচ্ছ চোখসদৃশ ফোঁটা থাকে। শুঁয়োপোকারাও বেশ বড়, শরীরে আছে কাঁটার মতো ধারালো অনেকগুলি গুটিকা। পিউপা পর্যায় রেশমি গুটি তৈরি করে। Samia cynthia ricini ভেড়েন্ডার পাতা খায় ও রেশমি গুটি বানায়। Cricula trifenestrata হলো আমের শুঁয়োপোকা, একে আমের পাতা ঝরানো পোকাও বলে, আমের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর। [মোনাওয়ার আহমাদ]