তাঁতি
তাঁতি হাত ও পায়ের সাহায্যে প্রথাগত তাঁতযন্ত্র পরিচালনা করে সুতি বস্ত্র তৈরির কারিগর। দৈনন্দিন ব্যবহার্য কাপড়ের চাহিদা পূরণের পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁতি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে। চর্যাপদে তাঁতিদের জীবননযাপন, কাজের ধরনের বর্ণনা আছে। এর থেকে বোঝা যায় প্রাচীন বাংলায় এই শৈল্পিক পেশা ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে স্নিগ্ধা, দুকুল, পাত্রনন্দা ইত্যাদি নামের কিছু মিহি সুতার উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের আবিষ্কার থেকে জানা যায় যে, প্রাচীনকালে বাংলা সুতিবস্ত্র উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। বাংলায় বস্ত্রশিল্পের সস্তা উপকরণ তুলা প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হতো। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ঢাকার মসলিন রোমে সুখ্যাতি ও বিপুল কদর লাভ করে। বাংলায় বিভিন্ন ধরনের মসলিন তৈরি হতো, যথা তানজেব, সারবন্দ, বাদান, খোশ, এলেবেলে, শর্বতি, তারাঙ্গম, কুমিশ, তূর্য, নয়নসুখ, চারখানা, মলমল, জামদানি এবং আদ্দি। মসলিন ছাড়াও বাংলা ভূখন্ডে অন্যান্য মিহি সুতার কাপড় প্রস্ত্তত করা হতো। এগুলির মধ্যে শবনম এবং আবে রাওয়াঁ উল্লেখযোগ্য। এসব বস্ত্রসহ বাংলার অন্যান্য অনেক কাপড় বুনন, সৌন্দর্য, কারুকার্য, নমনীয়তা এবং স্থায়িত্ব বিবেচনায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। তবে তাঁতিরা দৈনন্দিন ব্যবহারোপযোগী যেসব কাপড় প্রস্ত্তত করতেন সেগুলির অধিকাংশই হয় মোটা এবং অপেক্ষাকৃত কমদামি। তাঁতিদের কারখানায় এখন মানের দিক থেকে উৎকৃষ্ট বিবেচিত কাপড় প্রায় দুষ্প্রাপ্যই বলা চলে। তাঁতিরা এখন সাধারণ মানুষের আটপৌরে ব্যবহারের কাপড় তৈরি করেই তাদের পেশা জিইয়ে রেখেছেন।
একসময় হিন্দুদের বর্ণ প্রথার মধ্যেই তাঁতিদের দেখা হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত এ পেশার লোকজন আশ্বিনী তাঁতি নামে পরিচিত ছিল। তারা অন্যদের চেয়ে জাতে কিছুটা উঁচুতে ছিল। ব্রাহ্মণরা তাদের ছোঁয়া পানি নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতেন। পশ্চিমবঙ্গে আশ্বিনী বা আসান তাঁতিরা দাবি করেন যে তারাই আসল তাঁতি, অন্যসব তাঁতি হচ্ছেন তাদের উপগোত্র। এ দলের নারী তাঁতিরা নাকে নোলক পরতেন না এবং এটা ছিল তাদের সামাজিক স্বাতন্ত্র্যের নিদর্শন। সাধারণ তাঁতিদের নিচু জাতের বলে গণ্য করা হতো। শূদ্র পিতা ও ক্ষত্রিয় মাতা থেকে তাঁতির জন্ম হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
# #চিত্র:তাঁতি html 88407781.png
# #কর্মরত তাঁতি
তাঁতিরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেশা প্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশে তারা বিভিন্ন উপাধি যথা বারাশ, বসাক, বেদিয়া, নন্দী, পাল, চাঁদ, প্রামাণিক, সাধু, দত্ত, কর, মন্ডল, যোগি, মুখিম, সরকার, শীল ইত্যাদি নামে সুপরিচিত। এসব উপাধিধারী প্রত্যেকেই বর্তমানে আলাদা আলাদা পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করেন। বসাক উপাধি এসেছে ধনাঢ্যদের কাছ থেকে, এরা বুনন কাজ বাদ দিয়ে এক সময় কাপড় ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছে। ১৯২০-এর প্রথমার্ধে শহুরে তাঁতিদের থেকে ভিন্ন প্রকৃতির একদল তাঁতি পূর্ববঙ্গে এসে আবাস গড়েন এবং তারা বাংলার আসল তাঁতি বলে দাবী করেন। কথিত আছে যে, তারাই সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলের আগে সুতির কাপড় সরবরাহ করত।
সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে তাঁতিদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় ও তাদের বর্ণগত চরিত্রও বিবর্তিত হতে থাকে। মুগল আমলে হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই এ পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। ১৫১৮ সালের দিকে দুয়ার্তে বারবোসা নামের একজন পর্তুগিজ পরিব্রাজক বাংলা ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর লেখায় সে সময়ের বিশিষ্ট কিছু কাপড়, যেমন মেমোনা, চওলারি, চিনিবাপা, বালিহা ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঢাকা, চট্টগ্রাম, লক্ষমীপুর, কিশোরগঞ্জ এবং বাজিতপুরের তাঁতশিল্পের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেন। সিংহাম, কাস, মলমল, রেশমি, নীলা এবং টফেটা ছিল স্থানীয়ভাবে প্রস্ত্ততকৃত কাপড়ের প্রধান উদাহরণ।
ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসন এবং কর্তৃত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দেশিয়ভাবে উৎপাদিত কাপড়ের উন্নয়ন ও রপ্তানিকরণের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক হস্তক্ষেপ ঘটায়। প্রচলিত ধারণা ছিল যে, তাঁতিরা সাধারণত ভীরু প্রকৃতির এবং অসহায়, তাদের অধিকাংশই দুরবস্থায় পতিত, তারা হিসাব-নিকাশ রাখতে অক্ষম, জন্মগতভাবে পরিশ্রমী হলেও নিজেদের ওপর নির্ভর করতে পারেন না বলে অসহায়ত্বের শিকার। তবু তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী কাজে সন্তুষ্ট। তারা তাদের পরিবারের অস্তিত্ব রক্ষার্থে কোনোরকমে উপার্জন করে সততার সাথে কার্য সম্পাদন করেন। প্রায় এক শতাব্দী আগে বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরে বুনন মেশিন বা চরকা ছিল। স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে যখন বিদেশি পণ্য বর্জন করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে জাতীয় কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছিল তখন ব্রিটিশদের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় অচল হয়ে পড়ে। সেই সময় তাঁতবস্ত্রের উন্নয়ন ঘটার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে ভারতে তাঁতশিল্পে ঝলমলে ফ্যাশনের পুনর্বিকাশ ঘটতে শুরু করে।
হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁতিদের দেখা পাওয়া যায়। মুসলিম তাঁতিদের ‘জোলা’ নামে ডাকা হয়। এ নাম মুসলিম তাঁতিরা পছন্দ করেন না, নিজেরা সেই নামে পরিচিতও হতে চান না। ‘জোলা’ নামের পরিবর্তে তারা নিজেদেরকে কারিগর বলতেই অধিক পছন্দ করেন। যদিও স্মরণাতীতকাল থেকেই তাঁতিদের পেশা বুনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাপড় তৈরি করা, তথাপি তারা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এটাকে তাদের একচেটিয়া পেশার আওতায় ধরে রাখতে পারেন নি। সস্তায় কাপড় প্রস্ত্ততকরণ প্রযুক্তির বিকাশ তাঁতিদের অনেককে জীবনধারণের দ্বিতীয় উপায় হিসেবে অন্য পেশা গ্রহণে এবং এ পেশা পরিত্যাগে বাধ্য করছে।
আগেকার দিনে হস্তচালিত তাঁতের সাহায্যে তাঁতবস্ত্র তৈরি করার জন্য চরকা বা সুতাকাটার টাকু ব্যবহার করা হতো। আজকাল পর্যাপ্ত পরিমাণে সুতা মেশিনে তৈরি হচ্ছে, পরিণতিতে চরকা প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। এখন বয়নকারীরা শুধু নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহারোপযোগী চলতি মানের সস্তা গামছা, গেঞ্জি, লুঙ্গি এবং শাড়ি প্রস্ত্তত করছেন।
তাঁতিরা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এখন একান্তই পরিবারকেন্দ্রিক। তারা গ্রামের যে অঞ্চলে স্থায়িভাবে বসবাস করেন এর নাম তাঁতিপাড়া। দেশের কিছু অঞ্চল যেমন নরসিংদী, রায়পুরা, ডেমরা, টাঙ্গাইল, শাহজাদপুর, বেড়া, কুমারখালী, রুহিতপুর, বাবুরহাট, গৌরনদী এবং নাসিরনগর বয়নকার্যের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। কাপড়ের গুণগত বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ দেখা যায় অঞ্চলভিত্তিক কাপড় উৎপাদনে। রাজশাহীর সিল্ক, টাঙ্গাইল এবং পাবনার সুতি শাড়ি, মিরপুরের কাতান এবং জামদানি, ডেমরার বেনারসি এবং নরসিংদীর লুঙ্গি, গামছার খ্যাতি আছে সারাদেশব্যাপী। এসব স্থান এখনও ব্যাপক পরিমাণে কাপড় রপ্তানি করছে।
[গোফরান ফারুকী]