পরমাণু শক্তি কেন্দ্র, ঢাকা
পরমাণু শক্তি কেন্দ্র, ঢাকা ঢাকা শহরের কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউতে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র। ষাটের দশকের প্রথম দিকে এই গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী পরমাণু গবেষণাগারে কর্মরত অল্প কয়েকজন ঊর্ধ্বতন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানস্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তদনুযায়ী, ১৯৬৪ সালে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা যথাক্রমে একটি ভ্যান-ডি-গ্রাফ ত্বরকযন্ত্র (Van-De-Graff Accelerator), একটি ১৬২০ আইবিএম কম্পিউটার এবং একটি ৫০০০ কুরী Co-60 গামা বিকিরণ উৎস নিয়ে এই কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। তবে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র, ঢাকা আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মকান্ড শুরু করে ১৯৬৫ সালের ২৭ এপ্রিল।
প্রাথমিক অবস্থায় কেন্দ্রটিতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাসত্র, ইলেক্ট্রনিক্স, কম্পিউটার বিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, বিকিরণ ও তেজস্ক্রিয় জীববিজ্ঞান, নিউক্লিয়ার মেডিসিন এবং স্বাস্থ্য পদার্থবিদ্যার (Health Physics) ক্ষেত্রে গবেষণামূলক কর্মকান্ড শুরু হয়। কেন্দ্রটির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কর্মকান্ড ছিল ধানের দুটি উচ্চ ফলনশীল প্রকারভেদ IRATOM-24 ও IRATOM-38 এবং ডালের একটি উচ্চফলনশীল জাত HYPROSOLA-র মান উন্নয়ন ঘটানো। খাদ্যবিজ্ঞানে খাদ্যসংরক্ষণ, যেমন মাছ, পিঁয়াজ ও আলু এবং চিকিৎসা দ্রব্যাদি জীবাণুমুক্তকরণের জন্য বিকিরণ প্রযুক্তির ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত হয়।
স্বাভাবিক কারণেই স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশে অবস্থিত পরমাণু শক্তি প্রতিষ্ঠানগুলি পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ দেশের সমস্ত পরমাণু শক্তি প্রতিষ্ঠানগুলি তত্ত্বাবধানের জন্য বাংলাদেশ সরকার একজন বিজ্ঞানীকে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (OSD- Officer on Special Duty) হিসেবে শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দান করে। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সির সদস্য দেশে পরিণত হয় এবং ১৯৭৩-এর ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রীয় নির্দেশের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন (Bangladesh Atomic Energy Commission)।
কেন্দ্রটি প্রধানত ভৌত বিজ্ঞানের মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা ক্ষেত্রে তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এখানে পরমাণু ও সৌরশক্তি বিজ্ঞানে উন্নয়নের জন্য পরীক্ষামূলক ও তাত্ত্বিক উভয় অনুসন্ধানকে অন্তর্ভুক্ত করে পদার্থবিজ্ঞান ও সৌরশক্তির ক্ষেত্রে গবেষণার বিকাশ ঘটিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণাগারে 3MEV ভ্যান-ডি-গ্রাফ ত্বরকযন্ত্র কর্তৃক উচ্চশক্তির প্রোটন, ডিউটেরন ও আলফা কণার বীম সরবরাহের ব্যবস্থা থাকায় পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার বিশেষ সুযোগ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপাদান দিয়ে সৌর প্যানেল তৈরির বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েই সৌরশক্তি পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাকর্মগুলি পরিচালিত হয়েছে।
নিউক্লিয়নিক ও নিরীক্ষা উপকরণ এবং ছোট মাপের বিশ্লেষণী যন্ত্রপাতির নকশা ও নির্মাণের মাধ্যমে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র- ঢাকা এর ইলেক্ট্রনিক্স গবেষণাগারটির গবেষণা কার্যক্রম আরম্ভ হয়। পরবর্তীতে সাভারের পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ইলেক্ট্রনিক্স ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাসহ ইলেক্ট্রনিক বিভাগের কার্যক্রমকে পুনঃসংগঠিত করা হয়। শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য খাতগুলিতে নির্মাণ উপকরণের মান নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ কাজের জন্য কেন্দ্রের সাবেক আইসোটোপ বিভাগকে অ-বিনাশক পরীক্ষা বিভাগ হিসেবে পুনর্নামকরণ ও পুনর্গঠন করা হয়। স্বাস্থ্য পদার্থবিদ্যা বিভাগ পরমাণু শক্তির বিকাশ এবং স্বাস্থ্য, কৃষিবিজ্ঞান ও শিল্প-কারখানায় আয়োনাইজ সম্পন্ন বিকিরণ এবং রেডিও আইসোটোপ ব্যবহারের উন্নয়ন সম্পর্কিত গবেষণায় নিয়োজিত। বিকিরণ পরিবীক্ষণ স্বাস্থ্য পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একটি চাহিদাযোগ্য সেবা। এই বিভাগটি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিভিন্ন গবেষণাগার সহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালসমূহ, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী, আইসিডিডিআর-বি, বারডেম হাসপাতাল ইত্যাদির মতো সংস্থাকে নিয়মিত বিকিরণ নিরাপত্তা সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। [মিয়া মোঃ সিরাজুল হক]
আরও দেখুন পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান; বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।