গাজীর পট

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২০:১৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

গাজীর পট  এক প্রকার লোকচিত্রকলা। এতে গাজী পীরের উপাখ্যানের বিভিন্ন দৃশ্য চিত্রায়িত হয় এবং সঙ্গীতযোগে পটুয়ারা এগুলি পরিবেশন করে। এক সময় গাজীর পট বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, বিশেষত, বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, যশোর, খুলনা, রাজশাহী প্রভৃতি অঞ্চলে বিনোদনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল। গাজীর পটের পাশাপাশি মনসাপট, রামায়ণপট, কৃষ্ণপট ইত্যাদিও এক সময় প্রচলিত ছিল। বর্তমানে বিনোদনের বিভিন্ন আধুনিক মাধ্যম প্রচলিত হওয়ায় এ মাধ্যমটি বিলুপ্ত প্রায়। দু-একটি দৃষ্টান্ত ব্যতিরেকে ওইসব পটের নির্দশন আজ পাওয়া দুষ্কর। আশুতোষ মিউজিয়ামস সংগ্রহ (কলকাতা), গুরুসদয় দত্ত সংগ্রহ (কলকাতা), সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘর (নারায়ণগঞ্জ), বাংলা একাডেমী সংগ্রহ (ঢাকা) প্রভৃতি স্থানে বেশকিছু জড়ানো পট সংরক্ষিত আছে। পটশিল্পীদের সকলেই বেদে সম্প্রদায়ভুক্ত এবং  ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী।

গাজীর পট সাধারণত গ্রামে-গঞ্জে বাড়ির উঠানে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। কুশীলবরা জুড়ি, ঢোল, চটি প্রভৃতি বাজিয়ে গান গায় আর পট প্রদর্শন করে। এ সময় পটে অঙ্কিত চিত্রসমূহ একটি লাঠির সাহায্যে নির্দেশ করে তা সুর,  তাল ও কথার সাহায্যে বর্ণনা করা হয়। নির্দিষ্ট কোনো কাহিনীর পরিবর্তে গাজীর পটের বর্ণনাংশে তিনটি বিষয়ের সংমিশ্রণ ঘটে: ক. গাজী পীরের মাহাত্ম্য ও অলৌকিক ক্ষমতা; খ. কৌতুক মিশ্রিত হিতোপদেশ এবং গ. মৃত্যু তথা যমরাজের ভয়।

গাজীর পটের চিত্রসমূহ সাধারণত ৪৮১১০ আকৃতির মোটা কাপড়ে অঙ্কিত হয়।

চিত্র:GaziPat.jpg
গাজীর পট


সমগ্র পটটি মোট ২৫টি প্যানেলে বিভক্ত। তন্মধ্যে কেন্দ্রীয় প্যানেলটির পরিমাপ ১২২০.২৫। এর ওপরে চার ও নিচে তিন সারি প্যানেল থাকে। সর্বনিম্ন সারিটি ব্যতিরেকে অন্যসব সারিতেই তিনটি করে প্যানেল থাকে, যার প্রতিটি ৪.২৪৬.২৫ থেকে ৫.২৫৬.২৫ পরিমাপ-বিশিষ্ট।

কেন্দ্রীয় প্যানেলে অঙ্কিত হয় বাঘের পিঠে উপবিষ্ট গাজী এবং তার দুপাশে থাকে মানিক পীর ও কালু পীর। ওপর থেকে দ্বিতীয় সারির মাঝে থাকে নাকাড়া বাদনরত ছাওয়াল ফকির এবং তৃতীয় সারির মাঝের প্যানেলে থাকে কেরামতি শিমুল গাছ ও তার ডানে আসা হাতে গাজীর গুণকীর্তনরত দুই মহিলা। কেন্দ্রীয় প্যানেলের নিচের সারির মাঝে অঙ্কিত হয় গাজী পীরের ভগ্নী লক্ষ্মী ও তার বাহন পেঁচা। দ্বিতীয় সারির ডান দিকের প্যানেলে থাকে মকর মাছের পিঠে উপবিষ্ট গঙ্গা দেবী এবং সর্বনিম্ন সারির বামে থাকে যমদূত, ডানে কালদূত ও মাঝে মানুষের মাথা রন্ধনরত যমরাজের মা। প্রতিটি ফ্রেমের চারপাশে সাদার ওপর খয়েরি রঙের শেকল নকশাকৃত বর্ডার থাকে।

গাজীর পটের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো রঙের ব্যবহার ও বর্তনা-সৃষ্টি সম্পর্কে অনীহা। এতে কেবল লাল ও নীল রং থেকে যথাক্রমে রক্ত ও গোলাপী এবং শ্যাম ও আকাশি রং ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি প্রতিকৃতি সুস্পষ্টভাবে দ্বিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্বলিত ও রেখাসর্বস্ব। এ সকল প্রতিকৃতির গায়ে বৈচিত্র্য আনয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন বিমূর্ত নকশা (তির্যক, উল্লম্ব ও আনুভূমিক রেখা এবং ক্ষুদ্র বৃত্ত) ব্যবহূত হয়। দৃঢ়বদ্ধ রেখা ব্যবহারের ফলে প্রতিকৃতিসমূহে কোনো প্রকার ব্যঞ্জনা লক্ষ করা যায় না।  শিমুল গাছ,  আসা, তসবিহ, শিকারকৃত  হরিণ, হুক্কা ইত্যাদির অঙ্কন স্পষ্টতই অতিমাত্রায় বাস্তবতা-বিবর্জিত। গাজী কালু, মানিক পীর, যমদূত, কালদূত, শুক ও সারি ইত্যাদি প্রতিকৃতিসমূহের শারীরিক ভঙ্গিমায় জীবনের গতিময়তা রুদ্ধ করে প্রথাগত আকারের প্রতি আনুগত্য ফুটিয়ে তোলা হয়। এ প্রথাসিদ্ধ শৃঙ্খলায় গাজীর পট সম্পূর্ণরূপে অনড়।

গাজীর পট জড়ানো প্রকৃতির এবং তা সাধারণত মোটা কাপড়ে অঙ্কন করা হয়। অঙ্কনের আগে তেঁতুল বিচি বা বেলের আঠা দিয়ে পটের জমিন তৈরি করা হয়; তার ওপর চক পাউডার, তেঁতুল বিচির আঠা ও ইটের গুঁড়ার মিশ্রণের প্রলেপ দেওয়া হয়। এটি উত্তমরূপে রোদে শুকানোর পর সমগ্র পটটি নির্দিষ্ট প্যানেলে ভাগ করে শিল্পী বিভিন্ন প্রতিকৃতি অঙ্কন করেন।

চিত্রাঙ্কনের জন্য প্রয়োজনীয় রং নানা ধরনের উদ্ভিদ ও খনিজ পদার্থ থেকে সংগৃহীত হয়, যেমন: মশালের ওপর উপুড় করা মাটির সরার কালি থেকে কালো, শঙ্খগুঁড়া থেকে সাদা,  সিঁদুর থেকে লাল, হলুদগুঁড়া থেকে হলুদ, গোপী মাটি থেকে মেটে হলুদ এবং  নীল গাছ থেকে নীল রং সংগ্রহ করা হয়। ছাগল বা ভেড়ার লোম দিয়ে শিল্পী নিজেই তুলি তৈরি করেন। বর্তমানে বাজারে প্রাপ্ত রাসায়নিক রং এবং বিভিন্ন ধরনের তুলিও শিল্পীরা ব্যবহার করেন।

বাংলাদেশে এ পটশিল্পের শুরু খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক বলে মনে করা হয়। গাজীর পটে যমদূত ও তার মায়ের চিত্র থেকে অনুমিত হয় যে, এর উৎস প্রাচীন  যমপট, যেখানে ধর্মরাজ যমের মূর্তি এবং যমালয়ের ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য অঙ্কিত হতো। বাংলাদেশের পটচিত্রকলা ভারতীয় উপমহাদেশের বৌদ্ধপূর্ব ও অজন্তাপূর্ব যুগের চিত্রকলা এবং পরবর্তীকালে তিববত, নেপাল, চীন ও জাপানের ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে করা হয়।  [শাহনাজ হুসনে জাহান]

আরও দেখুন পটচিত্র