ক্রোশ
ক্রোশ (Krosh) দূরত্ব পরিমাপের একটি সনাতনী একক। ব্রিটিশদের দ্বারা মাইল ব্যবস্থা প্রবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত বাংলায় দূরত্ব পরিমাপে ‘ক্রোশ’-ই ছিল বহুল ব্যবহূত একক। বাংলার কিছু স্থানে ক্রোশকে ‘কোশ’ হিসেবেও উচ্চারণ করা হতো। বাংলা ছাড়া ভারতের অন্যান্য অংশেও ক্রোশ আদর্শ পরিমাপ একক হিসেবে প্রচলিত ছিল, তবে সর্বত্রই ক্রোশের নির্ধারিত দূরত্ব একরূপ ছিল না। বাংলায় সাধারণত ৮,০০০ হাতে (১ হাত = ১৮ ইঞ্চি) এক ক্রোশ অথবা কোশ ধরা হত।
ক্রোশ সম্পর্কে প্রাচীন ভারতীয় পন্ডিতদের মধ্যে বিভিন্ন মত ছিল: মনুর মতানুসারে ৪,০০০ হস্তের (হাত) সমপরিমাণ দূরত্ব হল এক ‘ক্রোশ’; প্রজাপতির মতে এটি ৫,০০০ হাতের সমপরিমাণ; এবং লীলাবতীর মতে এটি ৮,০০০ হাতের সমপরিমাণ। প্রাচীন ভারতের পরিমাপে ৪ ক্রোশে এক ‘যোজন’ হতো। চীনা পরিব্রাজক ফা হিয়েনের ভারত ভ্রমণের নির্ধারিত পথের দূরত্বের বর্ণনা থেকে স্যার এইচ.এম ইলিয়ট এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, ফা হিয়েনের সময় যোজন ৭ মাইলের কাছাকাছি ছিল। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এ দূরত্ব নির্ধারণ করেছেন সাড়ে সাত বা ৮ মাইল, ফার্গুসন ৬ মাইল; তবে ইলিয়টের প্রাক্কলনকে গড় হিসাবে ধরলে প্রাচীন ক্রোশ সমান পৌনে দুই মাইলের মতো হবে।
আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী ক্রোশ ছিল ৫,০০০ গজের সমান। ব্রিটিশ সরকার মুগল সম্রাট আকবরের সময়কার ‘ইলাহি গজ’-এর দৈর্ঘ্য নিরূপণ করেছিল ৩৩ ইঞ্চি। সে হিসেবে ‘আকবরী কোশ’-এর দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ২ মাইল ৪ ফার্লং ১৮৩১/৩ গজের সমান। দিল্লীর সন্নিকটস্থ এলাকায় দূরত্ব পরিমাপের জন্য সড়ক পথের পার্শ্বে স্থাপিত আকবরী আমলের কোশমিনার বা স্তম্ভগুলির কিছু কিছু এখনও দেখতে পাওয়া যায়। এ স্তম্ভগুলির মধ্যবর্তী দূরত্ব গড়ে ২ মাইল ৪ ফার্লং ১৫৮ গজ।
ব্রিটিশ শাসিত বাংলা এবং ভারতের অন্যান্য অংশে ব্যবহূত ক্রোশ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পরিমাপ এককসমূহ ছিল নিম্নরূপ:
৩ জব = ১ অঙ্গুলি বা বৃদ্ধাঙ্গুলির প্রশস্ততা (এক ইঞ্চির তিন-চতুর্থাংশ)
৪ অঙ্গুলি = ৩ মুষ্টি (৩ ইঞ্চি)
৩ মুষ্টি = ১ বিঘত (৯ ইঞ্চি)
২ বিঘত = ১ হাত (১৮ ইঞ্চি)
৪ হাত = ১ ধনু (৬ ফুট)
২,০০০ ধনু = ১ ক্রোশ (৪,০০০ গজ বা প্রায় সোয়া দুই মাইল)
৪ ক্রোশ = ১ যোজন
ব্রিটিশ ভারতের বাংলা শাসনবিভাগ অঞ্চলের (বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি) বৃহত্তর অংশে এক ক্রোশ সমান ২ মাইল হিসাব করা হতো, কিন্তু উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ছিল অনেক কম। উত্তর দোয়াব অঞ্চলে এ হিসাব আরও সুক্ষ্মভাবে করা হতো, এখানে সোয়া মাইলে এক ক্রোশ ধরা হতো। বুন্দেলখন্দ এলাকায় স্বাভাবিক ভাবে এটি ৩ মাইলের কাছাকাছি ছিল, এমনকি ৪ মাইল পর্যন্তও ছিল। মাদ্রাজে এটি ছিল সোয়া দুই মাইলের সমান এবং মহিশুরের ‘সুলতানী কোশ’ ছিল প্রায় ৪ মাইলের সমান। দেশের বিভিন্ন অংশসমূহে দুই ধরনের ক্রোশ প্রচলিত ছিল ‘পাকা’ এবং ‘কাচা’ ক্রোশ। ওজন ও পরিমাপে এ দুই ধরনের ব্যবস্থা ভারতের সর্বত্রই প্রচলিত ছিল; এমনকি পৃথিবীর অন্যান্য অনেক অংশেও এমন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। বর্তমান কালে ক্রোশ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত এককসমূহের মাধ্যমে পরিমাপ খুব একটা জনপ্রিয় অথবা গ্রহণযোগ্য নয়। [মাসুদ হাসান চৌধুরী]