গান্ধী আশ্রম
গান্ধী আশ্রম নোয়াখালী জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরে বেগমগঞ্জ উপজেলার জয়াগ গ্রামে অবস্থিত একটি জনহিতকর ও সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। এটি ১৯৪৬ সাল থেকে শান্তি ও সামাজিক সম্প্রীতির গান্ধীয় দর্শনের ওপর কাজ করছে। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী জেলার চারটি উপজেলার ১০২টি গ্রাম এবং নোয়াখালী ও চাটখিল পৌরসভা এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বিস্তৃত।
ভারত ছাড় আন্দোলন-এর শেষদিকে ১৯৪৬ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার সর্বত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। মহাত্মা গান্ধী ‘শান্তি মিশনে’ দ্রুত নোয়াখালী ছুটে যান। ১৯৪৬ সালের ৭ নভেম্বর তিনি চৌমুহনী রেলস্টেশনে অবতরণ করেন। আইনসভার স্থানীয় সদস্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় গান্ধী শান্তি ও ভালবাসার জন্য উদাত্ত আহবান জানান। দেশ ও বিদেশ থেকে যোগদানকারী স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে তিনি তার শান্তি মিশন চালিয়ে যান। তিনি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে যান এবং জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় নিরলস কাজ করতে থাকেন। অহিংসা এবং নৈতিকতা, সত্য ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের নীতি তার মিশনকে সফল করে তোলে।
১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি গান্ধী জয়াগ পৌঁছেন। স্থানীয় জমিদার এবং নোয়াখালী জেলার প্রথম ব্যারিস্টার হেমন্তকুমার ঘোষ তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি মহাত্মাকে দান করেন। গান্ধী ‘অম্বিকা-কালীগঙ্গা দাতব্য ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সে মর্মে এক দলিল নিবন্ধিত করেন। জনকল্যাণে নিবেদিত চারু চৌধুরীর অনুকূলে এক আমমোক্তারনামা সম্পাদিত হয়। স্থানীয় জনগণের স্বার্থে পূর্ণোদ্যমে উন্নয়ন কর্মকান্ড শুরু হয়। চারমাসব্যাপী মহাত্মা চাঁদপুর ও নোয়াখালীর বিভিন্ন অংশ ভ্রমণ করেন।
সাধারণ্যে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট নামে পরিচিত ‘অম্বিকা-কালীগঙ্গা দাতব্য ট্রাস্ট’-এর উন্নয়নমূলক ও দাতব্য কার্যক্রম দুটি লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট দাতব্য কার্যক্রম হাতে নেয় এবং দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করে। উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম ছাড়াও সমগ্র এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি জোরদার করার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত এসব কর্মকান্ড চালু ছিল।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর গান্ধী আশ্রমের দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্যের পরিবর্তন ঘটে। সরকার একে একটি অরাজনৈতিক ও অসাম্প্রদায়িক জনকলাণমূলক সংস্থায় পরিণত করেন। দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও কল্যাণের লক্ষ্যে একটি কমিটি এর সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে। বর্তমানে ট্রাস্ট যেসব কার্যক্রমে নিয়োজিত তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, প্রশিক্ষণ, অনাময়ব্যবস্থা, হ্যাচারি, কৃষি, দুগ্ধ খামার, জীবপদ্ধতি নির্ভর কৃষি প্রদর্শনী খামার, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত মহিলা সদস্যদের নেতৃত্বের উন্নয়ন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ, কাপড় রঙ করা, বস্ত্রবয়ন, সেলাই ও সূচিকর্ম।
ট্রাস্টটি হিসাবরক্ষণ, নারীর আইনগত অধিকার এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ দান করে। এটি প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ-বাজারে সদস্যদের অবাধ প্রবেশ ও দুর্গতদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করে এবং নারীর অন্তর্নিহিত শক্তি ও ক্ষমতায়ন দৃঢ় করে। পয়ঃনিষ্কাশন কর্মসূচিতে ট্রাস্ট নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহ ও পাকা পায়খানার মান নিশ্চিত করে এবং জলবাহিত রোগ হ্রাস করার চেষ্টাও করে। ট্রাস্ট একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি অনানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা করে। গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট কর্মসূচির মাধ্যমে বর্তমানে প্রায় এক লক্ষ লোক উপকৃত হচ্ছে। [সুলতান মাহমুদ ভূইয়া]