ঢাকা চিড়িয়াখানা
ঢাকা চিড়িয়াখানা ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চিড়িয়াখানা। ১৯৫০ সালে হাইকোর্ট চত্বরে জীবজন্তুর প্রদর্শনশালা হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৪ সালে ঢাকা চিড়িয়াখানা নামে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। পরে জায়গা স্বল্পতার কারণে ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন এটি এর বর্তমান জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে চিড়িয়াখানাটি মিরপুর-২ এ ২১৩.৪১ একর জমির উপর অবস্থিত। এটি মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাধানে পরিচালিত। প্রতিদিন এখানে প্রায় ১০,০০০ দর্শনার্থী আসেন এবং দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছে।
বর্তমানে চিড়িয়াখানায় বহু দেশি-বিদেশি পশুপাখি এবং বন্যপ্রাণি রয়েছে। চিড়িয়াখানাটিতে ১৯১ প্রজাতির ২১৫০ মেরুদন্ডী প্রাণি রয়েছে। এর মধ্যে ৬৪ প্রজাতির ৫৫১ স্তন্যপায়ী প্রাণি, ১৫ প্রজাতির ৭৩ সরীসৃপ এবং ৩২ প্রজাতির ১০৪ একুউরিয়াম মাছ আছে। এর সঙ্গে ৯১ প্রজাতির প্রায় ১৫০০ পাখি রয়েছে। দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করার জন্য ১৫টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ২১টি সিংহ, ৯টি জলহস্তী, প্রায় ২০০ বানর এবং ৩৩টি পাইথন রয়েছে। এর বাইরে আরও আছে ১১টি বাঘ, ১৬টি সিংহ, ৮টি জলহস্তি, ৬৫টি বানর এবং ১৪টি অজগর সাপ। এর পাশাপাশি আরও কিছু বিরল প্রাণি রয়েছে যেমন জেব্রা, এমু, গয়াল, কালো ভল্লুক ইত্যাদি।
এখানকার বন্দি প্রাণির প্রজনন কর্মসূচির আওতায় ইতোমধ্যে বাঘ, সিংহ, চিতা, নানা জাতের বানর ও অনেক প্রজাতির পাখির প্রজননে সাফল্য অর্জিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানার সঙ্গে প্রাণিবিনিময়ের ব্যবস্থাও আছে। এখানে রয়েছে দুটি স্বচ্ছ পনির লেক যেখানে প্রতি বছর শীতে অসংখ্য পরিযায়ী জলজ পাখি ভিড় জমায়।
কিউরেটরর অধীন দুই জন ডেপুটি কিউরেটর সার্বিক কার্যক্রম তদারকি করেন। ডেপুটি কিউরেটরের অধীনে রয়েছে প্রশাসন শাখা, প্রাণীপুষ্টি শাখা, ভেটেনারি শাখা, মাংসাশী শাখা, ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী ও সরিসৃপ শাখা, বৃহৎ প্রাণি তৃণভোজী শাখা, পাখি শাখা, গবেষণা শাখা, তথ্য শাখা, জাদুঘর শাখা, নিরাপত্তা শাখা এবং মৎস্য শাখা। মৎস্য এবং প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে প্রধান করে চিড়িয়াখানাটির একটি উপদেষ্টা কমিটি আছে। যারা বিভিন্ন বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বর্তমানে এখানে বিভিন্ন শাখায় ২১৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন।
প্রতি বছর প্রায় ৩ মিলিয়ন লোক চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করে। বছরে অক্টোবর থেকে মার্চ রবিবার বাদে সপ্তাহের বাকী ছয়দিন সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত এবং এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত চিড়িয়াখানা খোলা থাকে। সরকারি ছুটির দিনগুলিতেও একই সময় অনুয়ায়ী চিড়িয়াখানা দর্শনার্থীদের জন্য খোলা রাখা হয়। চিড়িয়াখানার মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দর্শনার্থী বিশেষ করে শিক্ষার্থী এবং শিশুদের জন্য সব ধরনের বিনোদন সুবিধা দেয়। প্রবশপথেই আছে একটি তথ্যকেন্দ্র, যেখান থেকে দর্শনার্থীরা তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারে। বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য হুইল চেয়ারেরও ব্যবস্থা আছে। এর ভিতর বাগানে একটি জ্যুওলিজক্যাল মিউজিয়াম আছে।
দেশের ছোট-বড় সকল চিড়িয়াখানাকে একই নিয়মের আওতায় আনা এবং আবদ্ধ বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা জন্য জ্যু অ্যাক্ট চালুকরণের কাজ ২০০৩ সাল থেকে শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে একাধিক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এছাড়াও আবদ্ধ বন্যপ্রাণির প্রজনন উপযুক্ত ব্রিডিং প্রোগ্রামের আওতায় ঢাকা চিড়িয়াখানাকে দেশের সকল চিড়িয়াখানার কেন্দ্রীয় বন্যপ্রাণির প্রজনন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে। এ জন্য উপযুক্ত ব্রিডিং প্রোগ্রাম ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শকর সহায়তায় ক্যাপটিভ ব্রিডিং প্রোগ্রাম চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। খাঁচায় আবদ্ধ অবস্থায় প্রজন্মের (Captive Breeding) ফলে অতিরিক্ত প্রাণিসমূহ প্রতিবছর দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন চিড়িয়াখানার চাহিদা সাপেক্ষে প্রদান করা হবে।
বর্তমান বিশ্বে চিড়িয়াখানাগুলিকে শুধু বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনায় না এনে শিক্ষা কার্যক্রম তথা কনজার্ভেশন এডুকেশনের (Coservation Education) উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। তাই জ্যু এডুকেশন চিড়িয়াখানার কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্তমানে ঢাকা চিড়িয়াখানায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি ও এ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি অনুষদ, বিভিন্ন ভেটেরিনারি কলেজ থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের ইন্টারর্নশিপ চালু রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাণিবিদ্যা বিষয়ক উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা চিড়িয়াখানায় আসেন। বর্তমানে ঢাকা চিড়িয়াখানায় কোন জু-এডুকেশন সেন্টার নেই। তাই ভিশন ২০২১ -এর আওতায় জ্যু এডুকেশন সেন্টার নির্মাণ করা হবে। ‘স্থানীয়ভাবে বিপন্ন এবং বিলুপ্ত প্রাণি সংরক্ষণ’-এর উদ্দেশ্যে ছাত্রছাত্রী ও জনগণের মাঝে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই এডুকেশনের ব্যবস্থা অধিক কার্যকর হবে। এখানে প্রতি সপ্তাহে একদিন স্কুল ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন প্রাণি সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা হবে এবং প্রতিদিন দর্শকদেরকে চিড়িয়াখানার মূল্যবান প্রাণি সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য ‘এ্যনিমেল টকশো’ চালু করা হবে।
চিড়িয়াখানার সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হলো: চিড়িয়াখানাটিতে একটি সাফারি পার্কের মতো করার উদ্যোগ করতে যাচ্ছেন যেখান প্রাণিরা খোলামেলাভাবে চলাফেরা করতে পারবে এবং দর্শনার্থীরা তাদেরকে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখবে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা হলো ব্যাটারি চালিত ক্লায়েন্ট কারের ব্যবস্থা যেটিতে চড়ে বৃদ্ধ এবং শিশুরা চিড়িয়াখানা ঘুরতে পারবে। অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্যে চিড়িয়াখানার ভিতরে আছে শিশুপার্ক স্থাপন। দশনার্থীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য একটি নতুন ডলফিন কর্নার এবং একটি প্রজাপতি বাগান করা হবে। [এ.বি.এম শহীদউল্লাহ]