জলাভূমি

জলাভূমি (Wetland)  অবনমিত প্রতিবেশ ব্যবস্থা যেখানে পানির স্তর সবসময়ই ভুপৃষ্ঠের কাছাকাছি বা প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করে। জলাভূমি বলতে বোঝায় জলা (marsh or fen), ডোবা (bog),  প্লাবনভূমি (floodplain) এবং অগভীর উপকূলীয় এলাকাসমূহকে। জলাভূমিকে মোহনাজ এবং স্বাদুপানি ব্যবস্থা - এ দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যাদের আবার মৃত্তিকার ধরন ও উদ্ভিজ্জ প্রকৃতির ভিত্তিতে আরও উপবিভাগে ভাগ করা যায়। ধীর গতিপ্রবাহ অথবা স্থির পানি দ্বারা জলাভূমি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এবং এ পানিরাশি বন্য জলজ প্রাণীজগতের জন্য একটি মুক্ত আবাসস্থল। রামসার (Ramsar) কনভেনশন-১৯৭১ অনুযায়ী জলাভূমির সংজ্ঞা হচ্ছে- ‘‘প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট, স্থায়ী অথবা অস্থায়ী, স্থির অথবা প্রবহমান পানিরাশিবিশিষ্ট স্বাদু, লবণাক্ত অথবা মিশ্র পানিবিশিষ্ট জলা, ডোবা, পিটভূমি অথবা পানিসমৃদ্ধ এলাকা এবং সেইসঙ্গে এমন গভীরতাবিশিষ্ট সামুদ্রিক এলাকা যা নিম্ন জোয়ারের সময় ৬ মিটারের বেশি গভীরতা অতিক্রম করে না’’। জলাভূমির সংজ্ঞা দুটির মধ্যে প্রথমটি অধিক ব্যবহূত কিন্তু পরিবেশগত পরিসরের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি প্রথমটির চেয়ে সংকীর্ণতর। জলাভূমির রামসার সংজ্ঞাটি বিস্তৃত পরিসরে স্বাদু পানি, উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক পরিবেশকে একত্রে উপস্থাপন করে। বাংলাদেশে রামসার সংজ্ঞাটিই গৃহীত ও ব্যবহূত হচ্ছে। জীবতাত্ত্বিক ও ভৌত বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন শ্রেণীর জলাভূমি শনাক্ত করা হয়েছে যার মধ্যে ৩০টি শ্রেণী প্রাকৃতিক এবং ৯টি মানবসৃষ্ট। বাংলাদেশের জলাভূমিগুলিকে জলতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, ভূ-প্রকৃতি এবং প্রতিবেশগত ক্রিয়াকলাপের ওপর ভিত্তি করে নিচের ছক অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যাস করা যায়:

১. লোনাপানির জলাভূমি ক) সামুদ্রিক জলাভূমি নিম্ন জোয়ারভাটার সময় স্থায়ী অগভীর পানিরাশি, উদাহরণস্বরূপ: উপসাগর প্রবাল প্রাচীর, উদাহরণস্বরূপ: সেন্ট মার্টিন প্রবাল প্রাচীর
খ) মোহনাজ জলাভূমি পরিমিত উদ্ভিজ্জবিশিষ্ট আন্তঃজোয়ারভাটা সৃষ্ট কাদা, বালু অথবা লবণাক্ত সমতল, যেমন: নতুন জেগে ওঠা ভূমি আন্তঃজোয়ার ভাটা সৃষ্ট জলা সমূহ আন্তঃ জোয়ার ভাটা সৃষ্ট বনাচ্ছাদিত জলাভূমিসমূহ, স্রোতজ গরান বনভূমিও এর অন্তর্ভুক্ত; যেমন: সুন্দরবন
গ) লবণাক্ত হ্রদীয় জলাভূমি (Lagoonal) স্বাদু-লবণাক্ত থেকে লবণাক্ত হ্রদসমূহ যা সংকীর্ণ পথে সমুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত
২. স্বাদুপানির জলাভূমি ক) নদীজ জলাভূমি (Riverine) স্থায়ী নদনদী ও স্রোতস্বিনীসমূহ এবং কতিপয় চরাভূমিও এর অন্তর্ভুক্ত অস্থায়ী মৌসুমি নদনদী ও স্রোতস্বিনীসমূহ
খ) হ্রদজ বা বিল জলাভূমি (Lacustrine) বাংলাদেশে বিভিন্ন আকৃতির হাজারো হ্রদ রয়েছে। এদের বেশিরভাগই প্রধান বদ্বীপীয় অঞ্চলের রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেট জেলায় অবস্থিত।
গ) প্যালাসট্রাইন জলাভূমি (Palustrine) উন্মেষরত উদ্ভিজ্জবিশিষ্ট স্থায়ী স্বাদুপানির জলা ও জলমগ্ন ভূমি (swamps) সমূহ পিটগঠনকারী স্থায়ী স্বাদুপানির জলমগ্ন ভূমিসমূহ স্বাদুপানির জলমগ্ন বনভূমি, যেমন: নিুভূমির হিজল বন
৩. মানবসৃষ্ট জলাভূমি মৎস্যচাষের পুকুরসমূহ (স্বাদুপানির এবং স্বাদু-লবণাক্ত মিশ্রণ, উভয় ধরনের) সেচকৃত জমি ও সেচ খালসমূহলবণচাষের ত্রেসমূহ জল-বাঁধ যেমন: কাপ্তাই লেক

কৃষিভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা জলাভূমির সংজ্ঞায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকেন। প্লাবন বা বন্যার স্থায়িত্ব ও গভীরতার ওপর ভিত্তি করে সমগ্র দেশকে ছয়টি বৃহৎ ভূমি ধরনে বিভক্ত করা হয়েছে: উঁচুভূমি, মধ্যম উঁচুভূমি, মধ্যম নিম্নভূমি, নিম্নভূমি, অতি নিম্নভুমি এবং তলদেশীয় ভূমি। এ ভূমি শ্রেণীবিন্যাসের মধ্যে জলমগ্ন মাটির মধ্যম নিম্নভূমি (যা বর্ষা ঋতুতে ১৮০ সেমি পর্যন্ত প্লাবিত হয়) থেকে তলদেশীয় ভূমি পর্যন্ত এলাকাসমূহকে জলাভূমি বলে বিবেচনা করা হয়।

জলাভূমি

বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী, স্রোতস্বিনী, স্বাদুপানির হ্রদ ও জলা, হাওর, বাঁওড়, খাল, বিল, জলাধার, মাছ চাষের পুকুর, প্লাবিত কৃষিজমি এবং বিস্তৃত স্রোতজ গরান বনভূমিসহ (mangrove forest) মোহনাজ ব্যবস্থা সমন্বয়ে জলাভূমির এক বিশাল ভান্ডার। তবে উপকূলীয় ও সামুদ্রিক উৎসের জলাভূমি বাংলাদেশে কম গুরুত্বপূর্ণ। নদীজ উৎসের হাওর, বাঁওর, বিল, ঝিল প্রভৃতিকে সাধারণভাবে স্বাদুপানির জলাভূমি নামে আখ্যায়িত করা হয়। এসকল স্বাদুপানির জলাভূমি চারটি ভূদৃশ্যগত একক জুড়ে বিস্তৃত - প্লাবনভূমি, স্বাদুপানির জলাসমূহ, হ্রদসমূহ ও জলমগ্ন বনভূমি। মানবসৃষ্ট জলাভূমিসমূহের মধ্যে রয়েছে কৃত্রিম হ্রদ, দিঘি, পুকুর ও ডোবা। নদীবাহিত  পলি দ্বারা গঠিত হয় প্লাবনভূমি যা নিয়মিত প্লাবন ও আকস্মিক বন্যা দ্বারা প্লাবিত হয়ে থাকে। প্লাবনভূমির পশ্চাৎঢালে অবস্থিত স্বাদুপানির জলাভূমিগুলি কমবেশি অগভীর জলাধার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, এসকল জলাধার পুরানো অথবা পরিত্যক্ত নদীখাত, যেগুলিতে স্রোতের অভাবে দীর্ঘ নলখাগড়া ও ঘাস গজিয়ে ওঠে এবং ভাসমান গাছগাছড়া দিয়ে আবদ্ধ থাকে। হ্রদগুলি হচ্ছে গভীরতর বহুবর্ষজীবী জলাধার। জলমগ্ন বনভূমি গড়ে ওঠে বিল, জলা ও হ্রদের প্রান্তীয় এলাকায়। এখানকার উল্লেখযোগ্য বৃক্ষ হচ্ছে  হিজল (Barringtonia acutangula), তমাল (Diospyros cordifolia), বরুণ (Crataeva nurvala), মাদার (Erythrina variegata), গাব (Diospyros peregrina), ডুমুর (Ficus hispida), চালতা (Dillenia indica), ডেউয়া (Artocarpus lacucha) প্রভৃতি।

বৈশিষ্ট্যসমূহ  ভূসংস্থানের নিম্নতর প্রান্তে অবস্থিত জলাভূমিগুলি বর্ষা ঋতুতে অগভীর থেকে গভীর প্লাবন ও  বন্যা দ্বারা প্লাবিত হয়। জলাভূমির জলজ-ভূরূপতাত্ত্বিক (hydro-geomorphological) বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুধাবন করার জন্য একটি আদর্শ হাওরকে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা (elevation) ও জলতত্ত্ব (hydrology)-এর ওপর ভিত্তি করে একটি হাওরকে তিনটি অংশে বিভক্ত করা যেতে পারে: পর্বত পাদদেশীয় অংশ, প্লাবনভূমি ও গভীরভাবে প্লাবিত এলাকা। তিনটি অংশের মধ্যে পর্বত পাদদেশীয় অংশ সবচেয়ে উঁচু এবং পরিবৃদ্ধি অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত যেখানে অধিকতর মোটা পলিসমূহ  নদী দ্বারা বাহিত হয়ে পাড় বরাবর সঞ্চিত হয়। নদীপাড়ের নিম্নঢাল বরাবর যেখানে পলি সঞ্চয়ন ন্যুনতম এবং ক্রমানুসারে বিন্যস্ত হয় সেখানে পশ্চাৎজলাভূমি গঠিত হয়। এ পশ্চাৎজলাভূমি পানি ও পলি সঞ্চয়নের আধারের ভূমিকা পালন করে। বন্যার চূড়ান্ত পর্যায়ে, নদ-নদীর পানি তীর উপচে প্রবাহিত হয় এবং পশ্চাৎজলাভূমিকে প্লাবিত করে। এভাবে ভাটি এলাকায় বন্যার উচ্চতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। আবার পশ্চাৎজলাভূমি থেকে বন্যার পানি নদী দ্বারা নিষ্কাশিত হওয়ার মাধ্যমে তা ভাটি এলাকার প্রবাহকে ত্বরান্বিত করে।

ভূসংস্থানের মধ্যভাগে অবস্থিত পরিমিত ঢালবিশিষ্ট প্লাবনভূমি সূক্ষ্মতর পলি লাভ করে এবং পলির পরিমাণও হয় নিুতর মাত্রার। প্রতি বর্ষা মৌসুমে এ খণ্ডে অবস্থিত পশ্চাৎজলাভূমিসমূহ প্লাবিত ও নিষ্কাশিত হয় এবং ভাটি এলাকায় বন্যার তীব্রতা হ্রাসে সহায়তা করে। জলাভূমির গভীরতম ও তৃতীয় অংশ হচ্ছে বিল। বর্ষায় বিল ও প্লাবনভূমিসমূহ গভীরভাবে বন্যা দ্বারা প্লাবিত হয় এবং একটি একক জলাধারে রূপ নেয়। সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা অববাহিকা এবং যশোর, খুলনা ও ফরিদপুর জেলার হাওর-বাঁওড়গুলি এধরনের জলাভূমির উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

বাংলাদেশের জলাভূমি মৃত্তিকাকে দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যায়- জৈব মাটি ও খনিজ মাটি। জৈব মাটি প্রায় ৭৪,০০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং বাংলাদেশের সমস্ত নিচু অববাহিকাগুলিতে এটি রয়েছে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ-খুলনা অববাহিকা জৈব মাটির বিস্তৃতিতে শীর্ষে রয়েছে। অন্যদিকে, জলাভূমি পরিবেশে গঠিত খনিজ মাটি বাংলাদেশে সর্বাধিক বিস্তৃত। জলাভূমি মৃত্তিকা গঠনের জন্য মাটির জৈব কার্বন ০.১ থেকে ৪০ শতাংশ দায়ী। বাংলাদেশের বেশিরভাগ খনিজ জলাভূমি মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের উপস্থিতি খুবই কম এবং অর্ধেকেরও বেশি মাটিতে মাত্র এক থেকে দুই শতাংশ জৈব পদার্থ বিদ্যমান থাকে।

ভৌগোলিক বণ্টন  বাংলাদেশে জলাভূমির আওতায় মোট এলাকা ভিন্ন ভিন্ন হিসাব অনুযায়ী সত্তর থেকে আশি হাজার বর্গ কিলোমিটার যা দেশের মোট ভূভাগের প্রায় অর্ধেক। বিভিন্ন শ্রেণীর জলাভূমির এলাকাগত বিস্তৃতি নিচের সারণিতে উপস্থাপন করা হলো:

বিভিন্ন প্রকার জলাভূমি ও তাদের আয়তন (বর্গ কিলোমিটার)

উন্মুক্ত জলরাশি নদ-নদী ৭,৪৯৭
খাড়িসমূহ ও স্রোতজ গরান জলমগ্নভূমি ৬,১০২
বিল ও হাওর ১,১৪২
বন্যাপ্লাবিত প্লাবনভূমি ৫৪,৮৬৬
কাপ্তাই লেক ৬৮৮
আবদ্ধ জলরাশি পুকুর ১,৪৬৯
বাঁওড় (অশ্বুরাকৃতি হ্রদ) ৫৫
লবণাক্ত স্বাদুজলের খামার ১,০৮০
সর্বমোট ৭২,৮৯৯

উৎস আকন্দ ১৯৮৯ এবং খান ১৯৯৪।

প্রধান প্রধান নদ-নদী এবং প্রচুর স্রোতস্বিনী ছাড়াও নদীজ উৎস থেকে সৃষ্ট অনেক বড় বড় জলাভূমি বাংলাদেশের প্লাবনভূমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। মানবসৃষ্ট জলাভূমি যেমন, পুকুর, দিঘি, হ্রদ প্রভৃতিও প্লাবনভূমিতে ছড়িয়ে রয়েছে। দেশের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জলাভূমি হচ্ছে - চলন বিল, আত্রাই অববাহিকা, নিম্নতর পুনর্ভবা সমভূমি, গোপালগঞ্জ-খুলনা বিল, আড়িয়াল বিল ও সুরমা-কুশিয়ারা প্লাবনভূমি।

নিম্নতর আত্রাই অববাহিকা  বরেন্দ্রভূমি ও  গাঙ্গেয় প্লাবনভূমি-এর মধ্যবর্তী নিম্ন এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। প্রাথমিকভাবে এ অববাহিকা  আত্রাই ও  যমুনা নদীদ্বয় থেকে পানি সংগ্রহ করে; গঙ্গার শাখানদীগুলি এবং বরেন্দ্রভূমির নিষ্কাশন থেকেও সামান্য পরিমাণে পানি পেয়ে থাকে। বর্ষা মৌসুমে এ এলাকা গভীরভাবে বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। নওগাঁ জেলার পশ্চিমে এবং নবাবগঞ্জ (চাপাই নবাবগঞ্জ) জেলার উত্তরে পুনর্ভবা নদীর নিম্নতর প্রবাহ বরাবর একটি সংকীর্ণ ভূখন্ডে নিম্নতর পুনর্ভবা প্লাবনভূমি অবস্থিত। এ আদর্শ ভূসংস্থান প্রশস্ত শৈলশিরা ও অববাহিকা নিয়ে গঠিত এবং অববাহিকা কেন্দ্রে রয়েছে একাধিক বিল। অধিকাংশ এলাকাই বর্ষা ঋতুতে গভীরভাবে প্লাবিত হয়, আবার আকস্মিক বন্যা দ্বারাও প্লাবিত হয়ে থাকে। গাঙ্গেয় প্লাবনভূমি ও গাঙ্গেয় জোয়ার-ভাটা প্লাবনভূমির মধ্যবর্তী অংশে গোপালগঞ্জ-খুলনা বিল অবস্থিত। অসংখ্য পৃথক অববাহিকা দ্বারা এ বিল এলাকা বিভক্ত যেগুলি এ বিল এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া নদ-নদী সংলগ্ন গাঙ্গেয় পললসৃষ্ট শৈলশিরা দ্বারা গঠিত। অববাহিকার কেন্দ্রস্থল প্রায় সমুদ্র সমতলের সমান উচ্চতাবিশিষ্ট, সে কারণে বর্ষা ঋতুতে বন্যার পানি দিয়ে প্লাবিত হয় এবং পানি সারা বছরই ধরে রাখে। সামান্য উঁচু অববাহিকা প্রান্তগুলি পরিমিত গভীরতায় বন্যাপ্লাবিত হয় এবং বছরে নয় মাসেরও বেশি সময় জুড়ে আর্দ্র থাকে। আড়িয়াল বিল গাঙ্গেয় প্লাবনভূমি এবং নবীন ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমির মধ্যবর্তী ও বৃহত্তর ঢাকা জেলার দক্ষিণে নিম্নভূমি অববাহিকা জুড়ে অবস্থিত। অববাহিকার কেন্দ্রীয় এলাকায় ঋতুভিত্তিক প্লাবনের মাত্রা গভীর হলেও উচ্চতর প্রান্তীয় এলাকায় পরিমিত মাত্রায় গভীর। শুকনা ঋতুর অধিকাংশ সময় জুড়ে অববাহিকা কেন্দ্রে পানি থাকে।  সুরমা ও  কুশিয়ারা নদী এবং তাদের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ি উপনদী ও শাখানদী দিয়ে সৃষ্ট সর্পিলাকার প্লাবনভূমি নিয়ে সুরমা-কুশিয়ারা প্লাবনভূমি এলাকা গঠিত। অসংখ্য হাওরের সমন্বয়ে গঠিত সুবিস্তৃত ও অবনমিত এ এলাকাকে সিলেট অববাহিকা নামে আখ্যায়িত করা হয়। মৌসুমি বন্যা সংঘটন মে মাসের প্রথম থেকে মধ্যভাগে শুরু হয় এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। অববাহিকার কেন্দ্রে পাঁচ মিটারেরও বেশি গভীরতার প্লাবন হয়ে থাকে। অববাহিকার গভীরতম অংশে সারা বছরই পানি থাকে এবং শুধুমাত্র শৈলশিরাগুলি জানুয়ারি মাসের পর থেকে শুকাতে আরম্ভ করে।

গুরুত্ব  বাংলাদেশের জলাভূমিগুলির ব্যাপক বিস্তৃত প্রতিবেশগত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব এবং মূল্য রয়েছে। স্থানীয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক তাৎপর্য বহনকারী এসকল জলাভূমি জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল। বাংলাদেশের জলাভূমিগুলি মানব বসতি, জীববৈচিত্র্য,  মৎস্য উৎপাদন, কৃষি বহুমুখীকরণ, নৌচলাচল ও যোগাযোগ এবং প্রতিবেশ-পর্যটন প্রভৃতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক সপুষ্পক উদ্ভিদ এবং ১,৫০০ প্রজাতির মেরুদন্ডী প্রাণী যাদের মধ্যে প্রায় ৭৫০ প্রজাতির  পাখি এবং ৫০০ প্রজাতির উপকূলীয় মোহনা এলাকার ও স্বাদুপানির  মাছ বাংলাদেশের জলাভূমি এলাকাগুলিতে পাওয়া যায়। ৪০০ প্রজাতির মেরুদন্ডী প্রাণী এবং প্রায় ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ তাদের জীবনকালের সমগ্র অংশ অথবা আংশিক সময়কালের জন্য জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল থাকে। বাংলাদেশের জলাভূমিগুলিতে প্রায় ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ পাওয়া যায়। স্বাদুপানির মৎস্য আহরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা এবং সে সঙ্গে প্রাণীজ আমিষের অন্যতম যোগানদাতা হচ্ছে এ স্বাদুপানির মাছ। সকল জলাভূমিতেই জৈবপদার্থ সমৃদ্ধ কর্দম মৃত্তিকার সঞ্চয়ন ঘটে এবং জলাবদ্ধতা ও প্লাবনসহন ক্ষমতাসম্পন্ন শস্যাদি জলাভূমির বিস্তৃত এলাকায় জন্মে থাকে। ষাটের দশকে শুকনো মৌসুমে যান্ত্রিক সেচ পদ্ধতি সূচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বর্ষা ঋতুর গভীর পানির  ধান তথা ভাসমান ধানই ছিল দেশের জলাভূমি এলাকায় চাষ করা প্রধান শস্য।

উন্নয়ন কর্মকান্ড  বিগত তিন দশকে জলাভূমি তথা প্লাবনভূমি ও হাওর এলাকায় রাস্তাঘাট, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রভৃতি ব্যাপক ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। অধিকাংশ উন্নয়ন কর্মকান্ডের বেলাতেই স্থানীয় ভূসংস্থানিক অবস্থা এবং প্রাকৃতিক পানি প্রবাহের বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করায় নিম্নমানের নিষ্কাশন ব্যবস্থা তথা জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে এবং স্থানীয় ভূপৃষ্ঠ জলরাশিতেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলি অতি দ্রুত ব্যাপক মাত্রায় জলাভূমির রূপান্তর সাধন করছে।  বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প-এর অধীনে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমি এলাকায় প্রায় ২১ লক্ষ হেক্টর জলাভূমির বিলুপ্তি ঘটেছে। জলাভূমিগুলিতে মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে দেশের ভঙ্গুর প্রতিবেশ ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত ধ্বংসের মুখোমুখি হচ্ছে এবং জলাভূমির দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় সমভূমির স্বাদু লবণাক্ত পানিসমৃদ্ধ জমিতে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের ফলে জমির ঊর্ধ্ব লবণস্তর অপসারিত হলে কৃষকেরা ধান চাষ করত, আর বছরের বাকি সময় সে জমিকে পশুচারণের জন্য পতিত রাখত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ চাষাবাদ ব্যবস্থা চলে আসছিল। কিন্তু বিগত দু’দশক যাবত চাষাবাদের এ চর্চা পরিত্যক্ত হয়ে তার পরিবর্তে অধিক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে  চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। এর ফলে, পরিবর্তিত পানি বিনিময় ব্যবস্থা, নদীখাতসমূহে পলি সঞ্চয়ন এবং প্রতিনিয়ত লবণাক্ত পানি দিয়ে জমি প্লাবিত করার ফলে স্থানীয় প্রতিবেশ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

হাওর এলাকাসমূহে বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে চতুপার্শ্বস্থ ঘনবসতি এলাকাগুলি থেকে লোকজন এসে বসতি গড়ে তুলছে এবং ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। অব্যাহতভাবে ব্যাপক মাত্রায় জলজ উদ্ভিদ ও ফলমূল, যেমন: মাকনা (Euryale ferox), সিঙ্গারা (Trapa bispinosa), পদ্ম, শাপলা, হোগলা (Typha elephantina), প্রভৃতি আহরণের ফলে হাওর এলাকার মাছ ও অতিথি পাখির আবাসের জন্য প্রয়োজনীয় এসব উদ্ভিদের পরিমাণ ও গুণাগুণ দুইই মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। একইভাবে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পের জন্য নির্মিত বাঁধগুলি একদিকে যেমন প্লাবনভূমি হ্রাস করছে তেমনি আবার খাদ্য সংগ্রহ ও পোনা ছাড়ার জন্য নদী থেকে বিভিন্ন বিল ও প্লাবনভূমিতে চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ফলে বহু জেলে তাদের জীবিকা ত্যাগে বাধ্য হচ্ছে।

জলাভূমি রূপান্তরের কিছু ইতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। প্রধান প্রভাব হচ্ছে চাষাবাদের ধরন ও নিবিড়তার ওপর। এর ফলে স্থানীয় বোরো ধানের ওপর নির্ভরতা কমে উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্প এলাকাগুলিতে মাছ চাষ প্রাকৃতিক মৎস্য আহরণ ঘাটতিকে পূরণে সহায়তা করছে। জলাভূমি এলাকাসমূহে উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় উন্নত সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপণন অবকাঠামোকে উন্নত করেছে এবং সামাজিক ও অন্যান্য সেবাগুলি তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য হয়েছে। বিপরীতক্রমে,  নৌপরিবহণ ব্যবস্থা হয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে অথবা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে, জলাভূমিগুলির ক্রমাবনতি বহু সমস্যার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে - পাখি ও সরীসৃপসহ বেশকিছু  বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হওয়া বা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়া; অনেক প্রকার দেশিয় ধানের প্রকারভেদের বিলুপ্তি; বহু ধরনের দেশিয় জলজ উদ্ভিদ, বীরুৎ, গুল্ম ও নলখাগড়ার ধ্বংস সাধন; মাটির প্রাকৃতিক পুষ্টি হ্রাস; প্রাকৃতিক জলাশয় ও তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপকারিতা হারিয়ে যাওয়া; বন্যার সংঘটন বৃদ্ধি পাওয়া এবং জলাভূমি ভিত্তিক প্রতিবেশ ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন এবং আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতির বিলুপ্তি এবং সর্বোপরি মানুষের জীবিকার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জলাভূমির গতিশীল প্রতিবেশ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে থাকে। বাহ্যিক হুমকির প্রতিরোধ ব্যবস্থা সত্ত্বেও অত্যধিক পলি সঞ্চয়ন, নদীর গতি পরিবর্তন প্রভৃতি কারণে এর স্বাভাবিক অবলুপ্তিও ঘটতে পারে। তবে মানবীয় কর্মকান্ডের মাধ্যমে জলাভূমির যে কোনো ধরনের পরিবর্তন অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে পরিচালিত করতে হবে।  [মোহা. শামসুল আলম এবং মাসুদ হাসান চৌধুরী]

আরও দেখুন নদী; বাঁওড়; বিল; হাওর