জৌনপুরী, কেরামত আলী
জৌনপুরী', 'কেরামত আলী ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক। তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত জৌনপুরের মোল্লাহাটায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবু ইবরাহিম শেখ মুহম্মদ ইমাম বখ্শ ছিলেন ফারসি সাহিত্যে সুপন্ডিত এবং হাদিস ও জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় পারদর্শী। তিনি ছিলেন শাহ আবদুল আজিজ দেহলভীর শিষ্য। কেরামত আলী ছিলেন হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ)-এর অধস্তন ৩৫তম পুরুষ।
পিতার নিকট কেরামত আলীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। তিনি মওলানা কুদরতউল্লাহ রুদলভীর নিকট ধর্মতত্ত্ব এবং আহমদউল্লাহ আল্লামীর নিকট হাদিস শিক্ষা করেন। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের কলাকৌশলও তিনি শিখেছিলেন। আঠারো বছর বয়সেই কেরামত আলী আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং আত্মশুদ্ধির তাগিদে তিনি রায়বেরিলীতে সৈয়দ আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর নিকট বাই’য়াত গ্রহণ করেন। সৈয়দ আহমদ শহীদ তাঁকে বাংলায় গিয়ে বয়ান ও লেখনীর মাধ্যমে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দেন।
বাংলায় আগমনের পূর্বে কেরামত আলী জৌনপুরে মাদ্রাসা-ই-হাসাফিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। অচিরেই এ মাদ্রাসা ইসলামি শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তিনি ছিলেন ইসলামের মৌলিক আদর্শ ও আচার অনুষ্ঠানের একান্ত অনুসারী। কিন্তু তৎকালীন বাংলার মুসলিম সমাজ বিদআ’ত কার্যক্রম, কুসংস্কার ও অনৈসলামিক পাপাচারে আচ্ছন্ন ছিল। বহু মুসলমান রোজা (সিয়াম), নামায (সালাত) ও আযানের মতো অবশ্য পালনীয় কর্তব্য পরিহার করে তদস্থলে হিন্দু আচার অনুষ্ঠান পালন এবং হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিত। শিরক ও বিদআ’ত মুসলিম মননকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলে। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের কাজে মওলানা সাহেব নিজেকে নিয়োজিত করেন।
কলকাতায় ধর্মপ্রচারের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করে কেরামত আলী যশোর ও খুলনা হয়ে বরিশাল পৌঁছেন। এ সময় হাজী শরীয়তউল্লাহ, আব্দুল জববার এবং অপরাপর ফরায়েজী নেতৃবৃন্দ সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া ও আব্দুল জববার অনুসৃত সংস্কার কার্যক্রম এবং কেরামত আলীর সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে নীতি বা আদর্শের পার্থক্য খুব সামান্যই ছিল। কিন্তু এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের ব্যাপারে দুপক্ষের অবস্থান ছিল পৃথক মেরুতে। হাজী শরীয়তউল্লাহ মনে করতেন, ব্রিটিশ শাসিত ভারত ছিল দার-উল-হারব বা শত্রু নিয়ন্ত্রিত নিবাস। পক্ষান্তরে, মওলানা কেরামত আলী ইংরেজদের সমর্থনে যুক্তি দেখান, যেহেতু ব্রিটিশরা স্থানীয় জনগণের ধর্মকর্মে হস্তক্ষেপ করছে না সেহেতু ভারতবর্ষ দার-উল-হারব নয়। তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ভারতবর্ষ দারুল ইসলাম (ইসলামি রাষ্ট্র) না হলেও নিদেনপক্ষে এটি দারুল আমান (নিরাপদ আবাসস্থল) বটে। এ জন্যই মুসলমানগণ ভারতে ধর্মীয় কার্যক্রম অনুশীলন করতে পারছে।
ভারতবর্ষ দার-উল-হারব কিনা এ বিষয়ে কেরামত আলীর সাথে ফরায়েজী নেতৃবৃন্দের আনুষ্ঠানিক বিতর্ক (বাহাস) অনুষ্ঠিত হয়। ফরায়েজীদের পক্ষে আব্দুল জববার এ বিতর্কে নেতৃত্ব দেন। এ বিতর্কে কেরামত আলী প্রমাণ করেন, ভারতবর্ষ দার-উল-হারব নয়। এ অবস্থায় দুই ঈদ ও জুমআর জামাত অনুষ্ঠান মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক। বিতর্কে ফরায়েজী নেতৃবৃন্দ পরাজিত হলেও তাঁরা কেরামত আলীকে নানাভাবে হয়রানি করেন। এমনকি কখনও কখনও তাঁকে তাঁর ধর্মপ্রচার স্থলে অবস্থান করতে দেওয়া হয় নি। তিনি মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত আযানের প্রচলন করেন। ইতঃপূর্বে শুধু রাত্রিকালে আযান দেওয়া হতো। মসজিদে যখন দিনের বেলায়ও আযানের প্রচলন করা হয়, তখন লোকে একে নতুন প্রথার প্রবর্তন বলে মনে করে। অনেক সাধ্য সাধনার পর তিনি তাদের মনে বিশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হন যে, দিনে পাঁচবার আযান প্রচার করা বাধ্যতামূলক। তিনি মসজিদে জুমআর নামায আদায়ও শুরু করান। প্রথমদিকে তাঁর প্রতিপক্ষরা তাঁর উদ্যোগের বিরোধিতা করেন, তবে ধীরে ধীরে জনগণ এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
কেরামত আলীর সংস্কার আন্দোলন ’তাইউনি আন্দোলন’ নামে পরিচিত। আরবি তাইউন শব্দ থেকে তাইউনি শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ হলো শনাক্ত করা। কেরামত আলীর কার্যক্রম দুপর্যায়ে বিভক্ত ছিল। প্রথমত তিনি মুসলিম সমাজে বিরাজমান শিরক ও বিদআ’তের মূলোৎপাটনের জন্য কঠোর সংগ্রাম করেন এবং দ্বিতীয়ত যেসব মুসলমান কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে বিপথগামী হয়ে পড়েছিল তাদেরকে তিনি ইসলামের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনেন। কেরামত আলী নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, আসাম, রংপুর এবং আরও অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল সফর করেন। রংপুরে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে তাঁর মৃত্যু হয়। রংপুরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
কেরামত আলী প্রায় ৪৬টি গ্রন্থ ও পুস্তিকা রচনা করেন। তাঁর গ্রন্থ মিফতাহ-উল-জান্নাহ্’র বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। বইটি ইসলামের ওপর লিখিত একটি প্রামাণ্য গ্রন্থরূপে উপমহাদেশে স্বীকৃতি লাভ করে। মওলানা কেরামত আলীর রচনাবলিকে চার শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়: (১) ধর্মীয় বিষয়াবলির সংক্ষিপ্তসার, (২) কুরআনের ব্যাখ্যা এবং নামায ও উযুর পদ্ধতি; (৩) আধ্যাত্মিক ও পীর-মুরিদ তত্ত্ব সম্পর্কিত বিষয় এবং (৪) হাজী শরীয়তউল্লাহ ও দুদু মিয়ার মতবাদের সমালোচনা। তাঁর অধিকাংশ বই উর্দুতে লেখা, তবে তিনি আরবি ও ফারসিতেও লিখেছেন। তাঁর লেখা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই হলো- মিফতাহ-উল-জান্নাহ, বাইয়া’ত-ই-তওবা, শিস্ত আল-মুসল্লি, মুখারিব-আল-হারুরফ্, কাউকাব-ই-দুর্রি, তরজমা শামায়েল-ই-তিরমিজী, তরজমা মিশকাত, আল-ক্বাউল আল-ছাবিত, বাইয়া’ত ওয়া তাবুয়া, ক্বাউল আল-আমিন, মুরদ আল-মুরিদিন, ফরজ্-ই-আযম, কিতাব আল-ইনতিকামাত, নূরুন আলা নূর, যাদ্ আল-তাক্বওয়া। [এম. ইনামুল হক]