গাজী কালু ও চম্পাবতী
গাজী কালু ও চম্পাবতী মধ্যযুগের পাঁচালি কাব্যের আদর্শে রচিত পীরসাহিত্য। ব্যাঘ্রশঙ্কুল দক্ষিণ বঙ্গে গাজী পীরের প্রভাব বিস্তার ও মাহাত্ম্য প্রচার এ কাব্যের উপজীব্য। ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়ের প্রতিপক্ষরূপে গাজী পীরের প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল (১৬৮৪) কাব্যে। এতে প্রথমে তাদের মধ্যে বিরোধ ও পরে বন্ধুত্ব দেখানো হয়েছে। এক সময় দক্ষিণ বঙ্গীয় সমাজে উভয়ের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ও পূজা প্রচারিত হয়। রায়মঙ্গলের কাহিনী নিয়ে গাজী কালু ও চম্পাবতী কাব্য রচনা করেন শেখ খোদা বখশ ১৭৯৮-৯৯ সালে। এতে গাজী-কালুর ফকিরবেশে দেশভ্রমণ, জনৈক হিন্দু রাজার সঙ্গে গাজীর যুদ্ধ, যুদ্ধে রাজার পরাজয় ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, গাজী কর্তৃক প্রজাদের দুঃখ-দারিদ্র্য মোচন, ব্রাহ্মণনগরের মটুক রাজার সঙ্গে গাজীর যুদ্ধ, যুদ্ধে রাজার পরাজয় ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, রাজকন্যা চম্পাবতীর সঙ্গে গাজীর বিবাহ, পরিশেষে সকলকে নিয়ে গাজীর গৃহে প্রত্যাবর্তন ও সুখে জীবন যাপনের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এসবের পাশাপাশি কাব্যে আরও কিছু উপকাহিনী রয়েছে। গাজী আল্লাহ্, খোয়াজ-খিজির ও গঙ্গাদেবীর সহায়তায় সর্বত্রই বিজয়ী বীর হিসেবে এ কাব্যে চিত্রিত হয়েছেন।
গাজী কালু ও চম্পাবতী কাব্য দ্বারা পরবর্তীকালের কবিরা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তাই কিছু পাত্র-পাত্রী, স্থান ও ঘটনার নাম পরিবর্তন করে মূল কাহিনী অবলম্বনে পরবর্তীকালে সৈয়দ হালু মীর, আবদুর রহিম, আবদুল গফুর প্রমুখ অনুরূপ কাব্য রচনা করেন। শেখ খোদা বখশ ছিলেন রংপুরের বোগদহের অধিবাসী, কিন্তু তাঁর কাব্যের লৌকিক সংস্করণ ‘চম্পাবতী কইন্যার পালাগান’ বা ‘গাজী সাহেবের গীত’ বাংলার নানা অঞ্চলে প্রচলিত আছে। এতে এ কাব্যের জনপ্রিয়তা প্রমাণিত হয়। দেব, নর, দৈত্য, জীন, পরী, ভূত-প্রেত, জীব-জন্তু সম্বলিত ও মর্ত্য-পাতাল-অন্তরীক্ষের পটভূমিতে রচিত এ কাব্য-কাহিনী সম্পূর্ণই কাল্পনিক। গাজীর মানত-শিরনি করলে বাঘের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এ বিশ্বাস কাব্যমধ্যে প্রতিফলিত।
এই শ্রেণির কাব্য রচনার পেছনে তখনকার ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করা হয়। উনিশ-বিশ শতকের উপনিবেশিক যুগে পরাজিত শক্তি হিসেবে বাংলার মুসলমানগণ এরূপ কাব্য রচনা ও পাঠ করে ইসলামের অতীত গৌরবে পুলক ও আত্মশ্লাঘা অনুভব করতেন।
[ওয়াকিল আহমদ]