শফী, মুহাম্মদ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
২ নং লাইন: | ২ নং লাইন: | ||
'''শফী, মুহাম্মদ''' (১৯১৫-১৯৭১) দন্ত চিকিৎসক, শহীদ বুদ্ধিজীবী। ১৯১৫ সালের ৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার দিঘড়ে গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা সুফি আবদুল লতিফ ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। তাঁর মা আয়েশা খাতুন। মুহাম্মদ শফী ১৯৩০ সালে হুগলি জেলা হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৩২ সালে হাওড়া গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। তিনি ১৯৩৬ সালে কলকাতা ডেন্টাল কলেজ থেকে দন্ত চিকিৎসায় ডিপ্লোমা এবং ১৯৪২ সালে কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। | '''শফী, মুহাম্মদ''' (১৯১৫-১৯৭১) দন্ত চিকিৎসক, শহীদ বুদ্ধিজীবী। ১৯১৫ সালের ৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার দিঘড়ে গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা সুফি আবদুল লতিফ ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। তাঁর মা আয়েশা খাতুন। মুহাম্মদ শফী ১৯৩০ সালে হুগলি জেলা হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৩২ সালে হাওড়া গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। তিনি ১৯৩৬ সালে কলকাতা ডেন্টাল কলেজ থেকে দন্ত চিকিৎসায় ডিপ্লোমা এবং ১৯৪২ সালে কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। | ||
[[Image:ShafiMuhammad.jpg|thumb|right|400px|মুহাম্মদ শফী]] | |||
মুহাম্মদ শফী কলকাতার আর. আহমদ ডেন্টাল ল্যাবরেটরিতে সার্জন হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডেন্টাল সার্জন পদে যোগ দেন। কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে ছিল তাঁর নিজস্ব ক্লিনিক। ভারত বিভাগের পর মুহাম্মদ শফী ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে চলে আসেন এবং চট্টগ্রামে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। তিনি এনায়েত বাজারের বাটালী রোডে তাঁর বাসভবনের নিচতলায় নিজস্ব ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। | মুহাম্মদ শফী কলকাতার আর. আহমদ ডেন্টাল ল্যাবরেটরিতে সার্জন হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডেন্টাল সার্জন পদে যোগ দেন। কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে ছিল তাঁর নিজস্ব ক্লিনিক। ভারত বিভাগের পর মুহাম্মদ শফী ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে চলে আসেন এবং চট্টগ্রামে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। তিনি এনায়েত বাজারের বাটালী রোডে তাঁর বাসভবনের নিচতলায় নিজস্ব ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। | ||
৭ নং লাইন: | ৮ নং লাইন: | ||
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তাঁর কার্যক্রম এবং তাঁর পারিবারিক বলয়ে সংস্কৃতি চর্চার বিকাশের ফলে মুহাম্মদ শফী চট্টগ্রামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। অন্যদিকে তিনি হয়ে উঠেন অবাঙালিদের বিরাগভাজন। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল সকালবেলা কয়েকজন পাকসেনা তাঁর বাড়ি থেকে তাঁকে একটি জিপে তুলে সার্কিট হাউজে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন ডাঃ শফীর এক সময়ের রুগী এবং পাক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার মির্যা আসলাম বেগ। ব্রিগেডিয়ারের নির্দেশে তখন তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়।কিন্তু মুক্তিলাভের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অপর এক সেনাদল তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে। | মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তাঁর কার্যক্রম এবং তাঁর পারিবারিক বলয়ে সংস্কৃতি চর্চার বিকাশের ফলে মুহাম্মদ শফী চট্টগ্রামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। অন্যদিকে তিনি হয়ে উঠেন অবাঙালিদের বিরাগভাজন। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল সকালবেলা কয়েকজন পাকসেনা তাঁর বাড়ি থেকে তাঁকে একটি জিপে তুলে সার্কিট হাউজে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন ডাঃ শফীর এক সময়ের রুগী এবং পাক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার মির্যা আসলাম বেগ। ব্রিগেডিয়ারের নির্দেশে তখন তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়।কিন্তু মুক্তিলাভের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অপর এক সেনাদল তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে। | ||
মেজর বোখারীর নেতৃত্বে কয়েকজন সশস্ত্র সৈনিক তাঁর বাড়িতে ঢোকে। মেজর তখন এক প্রস্ত কাগজ থেকে মুহাম্মদ শফীর বিরুদ্ধে আনীত ১১ দফা গুরুতর অভিযোগ পড়ে শোনান। অভিযোগগুলো সম্ভবত এলাকার অবাঙালিদের আনীত। সঙ্গে সঙ্গে মেজর বোখারী কয়েকজন সৈনিকসহ দ্রুত বাড়ির উপর তলায় উঠে যান। সেখানে একটি কক্ষের দরজার তালা ভেঙে উদ্ধার করেন অস্ত্র ও গুলিভর্তি কয়েকটি বাক্স। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণের জন্য এসব অস্ত্র ওই কক্ষে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। মুহাম্মদ শফী ও তাঁর শ্যালক খোন্দকার এহসানুল হককে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কড়া পাহাড়া বসানো হয় ডাঃ শফীর বাড়িতে। মুহাম্মদ শফী ও এহসানুল হককে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা যায়, কিন্তু তাদের মৃতদেহের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি। | মেজর বোখারীর নেতৃত্বে কয়েকজন সশস্ত্র সৈনিক তাঁর বাড়িতে ঢোকে। মেজর তখন এক প্রস্ত কাগজ থেকে মুহাম্মদ শফীর বিরুদ্ধে আনীত ১১ দফা গুরুতর অভিযোগ পড়ে শোনান। অভিযোগগুলো সম্ভবত এলাকার অবাঙালিদের আনীত। সঙ্গে সঙ্গে মেজর বোখারী কয়েকজন সৈনিকসহ দ্রুত বাড়ির উপর তলায় উঠে যান। সেখানে একটি কক্ষের দরজার তালা ভেঙে উদ্ধার করেন অস্ত্র ও গুলিভর্তি কয়েকটি বাক্স। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণের জন্য এসব অস্ত্র ওই কক্ষে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। মুহাম্মদ শফী ও তাঁর শ্যালক খোন্দকার এহসানুল হককে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কড়া পাহাড়া বসানো হয় ডাঃ শফীর বাড়িতে। মুহাম্মদ শফী ও এহসানুল হককে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা যায়, কিন্তু তাদের মৃতদেহের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি। |
০৮:৩৯, ১২ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
শফী, মুহাম্মদ (১৯১৫-১৯৭১) দন্ত চিকিৎসক, শহীদ বুদ্ধিজীবী। ১৯১৫ সালের ৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার দিঘড়ে গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা সুফি আবদুল লতিফ ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। তাঁর মা আয়েশা খাতুন। মুহাম্মদ শফী ১৯৩০ সালে হুগলি জেলা হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৩২ সালে হাওড়া গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। তিনি ১৯৩৬ সালে কলকাতা ডেন্টাল কলেজ থেকে দন্ত চিকিৎসায় ডিপ্লোমা এবং ১৯৪২ সালে কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন।
মুহাম্মদ শফী কলকাতার আর. আহমদ ডেন্টাল ল্যাবরেটরিতে সার্জন হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডেন্টাল সার্জন পদে যোগ দেন। কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে ছিল তাঁর নিজস্ব ক্লিনিক। ভারত বিভাগের পর মুহাম্মদ শফী ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে চলে আসেন এবং চট্টগ্রামে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। তিনি এনায়েত বাজারের বাটালী রোডে তাঁর বাসভবনের নিচতলায় নিজস্ব ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন।
ডাঃ শফী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। এনায়েত বাজারে তাঁর বাসভবনেই উদ্বোধন হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তাঁর কার্যক্রম এবং তাঁর পারিবারিক বলয়ে সংস্কৃতি চর্চার বিকাশের ফলে মুহাম্মদ শফী চট্টগ্রামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। অন্যদিকে তিনি হয়ে উঠেন অবাঙালিদের বিরাগভাজন। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল সকালবেলা কয়েকজন পাকসেনা তাঁর বাড়ি থেকে তাঁকে একটি জিপে তুলে সার্কিট হাউজে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন ডাঃ শফীর এক সময়ের রুগী এবং পাক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার মির্যা আসলাম বেগ। ব্রিগেডিয়ারের নির্দেশে তখন তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়।কিন্তু মুক্তিলাভের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অপর এক সেনাদল তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে।
মেজর বোখারীর নেতৃত্বে কয়েকজন সশস্ত্র সৈনিক তাঁর বাড়িতে ঢোকে। মেজর তখন এক প্রস্ত কাগজ থেকে মুহাম্মদ শফীর বিরুদ্ধে আনীত ১১ দফা গুরুতর অভিযোগ পড়ে শোনান। অভিযোগগুলো সম্ভবত এলাকার অবাঙালিদের আনীত। সঙ্গে সঙ্গে মেজর বোখারী কয়েকজন সৈনিকসহ দ্রুত বাড়ির উপর তলায় উঠে যান। সেখানে একটি কক্ষের দরজার তালা ভেঙে উদ্ধার করেন অস্ত্র ও গুলিভর্তি কয়েকটি বাক্স। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণের জন্য এসব অস্ত্র ওই কক্ষে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। মুহাম্মদ শফী ও তাঁর শ্যালক খোন্দকার এহসানুল হককে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কড়া পাহাড়া বসানো হয় ডাঃ শফীর বাড়িতে। মুহাম্মদ শফী ও এহসানুল হককে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা যায়, কিন্তু তাদের মৃতদেহের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি।
ডাঃ শফীর স্ত্রী মুশতারী শফী তার তিন পুত্র ও চার কন্যাসহ ওই রাতেই গোপনে পালিয়ে মিরের সরাই চলে যান এবং পরে সেখান থেকে আগরতলা পৌঁছেন।
মুহাম্মদ শফী ছিলেন প্রগতিশীল ও রাম রাজনীতির প্রতি অনুরাগী। চট্টগ্রাম কারাগারে রাজনৈতিক বন্দিদের চিকিৎসার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন মুহাম্মদ শফী। এই সুবাদে তিনি কারাগারে এবং প্রায়শ তাঁর ক্লিনিকে নামকরা বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। নিজে একজন লেখক, চিত্রকর, সঙ্গীতজ্ঞ এবং একসময় আকাশবানী কলকাতার তালিকাভুক্ত শিল্পী মুহাম্মদ শফী চট্টগ্রামে সাহিত্য চর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে উদার পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। তাঁর বাড়িটি ছিল নামকরা সাহিত্যিক ও শিল্পীদের মিলনক্ষেত্র। তিনি ছিলেন মহিলাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বান্ধবী সংঘের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, তাঁর স্ত্রী মুশতারী শফী সম্পাদিত মহিলাদের বাংলা মাসিকপত্র বান্ধবী’র প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি চট্টগ্রামের দুটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘প্রান্তিক’ ও ‘জাগৃতি’র প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
মুহাম্মদ শফী ছিলেন সব্যসাচী লেখক। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: জনসংখ্যা ও সম্পদ, প্রেম ও বিবাহের সম্পর্ক, চরিত্র হানির তাৎপর্য, নয়া গণতন্ত্র এবং অনুবাদ গ্রন্থ চিকিৎসা বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস, ঐতিহাসিক বসুতবাদ, শান্তি না শক্তি, হুনানের কৃষক আন্দোলন, জনযুদ্ধের বিজয় দীর্ঘজীবী হোক।
তাঁর রচিত জনসংখ্যা ও সম্পদ গ্রন্থের সৌকর্যের জন্য মুহাম্মদ শফী ১৯৬৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ জাতির জন্য তাঁর আত্মদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মুহাম্মদ শফীর নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। [মুয়ায্যম হুসায়ন খান]