বন্যা
বন্যা (Flood) তুলনামূলকভাবে পানির উচ্চ প্রবাহ, যা কোন নদীর প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম তীর অতিক্রম করে ধাবিত হয়। তীর ছাড়িয়ে পানি আশপাশের সমভূমি প্লাবিত করলে সাধারণত জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্লাবনভূমি যেহেতু মানুষের কাঙ্খিত ও কৃষিকাজের সহায়ক, তাই বন্যাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা ও এর ক্ষয়ক্ষতি যাতে সীমা ছাড়িয়ে না যায় তা লক্ষ্য করা জরুরী।
প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬,০০০ বর্গ কিমি অঞ্চল অর্থাৎ ১৮ শতাংশ ভূখন্ড বন্যা কবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সমগ্র দেশের ৫৫ শতাংশের অধিক ভূখন্ড বন্যার প্রকোপে পড়ে। প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশে তিনটি প্রধান নদীপথে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আর্দ্র মৌসুমে ৮৪৪,০০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। বাৎসরিক মোট প্রবাহের এটি ৯৫ শতাংশ। তুলনায় একই সময় দেশের অভ্যন্তরে ১৮৭,০০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার নদী প্রবাহ সৃষ্টি হয় বৃষ্টিজনিত কারণে।
বাংলাদেশে বন্যার সংজ্ঞা স্বতন্ত্র। বর্ষাকালে যখন নদী, খাল, বিল, হাওর ও নিচু এলাকা ছাড়িয়ে সমস্ত জনপদ পানিতে ভেসে যায় এবং ফসল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সহায়-সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে, তখন তাকে বন্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বন্যার সঙ্গে ফসলের একটা সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যাকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়: ক) মৌসুমি বন্যা (monsoon flood) - এই বন্যা ঋতুগত, নদনদীর পানি ধীরে ধীরে উঠানামা করে এবং বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে; খ) আকস্মিক বন্যা (flash flood) - আকস্মিক পাহাড়ি ঢল অথবা স্বল্প সময়ে সংঘটিত প্রবল বৃষ্টিপাত থেকে কিংবা প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট বাঁধ ভেঙে সংঘটিত হয়; এবং গ) জোয়ারসৃষ্ট বন্যা (tidal flood): সংক্ষিপ্ত স্থিতিকাল বিশিষ্ট এই বন্যার উচ্চতা সাধারণত ৩ থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং ভূভাগের নিষ্কাশন প্রণালীকে আবদ্ধ করে ফেলে।
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর বাৎসরিক সম্মিলিত বন্যার প্রবাহ একটিই নির্গম পথ অর্থাৎ লোয়ার মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এ কারণে লোয়ার মেঘনার ঢাল ও নিষ্ক্রমণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। নদীর পানির স্তরের এই উচ্চতার প্রতিকূল প্রভাব সারা দেশেই পড়ে। কারণ বন্যার পানি নিষ্ক্রমণের অবস্থা ও ক্ষমতা দুটোই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতে ছোট ছোট নদীর প্রবাহ কমে যায় এবং ভূ-পৃষ্ঠের পানির আভিকর্ষিক নিষ্ক্রমণ শুধুমাত্র বন্যার উপরে জেগে থাকা ভূমিতেই সীমাবদ্ধ। নিষ্ক্রমণ প্রতিবন্ধকতার কারণে সৃষ্ট বন্যা দেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের উঁচুভূমি ও পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া প্রায় সর্বত্রই বিরাজমান।
দেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের ডান দিকের প্লাবনভূমিগুলোকে রক্ষা করছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্লাবনভূমিসমূহকে ৩টি সুস্পষ্ট অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়, যথা: ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার বাম প্লাবনভূমি; মধুপুর গড় দ্বারা ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে বিচ্ছিন্ন পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী উপত্যকা ও মেঘনা নদী অববাহিকা। মেঘনা অববাহিকা মহা-সিলেট-অবনমন (Great Sylhet Depression) দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত যেখানে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী মিলিত হয়ে মেঘনা নাম পরিগ্রহ করেছে। মেঘনা নদীর পানির উচ্চমাত্রা বন্যার মৌসুমে ভাটিতে পদ্মানদীর পানির মাত্রা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বর্ষাকালের প্রারম্ভেই মেঘনা নদী দ্রুত বন্যার পানিতে ভরে ওঠে এবং বর্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা পূর্ণাবস্থাতেই বিরাজ করে। এই অববাহিকায় নিষ্ক্রমণের হার কম।
উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলে পার্বত্য পরিবাহ (hill catchment) নিষ্ক্রমণ আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করে। এই বন্যা স্বল্পকালীন হলেও এর সংঘটনের হার বা তীব্রতা সম্পর্কে আগে থেকে কিছু জানা যায় না। একই মৌসুমে এই ধরনের বন্যা বেশ কবার দেখা দিতে পারে।
দক্ষিণ-মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অধিকাংশ স্থানে বন্যা জোয়ারভাটা, ঝড়ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস ও অপর্যাপ্ত নিষ্ক্রমণ দ্বারা প্রভাবিত। দক্ষিণ মধ্যাঞ্চলের উত্তরাঞ্চলীয় অর্ধ পদ্মা ও লোয়ার মেঘনা নদীর মুখ্য প্লাবনভূমি আর দক্ষিণাঞ্চলীয় অর্ধ হচ্ছে জাল সদৃশ মোহনাস্থ খাঁড়ি যেগুলোর মাধ্যমে লোয়ার মেঘনার প্রবাহের প্রায় ৪০ শতাংশ সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলের নিষ্ক্রমণ ব্যবস্থা গঙ্গার পলি আবৃত সাবেক শাখা নদীগুলোর মাধ্যমেই প্রধানত চালু আছে। প্রায় মজে যাওয়া একটা বদ্বীপের (moribund delta) মাধ্যমে এই শাখা নদীগুলি সমুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত। ফলে অগভীর বন্যার প্রাদুর্ভাব এ অঞ্চলে খুব বেশি।
বাংলাদেশের বন্যা সংঘটনের জন্য দায়ী কারণগুলি হচ্ছে: ১) সাধারণভাবে নিম্ন উচ্চতাবিশিষ্ট ভূসংস্থান যার উপর দিয়ে প্রধান প্রধান নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীগুলি তাদের শাখা-প্রশাখা এবং উপনদীর সমন্বয়ে ঘন বিন্যস্ত নিষ্কাশন জালিকা গড়ে তুলেছে ২) দেশের বাইরে নদনদীর উজান এলাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে ভারি বৃষ্টিপাত; ৩) হিমালয় পর্বতে তুষার গলন এবং প্রাকৃতিকভাবে হিমবাহের স্থানান্তর সংঘটন; ৪) পলি সঞ্চয়নের ফলে নদনদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া/নদীর পার্শ্বদেশ দখল হয়ে যাওয়া/ভূমিধ্বস সংঘটন; ৫) প্রধান প্রধান নদীসমূহে একসঙ্গে পানি বৃদ্ধি এবং এক নদীর ওপর অন্য নদীর প্রভাব বিস্তার; ৬) প্রকৃতির ওপর মানবীয় হস্তক্ষেপ; ৭) জোয়ারভাটা এবং বায়ুপ্রবাহের বিপরীতমুখী ক্রিয়ার ফলে নদনদীর সমুদ্রমুখী প্রবাহ ধীরগতি প্রাপ্ত হওয়া (back water effect); ৮) সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া; ৯) ভূ-গাঠনিক বিশৃঙ্খলা (ভূমিকম্প, নদীর প্রবাহ ও ভূরূপতত্ত্বে পরিবর্তন); ১০) সম্ভাব্য গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি।
বন্যার ইতিহাস বাংলাদেশে বন্যার ইতিহাস দেশটির ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতি শতাব্দীতে বঙ্গীয় বদ্বীপ প্রায় অর্ধডজন বন্যার মুখে পড়েছে, ব্যাপকতায় যা ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যার প্রায় সমান। বাংলাদেশের এই মৌসুমি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা মহাভারত, রামায়ণ ও অন্যান্য গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (৩২১-২৯৬ খ্রি পূ) শাসনামলে তাঁর অর্থমন্ত্রী কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যান উল্লেখ রয়েছে যাতে প্রমাণিত হয় যে, বৃষ্টিপাতের হিসাব সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ছিল। জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির (৫০৭-৫৮৭ খ্রি পূ) বৃষ্টির পূর্বাভাস দিতে পারতেন। জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট ও ব্রহ্মগুপ্তও বর্ষা মৌসুম নিয়ে গবেষণা করেছেন। বিখ্যাত সংস্কৃতকবি কালিদাস বিরচিত বর্ষার বিরহাভিসার মেঘদূত ও ঋতুসংহার কাব্য বিশ্ববিশ্রুত ধ্রপদী-মহাকাব্য। তবে প্রাচীনকালে খনা নাম্নী এক বিদুষী মহিলা আবহাওয়া ও কৃষিবার্তা সম্পর্কে অধিকাংশ পূর্বাভাস করে গেছেন। আজও বাংলাদেশের কৃষককুল তাঁর রচনাসমূহ স্মরণ করে। আরবরা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করতে গিয়ে ঋতুর সঙ্গে মৌসুমি বায়ুর পরিবর্তন জ্ঞানকে লাভজনকভাবে কাজে লাগিয়েছে। মৌসুম শব্দটি আরবী শব্দ মৌসিম থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ঋতু। বাংলায় ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত সংঘটিত বন্যার ওপর অধ্যাপক পিসি মহলানবীশ প্রণীত সর্বপ্রথম বিস্তারিত রিপোর্টটিতে দেখানো হয়েছে যে, মাঝারি আকারের বন্যা গড়ে প্রতি দুই বছরে একবার এবং ভয়াবহ বন্যা গড়ে ৬/৭ বছরে একবার সংঘটিত হয়েছে।
বাংলাদেশে বন্যা একটি পুনঃপুনঃ সংঘটিত ঘটনা। ১৭৮৭ থেকে ১৮৩০ পর্যন্ত সংঘটিত পুনরাবৃত্ত বন্যায় ব্রহ্মপুত্রের পুরানো গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যায়। ১৯২২ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রলয়ংকরী এক বন্যার পর একটি বন্যা কমিটি গঠিত হয়। এছাড়াও উত্তরবঙ্গে ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বন্যার উপরে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের উপাত্ত বিশ্লেষণে মত প্রকাশ করা হয় যে, ব্যাপক বন্যা প্রতি সাত বছরে একবার এবং মহাপ্রলয়ংকরী বন্যা প্রতি ৩৩-৫০ বছরে একবার এই জনপদে হানা দিতে পারে।
অষ্টাদশ শতকের শেষপাদ থেকে এই অঞ্চলে বড় ধরনের মৌসুমি বন্যার ইতিহাস কালানুযায়ী নিচে দেখানো হলো:
বন্যার কালক্রম
১৭৮১ ব্যাপক বন্যা বিশেষ করে সিলেটের পশ্চিমাঞ্চলে। খাদ্যের অভাবে গবাদি পশুর ভোগান্তি ঘটে।
১৭৮৬ মেঘনার বানে তীরবর্তী গ্রামের ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। এর প্রকোপে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে বাকেরগঞ্জে ব্যাপক প্রাণহানি। ত্রিপুরায় গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙ্গে যায়। সিলেট পরগনা সম্পূর্ণ পানিতে তলিয়ে যায়। গবাদি পশু প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
১৭৯৪ গোমতী বাঁধে আবার ভাঙ্গন ও ত্রিপুরার চারপাশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি।
১৮২২ বাকেরগঞ্জ বিভাগ ও পটুয়াখালি মহকুমা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত; ৩৯,৯৪০ ব্যক্তি ও ১৯০০০ গবাদিপশু মারা যায় এবং ১৩ কোটি টাকা মূল্যের সহায়সম্পদ ধ্বংস হয়। বরিশাল, ভোলা ও মনপুরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ।
১৮২৫ বাকেরগঞ্জ ও এর আশপাশে বিধ্বংসী বন্যা। জেলাটিতে কোন গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ বা অন্য কোন ধরনের বন্যা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ছিল না।
১৮৩৮ ভারি বর্ষণে রাজশাহী ও আরও কিছু জেলা ব্যাপকভাবে প্লাবিত। গোসম্পদ খাদ্যের অভাবে বিপর্যস্ত, নিমজ্জিত অঞ্চল ছেড়ে উঁঁচু স্থানের খোঁজে জনগণের ব্যাপক দুর্ভোগ। পানি নেমে যাওয়ার পর মহামারী আকারে কলেরার বিস্তার।
১৮৫৩ ভারি স্থানীয় বর্ষণ ও মেঘনা নদীর তীর ছাপানোর কারণে সিলেটের পশ্চিম অংশে প্রতিবছরের চেয়ে বেশি প্লাবন।
১৮৬৪ বাঁধ ভেঙ্গে গঙ্গার পানিতে রাজশাহী শহরের বৃহত্তর অংশ গভীর পানির তলে। বহুলোকের দুর্ভোগ ও গোসম্পদের ক্ষতি।
১৮৬৫ ব্যাপক প্লাবনে রাজশাহী শহর ক্ষতিগ্রস্ত। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে রাজশাহী শহর বিপর্যস্ত।
১৮৬৭ বিধ্বংসী বন্যার কবলে বাকেরগঞ্জ। শস্যের ব্যাপক ক্ষতি।
১৮৬৯ ১৮৬৭-র অবস্থা।
১৮৭১ রাজশাহী ও আরও কিছু জেলায় ব্যাপক বন্যা। শস্য, গবাদি পশু ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিষপত্রের ক্ষতি। রাজশাহীতে রেকর্ডকৃত এ যাবৎকালের সবচেয়ে ভয়ংকর বন্যা।
১৮৭৬ বরিশাল ও পটুয়াখালী দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। মেঘনা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬.৭১ মিটার স্ফীত হয়ে গলাচিপা ও বাউফল ব্যাপক ক্ষতির মুখে। ২,১৫০০০ লোকের জীবনহানি। বন্যার অব্যবহিত পরে কলেরার প্রাদুর্ভাব।
১৮৭৯ ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তিস্তায় বান।
১৮৮৫ ভাগীরথী নদী বরাবর বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় ভয়াবহ বন্যার কবলে খুলনার সাতক্ষীরা মহকুমা।
১৮৯০ সাতক্ষীরা মহকুমায় আবার গুরুতর বন্যা এবং মানুষ ও গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষতি।
১৯০০ ভাগীরথী নদীর বাঁধ ভেঙ্গে আবার সাতক্ষীরা মহকুমা ক্ষতিগ্রস্ত।
১৯০২ সিলেটে নদীপৃষ্ঠ স্ফীত হয়ে প্রলয়ংকরী বন্যা। শস্য এবং মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি।
১৯০৪ অস্বাভাবিক উঁচু জোয়ারে কক্সবাজার মহকুমা ও কুতুবদিয়া দ্বীপের কিছু অংশে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত।
১৯১৫ ময়মনসিংহে তীব্র বন্যা। ১৮৫৯ সালে ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পরিবর্তন হেতু তিস্তা নদীর যে বন্যা হয়েছিল তার সঙ্গে-এ বছরের বন্যার ক্ষয়ক্ষতির তুলনা চলে।
১৯৫ ২ আগস্ট ঢাকা শহর পানির তলে নিমজ্জিত। ১ আগস্ট সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানির উচ্চতা ছিল ১৪.২২ মি এবং ৩০ আগস্ট হা©র্র্ডঞ্জ ব্রিজের কাছে গঙ্গা নদীর পানির উচ্চতা ছিল ১৪.৯১ মি।
১৯৫৫ ঢাকা জেলার ৩০% এলাকা প্লাবিত। বুড়িগঙ্গা ১৯৫৪ সালের সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যায়।
১৯৬২ দুইবার বন্যার পদধ্বনি। একবার জুলাই ও আরেকবার আগষ্ট-সেপ্টেম্বর। বহুলোক আক্রান্ত ও মূল্যবান সম্পত্তি বিনষ্ট।
১৯৬৬ ঢাকা জেলার অন্যতম প্রলয়ংকরী বন্যাটি হয় ৮ জুন ১৯৬৬। এ বছর সিলেট জেলাতেও বড় ধরনের বন্যা দেখা দেয়। বন্যা ছাড়াও ১৯৬৬ সালের ১২ জুন সকালে এক প্রচন্ড ঝড়ে জেলার পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হয়ে ওঠে। এতে প্রায় ২৫% ঘরবাড়ি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ৩৯ ব্যক্তি ও ১০০০০ গবাদি পশু মারা যায় এবং প্রায় ১২ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর ৫২ ঘণ্টা একনাগাড়ে বৃষ্টির ফলে ঢাকা শহর প্রায় ১২ ঘণ্টা ১.৮৩ মিটার পানির তলে নিমজ্জিত ছিল।
১৯৬৮ সিলেটে ভয়াবহ বন্যা এবং প্রায় ৭ লক্ষ লোক দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
১৯৬৯ চট্টগ্রাম জেলা বন্যার কবলে। শস্য এবং মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি।
১৯৭৪ ময়মনসিংহে প্রায় ১০,৩৬০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল বন্যা কবলিত। মানুষ ও গবাদি সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি ও লক্ষলক্ষ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত।
১৯৮৭ জুলাই-আগস্ট মাসে বন্যায় বড় ধরনের বিপর্যয়। প্রায় ৫৭,৩০০ বর্গ কিমি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত (সমগ্র দেশের ৪০% এরও অধিক এলাকা)। এ ধরনের বন্যা ৩০-৭০ বছরে একবার ঘটে। দেশের ভিতরে এবং বাইরে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতই বন্যার প্রধান কারণ ছিল। ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমাঞ্চল, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র একীভূত হওয়ার নিচের অঞ্চল, খুলনার উল্টরাংশ এবং মেঘালয় পাহাড়ের সংলগ্ন অঞ্চল বন্যা কবলিত হয়।
১৯৮৮ আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বন্যায় ভয়ংকর বিপর্যয়। প্রায় ৮২,০০০ বর্গ কিমি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত (সমগ্র দেশের ৬০% এরও অধিক এলাকা)। এ ধরনের বন্যা ৫০-১০০ বছরে একবার ঘটে। বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে (তিন দিনের মধ্যে) দেশের তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ একই সময় ঘটার (ংুহপযৎড়হরুব) ফলে বন্যার আরও ব্যাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরও প্লাবিত হয়। বন্যা স্থায়িত্ব ছিল ১৫ থেকে ২০ দিন।
১৯৮৯ সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও মৌলভীবাজার এলাকায় বন্যায় ৬ লক্ষ লোক পানিবন্দী।
১৯৯৩ সারা দেশে প্রচন্ড বৃষ্টিতে হাজার হাজার হেক্টর জমির শস্য পানিতে তলিয়ে যায়। মোট ২৮ জেলা বন্যা কবলিত হয়।
১৯৯৮ সমগ্র দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এলাকা দুই মাসের অধিক সময় বন্যা কবলিত হয়। বন্যার ব্যাপ্তি অনুযায়ী এটি ১৯৮৮ সালের বন্যার সাথে তুলনীয়। ব্যাপক বৃষ্টিপাত, একই সময়ে দেশের তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ ঘটার ফলে ও ব্যাক ওয়াটার এ্যাফেক্টের কারণে এই বন্যা ঘটে।
২০০০ ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ৫টি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা বন্যায় বিধ্বস্ত। প্রায় ৩০ লক্ষ লোক গৃহহ্লীন। বন্যাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মাটির বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে ঘটে।
বন্যা-ব্যবস্থাপনা বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নির্গমন প্রকল্পগুলি বাঁধ, পোল্ডার ও অভিকর্ষিক পরিবাহীর ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল। বন্যা ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত পদ্ধতির ওপর অতি নির্ভরশীলতা এবং একই সঙ্গে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথের মতো অন্যান্য স্থাপনা সমূহ যা পানির প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করে, এদের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে দেশে বন্যা পরিস্থিতিকে আরও সঙ্গিন করেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নির্গমন প্রকল্পসমূহে প্রচুর পরিমাণ বিনিয়োগ সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে ফলাফল সন্তোষজনক নয়।
১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যা ব্যাপক ধ্বংসের দুর্ভোগ ও প্রাণহানির কারণ হয়। পর পর দুই বছর এই বন্যার ফলে সরকার পুনঃপুনঃ বন্যা সমস্যার একটি দীর্ঘ মেয়াদী ব্যাপক ও স্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্রতী হয়। এ লক্ষ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জরিপ চালানো হয়, যার ফলশ্রুতিতে ১৯৮৯ সালে বন্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনা (FAP) প্রণীত হয়।
বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা বন্যার ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করার ব্যাপারে কয়েকটি প্রস্তাব করা হয়। অবশ্য এইসব প্রস্তাবের অধিকাংশই গঙ্গানদী কেন্দ্রিক, যদিও বন্যা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদের নির্গমনের মাত্রা গঙ্গা নদীর চেয়ে বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশ বন্যার হাত থেকে জনবসতি ও ফসলি জমি রক্ষার জন্য প্রতিবছর ১,৩০,০০০ হেক্টর হারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ (অধিকাংশই পোল্ডার) নির্মাণের কৌশল অনুসরণ করছে। মুনাফা ও নিরাপত্তার দিক থেকে এর উপকারিতা ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যদিও দীর্ঘমেয়াদে এর পরিবেশগত প্রভাব যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয় নি।
বন্যার ক্ষতি ও প্রতিকূল প্রভাব হ্রাস করতে ও অতিরিক্ত পানি সেচকার্যের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন র্বোড কিছু সংখ্যক বাঁধ তৈরি করেছে ও খাল খনন করেছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: জি-কে (গঙ্গা-কপোতাক্ষ) প্রজেক্ট, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) প্রজেক্ট, কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্প, উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প, উত্তরবঙ্গের নলকূপ প্রকল্প, ব্রহ্মপুত্র বাঁধ, চাঁদপুর সেচ-প্রকল্প, মেঘনা-ধনাগোদা প্রকল্প, মনু নদী প্রকল্প, খোয়াই নদী প্রকল্প, পাবনা সেচ প্রকল্প, গোমতী প্রকল্প, মহুরী বাঁধ প্রকল্প, তিস্তা বাঁধ প্রকল্প (পর্যায়-১), ঢাকা সমন্বিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, প্রণালী পূনর্বাসন প্রকল্প, জরুরী বাস্তবায়ন প্রকল্প।
উপরোল্লিখিত কাঠামোগত পদক্ষেপসমূহ ছাড়াও বন্যা প্রশমন প্রক্রিয়া ও ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের একটি বিকল্প কৌশল হিসেবে অ-কাঠামোগত পদক্ষেপের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। অ-কাঠামোগত পদক্ষেপ বলতে বন্যা মোকাবিলায় সামাজিক অভিযোজনকে বোঝানো হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে: (১) জনগণ যাতে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে সে লক্ষ্যে বন্যার পানির উচ্চতা বৃদ্ধির যথেষ্ট সময় পূর্বে জনগণের কাছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে জোরদার করা; (২) নদনদীর উপচে পড়া পানি হ্রাসের লক্ষ্যে ভূমি ব্যবস্থাপনা সাধন। এ উদ্দেশ্যে বনায়ন এবং পুনর্বনায়নের সমন্বিত কর্মসূচী গ্রহণ ও তার যথাযথ সংরক্ষণ যাতে পরিশোষণ প্রক্রিয়া বৃদ্ধির মাধ্যমে বন্যার পানির উচ্চতা হ্রাস ঘটতে পারে; (৩) ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন এবং বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগ, শস্য উৎপাদন বহুমুখীকরণ তথা, বন্যা প্রতিরোধী বা বন্যা সহনক্ষম শস্য চিহ্নিতকরণ ও রোপণ করা এবং শস্য রোপণ মৌসুমের অভিযোজন; (৪) প্লাবনভূমিসমূহকে বিভিন্ন জোনে বিভক্ত করা এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভূমি ব্যবহার জোন তৈরি করা। অ-কাঠামোগত পদক্ষেপসমূহ স্বল্প ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
যেহেতু বন্যা ব্যবস্থাপনা সার্বিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেহেতু আঞ্চলিক সহযোগিতা পানি প্রতিবেশ ব্যবস্থার স্থায়ী সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অতি প্রয়োজনীয় যৌথ কলাকৌশলের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্য করবে। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী এবং মোঃ সাজ্জাদ হোসেন]