পাট্টা
পাট্টা একটি অতি পুরানো ভূমি বন্দোবস্তের চুক্তিপত্র, যার আওতায় রাষ্ট্রের পক্ষে খাজনা আদায়ের এজেন্ট হিসেবে জমিদারগণ কতিপয় শর্তসাপেক্ষে রায়তদের নিকট লিখিতভাবে ভূমি বরাদ্দের প্রস্তাব করতেন। অপরদিকে সংশ্লিষ্ট প্রজা বা রায়ত উল্লিখিত শর্তে জমি বন্দোবস্ত গ্রহণে রাজি কি-না সে বিষয়ে লিখিত সম্মতি বা কবুলিয়ত প্রদান করতেন। পাট্টার শর্তগুলির মধ্যে জমির সীমানা বা চৌহদ্দি, জমির পরিমাণ, গুণগত মান, লিজ বা বরাদ্দের মেয়াদ, খাজনার হার এবং খাজনা প্রদানের পদ্ধতি লিপিবদ্ধ থাকত। একজন কৃষক পাট্টা পেলে এবং কবুলিয়ত দিলে তিনি পাট্টাধারী রায়ত হিসেবে পরিচিত হতেন। পাট্টাধারী রায়তদের নিকট থেকে খাজনা আদায়ের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োজিত একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি ছিল যাদেরকে বলা হতো পাটোয়ারি।
একদিক থেকে পাট্টাদার রায়তদের একটা সুবিধা ছিল যে তারা রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগকৃত এজেন্টদের নিকট পাট্টা মোতাবেক ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি খাজনা প্রদান করতেন এবং পাট্টা ও কবুলিয়তে উল্লিখিত সময়ে নির্ধারিত খাজনা অপরিবর্তিত থাকত। বাংলাদেশে প্রায় সব অঞ্চলেই কৃষকরা ছিল খুবই ক্ষুদ্রচাষি এবং বাড়ি-ঘরগুলি ছিল বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা। সুতরাং এসব চাষিদের নিকট থেকে সাধারণত স্থানীয়ভাবে পরিচিত প্রধান, প্রামাণিক, বসুনিয়া, চৌধুরী, মোকাদ্দাম, মাতববর ইত্যাদি নামে পরিচিতদের মাধ্যমে খাজনা আদায় করা হতো। স্থানীয়ভাবে এদের পদবি যাই হউক না কেন, তাদের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে খাজনা আদায় করা এবং রায়তদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। পাটোয়ারিদের মাধ্যমে তাকাবি বা কৃষি ঋণ বিতরণ ও আদায়ের ব্যবস্থা করা হতো। গ্রাম প্রধানগণ সরকারের নিকট থেকে গ্রামবাসীর পক্ষে একটি সাধারণ পাট্টা গ্রহণ করতেন এবং গ্রামবাসীরা তার ক্লায়েন্ট বা খাতক হিসেবে পরিচিত ছিল। এই পাট্টা গ্রাম প্রধানদের একটি বিশেষ মর্যাদা দিত এবং এই মর্যাদা খাজনা আদায় ও প্রজাদের সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতো। পাটোয়ারিগণ পাট্টাদার রায়ত এবং গ্রাম প্রধানদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করতেন। অধিকাংশ পাট্টা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রদান করা হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য পাট্টা দেওয়া হতো। এই ধরনের পাট্টাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কায়েমি রায়ত নামে পরিচিতি ছিল। সাধারণত তাদের খাজনার হার কদাচিৎ পরিবর্তিত হতো।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিধান মোতাবেক এক দফায় ১০ বছরের বেশি সময়ের জন্য পাট্টা প্রদান জমিদারদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু জমিদারগণ পাট্টা রেগুলেশনের (১৭৯৩) বিধানের বিরুদ্ধে এই মর্মে আপত্তি উত্থাপন করে যে, এর দ্বারা জমির ওপর তাদের মালিকানার পূর্ণ অধিকার খর্ব হয়। ১৮১২ সালের ৫নং রেগুলেশন দ্বারা ১০ বছরের এই শর্ত শিথিল করা হয় এবং ১৮১৯ সালের ৮নং রেগুলেশনের মাধ্যমে পাট্টা প্রদান করা না-করা জমিদারদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। সরকার পাট্টা প্রদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিল এ কারণে যে পাট্টা নিজস্ব স্বার্থ সংরক্ষণে প্রজাদের কিছুটা অধিকার প্রদান করত। কিন্তু জমিদারদের চাপের কারণে সরকারের পক্ষে পাট্টার মূলনীতি অনুসরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৮৮৫এর মাধ্যমে স্থায়ী রায়তদের পাট্টা প্রদান জমিদারদের ওপর বাধ্যতামূলক করা হয়। জরিপ ও সেটেলমেন্ট অপারেশন (বিভাগ) কর্তৃক তৈরি খতিয়ান বা রেকর্ড অব রাইট হচ্ছে ব্রিটিশ শাসনের আগে প্রচলিত পাট্টা প্রথারই আধুনিক সংস্করণ।
[সিরাজুল ইসলাম]