বন্দ্যোপাধ্যায়, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন
বন্দ্যোপাধ্যায়, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন (১৮১৩-১৮৮৫) সমাজসংস্কারক, পন্ডিত, ভাষাতাত্ত্বিক, খ্রিস্টান মিশনারি। ১৮১৩ সালের ২৪ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। আর্থিকভাবে দরিদ্র হওয়ায় তাঁর পিতা তাঁর শিক্ষার সুব্যবস্থা করতে পারেননি। তবে কৃষ্ণমোহন প্রখ্যাত ডেভিড হেয়ারের স্নেহ ও সহায়তায় তিনি পটলডাঙা স্কুলে লেখাপড়া আরম্ভ করেন। এ স্কুল তাঁকে হিন্দু কলেজে পড়ার জন্যে একটি বৃত্তি (১৮২৪) দেয় এবং ১৮২৯ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে অধ্যয়ন করেন।
এ সময়েই (১৮২৬) হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও হিন্দু কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। হিন্দু কলেজে যোগদানের অল্পকালের মধ্যেই অধ্যাপনা এবং ১৮২৮ সালে তাঁর স্থাপিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনে একটি বিতর্ক সভায় দর্শন সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে চুম্বকের মতো তিনি তাঁর ছাত্রদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক রীতিনীতিসহ প্রতিটি বিষয়ে প্রশ্ন করার জন্যে তিনি তাঁর ছাত্রদের উৎসাহিত করেন।
কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি তাঁর ছাত্র না-হলেও ডিরোজিওর শিক্ষায় প্রবলভাবে প্রভাবিত হন। ফলে তিনি ও তাঁর বন্ধুরা হিন্দু সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, কুসংস্কারসমূহের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেন এবং চিরাচরিত ধর্মীয় জীবনধারা অনুসরণ করতে অস্বীকার করেন। প্রাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রভাবিত এ তরুণরা ‘নব্যবঙ্গ’ বা ‘ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী’ নামে পরিচিত হন। কার্যত এ গোষ্ঠীর নেতায় পরিণত হন কৃষ্ণমোহন। ‘ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী’ হিসেবে চিহ্নিত ও পরিচিত হলেও তাঁরা কেউ তখন আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করেননি; কিন্তু হিন্দু সমাজ তাঁদের ধর্মবিদ্বেষী ও খ্রিস্টান বলে আখ্যায়িত করতে আরম্ভ করেন। তাঁদের জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এবং সমাজরীতি বিরুদ্ধ চলাফেরার জন্যে রক্ষণশীল সমাজ ডিরোজিওকেই দায়ী করে। এ রক্ষণশীল সমাজের চাপে ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসে ডিরোজিও হিন্দু কলেজ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।এ অবিচারের প্রতিবাদে পরের মাসে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এনকোয়ারার নামে একটি ইংরেজি সাময়িকী প্রকাশ করেন।
এ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি তরুণদের বক্তব্য তুলে ধরেন এবং রক্ষণশীল সমাজ ও হিন্দু ধর্মের কঠোর সমালোচনা করেন। পরে তিনি ইংরেজি এবং বাংলায় আরও একাধিক সাময়িকপত্র প্রকাশ করেছিলেন।
এনকোয়ারার পত্রিকায় প্রকাশিত যেসব অংশ পাওয়া যায়, তা থেকে বোঝা যায় যে, তাঁরা ইংরেজি খুব ভালো করে শিখেছিলেন। সর্বোপরি, রক্ষণশীল সমাজের সব রকমের চাপ অগ্রাহ্য করার জন্যে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। পরে তাঁরা হিন্দু ধর্মকে অগ্রাহ্য করেন।
১৮৩২ সালের অক্টোবর মাসে কৃষ্ণমোহন আলেকজান্ডার ডাফের কাছে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ফলে তিনি পটলডাঙা স্কুলে তাঁর শিক্ষকতার পদ হারান। এতে অবশ্য দমে না-গিয়ে তিনি বরং উৎসাহের সঙ্গে অন্যান্যের মধ্যে ব্রজনাথ ঘোষ নামে একটি বালক, তাঁর স্ত্রী বিন্দুবাসিনী, তাঁর ভাই কালীমোহন ব্যনার্জি এবং জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দেন। উল্লেখ্য যে, জ্ঞানেন্দ্রমোহন বঙ্গদেশের প্রথম ব্যারিস্টার ছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের খ্রিস্টান হওয়ার ব্যাপারে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের ভূমিকা ছিল।
কৃষ্ণমোহন ১৮৩৯ সালে একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজকে পরিণত হন এবং ১৮৫২ সালে এ পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বিশপস কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে নিযুক্ত ছিলেন।
সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল সমাজ-সংস্কারক এবং সরকার যখন সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে, তখন তিনি তা সমর্থন করেন। স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে তিনি একাধিক বক্তৃতা দেন এবং পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের একজন প্রধান সদস্য। তাছাড়া, তিনি বেথুন সোসাইটি (১৮৫১), বঙ্গীয় সমাজ-বিজ্ঞান সভা (১৮৬৬), ভারত সংস্কার সভা (১৮৭০) এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বহুভাষাবিদ ও পন্ডিত। বাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজি ছাড়া, তিনি গ্রিক এবং হিব্রু ভাষাও শিখেছিলেন। প্রথম তিনটি ভাষায় ধর্ম, দর্শন, সমাজ, এমনকি বিজ্ঞান বিষয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান অবদান হলো: তেরো খন্ডে বিদ্যাকল্পদ্রুম (১৮৪৬-৫১) নামে একটি এনসাইক্লোপেডিয়া প্রকাশ। এটিই ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম বিশ্বকোষ। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে উপদেশকথা (১৮৪০), ষড়দর্শন সংবাদ (১৮৬৭), ঋগ্বেদ সংহিতা (১৮৭৫), রঘুবংশ (১৮৭৪), দ্য কুমারসম্ভব অব কালিদাস (১৮৬৭), ডায়ালগস অন দ্য হিন্দু ফিলোসফি (১৮৬১) এবং দি এরিয়ান উইটনেস (১৮৭৫) বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
১৮৬৭-৬৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন। ১৮৭৬ সালে এ বিশ্ববিদ্যিালয় তাঁকে ডক্টর অব ল সম্মানে ভূষিত করে। পরে ইংরেজ সরকার তাঁকে সিআইই উপাধি দেয়। তিনি রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন। ১৮৮৫ সালের ১১ মে তিনি মারা যান।
[গোলাম মুরশিদ]