গোলাপ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২০:২৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

গোলাপ  Rosaceae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত Rosa গণের দ্বিবীজপত্রী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। সারা পৃথিবীতে গোলাপের প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ১৫০। বিদেশ থেকে আনা কয়েক প্রজাতির এবং বিভিন্ন জাতের গোলাপের চাষ হলেও বাংলাদেশের স্থানীয় একটি (Rosa involucrata) প্রজাতির গোলাপ জন্মে ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রামের কোনো কোনো অঞ্চলের জলাভূমিতে। অত্যন্ত কাঁটাযুক্ত ঘন ঝোপের এ গাছ তেমন সুশ্রী নয়। যেসব বুনো গোলাপ প্রজাতি থেকে আধুনিক গোলাপের জন্ম সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য Rosa rugosa, R. mundi, R. centifolia, R. canina, R. damascena, R. gallica ইত্যাদি। গোলাপ ফুল তার সৌন্দর্য্যের জন্য খুব স্বাভাবিকভাবেই পৌরাণিক কাহিনীতে ঠাঁই পেয়েছে। গ্রিক উপকথায় প্রেমের দেবী ভেনাসের পায়ের রক্ত থেকে গোলাপের জন্ম। আরব দেশিয় কাহিনীতে আছে যে সাদা গোলাপকে  বুলবুলি পাখি আলিঙ্গন করতে গেলে কাঁটায় আহত তার রক্তে সাদা গোলাপ থেকে লাল গোলাপ জন্মে। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে আছে বিষ্ণু ব্রহ্মাকে পদ্মই শ্রেষ্ঠ ফুল বললে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে স্বর্গে নিয়ে সেখানে হালকা রঙের একটি সুগন্ধি গোলাপ দেখান। গোলাপ সম্বন্ধে এমন অনেক গল্প আছে।

কয়েক জাতের গোলাপ


পাপা মিলাঁ


আইসবার্গ


রোজ গুজার্ড


বেংগলি


কুইন এলিজাবেথ


জুলিয়াস রোজ
ডাচ গোল্ড
সানসিল্ক


কিংস র‌্যানসন

জীবাশ্ম থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী প্রাচীনতম গোলাপের বয়স ২ কোটি ৬০ লক্ষ বছর থেকে ৩ কোটি ৮০ লক্ষ বছর। কবে, কোথায় ও কখন প্রথম গোলাপ চাষ শুরু হয়েছিল তার সঠিক বিবরণ জানা না গেলেও প্রাচীনকালে গ্রীস, রোম, মধ্যপ্রাচ্য ও চীনে গোলাপের আবাদ ছিল। গোলাপ উত্তর গোলার্ধ থেকে ক্রমে দক্ষিণ গোলার্ধে বিস্তৃতি লাভ করে। পাশ্চাত্যের দেশগুলির গোলাপ ছিল সাদা ও হালকা রঙের, ফুল দিত খুব অল্প দিন আর প্রাচ্যের গোলাপ ছিল হলুদ, লাল ইত্যাদি কড়া রঙের, বছরের অনেকটা সময় ধরে ফুল ফুটতো। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের গোলাপের সংকরায়ণের মাধ্যমে ঘটেছে এক পুষ্পবিপ্লব, উদ্ভব হয়েছে মনমাতানো অজস্র জাতের গোলাপ।

গোলাপ একটি সম্পূর্ণ ফুল অর্থাৎ এতে বৃতি, দল, পুংকেশর, গর্ভকেশর প্রভৃতি ফুলের সবকটি অংশই নির্দিষ্ট সংখ্যায় আছে। বৃতির সংখ্যা ৫ এবং দলের সংখ্যা ৫ বা পাঁচের গুণিতক। বুনো গোলাপের পাঁপড়ির একটি মাত্র আবর্ত থাকে। পুংকেশর ও গর্ভকেশর অনেক। গোলাপ গাছ সাধারণত কাঁটাযুক্ত ঝাড় (গুল্ম) অথবা লতা। আকর্ষী না থাকায় গোলাপ আশ্রয়ে উঠতে পারে না, তাই কাঁটার সাহায্যেই লতা-গোলাপ উপরে ওঠে। কাঁটার সংখ্যা, ঘনত্ব, রং- এসব বৈশিষ্ট্যও বিশেষ লক্ষণীয়। কাঁটাগুলি বাঁকা বলে লতাকে উঠতে সাহায্য করে। পল নিরো (Paul Neron) জাতীয় কোনো কোনো গোলাপে কাঁটার সংখ্যা একেবারেই কম, প্রায় নেই বললেই চলে, আবার কোনো কোনো গোলাপে কাঁটা খুব বেশি। গোলাপে রঙের বৈচিত্র্য অবর্ণনীয়; সাদা, গোলাপি, হলুদ, বেগুনি, লাল, ডোরাকাটা, এমনকি প্রায় কালো রঙের গোলাপও আছে।

গোলাপ গাছ একদিকে যেমন সরু সরু ডালপালাসহ ছোট ঝোপ হতে পারে, অন্য দিকে পাহাড়ি এলাকায় পাইনজাতীয় গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুনো লতাগোলাপ অনেক উঁচুতে উঠতেও পারে। খুব নিচু গোলাপঝোপ (যেমন Nozomi) বাগান সাজাতে বিশেষ সাহায্য করে। ত্রিশ থেকে ৪৫ সেমি উচ্চতার গোলাপ ঝাড় ছোট ছোট পাতা আর কুঁড়িতে ভারি সুন্দর দেখায়।

যতদূর জানা যায় ভারতীয় উপমহাদেশে সুন্দর গোলাপ এসেছে প্রায় পাঁচশ বছর আগে বসরা থেকে। মোগল সম্রাট বাবর প্রথম ‘বসরা’ নামের এক গোলাপ নিয়ে এসেছিলেন। সুগন্ধি গোলাপি রঙের এ গোলাপ এখনও এদেশে ‘বসরা’ নামে পরিচিত। কোনো কোনো পুরানো বাগানে এখনও এটির চাষ হয়। দুর্বল প্রকৃতির লম্বাটে গাছগুলিতে ডালের মাথায় থোকায় থোকায় ফুল ফোটে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে যে সব জাতের গোলাপ উদ্ভব হয়েছে তার মধ্যে ‘ফাতেমা ছাত্তার’, ‘শিবলী’, ‘রাহেলা হামিদ’, ‘পিয়ারী’, ‘ভাসানী’, ‘শের-এ-বাংলা’, ‘১৯৫২’, ‘জয়ন্তি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তবে উপযুক্ত বাগান এবং উদ্যোগের অভাবে এগুলি কতদিন টিকে থাকবে তা বলা যায় না।

জংলি গোলাপের কান্ডে বিভিন্ন উচ্চতায় ‘চোখ কলম’ জুড়ে দিয়ে সুন্দর সুন্দর গোলাপের ঝাড় বানানো যায় যেগুলিকে ‘স্ট্যান্ডার্ড রোজ’ বলে। বাগান সাজাতে পিছনে উঁচু, তারপর ক্রমান্বয়ে নিচু মাপের গাছ লাগালে দেখতে মানানসই হয়।

অনুকূল পরিবেশে  পিঁপড়াপ্রজাপতিমৌমাছি ইত্যাদির সাহায্যে পরাগায়িত হলে পরিণতিতে গোলাপ গাছে ফল ও বীজ উৎপন্ন হয়। এসব বীজ থেকে উৎপন্ন চারাগুলিতে প্রকারভেদ দেখা দেয়। এভাবেই গোলাপের নতুন জাত সৃষ্টি হয়। কখনও কখনও এক রঙের গোলাপ ফুলের গাছে হঠাৎ মিউটেশনের ফলে অন্য একটি ডালে ভিন্ন প্রকার ফুল ফোটে। আবার মিউটেশনের ফলে ঝাড় গোলাপের গাছ থেকে লতা গোলাপের গাছও জন্মায়। কোনোও কোনোও গোলাপ গাছের একটু পরিণত বয়সের ডালের কিছুটা অংশ কেটে মাটিতে লাগিয়ে দিলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শিকড় গজিয়ে নতুন পাতা ছাড়ে। এ পদ্ধতিতে চারা তৈরী করাকে কাটিং বা কলম বলে। বিদেশি গোলাপের মধ্যে Tajmahal, Papa Meilland প্রভৃতি গোলাপের ডাল থেকে কাটিং করা যায়, তবে ডালের নিচে কাটা মাথায় উপযুক্ত হরমোন দিলে শিকড় গজাবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গোলাপের চারা উৎপাদনের জন্য জংলি বা বুনো গোলাপের গাছে ‘চোখ কলম’ বসিয়ে বহু চারা বানানো যায়। এক্ষেত্রে গাছের নিচের অংশে থাকে বুনো গোলাপ, উপরের অংশটি নির্বাচিত গাছের ‘চোখ’ থেকে উৎপন্ন মূল গোলাপ। এভাবে বাংলাদেশেও এখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নামিদামি গোলাপ পাওয়া যায়। যেমন Papa Meilland, Double Delight, Dutch Gold, Queen Elizabeth, Monte Zuma ইত্যাদি। ইদানিং টিস্যু-কালচার বা মাইক্রোপ্রোপাগেশন পদ্ধতিতেও গোলাপের চারা উৎপাদনের চেষ্টা চলছে, তবে তা এখনও ততটা প্রসার লাভ করে নি।

প্রাচীনকাল থেকেই গোলাপ বহুল ব্যবহূত ফুল। ইতিহাসখ্যাত রাজা-রানীর কাছে গোলাপ সর্বদাই আদৃত হয়েছে। অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এদেশে গোলাপপানি ব্যবহার করা হয়। মুগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের আবিষ্কৃত ‘আতর-ই-জাহাঙ্গীর’ থেকে গোলাপের আতর প্রচলিত হয়। গোলাপ দিয়ে জেলি, মিষ্টি, হালুয়া, ইত্যাদি  খাদ্যসামগ্রী সুগন্ধি করা যায়। ভেষজ হিসেবেও গোলাপ গাছ ব্যবহূত হয়। গোলাপের ফল ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ।

বাংলাদেশে গোলাপের উৎপাদন ও বিপণন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সালনা ও সাভারের বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপকভাবে এখন গোলাপের চাষ হচ্ছে।  [মাহ্বুবার রহমান খান এবং তাবাস্সুম মুমতাজ]