বেভারীজ, হেনরী
বেভারীজ, হেনরী (১৮৩৭-১৯২৯) ভারতে ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তা ও ইতিহাসবিদ। মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন আমলা-ঐতিহাসিক প্রগতিশীল ধারণা নিয়ে ভারতের ইতিহাস চর্চা করেছেন তাদের অন্যতম হেনরী বেভারীজ। লর্ড রিপন যখন ভারতের বড়লাট (১৮৮০-৮৪) তখন গ্লাডস্টোনীয় উদার নীতির প্রভাব ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতিতে এক স্থায়ীরূপ পরিগ্রহ করেছিল। বেভারীজকে এ ধারার সর্বোত্তম প্রতিনিধিরূপে গণ্য করা যায়।
বেভারীজ ১৮৩৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হেনরী বেভারীজের (১৭৯৯-১৮৬৩) সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। গ্লাসগোর রয়াল সার্কাস স্কুল ও এডিনবার্গ একাডেমিতে তিনি শিক্ষালাভ করেন। পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে কিছুকাল তাঁর লেখাপড়া বন্ধ থাকে। পরে পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে তিনি গ্লাসগো কলেজে ভর্তি হন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত হয় বেলফাস্টের কুইন্স কলেজে। তাঁর পিতা যখন দি ব্যানার অব উলস্টার পত্রিকার সম্পাদক, তখন ১৮৫৬ সালে তিনি এই কলেজে ভর্তি হন।
কুইন্স কলেজে অধ্যয়নকালে পরিবারের দারুণ আর্থিক অনটন লাঘবের জন্য বেভারীজ চাকরি খুঁজতে থাকেন। ব্রিটেনে তাঁর কর্মলাভের সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ। চাকরির সন্ধানকালে তিনি ভারতে কর্মজীবন শুরু করার চিন্তা করছিলেন। খুব সম্ভবত ১৮৫৫ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের নিয়োগ প্রক্রিয়াতে যে পরিবর্তন আনা হয়, তা বেভারীজকে প্রভাবিত করে। বেভারীজ ভারতে চাকরি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৮৫৭ সালের জুলাই মাসে নতুন প্রবর্তিত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার তৃতীয়টিতে অংশগ্রহণ করেন এবং পরীক্ষায় তিনি প্রথম হন। ১৮৫৭ সালের ৩১ আগস্ট তিনি সার্ভিসে যোগ দেন এবং ওই বছর ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত অভিমুখে রওনা হন। ১৮৫৮ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি কলকাতা পৌঁছেন।
বাংলায় পৌঁছার পর বেভারীজ ফোর্ট উইলিয়মে স্থাপিত কলেজে শিক্ষানবিশি কোর্স সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত করেন এবং ১৮৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ময়মনসিংহে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর পদে প্রথম নিয়োগ লাভ করেন। ময়মনসিংহ থেকে তাঁকে ১৮৬১ সালের সেপ্টেম্বরে ঝিনাইদহে, ১৮৬২ সালের জানুয়ারিতে যশোরে, এপ্রিলে নদীয়ায়, ১৮৬৩ সালের জানুয়ারিতে মেদিনীপুরে এবং ঐ বছর ফেব্রুয়ারিতে সিলেটে বদলি করা হয়। ১৮৬৩ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৬৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তিনি বৈদেশিক বিভাগে কর্মরত ছিলেন এবং বিশেষ কাজে তাঁকে মণিপুরে পাঠানো হয়। মণিপুর থেকে ফেরার পর ১৮৬৪ সালের নভেম্বরে তাঁকে কোচবিহারে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর নিয়োগ করা হয় এবং ১৮৬৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা, ১৮৬৭ সালের নভেম্বরে নোয়াখালী এবং ১৮৬৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে হুগলিতে বদলি করা হয়। বেভারীজকে ১৮৭০ সালের মার্চে বরিশালে, ১৮৭১ সালের মার্চে চট্টগ্রামে এবং ১৮৭১ সালের জুন মাসে পুনরায় বরিশালে বদলি করা হয়।
১৮৭৫ সালে বেভারীজ বিকল্প হিসেবে বিচার বিভাগে তাঁর চাকরি ন্যস্ত করার মত প্রকাশ করেন। ১৮৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে রংপুরে জেলা ও দায়রা জজ নিয়োগ করা হয়। ১৮৯৩ সালের ১৫ জানুয়ারি অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ পদে পাবনা, চবিবশ পরগণা, ফরিদপুর, বীরভূম, হুগলি ও মুর্শিদাবাদ জেলায় কর্মরত ছিলেন। ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার পর তিনি অবসর জীবনের প্রায় ৩৭ বছর ধরে ভারতের ইতিহাস, ভাষা, শাসক ও জনগণ সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন এবং এ বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯২৯ সালের ৮ নভেম্বর ৯২ বছর বয়সে লন্ডনে তাঁর মৃত্যু হয়।
বেভারীজ উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পিতামাতার নিকট থেকে গভীর সাহিত্যানুরাগ লাভ করেন। তাঁর পিতার রচিত Comprehensive History of India (৩ খন্ড, লন্ডন, ১৮৫৮-৬২) বেভারীজের মধ্যে ভারতের ইতিহাস ও জনগণ সম্বন্ধে বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করে। পরবর্তী কর্মজীবনে ভারতে অবস্থানকালে এবং অবসর জীবনে এ বিষয়ের ওপর তিনি বিরামহীনভাবে লিখে যান। বহু ভাষা শেখার প্রবণতাও তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। তাঁর মাতা জেমিমা ওয়াট (১৭৯৫-১৮৮৫) বহু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। এছাড়া অ্যানেট সুসানার সঙ্গে দ্বিতীয় বিবাহ তাঁর সাহিত্যকর্মে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।
অবশ্য বেভারীজের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা ও সাহিত্যিক পটভূমিগত ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও লেখক ও ঐতিহাসিক হিসেবে তাঁর আবির্ভাব বেশ বিলম্বে ঘটে। তাঁর স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘন ঘন বদলি ও অস্থিতিশীল পারিবারিক অবস্থা এজন্য দায়ী ছিল বলে মনে করা হয়। ১৮৬৯ সালে থিওলজিক্যাল রিভিউ পত্রিকায় ‘Christianity in India’ নামক প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে পদার্পণ করেন। ১৮৭০ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে তিনি কালরস টেমপারেন্স সোসাইটি আয়োজিত সভায় Life and Manners in Bengal বিষয়ে এক নিবন্ধ উপস্থাপন করেন। ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ১৮৭৩ সালে প্রকাশ পায়, যখন তিনি বাকেরগঞ্জ থেকে একটি তাম্রশাসন পাঠোদ্ধারের জন্য কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটিতে পাঠান। সোসাইটির জার্নালে (১ম খন্ড ১ম সংখ্যা, ১৮৭৬) তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ছিল ‘Were Sundarbans Inhabited in Ancient Times?’ এ সময় থেকে সরকারি কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি ইতিহাস বিষয়ে বহু প্রবন্ধ লেখেন এবং সেগুলি প্রধানত ক্যালকাটা রিভিউ, জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, জার্নাল অব দি রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড এবং এশিয়াটিক কোয়ার্টার্লি রিভিউতে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বশেষ প্রবন্ধ ‘Timur’s Apocryphal Memoirs’ এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয় (খন্ড ১৭, নতুন সিরিজ, ১৯২২)।
বেভারীজের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ District of Bakarganj: Its History and Statistics ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ The Trial of Maharaja Nanda Kumar, A Narrative of a Judicial Murder (১৮৮৬) একটি বির্তকমূলক বিষয়ের ওপর লেখা হয়। বিতর্কটি ছিল ওয়ারেন হেস্টিংস এর সময়ে নন্দকুমার এর বিচার ও ফাঁসির ব্যাপারটি নিয়ে। ‘Warren Hastings in Lower Bengal’ শীর্ষক প্রবন্ধে (ক্যালকাটা রিভিউ, খন্ড ৬৫, ৬৬, ৬৮, ১৮৭৭-৭৯) তিনি নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ সম্বলিত রায়ের কঠোর সমালোচনা করেন। তাঁর মতামতের তীব্র প্রতিবাদ আসে স্যার জেমস এফ. স্টিফেনের কাছ থেকে। স্টিফেন ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত তাঁর The Story of Nuncumar and the Impeachment of Sir Elijah Impey গ্রন্থে ইম্পে ও ওয়ারেন হেস্টিংসের কার্যক্রমের যথার্থতা প্রমাণে প্রয়াসী হন। বেভারীজ অবশ্য তাঁর মতে স্থির থাকেন এবং স্টিফেনের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে জার্নালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধগুলি একত্র করে উল্লিখিত The Trial of Maharaja Nanda Kumar গ্রন্থে সংকলন করেন। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত মার্টিনের Indian Empire গ্রন্থে ‘The Administration of Warren Hastings’ শীর্ষক অধ্যায়টি তাঁর রচিত। ১৮৯০ সালে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সমিতির বার্ষিক সভায় দেওয়া তাঁর ভাষণ ১৮৯১ সালে পৃথকভাবে ছাপা হয়।
১৮৯৩ সালে অবসর গ্রহণের পর বেভারীজ আরও ব্যাপকভাবে জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থাকেন। অবসর জীবনে তিনি আকবরনামা ও মাসির-উল-উমারা গ্রন্থদ্বয় ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন এবং আলেকজান্ডার রজার্স অনূদিত তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী গ্রন্থটি সম্পাদনা করেন। এ সকল মূল গ্রন্থের অনুবাদ ছাড়াও তিনি এ সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে বহুসংখ্যক প্রবন্ধ রচনা করেন।
বেভারীজ প্রণীত গ্রন্থাবলির আলোকে ঐতিহাসিক হিসেবে তাঁর মেধার পূর্ণ বিকাশ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া কঠিন। তবে ভারতীয় ইতিহাসের আকরগ্রন্থ কয়টির ইংরেজি অনুবাদ তাঁকে এ দেশের ইতিহাসতত্ত্বে একটি স্থায়ী আসন করে দিয়েছে। আকবরনামা ও মাসির-উল-উমারার উঁচুমানের অনুবাদ এবং তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরীর ফলপ্রসূ সম্পাদনার জন্য ভারত ইতিহাসের ছাত্র ও গবেষকরা চিরকাল তাঁর নিকট কৃতজ্ঞ থাকবে। তাঁর District of Bakarganj: Its History and Statistics গ্রন্থটিও আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। [দেলওয়ার হোসেন]
গ্রন্থাপঞ্জি William Beveridge, India Called Them, London, 1947; MD Hussain, 19th Century Indian Historical Writing In English, Calcutta, 1992.