লাক্ষাকীট
লাক্ষাকীট (Lac Insect) Homoptera বর্গের Coccoidea অধিগোত্রের Metatachardia, Laccifer, Tachordiella, Austrotacharidia, Afrotachardina ও Tachardina এই ছয়টি গণভুক্ত যেকোন প্রজাতি। স্ত্রী-কীটের দেহনিঃসৃত রেজিন বা রজনের জন্য এদের খ্যাতি। Lacciferidae ও Tachardinidae গোত্রভুক্ত প্রজাতিগুলিই মূলত লাক্ষা বা গালা নিঃসরণ ঘটায়। এসব কীট ইউরোপ ছাড়া পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তৃত।
লাক্ষাকীটের বহু প্রজাতির মধ্যে Laccifer lacca (=Tachardia lacca) কীটটি বাণিজ্যিক লাক্ষাচাষের উৎস। প্রধানত ভারত ও বাংলাদেশে পোষক হিসেবে ব্যবহূত শেয়াকুল (Zizyphus mauritiana) ও কুল (Zizyphus jujuba) গাছে লাক্ষা চাষ হয়। লাক্ষাকীট প্রথমে লার্ভা অথবা অপ্রাপ্তদেহী পর্যায়ে জীবন শুরু করার সময় দৈর্ঘ্যে ০.৬ মিমি এবং বক্ষের কাছে প্রস্থে ০.২৫ মিমি হয়ে থাকে। অল্প বয়সীরা যূথবদ্ধ হয়ে পোষকগাছে সুবিধামত জায়গায় সমবেত হয়। শাখার এক বর্গ সেন্টিমিটার জায়গায় গড়ে ১৫০টি লার্ভা দলবদ্ধ হয়ে থাকে। Homoptera বর্গের অন্যান্য সদস্যের মতো এদেরও বিশেষ ধরনের ছেদক ও চোষক মুখোপাঙ্গ রয়েছে।
স্থায়িভাবে বসবাসের এক বা দুদিন পর লার্ভার রোস্ট্রাম, ব্র্যাকিয়াল পেট ও উদরের শীর্ষভাগ ছাড়া দেহের বাকি অংশ থেকে লাক্ষা নিঃসরণ শুরু হয় এবং এভাবে লার্ভা লাক্ষাকোষের মধ্যে আবদ্ধ হতে থাকে। গুটি যতো স্ফীত হয় কীটের শরীরও তত বড় হতে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে কীট দুবার ত্বক নির্মোচন করে। তাপ, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ, পোষক গাছের প্রকৃতি, ইত্যাদি পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর লার্ভার প্রতিটি পর্যায়ের সময়সীমা নির্ভরশীল। পুরুষ ও স্ত্রী লার্ভা যথাক্রমে লম্বাটে ও ডিম্বাকৃতির লাক্ষাগুটি উৎপাদন করে।
প্রথম ত্বক নির্মোচনের পর পুরুষ ও স্ত্রী লার্ভার পা, শুঙ্গ ও চোখ বিলুপ্ত হয়ে যায়। তৃতীয় ত্বক মোচনের পর লার্ভা তথাকথিত পিউপা পর্যায়ে পৌঁছায়। এ সময় তাদের মুখোপাঙ্গগুলি ক্ষয়ে যায় ও খাওয়া বন্ধ করে। পুং-লক্ষাকীট ডানাযুক্ত বা ডানাহীন হতে পারে এবং আবৃত অবস্থায়ই স্ত্রী-কীটের সঙ্গে সঙ্গম করে। বৃদ্ধিকালে প্রথম ত্বকমোচনের পর স্ত্রী-কীট তার উপাঙ্গগুলি হারায়। লাক্ষাকীট পরস্পর অতি কাছাকাছি অবস্থানে থাকায় পাশাপাশি কোষ থেকে নির্গত লাক্ষারসে সবাই একসঙ্গে জড়িয়ে যায়, ফলে বৃক্ষশাখার উপর লাগাতার আবরণের সৃষ্টি হয়। এই আবরণ চেঁচে নিয়ে শোধন করে গালা তৈরি করা হয়। শুধু সিল-মারার আঠা হিসেবে নয়, লাক্ষা বার্ণিশেও ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়।
লাক্ষা চাষ বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে লাক্ষা উৎপাদনের জন্য মানুষ প্রথম কবে লাক্ষাচাষের পত্তন করেছিল, সে বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। অথর্ববেদ থেকে দেখা যায়। প্রাগৈতিহাসিককালের মানুষ লাক্ষাকীট, তাদের জীবন ইতিহাস, নিঃসৃত নির্যাসের বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার জানত। সংস্কৃত সাহিত্যে লাক্ষাকীটের প্রধান পোষক-বৃক্ষ পলাশ (Butea monosperma) ‘লাক্ষাতরু’ নামে উল্লিখিত।
সম্ভবত মধ্যযুগে স্পেনীয়রা রং ও আরবি ওষুধ জাল করার জন্য ভারত থেকে ইউ‡রাপে লাক্ষা আমদানি করে। ভারত এখনো পৃথিবীর প্রধান লাক্ষা উৎপাদক দেশ। মায়ানমার (প্রাক্তন বার্মা) ষোড়শ শতকে লাক্ষা বাণিজ্যে যোগ দেয়। সম্ভবত বিগত ৪০০০ বছর থেকে চীনে লাক্ষাচাষ চলছে। চীনারা সেই সময় রেশম শিল্পের বিকাশ ঘটায় এবং সেই সঙ্গে লাক্ষাচাষও। তারা রেশম রং করার জন্য লাক্ষা ব্যবহার করত। চামড়ার জিনিসপত্র রং করার জন্যও লাক্ষা ব্যবহূত হতো। সম্প্রতি (বিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে) থাইল্যান্ডেও লাক্ষা চাষ শুরু হয়েছে। থাইল্যান্ড সাধারণত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বাজারে লাক্ষা রপ্তানি করে। তারা sticklac থেকে shellac তৈরি করে।
বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষে লাক্ষাচাষ সমকালীন। লাক্ষাচাষ চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার স্থানীয় লোকদের নিয়মিত জীবিকার একটি প্রধান উপায়, তবে তারা কেবল স্টিকল্যাকই উৎপাদন করে। রাজশাহী শহরের তালাইমারি এলাকায় শতাধিক কুটিরশিল্প আছে যেখানে চাপাইনবাবগঞ্জের স্টিকল্যাক থেকে শেল্যাক উৎপন্ন হয়।
লাক্ষাকীট চাষের জন্য কুল, শেয়াকুল, পলাশ, কুসুম (Schleichera oleosa), বাবলা (Acacia arabica), খয়ের (A. catechu), অড়হড় (Cajanus cajan), বট (Ficus benghalensis), ডুমুর (F. carica), অশ্বত্থ (F. religiosa) ইত্যাদি গাছ ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশে কুলগাছেই লাক্ষাচাষ সীমাবদ্ধ, যদিও অন্যান্য বন্য পোষকগাছ থেকেও লোকে স্টিকল্যাক সংগ্রহ করে। সবচেয়ে উন্নতমানের শেল্যাক যোগায় কুসুমবৃক্ষ।
লাক্ষাচাষের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়- লাক্ষাকীট দ্বারা পোষক গাছে সংক্রমণ ঘটানো এবং ফসল আহরণ। স্ব-সংক্রমণ বা কৃত্রিম সংক্রমণের মাধ্যমে বৃক্ষে লাক্ষাকীট সংক্রমণ ঘটাতে হয়। তবে সবক্ষেত্রেই লাক্ষার ডিম ব্যবহার্য। ফসল কাটার পরপরই কৃত্রিম সংক্রমণের সেরা সময়, আর সেজন্য লাক্ষার ডিমধারী কাঠের (১০-৩০ সেমি লম্বা) দুই বা তিন টুকরার অাঁটি পোষকগাছের ডালে এমনভাবে বাঁধতে হয় যাতে অাঁটির কাঠ গাছের শাখার সঙ্গে লেগে থাকে। ডিমধারী অাঁটি পোষকগাছে ২-৩ সপ্তাহ রাখাই বাঞ্ছনীয়, এর বেশি দিন রাখলে অর্থাৎ ডিম থেকে সবগুলি লার্ভা বেরিয়ে আসার পরও রাখলে ডিমশূন্য অাঁটির কাঠি থেকে পরজীবী বেরিয়ে আসতে পারে। পরিপক্ক হলেই কেবল লাক্ষা ফসল আহরণ করা উচিত।
বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চারটি মরসুমে লাক্ষাচাষ হয়ে থাকে- কার্তিকী, অগ্রহায়ণী, বৈশাখী ও জ্যৈষ্ঠী। সংক্রমণ ঘটানো থেকে ফসল আহরণ পর্যন্ত সময়কাল হলো কার্তিকী- জুলাই থেকে নভেম্বর, অগ্রহায়ণী জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি, বৈশাখী- নভেম্বর থেকে জুলাই এবং জ্যৈষ্ঠী- ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই। চাপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে বছরে কেবল একবার, জ্যৈষ্ঠীতেই লাক্ষা চাষ হয়। ডিসেম্বরে ফসল আহরণের পর কুলগাছ ছেঁটে দিলে জানুয়ারিতে নতুন শাখা গজায়। পূর্ববর্ণিত উপায়ে বাড়ন্ত কোমল ডালের সঙ্গে লাক্ষাধর কাঠিগুলি বেঁধে দিলে দু’এক সপ্তাহের মধ্যেই লার্ভাগুলি সেখানে জেঁকে বসে। পুরো সময় ধরে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুন) গাছের শাখার উপর কীটেরা নিজেদের ওপর রজন নিঃসরণ ঘটিয়ে আবরণ সৃষ্টি করে। জুলাই মাসে কীটনিঃসৃত লাক্ষার ঢাকনিযুক্ত ডালগুলি কাটার পর প্রতিটি শাখা ৫০ থেকে ৭০ সেমি লম্বা করে কেটে অাঁটি বাঁধা হয়। শেষে প্রত্যেকটি টুকরা থেকে লাক্ষা চেঁছে বিশেষ প্রক্রিয়ায় অশোধিত লাক্ষা আহরণ করা হয়।
ষাটের দশকের শেষে নবাবগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত লাক্ষাচাষ কেন্দ্রটি বর্তমানে বন্ধ। বর্তমানে লাক্ষাচাষের অবস্থা আশাপ্রদ নয়। স্থানীয় বাজারে পাওয়া লাক্ষা আসছে ভারত থেকে। সাধারণত অশোধিত লাক্ষাই আমদানি করা হয়ে থাকে। স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন লাক্ষা রাজশাহীতে শোধন করা হয়। নবাবগঞ্জের লাক্ষা শিল্প বিলুপ্তির পথে, অথচ এটিই বাংলাদেশে লাক্ষাচাষের একমাত্র অঞ্চল। [মোঃ মাহতাব আলী]
আরও দেখুন লাক্ষা।