পাহাড়পুর, প্রাকৃতিক কাঠামো
পাহাড়পুর (প্রাকৃতিক কাঠামো) জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে ৫কিমি পশ্চিমে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র গ্রাম, যেখানে হিমালয়ের দক্ষিণের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলায় অবস্থিত এ স্থানটির ভৌগোলিক অবস্থান ২৫°০´ উত্তর থেকে ২৫°১৫´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°৫০´ পূর্ব থেকে ৮৯°১০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। প্রায় ০.১০ বর্গ কিমি (১০ হেক্টর) এলাকা জুড়ে সপ্তদশ শতাব্দীর এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি অবস্থিত। গোটা নিদর্শনটি চতুর্ভুজ আকৃতির এবং এর প্রত্যেক বহিঃপার্শ্বের দৈর্ঘ্য ২৭৫ মিটার। প্রত্যেক দেওয়ালের পুরুত্ব ৪ মিটার এবং উচ্চতা ৩ থেকে ৪ মিটার।
জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু দ্বারা পাহাড়পুর বৈশিষ্টমন্ডিত। মে মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এখানে অধিকাংশ বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়ে থাকে। তাপমাত্রা, বায়ুর চাপ এবং বৃষ্টিপাতের পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করে এলাকাটিকে তুলনামূলকভাবে স্বল্প বৃষ্টিপাত বিশিষ্ট উষ্ণ গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু উপবিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এখানকার বার্ষিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭°সে থেকে ৩৯°সে-এর মধ্যে এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭°সে থেকে ১০°সে-এর মধ্যে বিরাজমান থাকে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই অল্প। মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমের মাসগুলিতে তা সুষমভাবে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২৫৪ মিমি পর্যন্ত পৌঁছায়। মে এবং অক্টোবর মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১২৭ মিমি হয়ে থাকে। বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫০৮০ মিমি।
মৃত্তিকা পাহাড়পুরের মৃত্তিকাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়: বরেন্দ্রভূমির লোহিত বর্ণের মৃত্তিকা, স্বাভাবিক প্লাবনমাত্রার ঊর্ধ্বে উত্থিত পললভূমির হাল্কা দোঅাঁশ মৃত্তিকা, এবং বৃষ্টিপাতের দ্বারা গভীরভাবে প্লাবিত ভূমির মৃত্তিকা। বরেন্দ্রভূমির লোহিত কর্দম অধিক পরিমাণে লৌহ ও চুনসমৃদ্ধ তবে এতে সিলিকাসমৃদ্ধ পদার্থের ঘাটতি রয়েছে। শীতকালীন ধান এই মৃত্তিকা সমৃদ্ধ এলাকার একমাত্র চাষকৃত ফসল।
নদীতীর বরাবর এলাকার মৃত্তিকা অধিক মাত্রায় পলল সমৃদ্ধ। পললভূমিতে পাট, হলুদ, ইক্ষু, আলু ও ধান চাষ করা হয়। জলাভূমির মৃত্তিকা সাধারণত কালো বর্ণের দোঅাঁশ এবং খুবই উর্বর।
কৃষি এই এলাকার বেশিরভাগই চাষের আওতাধীন, স্থানবিশেষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকায় প্রাকৃতিক গাছপালার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রধানত আউশ ও রোপা আমন ধানের চাষ করা হয়ে থাকে। উঁচু ভরাট ভূমি এবং বাড়িঘরের আশেপাশে শাকসবজি, কলা, বিভিন্ন ফলের গাছ, পান প্রভৃতি লাগানো হয় এবং আমন ধানের বীজতলাও এখানে তৈরি করা হয়। মোটামুটি ১০ শতাংশ জমিতে তিন ফসল, ৩৮ শতাংশ জমিতে দুই ফসল এবং ৪০ শতাংশ জমিতে এক ফসল ফলানো হয়ে থাকে।
ভূসংস্থান ও ভূ-প্রকৃতি পললভূমি বেষ্টিত সামান্য উত্থিত সোপান ভূমি দ্বারা গঠিত পাহাড়পুর, বরেন্দ্রভূমির ভূ-প্রকৃতি প্রদর্শন করে। চতুষ্পাশ্বের সমভূমি থেকে উত্থিত সোপানসমূহ ৮ মিটার থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে এবং তুলনামূলকভাবে এই ভূমি বন্যামুক্ত।
নিষ্কাশন ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্ষুদ্র, কর্তিত, অাঁকাবাঁকা নদী ও স্রোতধারা দ্বারা এলাকাটি উত্তমরূপে নিষ্কাশিত। পাহাড়পুরে কোন প্রকার প্রধান নদীর উপস্থিতি নেই। পুরাতন যমুনা, আত্রাই এবং অন্যান্য ছোট নদীগুলো পাহাড়পুর মঠ থেকে অনেক দূর দিয়ে প্রবাহিত। পশ্চিমে পুরাতন যমুনা নদী একাধিক অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ সৃষ্টি করে উত্তর-দক্ষিণে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়েছে। দক্ষিণে মঠ থেকে অনেক দুরে আত্রাই নদী প্রবাহিত হয়েছে। বহুসংখ্যক বাঁওড় এখানে দেখতে পাওয়া যায় যেগুলো মানব-সৃষ্ট খালের মাধ্যমে নদনদীর সঙ্গে যুক্ত।
ভূমিরূপ পাহাড়পুরের ভূমিরূপকে তিনটি এককে বিভক্ত করা যায়: (১) বরেন্দ্র সোপান, (২) তিস্তা সর্পিলাকার প্লাবনভূমি এবং (৩) ছোট যমুনা প্লাবনভূমি।
বরেন্দ্র সোপান প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার অধিকাংশ নিয়ে গঠিত এবং প্লাইসটোসিন যুগের মধুপুর কর্দম দ্বারা গঠিত একটি ধারাবাহিক উত্থিত ব্লকসারি এখানে বিদ্যমান। ছোট যমুনা এবং আত্রাই নদীগঠিত প্লাবনভূমি এই সোপানভূমিকে তিনটি প্রধান ব্লকে বিভক্ত করেছে। দুর্বল নিষ্কাশন ব্যবস্থা, উত্তমরূপে জারিত লোহিত এবং বাদামি বর্ণের মৃত্তিকা এই সোপানের বৈশিষ্ট্য।
তিস্তা সর্পিলাকার প্লাবনভূমি প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার উত্তরাংশ নিয়ে গঠিত। লোয়ার তিস্তা সর্পিলাকার প্লাবনভূমি থেকে ভূ-গাঠনিক (tectonic) উত্থানের ফলে এই ভূমির কিছুটা উত্থান ঘটেছে। একাধিক ছোট ছোট খাদের উপস্থিতির দ্বারা এই ভূমি মাঝে মাঝে বিরতিযুক্ত।
ছোট যমুনা প্লাবনভূমি প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার উত্তর-পশ্চিমাংশে এই ভূমিরূপের অবস্থান। ভূদৃশ্যে একটি চ্যুতি খাদ বিদ্যমান এবং বরেন্দ্র সোপানের সংলগ্ন অংশ পর্যন্ত এই প্লাবনভূমির পলি বিস্তৃত হয়েছে। ভূ-প্রকৃতি মোটামুটি সুষম, তবে স্থানীয়ভাবে চাষাবাদের জন্য একাধিক মানবসৃষ্ট প্লাটফর্ম দ্বারা বিরতিযুক্ত। নদীজ সঞ্চয়ন প্রধানত পলিময় এবং বালিময়। ছোট যমুনা সর্পিলাকার প্লাবনভূমির অববাহিকীয় পললসমূহ কর্দমময় এবং সচরাচর অবক্ষয়িত মধুপুর কর্দমের উপর অবস্থান করে। এই কর্দমের পুরুত্ব ১২ থেকে ২০ সেমি।
ভূতত্ত্ব বাংলাদেশের সোপান (shelf) এলাকায় পাহাড়পুর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি অবস্থিত। ভূ-গাঠনিক (tectonically) দিক থেকে এই ভূমি হিঞ্জ জোনের (Hinge zone) নিকটতম সক্রিয় বগুড়া ঢালের অন্তর্গত। ভিত্তিশিলাসমূহ একাধিক জালিকার ন্যায় ছেদিত চ্যুতিচিহ্ন দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। চ্যুতিগুলির উল্লম্ব স্থানচ্যুতির প্রবণতা হলো উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-উত্তরপূর্ব থেকে দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিম।
পাহাড়পুর কয়লাক্ষেত্রের প্রধান কাঠামোগত অববাহিকায় কতিপয় ঊর্ধ্বভাঁজ (anticlines) অথবা গম্বুজাকৃতি ভূমিরূপ এবং অধোভাঁজ অথবা খাদ দ্বারা সৃষ্ট অসমতলতা বিদ্যমান থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। আরও ধারণা করা হয় যে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে সক্রিয় চাপ প্রদানকারী শক্তির কারণে অক্ষীয় অঞ্চলটি (axial region) আন্দোলিত অথবা ঢেউ খেলানো।
প্লাইসটোসিন মধুপুর কর্দম স্তরসমষ্টির তুলনায় অধিক পুরানো কোন পলল পাহাড়পুরে দৃশ্যমান হয় না। তবে, বগুড়া ঢালসহ সুস্থিত সোপান (stable shelf) অঞ্চলের ভূগর্ভে প্রিক্যামব্রিয়ান ভিত্তিশিলার উপরে পার্মিয়ান যুগ থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত বয়সের পাললিক শিলা বিদ্যমান।
ভূকম্পনীয় অঞ্চল বিবেচনায় পাহাড়পুর এলাকাটি জোন-২ এ অবস্থান করছে যেখানে ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ তীব্রতা ৮ এবং বেসিক ভূকম্পনীয় সহগ ০.০৫ নির্দেশিত।
[সিফাতুল কাদের চৌধুরী]