দত্ত, রমেশচন্দ্র
দত্ত', 'রমেশচন্দ্র (১৮৪৮-১৯০৯) উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাবিদ এবং সুপন্ডিত ব্যক্তি। কলকাতার রামনগরের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে ১৮৪৮ সালের ১৩ আগস্ট তাঁর জন্ম। আর.সি দত্ত নামে তিনি সমধিক পরিচিত। ১৮৬৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দুবছর পর আর.সি দত্ত কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৬৮ সালে তিনি সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ও বিহারীলাল গুপ্তের সঙ্গে ইংল্যান্ডে যান। পরের বছর তিনি আই.সি.এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৮৭১ সালে আলীপুরে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তাঁর চাকরি জীবন শুরু হয়। অতঃপর তিনি মেহেরপুর (নদীয়া জেলা) ও দক্ষিণ শাহবাজপুরে (তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলায়) রিলিফ অফিসার পদে, বাঁকুড়া, বালেশ্বর, বাকেরগঞ্জ, পাবনা, ময়মনসিংহ, বর্ধমান, দিনাজপুর ও মেদিনীপুরে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং উড়িষ্যার বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, ইতঃপূর্বে বিভাগীয় কমিশনারের ন্যায় উচ্চ পদে কোন ভারতীয় নিয়োগ পান নি। ১৮৯৭ সালে ৪৯ বছর বয়সে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী তিনি আরও নয় বছর চাকরি করতে পারতেন। এই প্রসঙ্গে বড় ভাইয়ের কাছে লিখিত পত্রে তিনি বলেন যে, অনেক জুনিয়র অফিসারকে ইংরেজ সরকার উচ্চ পদে নিয়োগ দিয়েছিল, কিন্তু তাঁর প্রতি যথার্থ ‘বিশ্বাস ও আস্থা’ দেখানো হয় নি। অতএব তিনি ‘অন্য উপায়ে’ দেশের স্বার্থে নিজের ‘যোগ্যতা ও দক্ষতা’ কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসব অন্য উপায়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ, লেখা ও বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে সরকারি নীতি ‘সংশোধনের’ উদ্দেশ্যে ভারতে ও ইংলন্ডে জনমত গড়ে তোলা।
আই.সি.এস অফিসার হিসেবে কর্মজীবনের শুরুতেই আর.সি দত্ত প্রশাসনিক কাজে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যেও সময় করে লেখার কাজে হাত দেন এবং বাকি জীবনে সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে বিচরণ করেন। তিনি লেখার কাজকে তাঁর ’প্রথম প্রেম’ হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁর প্রথম লেখা Three Years in Europe ১৮৭২ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর প্রকাশিত হয় তাঁর Bengal Peasantry গ্রন্থ (১৮৭৫)। এই পুস্তকে তিনি রায়তদের পক্ষে কথা বলেন এবং তাদের দেয় খাজনার হার নির্দিষ্ট করে দেওয়ার দাবি উত্থাপন করেন। দ’ুবছর পর প্রকাশিত হয় Bengali Literature শীর্ষক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। তিনি শুধু সাহিত্যের ইতিহাস বর্ণনা করেই তুষ্ট হননি, সাহিত্যে নিজস্ব অবদান রাখায়ও সচেষ্ট হন।#চিত্র:দত্ত, রমেশচন্দ্র html 88407781.png
- রমেশচন্দ্র দত্ত
এ বিষয়ে তিনি তাঁর পিতার বন্ধু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর নিকট থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেন। তিনি চারটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেন: বঙ্গ বিজেতা, মাধবী কঙ্কণ, রাজপুত জীবন সন্ধ্যা ও মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত। প্রথম দুটি উপন্যাসে তিনি সম্রাট আকবর কর্তৃক বাংলা বিজয়, তৃতীয়টিতে আকবরের বিরুদ্ধে রানা প্রতাপ সিংহের সংগ্রাম এবং চতুর্থটিতে শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা শক্তির অভ্যুদয়ের কাহিনী বর্ণনা করেন। সব কটি উপন্যাসই ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি দুটি সামাজিক উপন্যাস সমাজ (১৮৮৫) ও সংসার (১৮৯৩) রচনা করেন। প্রথমটিতে হিন্দুসমাজে বিধবা বিবাহ এবং দ্বিতীয়টিতে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অপর একটি অবদান হচ্ছে বাংলায় ঋগ্বেদ-এর অনুবাদ (১৮৮৫)। ১৮৯৮ ও ১৮৯৯ সালে তিনি ইংরেজিতে যথাক্রমে রামায়ণ ও মহাভারত-এর কাব্যানুবাদ করেন। ১৮৯৪ সালে তিনি ইংরেজি পদ্যে রচিত তার Lays of Ancient India গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এ সময়ে তাঁর অপর অবদান হলো History of Civilisation in Ancient India.
আর.সি দত্তের তিনটি প্রকাশনায় প্রাধান্য পেয়েছিল ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা। এ প্রকাশনাগুলি হলো: England and India (১৮৯৭), Famines in India (১৯০০) এবং দুখন্ডে Economic History of India। England and India গ্রন্থে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওপর আলোকপাত করা হয়। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায় তাঁর পরবর্তী প্রকাশনায়। ১৯০০ সালে তিনি তাঁর Famines in India গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে তিনি ১৭৭০ সাল থেকে ঊনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত ভারতে দুর্ভিক্ষের বর্ণনা দেন। তাছাড়া এতে স্থান পায় গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড কার্জনএর কাছে লিখিত তাঁর পাঁচটি খোলা চিঠি। ১৯০২ সালের প্রথম দিকে লন্ডনে প্রকাশিত হয় তাঁর Economic History of India (১৭৫৭-১৮৫৭) গ্রন্থের প্রথম খন্ড। দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে। এ দুটি খন্ডে স্থান পায় যথাক্রমে ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ এবং ১৮৫৭ থেকে বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত উপমহাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে আলোচনা। Economic History of India ছিল তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ। এতে তিনি ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক প্রশাসনের বিভিন্ন দিক, ইংল্যান্ডের কলকারখানায় প্রস্ত্তত পণ্য-সামগ্রীর সঙ্গে অন্যায্য প্রতিযোগিতায় ভারতের শিল্পের ধ্বংস সাধন, কৃষি ও শিল্পের বিকাশে অবহেলা, ভূমি-রাজস্বের উচ্চ হার এবং তজ্জনিত কারণে কৃষক সমাজের দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের প্রকোপ, ‘হোম চার্জ’ আদায়ের মাধ্যমে ভারত থেকে সম্পদ পাচার, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে ভারত সীমান্তের বাইরে যুদ্ধের ব্যয় বহন প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। এ সকল গ্রন্থে যে মত প্রকাশ করা হয়েছিল এককভাবে তা আর.সি দত্তের মত নয়, এক্ষেত্রে তিনি পথিকৃৎও ছিলেন না। কিন্তু তাঁর সমালোচনা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইংল্যান্ড ও ভারতে তাঁর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যে বিতর্কের সূত্রপাত হয় তা এর প্রমাণ।
আর.সি দত্ত ১৮৯৯ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ঐ বছর ডিসেম্বর মাসে লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর বার্ষিক সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। আর.সি দত্তের রাজনৈতিক চিন্তাধারা ভারতের অর্থনীতিতে ইংরেজ শাসনের প্রভাব সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণের চেয়ে অনেক কম সংস্কারধর্মী ছিল। দাদাভাই নওরোজী, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী, জাস্টিস রানা দে প্রভৃতি ‘নরমপন্থী’ নেতাদের ন্যায় আর.সি দত্ত বিশ্বাস করতেন যে, ইংরেজ শাসন মূলত দেশের জন্য কল্যাণকর হয়েছে। তাঁর লক্ষ্য ছিল লেখা ও বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে ইংল্যান্ড ও ভারতে উপযুক্ত জনমত গড়ে তোলা এবং এভাবে ইংরেজ শাসনের সংস্কার করা। দ্বিতীয়ত, তিনি চেয়েছিলেন এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি যাতে অব্যাহত না থাকে সে জন্য প্রশাসনের সকল পর্যায়ে ভারতীয়দের অধিকতর সম্পৃক্ত করা হোক। Economic History of India গ্রন্থে তিনি প্রায় সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, উপনিবেশিক শাসন শাসিতের স্বার্থের পরিপন্থী হতে বাধ্য। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জে.এস মিলের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেন যে, কোন জাতির ওপর চাপানো অপরের দ্বারা পরিচালিত সরকার কোন দিন টিকে থাকে না এবং টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ভারতের জন্য স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেন নি। ব্রিটিশ শাসনের অর্থনৈতিক নীতি সম্পর্কে তাঁর সমালোচনা রাজনীতিতে চরম মতবাদের জন্ম দিলেও তিনি নিজে এ চরমপন্থী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না।
Economic History of India গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর আর.সি দত্ত ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ফিরে আসেন এবং ১৯০৪ সালের আগস্ট মাসে বরোদা রাজ্যের রাজস্ব মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এ পদে তিন বছর বহাল থাকার পর তিনি বরোদা ত্যাগ করেন এবং Royal Decentralisation Commission-এর সদস্য নিযুক্ত হন। এ কমিশনের দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর তিনি বরোদায় ফিরে যান এবং এ রাজ্যের দীউয়ান পদে অধিষ্ঠিত হন। দীউয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ১৯০৯ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। [এম মোফাখখারুল ইসলাম]