মুজিবনগর সরকার: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
২২ নং লাইন: | ২২ নং লাইন: | ||
|} | |} | ||
[[Image:MujibnagarGovernment.jpg| | [[Image:MujibnagarGovernment.jpg|thumb|400px|right|মুজিবনগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি,প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ এবং প্রধান সেনাপতি]] | ||
'''''প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়''''' এস.এ সামাদ প্রতিরক্ষা সচিব। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি ওসমানী, চীফ অব স্টাফ কর্নেল আবদুর রব, উপ-সেনাপতি এ.কে খন্দকার, এবং ডি.জি মেডিকেল সার্ভিস ও বিভিন্ন পদবীর স্টাফ অফিসার এ দপ্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুদ্ধরত অঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটিতে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। তবে ১০নং বা নৌ সেক্টরে কোন সেক্টর কমান্ডার ছিল না, কমান্ডোরা যখন যে এলাকায় অভিযান করত সে সেক্টরের কমান্ডারের অধীনে থাকত। এ ছাড়াও জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও এস ফোর্স নামে তিনটি ব্রিগেড গঠন করা হয়। ব্রিগেডগুলির কমান্ডার হলেন যথাক্রমে মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর কে.এম সফিউল্লাহ। | '''''প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়''''' এস.এ সামাদ প্রতিরক্ষা সচিব। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি ওসমানী, চীফ অব স্টাফ কর্নেল আবদুর রব, উপ-সেনাপতি এ.কে খন্দকার, এবং ডি.জি মেডিকেল সার্ভিস ও বিভিন্ন পদবীর স্টাফ অফিসার এ দপ্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুদ্ধরত অঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটিতে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। তবে ১০নং বা নৌ সেক্টরে কোন সেক্টর কমান্ডার ছিল না, কমান্ডোরা যখন যে এলাকায় অভিযান করত সে সেক্টরের কমান্ডারের অধীনে থাকত। এ ছাড়াও জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও এস ফোর্স নামে তিনটি ব্রিগেড গঠন করা হয়। ব্রিগেডগুলির কমান্ডার হলেন যথাক্রমে মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর কে.এম সফিউল্লাহ। | ||
১০:০৭, ৪ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১০ এপ্রিল এ সরকার গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ হয় মুজিবনগর। মুজিবনগর সরকারের কর্মকান্ড বাংলাদেশ ভূখন্ডের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়েছিল বলে এ সরকার প্রবাসী মুজিবনগর সরকার হিসেবেও খ্যাত।
সরকার গঠন ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড তথা প্রধান নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুক্তাঞ্চল বৈদ্যনাথতলায় সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এম.এন.এ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এম.এন.এ। নবগঠিত সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে এখানে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সরকার গঠন এবং ১৭ এপ্রিল সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলেও মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন হয় ১৮ এপ্রিল। এদিন সরকারের কাঠামো ছিল নিম্নরূপ:
মুজিবনগর সরকারকে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ভাগ করা হয়। এছাড়া কয়েকটি বিভাগ মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীনে থাকে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রম নিম্নরূপ:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান | রাষ্ট্রপতি |
সৈয়দ নজরুল ইসলাম | উপরাষ্ট্রপতি (রাষ্ট্রপতি পাকিস্তানে অন্তরীণ থাকার কারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের দায়িত্বপ্রাপ্ত) |
তাজউদ্দীন আহমদ | প্রধানমন্ত্রীএবং প্রতিরক্ষা, তথ্য, সম্প্রচার ও যোগাযোগ, অর্থনৈতিক বিষয়াবলি, পরিকল্পনা বিভাগ, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ, সংস্থাপন এবং অন্যান্য যেসব বিষয় কারও ওপর ন্যস্ত হয়নি তার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী |
খন্দকার মোশতাক আহমদ | মন্ত্রী, পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় |
এম মনসুর আলী | মন্ত্রী, অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় |
এ এইচ এম কামরুজ্জামান | মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয় |
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এস.এ সামাদ প্রতিরক্ষা সচিব। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি ওসমানী, চীফ অব স্টাফ কর্নেল আবদুর রব, উপ-সেনাপতি এ.কে খন্দকার, এবং ডি.জি মেডিকেল সার্ভিস ও বিভিন্ন পদবীর স্টাফ অফিসার এ দপ্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুদ্ধরত অঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটিতে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। তবে ১০নং বা নৌ সেক্টরে কোন সেক্টর কমান্ডার ছিল না, কমান্ডোরা যখন যে এলাকায় অভিযান করত সে সেক্টরের কমান্ডারের অধীনে থাকত। এ ছাড়াও জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও এস ফোর্স নামে তিনটি ব্রিগেড গঠন করা হয়। ব্রিগেডগুলির কমান্ডার হলেন যথাক্রমে মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর কে.এম সফিউল্লাহ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুদ্ধের সময় বিদেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করে এবং বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে বহির্বিশ্বের সরকার ও জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে এ মন্ত্রণালয়। এ লক্ষে কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, স্টকহোম প্রভৃতি স্থানে কূটনৈতিক মিশন স্থাপন করা হয় এবং জাতিসংঘ, আফগানিস্তান, সিরিয়া-লেবানন, নেপাল, শ্রীলংকা, বার্মা, থাইল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি দেশের সমর্থন আদায়ের জন্য কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে এ মন্ত্রণালয় থেকে পত্র প্রেরিত হয়। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর প্রধান ছিলেন কলকাতায় হোসেন আলী, দিল্লিতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, ইউরোপে বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ওয়াশিংটনে এম আর সিদ্দিকী। স্টকহোমে আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ মিশনের প্রতিনিধিত্ব করেন।
বাংলাদেশ সরকার প্রেরিত কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সিরিয়া-লেবাননে মোল্লা জালাল উদ্দীন এমএনএ ও ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী, আফগানিস্তানে আবদুস সামাদ আজাদ, আশরাফ আলী চৌধুরী এমএনএ, মওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী ও এডভোকেট নূরুল কাদের। নেপালে প্রেরিত হন আবদুল মালেক উকিল, সুবোধচন্দ্র মিত্র ও আবদুল মোমিন তালুকদার। এডভোকেট ফকির শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে শামসুল হক ও জ্যোতিপাল মহাথেরো শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড ও জাপান গমন করেন। মাহবুব আলম চাষী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পররাষ্ট্র দপ্তর অবস্থিত ছিল কলকাতার ৯ সার্কাস এভিনিউতে।
অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এম মনসুর আলী এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন সচিব। যুদ্ধের সময় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য কোন কাজ ছিল না। তবে অর্থ বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করে: সরকারের আয়-ব্যয়ের বাজেট প্রণয়ন; বাংলাদেশের অভ্যন্তর ও অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত সম্পদের হিসাব তৈরি; বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গকে অর্থ প্রদানের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন; আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা; রাজস্ব ও শুল্ক আদায়; এবং যেকোন আর্থিক অনিয়ম রোধের জন্য কমিটি গঠন।
বাংলাদেশ সরকার তার আয়ের উৎস ও ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে প্রথমে ছয় মাসের জন্য একটি বাজেট তৈরি করে। বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থ সংরক্ষণের জন্য ট্রেজারি স্থাপন করে এবং প্রবাসী বাঙালি ও বিভিন্ন বিদেশী নাগরিক ও সংস্থার তরফ থেকে প্রাপ্ত অর্থ বাংলাদেশ ফান্ড নামের একটি তহবিলে জমা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বেতন-ভাতা ছাড়া অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের প্রস্তাব প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপিত হত এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের কাছে সে অর্থ পৌঁছাত। সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় মন্ত্রিপরিষদের সভায় বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন, সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ এবং এসব বিষয়াদি লিপিবদ্ধকরণ মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ের আওতাভুক্ত ছিল। মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হবার পর পরিষদের প্রথম দুই মাসের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকাংশই তাজউদ্দীন আহমদ নিজ হাতে লিপিবদ্ধ করেন। এরপর এইচ টি ইমাম সচিব হিসেবে যোগ দেবার পর অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের সমনতয়ে সচিবালয় গড়ে ওঠে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের সমন্বয় সাধনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সাধারণ প্রশাসন বিভাগ নিয়োগ, বদলী, পদোন্নতি ও চাকরির বিধি প্রণয়নের নিমিত্তে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের আওতায় সাধারণ প্রশাসন বিভাগ সৃষ্টি করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রধানত দ্বিতীয় শ্রেণীর বিভিন্ন নিয়োগ এ বিভাগের আওতাধীন ছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তালিকা বহির্ভূত ব্যক্তিবর্গকে চিহ্নিতকরণ এবং বিভিন্ন নিয়োগের জন্য প্যানেল তৈরি করাও ছিল এ বিভাগের দায়িত্ব। নুরুল কাদের সংস্থাপন সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিল সাধারণ প্রশাসন বিভাগের আওতায় এ কাউন্সিল গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের পক্ষে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিটি জেলায় সরাসরি কাজ করা অসম্ভব বিধায় কয়েকটি জেলার সমন্বয়ে একটি করে প্রশাসনিক জোন গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৯টি জোন এবং পরবর্তী সময়ে আরও দু’টি জোন প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিটি জোনের একটি হেডকোয়ার্টার ছিল এবং একজন চেয়ারম্যান (এমএনএ বা এমপিএ) ও একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জোনের দায়িত্ব পালন করেন। সংশ্লিষ্ট জোনের চেয়ারম্যান, সদস্য, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য কর্মচারীদের সমন্বয়ে প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠিত হয়।
দায়িত্ব ও কর্তব্য মন্ত্রিসভা কর্তৃক জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলের জন্য গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, জোনের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তথা জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, উদ্বাস্ত্তদের ত্রাণ সহায়তা প্রদান, বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে ত্রাণ প্রদানের বিষয়টির সমন্বয় সাধন, যুবক্যাম্পগুলোকে সাধ্যমত সহায়তা প্রদান এবং সেক্টর কমান্ডকে সহায়তা করা জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলের প্রধান কাজ ছিল। মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন যে কার্যকর রয়েছে তা জনগণকে বোঝানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জোনাল প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল। সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে ৫ দিনের নোটিশে প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা সচিবকে মাসে কমপক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হত।
স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ মন্ত্রণালয় একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে প্রথম কাজ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে মহাপরিচালককে সচিবের মর্যাদা দেয়া হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ দুভাগে বিভক্ত ছিল: (ক) সেনাবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা ও (খ) বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ বা সরাসরি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে নি এমন জনগণকে চিকিৎসা প্রদান। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল, চিকিৎসক নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ, ঔষধ-পথ্য সংগ্রহ, মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসক দল প্রেরণ, শল্য চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, এবং আহত ও নিহতদের জন্য পরিবহণের ব্যবস্থা করা। ডা. টি হোসেন প্রথমে স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক এবং পরে স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নিযুক্ত হন।
তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে বসবাসরত বাঙালিদের মনোবল উজ্জীবিত রাখার প্রয়োজনে এ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ মন্ত্রণালয় প্রধানত চারটি মাধ্যমে এর কর্মকান্ড পরিচালনা করত: (ক) বেতার (স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র), (খ) চলচ্চিত্র, (গ) প্রকাশনা, (ঘ) চারুকলা ও ডিজাইন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মুক্তাঞ্চল, শরণার্থী ক্যাম্প ও ট্রেনিং ক্যাম্পে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এ মন্ত্রণালয়ের প্রধান দায়িত্ব ছিল। মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির ব্যাপারে সরকারকে সহায়তা এবং যুদ্ধ এলাকা ও মুক্তাঞ্চলে গোয়েন্দা তৎপরতা পরিচালনার জন্য গোয়েন্দা বিভাগ গঠন করা হয়। এ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ পুলিশের পোশাক, ব্যাজ ও মনোগ্রাম নির্ধারণ করে। আবদুল খালেককে প্রথমে পুলিশের আই.জি ও পরে স্বরাষ্ট্র সচিব নিয়োগ দেয়া হয়। যুদ্ধের শেষদিকে বাংলাদেশকে ৪টি রেঞ্জে ভাগ করে চারজন ডিআইজি ও প্রত্যেক জেলায় এসপি নিয়োগ করা হয়। ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশী জনগণের ভ্রমণ ডকুমেন্ট ইস্যু করাও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। শরণার্থীদের আবেদন বিবেচনা করে তাদের সাধ্যমত সহায়তা প্রদান করা হত। ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয়: (ক) ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি এবং (খ) উদ্বাস্ত্ত কল্যাণ বোর্ড।
সংসদ বিষয়ক বিভাগ পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ বিভাগ কাজ করে। প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদ সদস্যদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং তাদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করা এ বিভাগের প্রধান দায়িত্ব ছিল। মুক্তিযোদ্ধা বাছাই, শরণার্থীদের আবাসন ও যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে পরিষদ সদস্যগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এসব কর্মকান্ডের জন্য তাদের ভাতা প্রদান করা হত।
কৃষি বিভাগ যুদ্ধপরবর্তী সময়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং যুদ্ধকালীন ক্ষতির বিবেচনায় কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে কিভাবে খাদ্য সংকট কাটিয়ে উঠা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেবার জন্য এ বিভাগ কাজ করে। নুরুদ্দিন আহমদ কৃষি সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রকৌশল বিভাগ যুদ্ধে সেক্টরগুলোতে প্রকৌশল বিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ করে দ্রুত রাস্তা নির্মাণ ও মেরামত এবং সেতু মেরামতের জন্য কিছুসংখ্যক প্রকৌশলীকে এ বিভাগের অধীনে নিয়োগ করা হয়। এমদাদ আলী প্রধান প্রকৌশলী নিযুক্ত হন।
পরিকল্পনা সেল আওয়ামী লীগের ছয়দফা এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে এ দলের ইশতেহারের পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে দেশকে গড়ে তোলার জন্য, বিশেষ করে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কিভাবে দ্রুত কাটিয়ে উঠা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য সরকার এ সেল গঠন করে। পাকিস্তান শাসনামলে উন্নয়নবঞ্চিত এলাকা চিহ্নিতকরণ ও প্রশাসনিক পুনর্গঠন বিষয়ে পরামর্শ দেয়াও এর কাজ ছিল। প্রাথমিকভাবে বাস্ত্তহারাদের পুনর্বাসন, খাদ্য সরবরাহ, স্বাস্থ্য, পানি-বিদ্যুৎ ও বন্ধ শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালুর বিষয়ে এ সেল সরকারকে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দান করে। এ সেলই পরবর্তী সময়ে পরিকল্পনা কমিশনে রূপান্তরিত হয়। ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী চেয়ারম্যন এবং ড. খান সারোয়ার মুর্শেদ, ড. মোশাররফ হোসেন, ড. এস.আর বোস ও ড. আনিসুজ্জামান পরিকল্পনা সেলের সদস্য ছিলেন।
যুব ও অভ্যর্থনা শিবির নিয়ন্ত্রণ বোর্ড মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী যুবকদের প্রথমে অভ্যর্থনা ক্যাম্পে এবং পরে সেখান থেকে যুবক্যাম্পে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হত। জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলগুলোর আওতায় উভয় ক্যাম্প পরিচালিত হত। এ বোর্ডের চেয়ারম্যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাহায্যে কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে মোট ১০৬টি যুব ক্যাম্প ও ১১২টি অভ্যর্থনা ক্যাম্প ছিল। বোর্ডের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরকারের বাজেটেই উভয় ক্যাম্প পরিচালিত হয়। অধ্যাপক ইউসুফ আলী যুব ও অভ্যর্থনা শিবির নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া প্রতিটি ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন একজন করে এমএনএ বা এমপিএ। [মোহাম্মদ ফায়েকউজ্জামান ]
গ্রন্থপঞ্জি হাসান হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, ঢাকা, ১৯৮২; এইচ.টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, ২০০৪; নূরুল কাদের, একাত্তর আমার, ১৯৯৯; শামসুল হুদা চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর, ১৯৮৫; বি বি বিশ্বাস, একাত্তরে মুজিবনগর, ২০০০; মোহাম্মদ ফায়েকউজ্জামান, মুজিবনগর সরকার ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ঢাকা, ২০০৮।