ভূতাত্ত্বিক গঠন
ভূতাত্ত্বিক গঠন (Geological Structure) শিলার যে কোন ধরনের প্রাকৃতিক গঠন (যেমন, একটি ঊর্ধ্বভাঁজ অথবা শৈলশিরা), যেখানে তেল বা গ্যাসের সঞ্চয় থাকতে পারে। বাংলাদেশে বেশ কিছুসংখ্যক সম্ভাবনাপূর্ণ ভূতাত্ত্বিক গঠন রয়েছে, যেমন:
'রশিদপুর ভূতাত্ত্বিক' গঠন হবিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত একটি ঊর্ধ্বভাঁজ। এটি উত্তর-দক্ষিণে বিন্যস্ত এবং ৩৫ কিমি লন্বা ও ৭ কিমি চওড়া। এটি অসম যার পূর্বপার্শ্ব অপেক্ষাকৃত অধিক ঢালু (২২°-২৫°) এবং পশ্চিমপার্শ্ব আলতো (৮° থেকে ১২°)। ঊর্ধ্বভাঁজটির অক্ষ ত্রিপুরার তেলিয়ামুরা পৃষ্ঠ ঊর্ধ্বভাঁজের সঙ্গে গাঠনিকভাবে সমান্তরাল। রশিদপুর ভূতাত্ত্বিক গঠনে প্রকটিত ডুপিটিলা স্তরসমষ্টির পার্শ্বীয় ওলটপালট (flank reversal) দেখা যায়। এটি সম্ভবত অক্ষীয় বিস্তৃতি নির্দেশ করে।
ঊর্ধ্বভাঁজটির পূর্বপার্শ্ব একটি বড় ধরনের উত্তর-দক্ষিণ বিন্যস্ত চ্যুতি দ্বারা বেষ্টিত। চ্যুতির ফলে ঊর্ধ্বভাঁজটির (anticline) নিম্নের অংশটি (down thrown block) এর পূর্বপার্শ্বে অবস্থিত। কিছু আড়াআড়ি চ্যুতিও আছে এবং তাদের মধ্যে একটি ভূতাত্ত্বিক গঠনের মাঝ বরাবর চলে গেছে।
রশিদপুর ভূতাত্ত্বিক গঠনে শেল অয়েল কোম্পানি অনুসন্ধানমূলক কূপ খনন করে এবং ১৯৬০ সালে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। এটি ছিল ষাটের দশকের দিকে শেল অয়েল কোম্পানি কর্তৃক আবিষ্কৃত পাঁচটি বড় গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে প্রথমটি। রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের মোট প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মজুত ২,২৪২ বিলিয়ন ঘনফুট, যার মধ্যে ১,৩০৯ বিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলনযোগ্য। এই ভূতাত্ত্বিক গঠনে প্রায় ১,৩৮০ মিটার থেকে ২,৭৮৭ মিটার গভীরতার মধ্যে মোট ২টি গ্যাস জোন রয়েছে। গ্যাস জোনসমূহ মায়োসিন-প্লায়োসিন সময়ের অগভীর সামুদ্রিক পরিবেশে সৃষ্ট বেলেপাথরের আধারে গঠিত। বেলেপাথর আধারের ফাঁকা স্থান ও প্রবেশ্যতা খুব ভাল। খনন কাজ চলাকালে রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের অনেক গভীরে অধিচাপ (overpressure) অঞ্চল ধরা পড়েছে।
সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানী লিমিটেড (পেট্রোবাংলার একটি সম্পূরক প্রতিষ্ঠান) রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনা করে। ২০০১ সাল থেকে এই গ্যাসক্ষেত্র প্রতিদিন ৯০ মিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস উত্তোলন করছে।
ফেঞ্চুগঞ্জ ভূতাত্ত্বিক গঠন সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার একটি ঊর্ধ্বভাঁজ। সিলেট শহর থেকে ৪০ কিমি দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত। এটি ৯১°-৯২° পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২৪°৩০র্- ২৪°৩৭র্ উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভূগাঠনিকভাবে এটি মধ্য-সুরমা অববাহিকা এবং পূর্বের বলিত বলয়ের মধ্যে অবস্থিত। ফেঞ্চুগঞ্জ ভূগঠনটি সম্প্রসারিত এবং ৩০ কিমি লন্বা ও ৮ কিমি চওড়া। এটি একটি ওলটপালট চ্যুতিবেষ্টিত অসম উত্তর-উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিম বিন্যস্ত ঊর্ধ্বভাঁজ। পশ্চিমপার্শ্ব অপেক্ষা পূর্বপার্শ্ব অধিক ঢালু। পূর্বপার্শ্বের নতি ৩০° থেকে ৩৫°, অপরদিকে পশ্চিমপার্শ্বে নতি পরিবর্তন মাত্রা ২০° থেকে ২৫°। ফেঞ্চুগঞ্জ ঊর্ধ্বভাঁজটি মায়োসিন সময়ের ‘আপার মেরিন শেলের’ মানদন্ডে জালালাবাদ, কৈলাস টিলা ও বিয়ানীবাজার ঊর্ধ্বভাঁজসমূহের তুলনায় ‘ভূগাঠনিকভাবে ঊর্ধ্বে’ অবস্থিত। অবশ্য এটি ‘আপার মেরিন শেলের’ মানদন্ডে আটগ্রাম ঊর্ধ্বভাঁজের তুলনায় ‘ভূগাঠনিকভাবে নিম্নে’ অবস্থিত। এই ঊর্ধ্বভাঁজে প্লায়ো-প্লাইসটোসিন সময়ের ডুপিটিলা স্তরসমষ্টি প্রকটিত।
ভূতাত্ত্বিক গঠনটির ক্লোজার নতিমাত্রা ও চ্যুতিবেষ্টিত। ঊর্ধ্বভাঁজটির ব্যাপ্তি প্রায় ২০০ মিটার। ভূতাত্ত্বিক গঠনটি নবীন মায়োসিন সময়ের ‘আপার মেরিন শেল’ অবক্ষেপের পরে গঠিত হয়েছে।
ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রটি একটি মাঝারি আকৃতির গ্যাসক্ষেত্র এবং পেট্রোবাংলা ১৯৮৮ সালে এটি আবিষ্কার করে। তবে এটি হলো বাংলাদেশের গভীরতম কূপ, যার মোট গভীরতা ৪,৯৭৭ মিটার। এই গ্যাসক্ষেত্রে কিছু অবাণিজ্যিক তেলও পাওয়া যায়। বর্তমানে এই ক্ষেত্রটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
কৈলাস টিলা ভূতাত্ত্বিক গঠন সিলেট শহর থেকে ২০ কিমি দক্ষিণপূর্বে গোলাপগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। এই ভূতাত্ত্বিক গঠনটি বঙ্গীয় পুরঃখাতের বলিত বলয়ের পার্শ্বে অর্থাৎ সিলেট খাদের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থান করে। এটি উত্তরে সিলেট ভূতাত্ত্বিক গঠন, পূর্বে বিয়ানীবাজার এবং দক্ষিণে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা দ্বারা বেষ্টিত। এই ভূতাত্ত্বিক গঠনটিকে গিরিশিরার মাঝখানের সামান্য চাপা অংশ ফেঞ্চুগঞ্জ ঊর্ধ্বভাঁজটি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এই ঊর্ধ্বভাঁজটি ডুপিটিলা স্তরসমষ্টি সমেত ভূ-পৃষ্ঠে প্রকটিত। এটি একটি উত্তর-উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিম দিকে বিন্যস্ত অসম ঊর্ধ্বভাঁজ। একটি ঘাত চ্যুতি উত্তর দিকে সিলেট ভূতাত্ত্বিক গঠন থেকে কৈলাস টিলা ভূতাত্ত্বিক গঠনকে পৃথক করেছে। ভূতাত্ত্বিক গঠনটি ৬ কিমি লন্বা এবং ৩ কিমি চওড়া। পূর্ব পার্শ্ব অপেক্ষা পশ্চিম পার্শ্ব খাড়া।
এই ঊর্ধ্বভাঁজে কৈলাস টিলা গ্যাসক্ষেত্রটি অবস্থিত। এটি পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি ১৯৬২ সালে আবিষ্কার করে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্র। এখানে প্রমাণিত ও সম্ভাব্য গ্যাস মজুত ৩.৬৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট এবং উত্তোলনযোগ্য মজুত ২.৫২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের সঙ্গে এখানে প্রচুর পরিমাণে কনডেনসেটও পাওয়া যায়। ১৯৮৩ সাল থেকে অদ্যাবধি এই ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। অবাণিজ্যিকভাবে এই ক্ষেত্রের গভীরে খনিজ তেলও পাওয়া যায়।
তিতাস ভূতাত্ত্বিক গঠন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তিতাস নদীর তীরে অবস্থিত। ভূতাত্ত্বিক গঠনটি ভূগর্ভে উত্তর-দক্ষিণে বিন্যস্ত গন্বুজ সম ঊর্ধ্বভাঁজ। ভূ-পৃষ্ঠের নিচে প্রায় ৯৬০ মিটার গভীরতায় এই কাঠামোটির বহিস্থ ক্লোজার এলাকা ১৪ কিমি × ১৯ কিমি। এই ঊর্ধ্বভাঁজ অসম, যার পূর্বপার্শ্ব অপেক্ষাকৃত অধিক ঢালু। ঊর্ধ্বভাঁজটিতে কোনো চ্যুতি লক্ষ্য করা যায় না।
তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২৬০০ মিটার থেকে ৩১০০ মিটার গভীরতার মধ্যে মোট ১০টি গ্যাস জোন রয়েছে। গ্যাস জোনসমূহ ভুবন ও বোকাবিল স্তরসমষ্টির বেলেপাথরের আধারে অবস্থিত। গ্যাস জোনসমূহের একেকটির নেট পুরুত্ব ২৫ মিটার থেকে প্রায় ৬৫ মিটার পর্যন্ত এবং সম্মিলিত বা মোট নেট পুরুত্ব প্রায় ১৩০ মিটার। বেলেপাথরের গ্যাস আধারসমূহের ফাঁকা স্থান মান প্রায় ১৭% থেকে ২৪% এবং এতে গ্যাস সম্পৃক্ততা ৫৫% থেকে ৭০%।
১৯৬২ সনে শেল অয়েল কোম্পানি গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে। ১৯৬৮ সনে এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয় এবং বর্তমানে এই গ্যাসক্ষেত্র বাংলাদেশে গ্যাস চাহিদার সর্ববৃহৎ অংশ সরবরাহ করে থাকে। ১৯৯৪ সনের জুন মাস পর্যন্ত এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে ১১০৭ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়। তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে বর্তমানে ১১টি উৎপাদন কূপের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং ৩৫০ ব্যারেল কনডেনসেট উৎপাদিত হয়। [বদরুল ইমাম]
বিয়ানীবাজার ভূতাত্ত্বিক গঠন সুরমা অববাহিকার উত্তরপূর্বাংশে অবস্থিত। ১৯৮০-৮১ সালে বিয়ানীবাজার-১ কূপটি খননের মাধ্যমে গ্যাস আবিষ্কৃত হয়। ভূতাত্ত্বিক গঠনটি সমঊর্ধ্বভাঁজ, যার সরু চূড়া, খাড়া পার্শ্ব এবং জটিল স্ট্রাইক চ্যুতি আছে। সুরমা অববাহিকার অন্যান্য ভূকাঠামোর পাললিক অবক্ষেপের মতোই বিয়ানীবাজার ভূতাত্ত্বিক গঠনটিও বদ্বীপীয়, নদীজ ও সামুদ্রিক বালুরাশি, পলিকণা ও কর্দম শিলা দ্বারা গঠিত।
ভূগাঠনিকভাবে বিয়ানীবাজার ভূকাঠামোটি দুটি বৃহৎ শক্তির দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল, যার একটি পশ্চিম দিক থেকে সংকোচনশীল শক্তির মাধ্যমে ইন্দো-বার্মা ভাঁজ অঞ্চল গঠন করে এবং অপরটি উত্তরাংশের শক্তির উপাদানসমূহের মাধ্যমে শিলং ম্যাসিফের সঙ্গে ডাউকি চ্যুতি বরাবর একত্রিত হয়েছিল।
১৯৬০ সালে একক ভাঁজ সম্পন্ন ভূ-কম্পন উপাত্তের দ্বারা পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি সর্বপ্রথম এই বিয়ানীবাজার ভূকাঠামোটিকে চিহ্নিত করে এবং পরবর্তীতে ১৯৭৯-৮০ সালে প্রাকলা ভূ-কম্পন উপাত্তের দ্বারা এটি সম্পর্কে আরও অধিক নিশ্চিত হওয়া যায়। বিয়ানীবাজার ঊর্ধ্বভাঁজকে প্রাথমিকভাবে মামা-ভাগ্নে ঊর্ধ্বভাঁজ হিসেবেও গণ্য করা হয়, যার উত্তরদক্ষিণে ৩৫ কিমি দৈর্ঘ্যের ক্লোজারে ২১৩ মিটার ভূগর্ভে একটি আপার গ্যাস জোন আছে।
বিবিয়ানা ভূতাত্ত্বিক গঠন সুরমা অববাহিকার ১২ নম্বর ব্লকের অন্তর্ভুক্ত। এই ভূতাত্ত্বিক গঠনটির আকৃতি বিয়ানীবাজার ভূতাত্ত্বিক গঠনের অনুরূপ। রশিদপুর ঊর্ধ্বভাঁজের প্রায় ৩৫ কিমি উত্তরে উত্তরদক্ষিণ বরাবর বিবিয়ানা ভূকাঠামোটি চারিদিকে বিস্তৃত একটি ফাঁদ রূপে অবস্থান করছে। মায়োসিন সুরমা শিলাদল মজুত শিলার অংশ, যেখানে হাইড্রোকার্বনসমূহ ৬টি বালুকণা স্তরে বিভক্ত এবং প্রত্যেকটি স্তরই কর্দম শিলা দ্বারা পৃথকীকৃত। ছয়টি বালুকণা স্তরই প্রবীণ ভূবন স্তরসমষ্টিতে অবস্থান করে। এই ভূতাত্ত্বিক গঠনটির ক্লোজারের ধরন ট্রান্সগ্রেসনাল। সংযুক্তি সিয়ার চ্যুতির সঙ্গে অনুদৈর্ঘ্য চ্যুতির সংমিশ্রণের কারণে বিবিয়ানা ভূতাত্ত্বিক গঠনটির কেন্দ্র সম্ভবত বেশ জটিল।
[এম লুৎফার রহমান চৌধুরী]
হবিগঞ্জ ভূতাত্ত্বিক গঠন বঙ্গীয় পুরঃখাতের উত্তরপূর্বাংশ এবং সুরমা অববাহিকার দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত। এটি ত্রিপুরার বারামুরা ঊর্ধ্বভাঁজের উত্তরাঞ্চলীয় শীর্ষবিন্দু। মূলত হবিগঞ্জ ভূতাত্ত্বিক গঠন ও বারামুরা ঊর্ধ্বভাঁজের মাঝখানে একটি সামান্য চাপা অংশ রয়েছে। ভূতাত্ত্বিক গঠনটি সমমাত্রিক এবং দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব দিকে বিন্যস্ত।
হবিগঞ্জ ভূতাত্ত্বিক গঠনটির ভূ-কম্পন তথ্য ও কূপ তথ্য প্রমাণ করে যে, এটির ক্লোজার সম্পূর্ণ আলাদা। বারামুরা ঊর্ধ্বভাঁজসহ ভূতাত্ত্বিক গঠনটি বিরাট, প্রায় ১৩০ কিমি লম্বা। এখানে ডুপিটিলা স্তরসমষ্টির শিলাসমূহ প্রকটিত এবং অঞ্চলটি গড় সমুদ্র সীমা থেকে প্রায় ২০ মিটার উঁচু। ভূতাত্ত্বিক গঠনটির কোন পার্শ্বেই চ্যুতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না।
এই ভূতাত্ত্বিক গঠনটিতে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম উৎপাদনশীল গ্যাসক্ষেত্রটি অবস্থিত। পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি ১৯৬৩ সালে এটি আবিষ্কার করে। গ্যাসক্ষেত্রটি ১১ কিমি লম্বা এবং ৪.৫ কিমি চওড়া। বেলেপাথর আধারের ৩০% ফাঁকা স্থান ও প্রবেশ্যতা খুব ভাল। এখন পর্যন্ত এই ভূতাত্ত্বিক গঠনে ১০টি কূপ খনন করা হয়েছে। ‘আপার গ্যাস স্যান্ড’ স্তর ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১,২৫৫ মিটার থেকে ১,৫৮৫ মিটার গভীরতায় অবস্থিত। এই স্তরটি মিহি দানা বিশিষ্ট, পরিষ্কার, অসংহত এবং ভালভাবে বাছাইকৃত। ‘আপার গ্যাস স্যান্ড’ স্তরে কাদা মণিকের অপর্যাপ্ততা এবং গ্লুকোনাইট মণিকের উপস্থিতি নির্দেশ করে যে, এটি উচ্চ শক্তিসম্পন্ন উপকূলীয় বা উপকূলের কাছাকাছি অঞ্চলে অবক্ষেপিত হয়েছিল। বালির স্তর সৈকত বালির বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে। ‘আপার মেরিন শেল’ ‘আপার গ্যাস স্যান্ড’ স্তরের সীল হিসেবে কাজ করে।
হারারগঞ্জ ভূতাত্ত্বিক গঠন ভৌগোলিকভাবে মৌলভীবাজার জেলার পূর্বপার্শ্বে এবং ভূগাঠনিকভাবে সিলেট খাদের দক্ষিণে অবস্থিত। ঊর্ধ্বভাঁজটির উত্তর অংশ বাংলাদেশে এবং দক্ষিণ অংশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পড়েছে। এটি ৭০ কিমি লম্বা, যার মধ্যে ৩০ কিমি বাংলাদেশে। সর্বোচ্চ উচ্চতা ৩৩৫.৮৯ মিটার। ভূতাত্ত্বিক গঠনটির ভাঁজ সম্প্রসারিত এবং দুই দিকে ক্লোজার আছে, চূড়া সরু এবং দেখতে বাক্সের মতো। এটি অসম এবং পশ্চিমপার্শ্ব অপেক্ষা পূর্বপার্শ্ব খাড়া। কেন্দ্রটি আভ্যন্তরীণ শক্তির ফলস্বরূপ চারদিক থেকে পেষিত হয়েছে। ঊর্ধ্বভাঁজটির স্তরসমূহ খাড়া হওয়ার ফলে এটির মধ্যের অংশ ভূকম্পনীয়ভাবে ব্লাইন্ড। হারারগঞ্জ পাহাড়শ্রেণী অসংখ্য পাহাড়িয়া ছড়ার কারণে ব্যবচ্ছেদিত হয়েছে। পাহাড়িয়া ছড়াসমূহের নকশা মূলত প্রশাখী এবং ট্রেলিস ধরনের।
ঊর্ধ্বভাঁজটির কেন্দ্রে নবীন ভূবন স্তরসমষ্টি সবচেয়ে প্রবীণতম শিলা হিসেবে প্রকটিত। এটি বেলেপাথর সমৃদ্ধ এবং আড়াআড়ি স্তরায়ণ, ফ্লেসার স্তরায়ণ, উর্মিমালা এবং চ্যানেল অবক্ষেপে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কর্দমশিলাগুলি বালি বা সিল্ট পূর্ণ এবং অগভীর সামুদ্রিক পরিবেশে অবক্ষেপিত হয়েছিল।
বোকাবিল স্তরসমষ্টি সংগতভাবে নবীন ভূবন স্তরসমষ্টির উপর শায়িত এবং নিচের ও উপরের স্তর অপেক্ষা অধিক এঁটেল। হারারগঞ্জের চূড়ায় একটি তেল ও কয়েকটি গ্যাসক্ষরণ আছে। তেল এবং গ্যাসক্ষরণগুলি সাগরনাল ছড়ার শাখানদী ধলি ছড়ায় পাওয়া গেছে।
হাতিয়া ভূতাত্ত্বিক গঠন এটি বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব অংশে বৃহত্তর নোয়াখালী ও বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকা জুড়ে বিরাজ করছে। ভূগাঠনিকভাবে এটি বঙ্গীয় পুরঃখাতের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্ল্যাটফর্ম অংশে অবস্থিত। এটি বঙ্গীয় পুরঃখাতের সবচেয়ে অবনমিত ও গভীরতম অংশ। এখানে পাললিক শিলার পুরুত্ব ২০ কিমির বেশি। এটি একটি অসম ঊধর্বভাঁজ এবং এর পশ্চিম পার্শ্ব বেশ আলতো। পূর্ব পার্শ্বটি খাড়া এবং সম্ভবত চ্যুতি সম্বলিত। এই ঊর্ধ্বভাঁজের শাহবাজপুর এবং বেগমগঞ্জে অধিচাপ অঞ্চলের উপরে বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস পাওয়া গেছে। শাহবাজপুরে ‘আপার গ্যাস স্যান্ড’ স্তরটি বোকাবিল স্তরসমষ্টিতে এবং ‘লোয়ার গ্যাস স্যান্ড’ স্তরটি নবীন ভূবন স্তরসমষ্টিতে পাওয়া গেছে।
হাজীপুর ভূতাত্ত্বিক গঠন এটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার মধুপুরে তথাকথিত ‘হিঞ্জ জোনের’ উপরে অবস্থিত। স্ট্যানভ্যাক অয়েল কোম্পানির তদারকিতে ১৯৫৯-৬০ সালে হাজীপুর এলাকাটি একক ভাঁজ ভূকম্পনীয় জরিপের (single fold sysmic survey) আওতায় আসে। পরবর্তীতে প্রাকলা সাইসমোজ কর্তৃক গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণপশ্চিমার্ধে ১২ ভাঁজ বিশিষ্ট ভূকম্পনীয় জরিপ কার্য সমাধা করা হয়।
ভূকম্পনীয় জরিপ নবীন ওলিগোসিন স্তর ও মধ্য টারশিয়ারী স্তরের মধ্যে অসংগতি নির্দেশ করে। বরাইল শিলাদল সুস্থিত সোপান অঞ্চলে অবক্ষেপিত না হয়ে বরঞ্চ ‘হিঞ্জ জোনের’ কাছাকাছি ও অববাহিকা অঞ্চলে অবক্ষেপিত হয়েছিল। স্ট্যানভ্যাক অয়েল কোম্পানির একক ভাঁজ ভূকম্পনীয় জরিপের ওপর ভিত্তি করে ১৯৬০ সালে হাজীপুর কূপ-১টি ৩,৮১৬ মিটার গভীরতা পর্যন্ত খনন করা হয়েছিল। তবে এটি শুষ্ক কূপ হওয়াতে পরে পরিত্যক্ত হয়। [শেখ আমিনুল ইসলাম]
দক্ষিণ নিলা ভূতাত্ত্বিক গঠন কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার ২০°৫২´ থেকে ২১°০৭´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°০৮´ থেকে ৯২°১৮´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং বাংলাদেশ মূল ভূখন্ডের দক্ষিণপূর্বের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। উত্তর ১৭° পশ্চিম ও দক্ষিণ ১৭° পূর্ব দিকে বিন্যস্ত পাহাড় ও উপত্যকা ঊর্ধ্বভাঁজটির প্রতিনিধিত্ব করে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ উচ্চতা ২৬৬ মিটার। ঊর্ধ্বভাঁজটির উত্তর পার্শ্বে ভূমির বন্ধুরতা খুব কম এবং দক্ষিণ পার্শ্বটি আচমকা সমভূমির সাথে মিশে গেছে।
ঊর্ধ্বভাঁজটি সম্প্রসারিত, অসম এবং বাক্সের মতো। অনুদৈর্ঘ্য ও অনুপ্রস্থ বরাবর চ্যুতি থাকার কারণে ভূগঠনটি বেশ জটিল। প্রকটিত প্রবীণতম শিলা হলো নবীন ভূবন, যা প্রায় ৫৪৫ মিটার পুরু। প্রবীণ থেকে নবীন শিলা স্তরক্রমসমূহ হলো নবীন ভূবন, বোকাবিল, টিপাম এবং ডুপিটিলা স্তরসমষ্টিসমূহ। মূলত কর্দম শিলা এবং সামান্য বেলেপাথর শিলা ঊর্ধ্বভাঁজটিকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলেছে। এর অক্ষ উত্তর-উত্তরপশ্চিম ও দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব দিকে বিন্যস্ত। বঙ্গোপসাগর ঊর্ধ্বভাঁজটির পশ্চিম পার্শ্বের কিছু অংশ ও দক্ষিণ পার্শ্বের ক্ষয় করেছে।
এই ভূগঠনটি ক্রান্তীয় জলবায়ুর আওতাভুক্ত এবং বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাতের মুখোমুখি হয়। এলাকাটি ঘন জঙ্গলে আবৃত এবং গামা, চিটাগাং টিক, বাঁশ ও ঝোপে পূর্ণ। বন্য প্রাণীর মধ্যে হাতি ও বানর উল্লেখযোগ্য, তবে হরিণ ও শূকরও পাওয়া যায়। এলাকাটিতে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের মাধ্যমে অথবা ভাটার সময় সমুদ্র সৈকতের উপর দিয়ে জিপ চালিয়ে পৌঁছানো যায়।
ফেনী ভূতাত্ত্বিক গঠন ফেনী জেলার ফেনী পুলিশ স্টেশনের কাছে একটি ভূগর্ভস্ত ঊর্ধ্বভাঁজ। ফেনী শহর থেকে ঊর্ধ্বভাঁজটি ৮ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত। এটি ২০°৫০´-২৩°০০´ উত্তর অক্ষাংশ ও ৯১°২০´-৯১°২৯´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এই ঊধর্বভাঁজটি ভূকম্পনীয় জরিপের মাধ্যমে ধরা পড়েছে। এটি একটি ডিমের আকৃতির চ্যুতিবর্জিত সমমাত্রিক ঊধর্বভাঁজ। ভূতাত্ত্বিক গঠনটির ভাঁজের ব্যাপ্তি ২০০ মিটার। দক্ষিণ দিকের তুলনায় উত্তর দিক বেশি আলতো। এটি প্রায় ১২ কিমি লম্বা ও ৫ কিমি চওড়া।
ভূগাঠনিকভাবে ঊর্ধ্বভাঁজটি বঙ্গীয় পুরঃখাতের বলিত বলয় অর্থাৎ হাতিয়া খাদ এবং ত্রিপুরা পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত। ভূগঠনটির পূর্ব ও পশ্চিম পার্শ্ব সীতাকুন্ড ও বেগমগঞ্জ ঊর্ধ্বভাঁজের মধ্যবর্তী নিম্নভঙ্গ (syncline) দ্বারা বিচ্ছিন্ন। গাঠনিকভাবে এটি বেগমগঞ্জ ঊর্ধ্বভাঁজ থেকে প্রায় ১৫০ মিটার উচ্চে অবস্থিত। এই ঊর্ধ্বভাঁজটি বেগমগঞ্জ ঊর্ধ্বভাঁজের সমান্তরাল।
ঊর্ধ্বভাঁজটিতে দুটি কূপ খনন করা হয়েছে। ১৯৮১ সালে ৩,২০০ মিটার গভীরতায় পেট্রোবাংলা প্রথম কূপটি খনন করে। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে এই কূপটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কামতা ভূতাত্ত্বিক গঠন ঢাকা শহরের ২০ কিমি উত্তর-উত্তরপূর্বে গাজীপুর জেলায় অবস্থিত একটি ভূগর্ভস্থ ঊর্ধ্বভাঁজ। এটি কৈলাস টিলা ঊর্ধ্বভাঁজের মতো এত বড় নয়। এটি বাখরাবাদ ঊর্ধ্বভাঁজ থেকে প্রায় ৪৫ কিমি পশ্চিমে অবস্থিত। ভূগাঠনিকভাবে এটি মধুপুর গড়ের দক্ষিণে অবস্থিত। এলাকাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫-১০ মিটার উচ্চে অবস্থিত। প্লাইসটোসিন সময়ের মধুপুর কর্দম স্তরসমষ্টি এলাকাটিতে প্রকটিত। এখানে পৃষ্ঠ ভাঁজের কোন আলামত নেই। ভূ-অভ্যন্তরে ঊর্ধ্বভাঁজটির অস্তিত্ব ভূকম্পনীয় জরিপের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।
ভূতাত্ত্বিক গঠনটির আকৃতি পদচিহ্নের অনুরূপ। এটি একটি উভয় পার্শ্বে আলতো নতিমাত্রাসম্পন্ন প্রশাখী ঊর্ধ্বভাঁজ। এটি ১৩ কিমি লম্বা, ৪ কিমি চওড়া ও ব্যাপ্তি ২৮ মিটার। ভূতাত্ত্বিক গঠনটির অক্ষ উত্তরপূর্ব থেকে দক্ষিণপূর্ব দিকে বিন্যস্ত।
পেট্রোবাংলা ১৯৮১ সালে কূপটি খনন করে। অতিরিক্ত পানি প্রবাহের কারণে এই ছোট গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে উৎপাদন ১৯৯১ সালে স্থগিত হয়ে যায়। [এম.এ বাকী]
মহেশখালী ভূতাত্ত্বিক গঠন কক্সবাজার জেলার ২১°২৮´-২১°৪৫´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°০৫´-৯২°০১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। দ্বীপটির পূর্ব পার্শ্বে পাহাড়শ্রেণি একটি সামন্তরিক ক্ষেত্র তৈরি করে। পাহাড়শ্রেণিটি উত্তর-উত্তরপশ্চিম এবং দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব দিকে বিন্যস্ত। সর্বোচ্চ উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৬.২৬ মিটার।
ভূগাঠনিকভাবে ঊর্ধ্বভাঁজটি বঙ্গীয় পুরঃখাতের বলিত বলয়ের পশ্চিম পার্শ্বের অন্তর্গত। এটি একটি সাধারণ অসম ঊর্ধ্বভাঁজ। এর পূর্ব পার্শ্ব উত্তরপূর্ব দিকে ৭°-১০° নতিমাত্রায় শায়িত। অপরদিকে ঊর্ধ্বভাঁজটির পশ্চিম পার্শ্ব সরাসরি পশ্চিমদিকে ৩০°-৪০° নতিমাত্রায় শায়িত; উভয়ে মিলিতভাবে একটি অসমতা নির্দেশ করে। [মোঃ খুরশিদ আলম]
বাখরাবাদ ভূতাত্ত্বিক গঠন কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত। ঢাকা শহর থেকে পূর্বদিকে এর দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। ভূতাত্ত্বিক গঠনটি ভূগর্ভে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত প্রায় ৬৫ কিলোমিটার লম্বা ঊর্ধ্বভাঁজের এক অংশ জুড়ে অবস্থিত। এই ঊর্ধ্বভাঁজে তিনটি চূড়া বা কালমিনেশন রয়েছে এবং বাখরাবাদ ভূগঠনটি সর্বদক্ষিণে অবস্থিত কালমিনেশন ‘এ’ তে অবস্থিত। পরবর্তীতে উত্তরের দুটি কালমিনেশন ‘বি’ এবং ‘সি’-তে কূপ খনন করা হলে উভয় ক্ষেত্রেই গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে বিস্তারিত ভূগাঠনিক চরিত্রের বিশ্লেষণে জানা যায় যে, বাখরাবাদ ঊর্ধ্বভাঁজের উত্তরের দুটি কালমিনেশন (বি এবং সি) প্রকৃতপক্ষে দুটি পৃথক কাঠামোর সাক্ষ্য বহন করে। সে হিসেবে এই দুই স্থানে গ্যাস প্রাপ্তির কারণে দুটি পৃথক গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে, যথা মেঘনা এবং বেলাবো বলে গণ্য করা হয়।
বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্রটি ১৯৬৮ সনে শেল অয়েল কোম্পানি কর্তৃক আবিষ্কৃত হয় এবং ১৯৮৪ সন থেকে এই ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয়। ভূ-পৃষ্ঠের নিচে গ্যাসক্ষেত্রটির প্রায় ১৮২০ মিটার থেকে ২১৫০ মিটার গভীরতার মধ্যে চারটি গ্যাস জোন রয়েছে। এই গ্যাসজোনসমূহ বোকাবিল স্তরসমষ্টির বেলেপাথরের আধারে অবস্থিত, যাতে ফাঁকা স্থান বা পোরোসিটি মান প্রায় ১২% থেকে ২৪% (গড়ে ২২%) এবং গ্যাস সম্পৃক্ততা মান ৪০% থেকে ৮০% (গড়ে ৬৫%)।
১৯৯৪ সনের জুন মাস পর্যন্ত এই ক্ষেত্র থেকে ৩৭৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়। বর্তমানে বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্রে ৮টি উৎপাদন কূপের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ১৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং ১৬৫ ব্যারেল কনডেনসেট উৎপাদিত হয়।
পাথারিয়া ভূতাত্ত্বিক গঠন সিলেট খাদ অঞ্চলের একেবারে পূর্বের ঊর্ধ্বভাঁজ, ভারতের আসাম রাজ্যের সীমানার কাছাকাছি অবস্থিত। এই পাথারিয়া পাহাড় সারির পৃষ্ঠে জায়গায় জায়গায় তেল ও গ্যাসক্ষরণ হয়। এখানে পাঁচটি অনুসন্ধানমূলক কূপ খনন করা হয়েছে। তবে এখনো তেল বা গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ভূগঠনটি একটি সম্প্রসারিত অসম ঊর্ধ্বভাঁজ। এটি উত্তর থেকে উত্তর দক্ষিণ দিকে প্রায় ৫০ কিমি লন্বা। ঊর্ধ্বভাঁজটির পূর্ব পার্শ্বের কিছু অংশ এবং উত্তর ও দক্ষিণের বন্ধ হয়ে যাওয়া অংশ ভারতে অবস্থিত। ঊর্ধ্বভাঁজটির আলতো অক্ষীয় চূড়া প্রায় ১ কিমি প্রশস্ত এবং স্তরসমূহের নতিমাত্রা ২০০ পর্যন্ত। কিন্ত ঊর্ধ্বভাঁজটির পূর্ব ও পশ্চিম পার্শ্ব খুব খাড়া ও উল্লম্ব। সুরমা খাদের মধ্যে পাথারিয়া হলো গাঠনিকভাবে উন্নীত ভূতাত্ত্বিক গঠন। মধ্য ভূবন স্তরসমষ্টির অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ এবং আটগ্রাম ঊর্ধ্বভাঁজের চাইতে পাথারিয়া ঊর্ধ্বভাঁজটি যথাক্রমে ৩,৯০০, ২,৪০০ ও ১,৯০০ মিটার ভূগাঠনিকভাবে উচ্চে অবস্থিত (প্রত্যেকটি ৩০০±৩০ মিটার)। এখানে উল্লেখ্য যে, মধ্য ভূবন স্তরসমষ্টি পাথারিয়া ঊর্ধ্বভাঁজের চূড়ায় এবং অন্যান্য ভূগঠনগুলির ভূঅভ্যন্তরে অবস্থান করছে। মূলত পাথারিয়া ঊর্ধ্বভাঁজে নিওজিন সময়ের পুরু শিলাস্তর প্রকটিত। স্তরসমষ্টিগুলি নবীন থেকে প্রবীণক্রমে এই রকম: ডুপি টিলা, গিরুজান ক্লে, বোকাবিল ও ভূবন স্তরসমষ্টিসমূহ।
নবীনতম ডুপি টিলা স্তরসমষ্টি ঊর্ধ্বভাঁজটির উভয়পার্শ্বে ছোট ছোট টিলার সৃষ্টি করেছে, কিন্ত ঊর্ধ্বভাঁজটির কেন্দ্রে মধ্য ভূবন স্তরসমষ্টি প্রকটিত। পাথারিয়া ৫ কূপটি জামকান্দি নামক জায়গায় অবস্থিত পাথারিয়া ১,২,৩,৪ নম্বর কূপ থেকে প্রায় ৭ কিমি দক্ষিণে ঊর্ধ্বভাঁজটির চূড়ায় অবস্থিত। প্রায় ৫,০০০ মিটার গভীরে অবস্থিত ওলিগোসিন বড়াইল শিলাদল পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য ১৯৮৯ সালে এই কূপটি খনন করা হয়েছিল। কিন্ত কূপটি ৩,৪৩৪ মিটার গভীরে পৌঁছানোর পর সর্বমোট ৩৪০ দিকভ্রষ্ট হওয়ার ফলে পরবর্তীতে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। চীনা বিশেষজ্ঞরা পুনরায় কূপটিকে সোজা করতে ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে কূপটিকে অবশেষে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। পাথারিয়া ৫ কূপটি মাত্র ৪৮০ মিটার গভীরেই অধিচাপ বলয়ের সম্মুখীন হয়েছিল।
জৈন্তাপুর ভূতাত্ত্বিক গঠন দুটি ভিন্নধর্মী ভূতাত্ত্বিক গঠন- উত্তরের উত্থিত শিলং মালভূমি এবং দক্ষিণের অবনমিত সুরমা অববাহিকার মাঝখানে অবস্থিত। ভূতাত্ত্বিক গঠনটি উত্তরে খাসিয়া-জৈন্তা এবং শিলং মালভূমি, দক্ষিণে গোয়াইন খাদ, পূর্বে আটগ্রাম ঊর্ধ্বভাঁজ এবং পশ্চিমে গোয়াইন খাদ ও খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশ দ্বারা বেষ্টিত। এলাকাটি সংকীর্ণ পূর্ব-পশ্চিমে সম্প্রসারিত এবং পাহাড়ের মাঝে মাঝে জলাভূমি দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। ভূগাঠনিকভাবে এলাকাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথা: অঞ্চল ১- পশ্চিমের ডাউকি নদী এবং পূর্বের নালজুরি বাজারের মধ্যবর্তী এলাকা; অঞ্চল ২- পূর্বের নালজুরি ও আসামপারার মধ্যবর্তী স্থান; এবং অঞ্চল ৩- পশ্চিমের জৈন্তাপুর ও পূর্বের ডুপিগাঁও সহ সারি নদীর মধ্যবর্তী এলাকা।
জৈন্তাপুর ভূতাত্ত্বিক গঠনের প্রবীণ থেকে নবীনক্রমে প্রকটিত শিলাসমূহ হলো: সিলেট চুনাপাথর, কোপিলি শেল, বরাইল, ভূবন, বোকাবিল, টিপাম বেলেপাথর, গিরুজান ক্লে, ডুপিটিলা এবং ডিহিং স্তরসমষ্টিসমূহ।
জিঞ্জিরা ভূতাত্ত্বিক গঠন সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপের ভূতাত্ত্বিক গঠন। ভূতাত্ত্বিক গঠনটি সাধারণ এবং একটি ঊর্ধ্বভাঁজ দ্বারা নির্দেশিত। দ্বীপটি ঊর্ধ্বভাঁজের পূর্বপার্শ্বে অবস্থিত। দক্ষিণ পাড়ার পশ্চিম উপকূলে ঊর্ধ্বভাঁজটির অক্ষের সামান্য অংশের চিহ্ন পাওয়া যায়। অক্ষের প্রকটিত অংশটি উত্তর-উত্তরপশ্চিম ও দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব দিকে বিন্যস্ত এবং দ্বীপটির সঙ্গে প্রায় সমান্তরাল। দ্বীপটির উত্তরপশ্চিম উপকূলে একটি চ্যুতি আছে, যার অক্ষ দ্বীপটির অক্ষের সাথে প্রায় সমান্তরাল। চ্যুতিটি রিভার্স ধরনের, যার পূর্ব পার্শ্বটি উত্তোলিত (up thrown block) অংশ।
ঊর্ধ্বভাঁজটি অসম। পূর্ব পার্শ্বের অক্ষের কাছে শিলাস্তর সমূহের নতিমাত্রা পূর্বদিকে খুব আলতো (৩°-৫°), তবে আরও পূর্বে নতিমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে (১০°-১২°)। সিরাদিয়ার (ছেরাদিয়া) কাছে নতিমাত্রা ৩০° বা আরও বেশি। পশ্চিম পার্শ্বের খুব সামান্য অংশই সমুদ্রের উপরে প্রকটিত, যার নতিমাত্রা পশ্চমদিকে ৬০। একনতিক (monoclinal swing) দোলন ঊর্ধ্বভাঁজটিকে একটি বাক্সের মতো রূপ দিয়েছে।
ইনানী ভূতাত্ত্বিক গঠন কক্সবাজার জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত। এই ভূতাত্ত্বিক গঠনটি কক্সবাজার শহর থেকে ৫ কিমি দক্ষিণে ২১°৫´-২১°২৫´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°০´-৯২°১০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। এটি উত্তর-উত্তরপশ্চিম ও দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব দিকে বিন্যস্ত ছোট ছোট পাহাড় দিয়ে গঠিত। সর্বোচ্চ উচ্চতা প্রায় ৫৪.৮৬ মিটার। ভূ-গাঠনিকভাবে ইনানী ঊর্ধ্বভাঁজটি বঙ্গীয় পুরঃখাতের চট্টগ্রাম বলিত বলয়ের মধ্যে অবস্থিত। ভূগঠনটি বঙ্গোপসাগরের উপকূলরেখা বরাবর বিস্তৃত। উভয়দিকে ঊর্ধ্বভাঁজটি রেজুখালের মাধ্যমে দুইভাগে বিভক্ত হয়েছে। ঊর্ধ্বভাঁজটির দক্ষিণদিক নিচু বন্ধুরতা সম্পন্ন। এখানে ইনানী ভূতাত্ত্বিক গঠন দক্ষিণ নিলা ভূতাত্ত্বিক গঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
ইনানী একটি সংকীর্ণ ও সম্প্রসারিত ভূতাত্ত্বিক গঠন, যেখানে ঊর্ধ্বভাঁজটির উভয়পার্শ্বে টিপাম বেলেপাথর স্তরসমষ্টি খুবই খাড়া অঞ্চল গঠন করে। খাড়া অঞ্চলে সর্বাধিক ৭০° পর্যন্ত নতিমাত্রা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তবে চূড়া অঞ্চলে (crest) ৩° থেকে ১২° পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়। এখানে বোকাবিল স্তরসমষ্টি হলো সবচাইতে প্রবীণ প্রকটিত শিলাস্তর।
সীতাপাহাড় ভূতাত্ত্বিক গঠন পটিয়া ভূতাত্ত্বিক গঠনের পূর্বদিকে এবং বেলাসরি ও গিলাসরি ভূতাত্ত্বিক গঠনের পশ্চিমদিকে অবস্থিত। ঊর্ধ্বভাঁজটির উত্তরে চ্যাংগোটাং এবং দক্ষিণে বান্দরবান ঊর্ধ্বভাঁজসমূহ অবস্থিত। এটি উত্তরে ২০° পশ্চিম থেকে দক্ষিণে ২০° পূর্বদিকে বিন্যস্ত। ঊর্ধ্বভাঁজটি দক্ষিণ ১৮° পূর্বে ৬° নতিমাত্রায় শেষ হয়েছে। এটি লম্বায় ৪০ কিমি এবং এর খাড়া পশ্চিম পার্শ্বটি জায়গায় জায়গায় ওলটান (overturn) অবস্থায় আছে।
কর্ণফুলি নদী এই এলাকার প্রধান নদী। ঊর্ধ্বভাঁজটির অক্ষের অনুদৈর্ঘ্য বরাবর শিলছড়ি ছড়ার গতি এই এলাকার ভূরূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের একটি প্রধান দিক। ছড়াটি ঊর্ধ্বভাঁজের উপত্যকা বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। সাধারণত অক্ষের অনুদৈর্ঘ্য বরাবর তুলনামূলকভাবে নরম শিলা প্রকটিত থাকলে এই ধরনের উপত্যকার সৃষ্টি হয়।
সীতাকুন্ড ভূতাত্ত্বিক গঠন চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে পশ্চিম প্রান্তের অন্যতম ভূতাত্ত্বিক গঠন। চট্টগ্রাম জেলার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে ২২°৩৪´-২২°৪৩´ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৯১°৩৮´-৯১°৪১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে এর অবস্থান। এর উত্তরে ফেনী নদী, দক্ষিণে কর্ণফুলী নদী, পূর্বে হালদা নদী ও পশ্চিমে সন্দ্বীপ চ্যানেল। এই ভূতাত্ত্বিক গঠনটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০ কিমি ও প্রস্থ ৯০ কিমি।
সীতাকুন্ড ভাঁজ একটি দ্রাঘিত, অপ্রতিসম, বক্সজাতীয় দ্বি-ভঙ্গাক্ষনত উত্তলভঙ্গ। ভাঁজটির অক্ষ রেখা উত্তর-উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব মুখে ধাবমান, যা আঞ্চলিক আয়ামের (strike) সাধারণ প্রবণতার সমান্তরাল। উত্তলভঙ্গটির উভয় পার্শ্বদেশ এর দ্বি-ভঙ্গাক্ষনত প্রকৃতির কারণে উত্তরে ফেনী নদী ও দক্ষিণে কর্ণফুলী নদীর পাললিক সমভূমিতে গিয়ে মিশেছে।
ভূতাত্ত্বিক গঠনটির একটি মৃদু নতিশীল পূর্বপার্শ্ব ও খাড়া নতিশীল পশ্চিম পার্শ্বদেশ রয়েছে, যা আকস্মিকভাবে পাললিক সমভূমি দ্বারা কর্তিত হয়েছে। এই কর্তন উত্তলভঙ্গের সাধারণ আয়ামের সমান্তরাল রেখায় ধাবমান একটি বড় বিচ্যুতির কারণে ঘটেছে।
গঠনটির প্রকটিত পাললিক শিলা অনুক্রমে সার্বিক শিলালক্ষণে চট্টগ্রাম ও পাবর্ত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য ভূতাত্ত্বিক গঠনের চাইতে কোন পার্থক্য নেই। অবশ্য চূনাপাথর এর ব্যতিক্রম। সীতাকুন্ড ভূতাত্ত্বিক গঠন বেলেপাথর, কর্দম শিলা ও পলি শিলার একটি পুরু পাললিক স্তরক্রম ধারণ করছে। প্রকটিত অবক্ষেপের মোট পুরুত্ব প্রায় ৬৫০০ মিটার। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]