ডাফরিন, লর্ড
ডাফরিন, লর্ড (১৮২৬-১৯০২) ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় (১৮৮৪-১৮৮৮)। ইটন এবং অক্সফোর্ডের ক্রাইস্ট চার্চে শিক্ষাপ্রাপ্ত লর্ড ডাফরিন অনেক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদ অলংকৃত করেছিলেন। এগুলির মধ্যে রয়েছে সিরিয়ায় ব্রিটিশ কমিশনার, ১৮৬০; আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া, ১৮৬৪-১৮৬৬; আন্ডার সেক্রেটারি ফর ওয়ার, ১৮৬৬; কানাডার গভর্নর জেনারেল, ১৮৭২-১৮৭৮; সেন্ট পিটার্সবার্গে রাষ্ট্রদূত, ১৮৭৯ এবং তুরস্কে রাষ্ট্রদূত, ১৮৮১।
লর্ড রিপনের উত্তরাধিকারী হিসেবে ডাফরিনকে একটি মনস্তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক বিপজ্জনক অবস্থা অতিক্রম করতে হয়েছিল। লর্ড রিপন ভারতীয়দের অতুলনীয় শুভেচ্ছা এবং শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন কিন্তু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের কাছে তিনি ছিলেন খুবই অপ্রিয়। তাদের কাছে তিনি ছিলেন একজন স্বপক্ষত্যাগী। ডাফরিনের অসুবিধা ছিল এখানে যে, যে কোনো মাত্রায় সফলতার সঙ্গে শাসন করতে হলে তাকে অবশ্যই এদেশীয় এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সমর্থন লাভে সক্ষম হতে হবে। কিন্ত তখন উভয় দলই তাঁর পূর্বসূরি লর্ড রিপনের সংস্কার উদ্যোগকে কেন্দ্র করে বিবাদমান অবস্থায় ছিল। একদিকে তাঁকে তাঁর সম্প্রদায়ের সমর্থন অবশ্যই আদায় করতে হবে এবং অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গদের জাতিগত উগ্রতার ফলে ভারতীয়দের মনে সৃষ্ট তিক্ততা তাকে প্রশমিত করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি অবিশ্বাস্যভাবে সফলতা অর্জন করেছিলেন।
তাঁর বৈশিষ্ট্যমূলক কূটনৈতিক দক্ষতায় ডাফরিন ইলবার্ট বিল হতে সৃষ্ট উত্তেজনা ও বর্ণবিদ্বেষ উপশম করতে সক্ষম হন। শাসকের চেয়েও তিনি ছিলেন একজন দক্ষ কূটনীতিবিদ। তাই তার শাসনামলকে চিরাচরিত অর্থে শাসন না বলে বরং একে সাম্রাজ্যিক দৌত্যকাল হিসেবে যথার্থভাবে বর্ণনা করা যায়।
লর্ড ডাফরিনের পররাষ্ট্র বিষয়ক কাজটি ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি সফলভাবে ১৮৮৫ সালের আফগানিস্তানের পাঞ্জদেহ ঘটনার সমাপ্তি টানেন। ১৮৮৬ সালে তিনি উত্তর বার্মা সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেন। তিনি সদ্য গঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং অন্যান্য জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতি অত্যন্ত সাবধানী ও হিসেবী মনোভাব প্রদর্শন করেন। পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার শর্ত সাপেক্ষে তিনি জাতীয়তাবাদীদের প্রতি শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ও প্রশাসনের ‘ভারতীয়করণে’র সম্ভাবনার বিষয়টি তুলে ধরেন। শুধু ব্রিটিশ কমান্ডারদের পরিদর্শনের ব্যবস্থাধীনে ভারতীয় অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত ‘ইম্পেরিয়াল সার্ভিস কোর’ নামে একটি আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করে তিনি জাতীয়তাবাদীদেরকে বিশেষভাবে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হন। এক অর্থে এ ‘ইম্পোরিয়াল সার্ভিস কোর’ কে আধুনিক ভারতীয় সেনাবাহিনীর সূচনালগ্ন বলে অভিহিত করা যেতে পারে। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন (১৮৮৫) প্রণয়ন করে ডাফরিন ব্যাপক সংশোধনীর মাধ্যমে রেন্ট কমিশনের প্রতিবেদনকে কার্যে পরিণত করেন। ভূমির উপর রায়তের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে জমিদার-প্রজা সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে রিপন ১৮৮২ সালে এ রেন্ট কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের আপত্তির কারণে তখন এ প্রতিবেদন কার্যকর করা যায় নি।
ডাফরিনের মন ছিল পান্ডিত্যপ্রবণ। তিনি কৃষক ও শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা জানার জন্য বাংলার নিম্ন শ্রেণীর লোকদের অবস্থা সম্পর্কে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন (যা সাধারণভাবে ডাফরিন রিপোর্ট নামে পরিচিত) প্রস্ত্তত করেন (১৮৮৪-১৮৮৮)। ব্রিটিশ শাসনাধীনে সাধারণ মানুষের অবস্থার উন্নতি ঘটেছে বলে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মতবাদের বিরুদ্ধে এ প্রতিবেদন জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে একটি অনন্য সাধারণ দলিলে পরিণত হয়। এ প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য বিষয় কংগ্রেসের মতবাদকে শক্তিশালী করে তোলে যে, দেশের প্রশাসনের ক্ষেত্রে দেশবাসীর অংশগ্রহণ ছাড়া দেশ কখনওই সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে না। ডাফরিন নিজে এ যুক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি নির্বাচিত সদস্যসহ প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পরিষদ প্রতিষ্ঠার কংগ্রেসী দাবির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের দাবি পূরণের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দেন। এ সুপারিশের ফলই ছিল ১৮৯২ সালের ইন্ডিয়ান কাউন্সিলস অ্যাক্ট যা উপমহাদেশে নির্বাচন সংক্রান্ত রাজনীতির সূচনা করেছিল।
একজন পন্ডিত হিসেবে লর্ড ডাফরিন গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করেন। সরকারি কর্মজীবন হতে অবসর গ্রহণের পর তিনি ব্রিটিশ জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটির সভাপতি, এডিনবার্গ এবং সেন্ট এন্ড্রুর রেক্টর পদে অধিষ্ঠিত হন। তার ব্যক্তিগত পান্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ডি.সি.এল, এল.এল.ডি, এফ.আর.এস এবং ডক্টর অব ওরিয়েন্টাল লার্নিং (পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়) প্রভৃতি সাম্মানিক উপাধি লাভ করেন। তার পান্ডিত্যপূর্ণ রচনাবলি হলো Letters from High Latitudes, Irish Questions ও Speeches in India. লর্ড ডাফরিন ১৯০২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মারা যান। [সিরাজুল ইসলাম]