বাঁধ, আড়: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
৪২ নং লাইন: | ৪২ নং লাইন: | ||
| নিরাপত্তামূলক কাজ (মিটার) || || | | নিরাপত্তামূলক কাজ (মিটার) || || | ||
|- | |- | ||
| | | উজান অঞ্চল || ৯ || ৬ | ||
|- | |- | ||
| | | ভাটি অঞ্চল || ১৩ || ৮ | ||
|- | |- | ||
| স্ফীত ড্যামের আয়তন (ঘন মিটার) || ১২০০ || ৮০০ | | স্ফীত ড্যামের আয়তন (ঘন মিটার) || ১২০০ || ৮০০ |
০৩:৫৭, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
বাঁধ, আড় (Dam) পানি ধরে রাখার জন্য নদীর মধ্যে অথবা মোহনায় নির্মিত এপার-ওপার বিস্তৃত প্রাকার বা ড্যাম। স্রোতের গতি রোধ করে আড় বাঁধের উজানে জলাধার সৃষ্টি করা হয়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পানির বহুমাত্রিক ব্যবহার, যেমন সেচ, কলকারখানায় পানির ব্যবহার, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি উদ্দেশ্যে এরূপ বাঁধ নির্মিত হয়। জলাধারগুলি বন্যার পানির উচ্চ সীমা হ্রাসকরণ, জলবিদ্যুৎ তৈরিতে প্রয়োজনীয় পানির সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ অথবা নদীর পানির গভীরতা বৃদ্ধি করে নৌচলাচল, পরিবহণ এবং পর্যটন ব্যবস্থার উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। নির্মাণশৈলীর দিক থেকে এই জলস্রোত রোধকারী ড্যাম দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত: পাথর চুন সুরকি নির্মিত (কংক্রিট) এবং ভেড়িবাঁধ (মৃত্তিকা অথবা শিলা নির্মিত)। কংক্রিটের আড় বাঁধ সাধারণত সংকীর্ণ গিরিখাত হতে প্রবাহিত স্রোতধারার উপর নির্মাণ করা হয়। পার্বত্য ভূখন্ডে এমন বাঁধ নির্মিত হয়। যদিও এ ধরনের বাঁধ অনেক উঁচু করে নির্মিত হতে পারে তবুও এর নির্মাণে প্রয়োজনীয় উপকরণের পরিমাণ অন্যান্য বাঁধের তুলনায় অনেক কম। প্রশস্ত জলধারা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মাটির তৈরি আড় বাঁধের গ্রহণযোগ্যতা এবং উপযোগিতা তুলনামূলকভাবে বেশি, কেননা একটি বৃহৎ আকৃতির কংক্রিট প্রতিবন্ধক নির্মাণের জন্য প্রচুর উপকরণের প্রয়োজন। ড্যামটি কংক্রিটের না মাটি ভরাটের মাধ্যমে নির্মিত হবে এবং এর মূল নকশাটি নির্ভর করে স্থানটির ভৌগোলিক অবস্থান, ড্যামটি কি উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হবে এবং ব্যয় সংকুলানের আর্থিক সামর্থ্যের উপর।
ড্যামে সহায়ক কার্যক্রমগুলি হলো এর নির্গম পথ, দ্বার, জলকপাটিকার মাধ্যমে জলাধার থেকে উদ্বৃত্ত পানি ড্যামের ভাটির দিকে প্রবাহিতকরণ। ড্যামের অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে পানিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে, খালে, সুরঙ্গে অথবা দূরবর্তী অঞ্চলে ব্যবহারের জন্য নলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া জলাধারে জমে ওঠা পলি অপসারণ, ড্যামের মধ্য দিয়ে নৌকার অথবা মাছের চলাচলের ব্যবস্থা এর সার্বিক কাঠামোর সাথে সংযুক্ত থাকে। ফলে একটি বাঁধ একটি বহুমুখী কার্যক্রমের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার রূপ নেয়, যার মূল উদ্দেশ্যে হলো পানি সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ।
সাধারণত ড্যামের উজানে অবস্থিত জলাধারটির পানির ঊর্ধ্বসীমা নিয়ন্ত্রণ করা হয় জলকপাটের দ্বারগুলি খোলা ও বন্ধ রাখার মধ্য দিয়ে। এই দ্বারগুলিই ড্যামটির নিরাপত্তা কপাটিকার কাজ করে। পানির এ ধরনের নির্গমন ছাড়াও সেচ ও পানি সরবরাহের জন্য, নদীর গতিধারার ভাটি অঞ্চলে নিম্নতম প্রবাহমানতা রক্ষার জন্য, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এবং জলাধার থেকে পানি ও জমে থাকা পলি অপসারণের জন্য পানি নির্গমন ব্যবস্থাটির প্রয়োজন রয়েছে। নদীবাহিত পলি জলাধারের কার্যকারিতার এবং স্থায়িত্বের উপর অনেক প্রভাব ফেলে। জলাধারের ধারণক্ষমতা দারুণভাবে হ্রাস পায়, স্বভাবতই ড্যাম নির্মাণে ব্যয়িত বিপুল অর্থের সদ্ব্যবহার হয় না। জলাধার পলি দ্বারা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় বর্তমান সময়ে নির্মিত কিছু ড্যামে ইতোমধ্যেই পানিধারণ ব্যবস্থাটি কার্যত অচল হয়ে পড়েছে, অন্যান্য অনেকগুলিতে ধারণক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সাধারণত বন্যা মৌসুমে বন্যার পানি বাহিত প্রচুর পলি ড্যামের জলকপাটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে দেয়া হয় এবং শুধুমাত্র বন্যা মৌসুমের শেষে জলাধারে স্বচ্ছতর পানি সঞ্চিত করা হয়।
ড্যাম নির্মাণের ইতিহাস সুপ্রাচীন। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৯০০ অব্দে মিশরের কোশেইশে নীল নদের উপর ৪৯ ফুট (প্রায় ১৫ মিটার) উচুঁ সুরকি পাথর নির্মিত ড্যাম সদৃশ কাঠামোর চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছে। রাজা মেনেসের রাজধানী মেম্ফিসে পানি সরবরাহের জন্য এ বাঁধ নির্মিত হয়। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ অব্দে কায়রোর প্রায় ১৯ মাইল (প্রায় ৩০ কিমি) দক্ষিণে অবস্থিত সাদ-এল-কাফারায় নির্মিত একটি মৃত্তিকাবাঁধের অস্তিত্বের প্রমাণ রয়েছে, যার উপরে পাথর চুন সুরকির আবরণ ছিল। ড্যামটি নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এতে কোন নির্গমন পথ না থাকার কারণে সে সময়ে সংঘটিত কোন বন্যার পানি বাঁধের উচ্চতাকে ছাড়িয়ে যায়, ফলে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। এখনও পর্যন্ত কার্যকরভাবে টিকে আছে এমন ড্যামের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ড্যামটি কৃত্রিম পাথর নির্মিত। অবস্থান সিরিয়ার অরেন্টাসের উপর। বাঁধটি নির্মিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ অব্দে। এর উচ্চতা ২০ ফুট (৬.১ মিটার)। এশিয়ায় নদীতে ড্যাম নির্মাণের ধারাটি সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৪০ অব্দে চিনের গাকৌ নদীর উপর একটি বিরাটাকৃতির শিলা নির্মিত বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছিল। এর উচ্চতা ছিল ৯৮ ফুট (২৯.৮৯ মিটার) এবং প্রায় ৯৮৫ ফুট (৩০০.২৩ মিটার) দীর্ঘ ছিল। শ্রীলঙ্কার অধিবাসীরা অনেক মৃত্তিকা নির্মিত ড্যামের উদ্যোক্তা। তাদের নির্মিত ড্যামের উচ্চতা সাধারণত মাঝারি ধরনের ছিল (কোন কোন ক্ষেত্রে উচ্চতা ছিল অনেক বেশি)। সেচ কার্যের জন্য জলাধার বা বড় জলাশয় সৃষ্টির নিমিত্তেই খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের পরে এ ধরনের ড্যাম নির্মিত হতে থাকে। ভারতবর্ষ এবং প্রাচীন বাংলাও সে সময় থেকে ড্যাম নির্মাণ কর্মকান্ডের সাথে পরিচিত ছিল। তবে বর্তমানে তার কোনটিরই অস্তিত্ব নেই। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বেশ কিছু সংখ্যক রাবারের তৈরি ড্যাম নির্মিত হয়েছে।
কাপ্তাই ড্যাম চট্টগ্রাম থেকে ৬৫ কিমি উজানে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলি নদীর উপর নির্মিত এই ড্যামটি দেশের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ড্যাম। এর দৈর্ঘ্য ৬১০ মিটার এবং উচ্চতা ৪৩ মিটার। পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন এই ড্যাম নির্মাণের মূল উদ্দেশ্যে। অধিকন্তু এর নির্মাণ নৌপরিবহণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মৎস্য চাষ, পর্যটন এবং বিনোদনের মতো অন্যান্য দিক গুলোতেও যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। কেন্দ্রের জলাধারে বন্যা মৌসুমে পানি ধরে রেখে কর্ণফুলি নদীর ভাটি অঞ্চলে বন্যার পানির উচ্চতার শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। সাধারণত মে থেকে আগস্ট মাস জুড়ে সৃষ্ট সকল বন্যার পানি জলাধারে সঞ্চিত করা হয়। ড্যামটির উপর দিয়ে জলাধার থেকে নদীর ভাটির দিকে পণ্য পরিবহণের আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে। এর ফলে সহজতর হচ্ছে নৌযান, কাঠের গুঁড়ি এবং অন্যান্য পণ্যের স্থানান্তর প্রক্রিয়া। মূলত মাটি ভরাটের মাধ্যমে কাপ্তাই ড্যাম নির্মিত হয়েছে। এর ভিত্তিস্তর এবং উপরিতলের প্রশস্ততা যথাক্রমে ৪৫৭ মিটার এবং ৭.৬ মিটার। ড্যামের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা থেকে ৩৬ মিটার উপরে অবস্থিত। ড্যামটি নির্মাণে সর্বমোট ১,১৩,৪০০ ঘনমিটার (৪.০৫ মিলিয়ন ঘনফুট) মাটি খনন করা হয়েছিল। এটি একটি মৃত্তিকা নির্মিত ড্যাম, ফলে পানি নির্গমনের জন্য মূল বাঁধের বাম পার্শ্বে ২২৭ মিটার দীর্ঘ একটি আলাদা নির্গমপথ নির্মাণ করা হয়েছে। নির্গমপথ থেকে প্রতি সেকেন্ডে ১৬০০০ ঘন মিটার পানি নির্গত হতে পারে। নির্গমপথে ১৬টি পরপর আলাদা দরজা বা ফটক সংযুক্ত রয়েছে যা একটি বৃত্তচাপের মতো সাজানো। এর প্রতিটির মাপ ১২.২ মিটার × ১১.৫ মিটার। কাপ্তাই ড্যামের জলাধারের জল সরবরাহের জন্য জলধারণ এলাকার আয়তন ১১,০০০ বর্গ কিলোমিটার। সমগ্র জল সরবরাহ অঞ্চলটিতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২,৫০০ মিমি এবং জলাধারে বার্ষিক গড় পানি প্রবাহের পরিমাণ ১ কোটি ২০ লক্ষ একর ফুট। পরিপূর্ণ জলাধারের উচ্চ জলসীমা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার ৩৩.২৩ মিটার উপরে এবং এসময়ে জলাধার এলাকার বিস্তৃতি এবং ধারণক্ষমতা যথাক্রমে ৭৭৭ বর্গ কিমি এবং ৫২ লক্ষ ৫০ হাজার একর ফুট। জলাধারে তীব্র পানি ঘাটতির সময়ে সঞ্চিত পানির ঊর্ধ্ব জলসীমা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার ২৩.১৫ মিটার উপরে এবং ধারণকৃত পানির পরিমাণ ১১ লক্ষ ৮০ হাজার একর ফুট। বন্যার পানি ধারণ ক্ষমতা ৮ লক্ষ ৩০ হাজার একর ফুট। ড্যামের উজানে সৃষ্ট মনোমুগ্ধকর বিস্তৃত দৃশ্যপট এবং নৌভ্রমণ সুবিধা স্থানটিকে একটি আকর্ষণীয় বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করেছে এবং এর মনোরম সৌন্দর্য্য বহু দর্শনার্থীকে আকৃষ্ট করছে।
কর্ণফুলি জলবিদুৎ প্রকল্প সম্পর্কে সর্বপ্রথম চিন্তাভাবনা করা হয় ১৯০৬ সালে এবং ঐ সময়ে এলক্ষ্যে একটি সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক জরিপ ও পরিচালিত হয়েছিল। এ ধরনের আর একটি পদক্ষেপ নেয়া হয় ১৯২৩ সালে। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৪৬ সালে ই.এ.মুর কর্তৃক পেশকৃত প্রতিবেদনে বর্তমান ড্যামটির অবস্থান থেকে ৬৫ কিমি উজানে বরকল নামক স্থানে ড্যাম নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। ১৯৫০ সালে মার্জ রেনডাল ভ্যাটেন নামক একটি প্রকৌশল পরামর্শক সংস্থা কাপ্তাই থেকে ৪৮ কিমি উজানে চিলারডাক নামক স্থানকে ড্যাম নির্মাণের স্থল হিসেবে প্রস্তাব করে। ১৯৫১ সালে সরকারি প্রকৌশলিগণ কাপ্তাই থেকে ১১ কিমি ভাটিতে চিতমোরামে ড্যাম নির্মাণের প্রস্তাব করেন। অবশেষে ১৯৫১ সালে সেচ বিভাগের তদানীন্তন প্রধান প্রকৌশলি খাজা আজিমুদ্দিনের তত্ত্বাবধানে কাপ্তাইকে ড্যাম নির্মাণের স্থান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এ সংক্রান্ত প্রাথমিক কর্মকান্ডের সূত্রপাতও ঘটে ১৯৫১ সালেই এবং এ সময়ে সরকারি প্রকৌশলিগণ ড্যামটির ভৌত কাঠামো নির্মাণের কাজের কিছু অংশ সম্পন্ন করেন। এ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সহযোগিতা দানে চুক্তিবদ্ধ হয়। ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রশাসনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রকৌশল সহযোগিতা সংস্থা আইইসিও (IECO) প্রকল্প সম্পর্কে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। এসকল সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে প্রকল্পটিকে গ্রহণ করা হয় এবং আইইসিও প্রকল্পের প্রকৌশলগত সাহায্য-সহযোগিতাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিযুক্ত হয়। উটাহ আন্তর্জাতিক সংস্থাকে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিযুক্ত করা হয় এবং ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে ড্যামের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
১৯৬২ সালে এর প্রাথমিক পর্যায়ের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। এর মধ্যে বাঁধ নির্মাণ, নির্গমন পথ, জলকপাট এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কাজ অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন পৃথক দুটি স্থাপনা মিলে মোট ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তৃতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদক স্থাপনাটি প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন হয় ১৯৮১ সালের নভেম্বর মাসে, যার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট। বাঁধ এবং তার সহায়ক কাঠামো নির্মাণে, বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থাপনা ১, ২ এবং ৩ এর অংশ বিশেষের নির্মাণে সর্বমোট অর্থ ব্যায়ের পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ৩০ লক্ষ রূপি, যার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল ১৭ কোটি ১৬ লক্ষ টাকা। সরকার এবং ইউএসএইড ৩য় স্থাপনাটির বাকি অংশের নির্মাণ ব্যয়ের যোগান দেয়। এ বাবদ সর্বমোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৭ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে ব্যয়িত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪র্থ ও ৫ম স্থাপনার নির্মাণ সমাপ্ত হয়। এ দুটি স্থাপনা সহ কেন্দ্রটির সর্বমোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়ায় ২৩০ মেগাওয়াট। কেন্দ্রের সম্প্রসারণের এই কাজে সর্বমোট ব্যয়ের পরিমাণ ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল ১০৮ কোটি টাকার।
যদিও কাপ্তাই ড্যাম বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করেছে, কিন্তু এর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাবও পড়েছে জনজীবনে। পানি সঞ্চয়ের জন্য জলাধার নির্মাণে এ অঞ্চলের অনেক অধিবাসীর বসতভিটা তলিয়ে গেছে। জীবনধারণের শেষ অবলম্বন থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে। ব্যাপক এলাকা জলমগ্ন হওয়ার কারণে সহায় সম্বল হারায় অনেকে এবং এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বনাঞ্চল ও মুক্তস্থান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বনাঞ্চল ও মুক্ত স্থান হারানোর সাথে সাথে অবধারিতভাবে বিনষ্ট হয় অরণ্যসম্পদ।
মেঘনা ড্যাম মেঘনা নদীর একটি প্রধান গতিধারা রামগতি এবং নোয়াখালীর মূলভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। গতিধারাটিতে ২০ থেকে ৩০ বছর সময় জুড়ে ক্রমান্বয়ে পলি জমতে থাকে। ১৯৫৭ সালে গতিধারাটির স্রোত পশ্চিম দিকে প্রবাহিত করানোর জন্য সেচ বিভাগ কর্তৃক ১২ কিমি দীর্ঘ ড্যাম নির্মাণ করা হয়। এই ড্যামটিই মেঘনা বাঁধ-১ হিসেবে পরিচিত। এটির নির্মাণ ব্যয় ছিল ১৪ লক্ষ টাকা। ড্যাম নির্মাণের ফলে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাঁধের সন্নিকটস্থ ধীর গতিধারা অঞ্চলে ২০৭ বর্গ কিলোমিটারের এক বিস্তৃত নতুন ভূখন্ডের সৃষ্টি হয়। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৬ কিমি দীর্ঘ আরও একটি বাঁধের নির্মাণ সমাপ্ত করে, যা মেঘনা বাঁধ-২ হিসেবে পরিচিত। চর জববার এবং নোয়াখালীর মূলভূমির মধ্যে নির্মিত এ ড্যামের নির্মাণ ব্যয় ছিল ৯০ লক্ষ টাকা। এই ড্যাম নির্মাণের ফলে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আরও ৫৬৩ বর্গ কিমি এলাকার আর একটি নতুন ভূখন্ড গড়ে ওঠে। এ নিয়ে সর্বমোট গড়ে ওঠা ভূখন্ডের আয়তন দাঁড়ায় ৭১৭ বর্গ কিলোমিটার।
ফেনী ড্যাম ফেনী নদীর উপর ১৯৬৫-৬৬ অর্থ বৎসরে ৫৯ কোটি ৩৫ লক্ষ রুপি ব্যয়ে মূল প্রবাহের দিক পরিবর্তন করে ফেনী রেগুলেটর (নিয়ন্ত্রক) দিয়ে প্রবাহিত করানোর জন্য ৩.৪১ কিমি দীর্ঘ এই ড্যাম নির্মিত হয়। এটি চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই এবং ফেনী জেলার সোনাগাজিতে অবস্থিত। ফেনী রেগুলেটরের ৪০টি দ্বার নির্মিত হয়েছে বাঁধের ভাটি অঞ্চল থেকে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে এবং বাঁধের উজানে মুহুরি সেচ প্রকল্পে স্বাদু পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে।
রাবার ড্যাম ছোট নদী এবং স্রোতধারা সমূহে পানি ধরে রাখার জন্য বাতাস অথবা পানি দ্বারা স্ফীত রাবার ব্যাগ পরস্পর সংযোজিত করে এই ড্যাম নির্মিত হয়। নির্মিত বাঁধ নদী স্রোতধারার তলদেশে নোঙরের মাধ্যমে আবদ্ধ রাখা হয়। রাবার ড্যাম কাঠামোটি তৈরি করা হয় রাবার ব্যাগগুলিকে কৃত্রিম তন্তু দিয়ে বুননের মাধ্যমে। স্ফীত রাবার ব্যাগগুলির এই সংযোজন ব্যবস্থাটির প্রসারণ শক্তি রয়েছে যা পানি প্রতিরোধী এবং আসঞ্জনশীল (cohesive)। ড্যামটি মজবুত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা হিসেবে স্তরে স্তরে কৃত্রিম তন্তুদ্বারা সংযোজিত করা হয়।
কংক্রিট নির্মিত ড্যাম এবং রেগুলেটরের তুলনায় রাবার ড্যাম সস্তা এবং নমনীয়। বন্যা মৌসুমে বন্যার পানি বাধাহীনভাবে সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহজেই রাবার ব্যাগগুলো থেকে পানি অথবা বাতাস শূন্য করে বাঁধ সরিয়ে ফেলা যায়। রাবার ড্যামগুলো ১০০ মিটারের মতো দীর্ঘ হতে পারে এবং সেচ ও গ্রামীণ এলাকায় পানি সরবরাহে ব্যবহূত হতে পারে। পার্বত্য স্রোতধারায় ক্ষুদ্র পর্যায়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ ধরনের ড্যাম ব্যবহার করা যেতে পারে। সম্প্রতি চীনের বেইজিংস্থ আইডব্লিউএইচআর-এর কারিগরি সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ কক্সবাজার জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে দুটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে একটি নির্মিত হয় বাকখালিতে, অন্যটি ঈদগাঁওয়ে। নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয় ১৯৯৫-এর ফেব্রুয়ারিতে এবং সমাপ্ত হয় মে মাসে। উল্লিখিত দুটি রাবার ড্যামের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নে দেওয়া হলো:
বৈশিষ্ট্য | বাকখালি ড্যাম | ঈদগাঁও ড্যাম |
দৈর্ঘ্য (মিটার) | ৮৪ | ৫২ |
উচ্চতা (মিটার) | ৩.৫ | ৩ |
সর্বোচ্চ পানি ধারণ গভীরতা (মিটার) | ৪ | ৩ |
সর্বোচ্চ অধিপ্রবাহ (কিউমেক) | ২৫৬ | ৮০ |
সর্বোচ্চ বন্যা প্রবাহ (কিউমেক) | ১০৭৩ | ৬০০ |
কংক্রিট মেঝের দৈর্ঘ্য | ৪০ | ৩৩.৫ |
নিরাপত্তামূলক কাজ (মিটার) | ||
উজান অঞ্চল | ৯ | ৬ |
ভাটি অঞ্চল | ১৩ | ৮ |
স্ফীত ড্যামের আয়তন (ঘন মিটার) | ১২০০ | ৮০০ |
ড্যামের ব্যাগসমূহের ওজন (টন) | ১৪ | ৭ |
রাবার ব্যাগে বায়ু পূরণ মতা (ঘন মি./ঘণ্টা) | ১৫০ | ১০০ |
পূর্ণ/খালি হওয়ার সময় (ঘণ্টা) | ৮.১ | ৮.১ |
সর্বমোট ব্যয় (কোটি টাকা) | ৩ কোটি ৬০ লক্ষ | ১ কোটি ৮০ লক্ষ |
ড্যাম এলাকার বাকখালি নদীতে জোয়ারভাটা আছে এবং কক্সবাজার থেকে প্রায় ৩ কিমি দূরে ঝিলওয়াঞ্জি ইউনিয়নে এর অবস্থান। বাঁধ উজানের দিকে স্বাদুপানি সংরক্ষণ করে এবং ভাটি অঞ্চল থেকে লবণাক্ত পানির অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ প্রতিহত করে। জানুয়ারি থেকে মে সময়কালে ধরে রাখা পানি পাম্প দ্বারা বোরো ধান চাষে ব্যবহূত হয়। ঈদগাঁও খাল ড্যাম এলাকায় জোয়ারভাটা নির্ভরশীল নয়। ড্যামটি কক্সবাজার থেকে প্রায় ৩০ কিমি দূরে চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কের সন্নিকটে অবস্থিত। স্রোতোধারার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ড্যামটি নির্মিত হয়েছে। পানি ধারণ করে ভাটি অঞ্চলে বোরো ধানের চাষে জলসেচের ক্ষেত্রে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে কাজে লাগানো হয়। [মোহাম্মদ ফজলুল বারী]