রাসমণি, রাণী
রাসমণি, রাণী (১৭৯৩-১৮৬১) সমাজ সেবক ও ধর্মানুরাগী। রাণী রাসমণি ২৬ সেপ্টেম্বর ১৭৯৩ সালে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে বর্তমান উত্তর ২৪ পরগণার কোণা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম হরেকৃষ্ণ দাস। কলকাতার জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রাজচন্দ্র মর এর সঙ্গে মাত্র এগারো বছর বয়সে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর তেতাল্লিশ বছর বয়সে তিনি পরিবারিক জমিদারি ও ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং শিঘ্রই এ কাজে নিজের দক্ষতার পরিচয় দেন।
রাসমণি তাঁর পরিবারের সম্পদ উল্লেখযোগ্য সামাজিক কর্মকান্ড, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করেন। কলকাতায় দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণ তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান। তিনি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসেবে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসকে নিযুক্ত করেন (১৮৫৫)। রাসমণি নিম্ন বর্ণজাত হওয়ায় ব্রাহ্মণগণ দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরটি নির্মাণে বাঁধা প্রদান করেছিলেন। কিন্তু তিনি মন্দির নির্মাণের কাজে অবিচল থাকেন ও কৃতকার্য হন। সমাজসেবার সাথে সাথে এটি ছিল তাঁর গভীর ধর্মানুরাগের পরিচায়ক।
তিনি গঙ্গা নদীতে দরিদ্র জেলেদের মাছ ধরার অধিকার আদায়েও সক্ষম হন। রাণী রাসমণি দরিদ্র জেলে সম্প্রদায়ের ওপর আরোপিত নদীতে মাছ ধরার শুল্ক তুলে নিতে ব্রিটিশদের বাধ্য করেন। তাছাড়াও জেলেদের মাছ ধরার সুবিধার্থে গঙ্গায় চলাচলকারী কয়েকটি স্টিমার সার্ভিস বন্ধ করতে তিনি সক্ষম হন। এ জন্য তাঁকে প্রচুর অর্থও ব্যয় করতে হয়েছিল। পুজার মিছিল শহরে শান্তি-শৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে এ অভিযোগে ব্রিটিশ সরকার রাণী রাসমণিকে অর্থদন্ড প্রদান করলে কলকাতার জনগনের চাপের মুখে তারা তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলির ওপর রাণী রাসমণির কর্তৃত্ব বজায় ছিল। এগুলির মধ্যে জানবাজার, রাসমণি বাজার এবং যদুবাবু বাজার উল্লেখযোগ্য। যদুবাবু বাজার নামকরণ হয় তাঁর পৌত্রের নামানুসারে। অন্যান্য অনেক জনকল্যাণকর কাজের জন্য রাণী রাসমণি প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। তিনি সুবর্ণরেখা নদী থেকে পারি পর্যন্ত তীর্থ যাত্রীদের চলাচলের সুবিধার জন্য একটি রাস্তা নির্মাণের কাজ তদারকি করেন। তাছাড়াও তিনি গঙ্গায় তীর্থযাত্রীদের নিত্যদিনের স্নানের সুবিধার্থে বাবু ঘাট (তাঁর স্বামীর স্মরণে), আরিটোলা ঘাট ও নিমতলী ঘাট নির্মাণ করেন। রাণী কলকাতার ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি (বর্তমানে, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব ইন্ডিয়া) এবং হিন্দু কলেজ (বর্তমানে, প্রেসিডেন্সি কলেজ) প্রতিষ্ঠায় বিপুল অংকের অর্থ প্রদান করেন।
রাণী রাসমণি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপারে দৃড়চিত্ত ছিলেন। তিনি যে কাজকে সঠিক বলে বিবেচনা করতেন, তাই-ই প্রতিষ্ঠিত করতেন। তাঁর সময়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে রাণীর ঘটনাবহুল দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বাংলার ঘরে ঘরে রূপকথার গল্পের মত প্রচলিত ছিল। হিন্দু ধর্মের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল অবিচল। রাসমণির ধর্মীয় ও সেবামূলক কর্মকান্ড এতোই জনপ্রিয়তা পায় যে, কলকাতার জনগন তাঁকে ‘রাণী’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করে। ১৮৬১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাণী রাসমণির মৃত্যু হয়। তাঁর জীবদ্দশায় করে যাওয়া সেবামূলক কর্মকান্ড পরবর্তী প্রজন্মের নিকট অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ভারতের ডাক বিভাগ রাণী রাসমণির স্মরণে একটি স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করেছে। [আকসাদুল আলম]