খাজা আম্বর মসজিদ
খাজা আম্বর মসজিদ ঢাকা শহরের কারওয়ান বাজার এলাকার বর্তমানে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ নামে পরিচিত ময়মনসিংহ রোডের পূর্বদিকে অবস্থিত। মুগল সুবাহদার মীরজুমলা উত্তর পূর্ব সীমান্তে অশ্বারোহী বাহিনীর যাতায়াতের সুবিধার্থে রাস্তাটি নির্মাণ করেছিলেন। আলোচ্য মসজিদটি অনেক বার সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ১৯৬০ দশকে এর আমূল সংস্কার করা হয়। তখন পূর্ব প্রান্তে তিন গম্বুজ আচ্ছাদিত একটি বারান্দা যোগ করা হয়। ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে পূর্ব প্রান্তে বহুতলবিশিষ্ট সম্প্রসারিত অংশ নির্মাণ করায় বর্তমানে ইমারতটি আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করেছে।
মসজিদটিতে দুটি শিলালিপি আছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবের উপরে স্থাপিত প্রথম শিলালিপিতে রয়েছে কুরআনের একটি আয়াত। আর কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের উপরে বাইরের দিকে স্থাপিত দ্বিতীয় শিলালিপিতে সুবাহদার শায়েস্তা খান এর প্রধান খোজা, খাজা আম্বর কর্তৃক ১৬৮০ খিষ্টাব্দে একটি মসজিদ এবং একটি সেতু নির্মাণের উল্লেখ রয়েছে।
তিন গম্বুজের এ মসজিদ ভূমি থেকে প্রায় ১২ ফুট (৩.৬৬ মি) উঁচু একটি উত্তোলিত মঞ্চের (Platform) পশ্চিম অর্ধাংশ জুড়ে অবস্থিত। এ ভিত্তিমঞ্চের শীর্ষে রয়েছে বদ্ধ পদ্ম-পাঁপড়ি নকশার একটি সারি। এর চারকোণে রয়েছে চারটি বিশাল আকৃতির পার্শ্ববুরুজ। অষ্টভুজাকৃতির বুরজগুলি ভিত্তিমঞ্চের চেয়ে সামান্য একটু উঁচু এবং এগুলির শীর্ষে রয়েছে ক্ষুদ্রাকৃতির গম্বুজ। পূর্ব প্রান্তে একটি সিঁড়ি পেরিয়ে পাথরের তৈরী ফ্রেমবিশিষ্ট খিলানযুক্ত একটি তোরণ পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। এ সিঁড়িপথের ডান দিকে খাজা আম্বরের খননকৃত কূপটি ছিল, তবে বর্তমানে এটিকে মাটি ফেলে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ভিত্তিমঞ্চের পূর্বদিকে রয়েছে খাজা আম্বরের সমাধি। আদিতে এখানে শুধু পাথরের তৈরি কবর ফলক (Sarcophagus) দৃশ্যমান ছিল। তবে বর্তমানে এর উপরে ইট দিয়ে একটি ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে।
মসজিদটি পরিকল্পনায় আয়তাকার। বাইরে থেকে এর পরিমাপ ১৩.৪১ মি × ৬.৭১ মি। মসজিদের চার কোণকে মজবুত করতে নির্মিত অষ্টভুজ পার্শ্ববুরুজগুলি ছাদের সমান্তরাল বপ্র (Parapet) ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। ইমারতটিতে প্রবেশের জন্য রয়েছে পাঁচটি প্রবেশপথ পূর্ব দিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে। মসজিদের বড় কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটি যথারীতি দেওয়াল থেকে প্রক্ষিপ্ত একটি আয়তকার ফ্রন্টনের মধ্যে স্থাপিত। দুপ্রান্তের আলঙ্কারিক মিনার দুটিসহ এ প্রক্ষেপণের পুরো অংশটিই তৈরি করা হয়েছে কালো ব্যাসাল্ট পাথর দিয়ে। অন্য চারটি প্রবেশ পথেরও দুপার্শ্বে রয়েছে আলঙ্কারিক মিনার। এ গুলির খিলানযুক্ত ফ্রেমও কালো ব্যাসাল্ট পাথর দিয়ে তৈরী। পূর্ব দিকের তিনটি প্রবেশপথের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পশ্চিম দেওয়ালের ভেতরের অংশে রয়েছে অর্ধ অষ্টকোণাকৃতির তিনটি মিহরাব। দুপার্শ্বের দুটি মিহরাব অপেক্ষা বড় কেন্দ্রীয় মিহরাবটিও বাইরের দিকে প্রক্ষিপ্ত একটি আয়তাকার অংশের মধ্যে স্থাপিত। এ প্রক্ষেপণের দুপ্রান্তে রয়েছে ক্ষুদ্রাকৃতির মিনার। কেন্দ্রীয় মিহরাবটিকে ঘিরে রাখা আয়তাকার ফ্রেমসহ পুরো মিহরাবটিই কালো ব্যাসাল্ট পাথর দিয়ে তৈরী, তবে পার্শ্ববর্তী মিহরাবদ্বয়ের কেবল খিলানটুকু পাথরের, বাকি অংশ ইট দিয়ে নির্মিত। কেন্দ্রীয় মিহরাবের উত্তরে স্থাপিত তিন ধাপবিশিষ্ট মিম্বারটিও পাথর দিয়ে তৈরী।
দেওয়ালের গায়ে সংলগ্ন ইট দিয়ে নির্মিত স্তম্ভের উপর থেকে উত্থিত এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রলম্বিত দুটি প্রশস্ত খিলান মসজিদের ভেতরের অংশটিকে তিনটি ‘বে’তে বিভক্ত করেছে। এরমধ্যে মধ্যবর্তী বেটি বর্গাকার এবং এর প্রতি বাহু ৪.২৭ মি। পার্শ্ববর্তী ‘বে’ দুটি আয়তাকার এবং অপেক্ষাকৃত ছোট। এ তিনটি ‘বে’র উপর আচ্ছাদন হিসেবে রয়েছে তিনটি গম্বুজ।
অষ্টকোণ পিপার (Drum) উপর স্থাপিত সামান্য কন্দাকৃতির এ গম্বুজগুলির মধ্যে মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড়। পদ্ম কলস নকশার শীর্ষচূড়া (Finial) শোভিত গম্বুজগুলি নির্মাণে লালবাগ দুর্গের মসজিদের অনুরূপ কৌশল অনুসৃত হয়েছে।
কালের পরিক্রমায় এবং পরবর্তীকালের ব্যাপক সংস্কারের ফলে মসজিদটির আদি অলঙ্করণের প্রায় সবকিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে। দেওয়াল এক সময় খোপ নকশা (Panel) দিয়ে অলঙ্কৃত ছিল, তবে বর্তমানে তা সিমেন্টের মসৃণ পলেস্তারায় ঢেকে দেওয়া হয়েছে। সবগুলি পার্শ্ববুরুজ এবং প্রান্তীয় আলঙ্কারিক মিনারগুলির ভিত্তিতে আছে কলস নকশা, আর শীর্ষে খাঁজকাটা ক্ষুদ্র গম্বুজে আচ্ছাদিত নিরেট ছত্রী। গম্বুজের অষ্টকোণ পিপা এবং ছাদের বপ্র (Parapet) বদ্ধ পদ্ম পাঁপড়ি নকশার সারি দিয়ে অলঙ্কৃত। কালো ব্যাসাল্ট পাথরে দিয়ে তৈরী কেন্দ্রীয় মিহরাবটিতে রয়েছে দৃষ্টি নন্দন বহুখাঁজবিশিষ্ট খিলান। এ খিলান উত্থিত হয়েছে অর্ধ অষ্টভুজাকৃতির দুটি সংলগ্ন স্তম্ভ থেকে। স্তম্ভগুলি সামান্য উঁচু ব্যান্ড নকশার সাহায্যে কয়েকটি অংশে বিভক্ত। খিলানের স্প্যান্ড্রেল গভীরভাবে খোদাই করা গোলাপ নকশা (Rossette) দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। মিহরাবটির আয়তাকার ফ্রেমের উপরে রয়েছে উত্থিত একটি ব্যান্ড, যাতে রয়েছে বদ্ধ পদ্ম-পাঁপড়ি নকশার একটি সারি। মিহরাবের ফ্রেমেও এ ব্যান্ডের মধ্যবর্তী অবতল স্থানটি প্যাঁচানো নকশা দিয়ে অলঙ্কৃত।
ইমারতটির একটি গুরুত্বপুর্ণ দিক হচ্ছে এর প্রবেশপথ, মিহরাব ও মিম্বারে কালো ব্যাসাল্ট পাথরের ব্যবহার। এ পাথরগুলি সম্ভবত সংগৃহীত হয়েছিল রাজমহলের পাহাড়ি এলাকা থেকে। আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর পূর্বদিকের প্রবেশ পথগুলির প্রক্ষেপণের দুপ্রান্তে আলংকারিক মিনার নির্মাণ। এ মসজিদেই প্রথম এ বৈশিষ্ট্য যোগ করা হয়, তবে এরপর থেকে তা বাংলার মুগল মসজিদ স্থাপত্যের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। [এম.এ বারি]