প্লেগ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
[[Category:বাংলাপিডিয়া]] | [[Category:বাংলাপিডিয়া]] | ||
'''প্লেগ (Plague) | '''প্লেগ''' (Plague) ''Yersinia pestis'' নামক ব্যাকটেরিয়াঘটিত মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয় তাই ব্যাপক প্রাণসংহারকারী বা অনিস্টকর কোন পরিস্তিতি বর্ণনায় ‘প্লেগ’ শব্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। প্লেগ অতি প্রাচীনকালীন এক ব্যাধি, প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে এর অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। ইতিহাস সূত্রে জানা যায় মধ্য যুগে বহু রাজ্য এ রোগ দ্বারা ধ্বংসাত্মক পরিণতির শিকার হয়েছে। | ||
Y. pestis একটি গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া যা ইঁদুরের ফ্লি ''Xenopsylla chaeopis'' নামক পতঙ্গের অন্ত্রে বাস করে। ফ্লি ইঁদুর ও ইঁদুরজাতীয় প্রাণীর বহিঃপরজীবী এবং পোষকের ত্বকে দংশনের মাধ্যমে এর অন্ত্র থেকে ব্যাকটেরিয়াকে পোষকের দেহে চালান করে। কাজেই, ফ্লি ইঁদুর থেকে ইঁদুরে, কখনও কখনও ইঁদুর থেকে মানুষে প্লেগ জীবাণু স্থানান্তরের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে এবং রোগের উপসর্গ সৃষ্টি করে। একজন নিউমোনিক প্লেগে সংক্রমিত মানুষ অন্য মানুষে রোগ ছড়ায় এবং এভাবে প্লেগ মহামারীর আকার পায়। | ''Y. pestis'' একটি গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া যা ইঁদুরের ফ্লি ''Xenopsylla chaeopis'' নামক পতঙ্গের অন্ত্রে বাস করে। ফ্লি ইঁদুর ও ইঁদুরজাতীয় প্রাণীর বহিঃপরজীবী এবং পোষকের ত্বকে দংশনের মাধ্যমে এর অন্ত্র থেকে ব্যাকটেরিয়াকে পোষকের দেহে চালান করে। কাজেই, ফ্লি ইঁদুর থেকে ইঁদুরে, কখনও কখনও ইঁদুর থেকে মানুষে প্লেগ জীবাণু স্থানান্তরের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে এবং রোগের উপসর্গ সৃষ্টি করে। একজন নিউমোনিক প্লেগে সংক্রমিত মানুষ অন্য মানুষে রোগ ছড়ায় এবং এভাবে প্লেগ মহামারীর আকার পায়। | ||
অনুমান করা হয় যে চর্তুদশ শতকে ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা অর্থ্যাৎ প্রায় ২৫,০০০,০০০ মানুষ প্লেগে আকান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। এরপর বিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয় যে, চৌদ্দ শতকের দ্বিতীয় মহামারীর সূত্রপাত হয় মধ্য এশিয়ায়, যা পরে ইউরোপ, ভারত এবং চীনে বিস্তৃতি লাভ করে। ১৬৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত The Great Plague of London কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমগ্র ইউরোপে এ রোগ মাঝে মধ্যেই দেখা দিয়েছে পনেরো, ষোল এবং সতেরো শতকে। | অনুমান করা হয় যে চর্তুদশ শতকে ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা অর্থ্যাৎ প্রায় ২৫,০০০,০০০ মানুষ প্লেগে আকান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। এরপর বিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয় যে, চৌদ্দ শতকের দ্বিতীয় মহামারীর সূত্রপাত হয় মধ্য এশিয়ায়, যা পরে ইউরোপ, ভারত এবং চীনে বিস্তৃতি লাভ করে। ১৬৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত The Great Plague of London কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমগ্র ইউরোপে এ রোগ মাঝে মধ্যেই দেখা দিয়েছে পনেরো, ষোল এবং সতেরো শতকে। | ||
১০ নং লাইন: | ১০ নং লাইন: | ||
দক্ষিণ চীনের বন্দরগুলিকে অনেকেই প্লেগ বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করেন। ১৮৯৪ এবং ১৯২২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এ রোগ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়ের কোন কোন মহামারী পূর্বগুলির তুলনায় অনেক ব্যাপক ও মারাত্মক ছিল। ভারতের অনেক স্থানের মধ্যে ১৮৯৬ সালে মুম্বাই-এ এবং ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। অনেক দেশের তুলনায় ভারতে প্রাণহানি হয় বেশি। এক তথ্য থেকে জানা যায় ১৮৯৬ এবং ১৯১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৯৩,১৫,৮৯২ জন, অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রতি হাজারে ৫.১৬ জন। সৌভাগ্যবশত এর পরের ২৫ বছর তেমন মৃত্যু ঘটে নি। ১৯২৩ সালে মৃত্যু সংখ্যা ছিল ২৫০,০০০; ১৯৪২-এ ১০,৫৭৭; ১৯৪৭-এ ৪১,৭৪৫; ১৯৪৮-এ ৯,৭৫৭ এবং ১৯৫২-তে ১,০০৭ জন। একটি অসম্পূর্ণ তথ্য থেকে জানা যায় বার্মায় (মায়ানমার) ১৯৫৪ সালে মারা যায় ১৫৭ জন এবং ভারতে ৫৪৭ জন। | দক্ষিণ চীনের বন্দরগুলিকে অনেকেই প্লেগ বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করেন। ১৮৯৪ এবং ১৯২২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এ রোগ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়ের কোন কোন মহামারী পূর্বগুলির তুলনায় অনেক ব্যাপক ও মারাত্মক ছিল। ভারতের অনেক স্থানের মধ্যে ১৮৯৬ সালে মুম্বাই-এ এবং ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। অনেক দেশের তুলনায় ভারতে প্রাণহানি হয় বেশি। এক তথ্য থেকে জানা যায় ১৮৯৬ এবং ১৯১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৯৩,১৫,৮৯২ জন, অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রতি হাজারে ৫.১৬ জন। সৌভাগ্যবশত এর পরের ২৫ বছর তেমন মৃত্যু ঘটে নি। ১৯২৩ সালে মৃত্যু সংখ্যা ছিল ২৫০,০০০; ১৯৪২-এ ১০,৫৭৭; ১৯৪৭-এ ৪১,৭৪৫; ১৯৪৮-এ ৯,৭৫৭ এবং ১৯৫২-তে ১,০০৭ জন। একটি অসম্পূর্ণ তথ্য থেকে জানা যায় বার্মায় (মায়ানমার) ১৯৫৪ সালে মারা যায় ১৫৭ জন এবং ভারতে ৫৪৭ জন। | ||
প্লেগ আক্রান্ত মানুষে যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গ প্রকাশ পায় সেটি হলো লসিকা গ্রন্থির স্ফীতি। এ অবস্থাকে বলা হয় ‘বুবো’ (bubo) বা গ্রন্থিস্ফীতি। লসিকা গ্রন্থির তীব্র প্রদাহের সঙ্গে জ্বর ও ব্যথা থাকে। এই অবস্থায় এটি বুবোনিক প্লেগ (bubonic plague) হিসেবে পরিচিত হয়। রোগের আক্রমণ মৃদু হলে সংক্রমণ প্রক্রিয়া আপেক্ষিকভাবে লসিকা গ্রন্থির মধ্যে সীমিত থাকে, কিন্তু কিছু রোগীতে ফুসফুস সংক্রমিত হয়ে নিউমোনিয়ার সঞ্চার হয়। রোগের এই ধরনের অবস্থাকে নিউমোনিক প্লেগ (pneumonic plague) নামে বর্ণনা করা হয়। এ অবস্থা রোগের দ্রুত বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ, আক্রান্ত রোগী বাইরে যে কফ ফেলে তার মধ্যে ব্যাকটেরিয়া থাকে। ব্যাকটেরিয়া সুস্থ মানুষের নাসিকা পথে সহজে ঢুকে পড়ে ও দেহে সংক্রমণ ঘটায়। অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধের সাহায্যে নিউমোনিক প্লেগের চিকিৎসা না হলে তা মারাত্মক আকার নিতে পারে। মাঝে মাঝে রোগীর রক্তেও এই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটায়। সংক্রমিত রক্ত দেহের নানা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে মুক্তভাবে চলাচল করে যে প্লেগ রোগের উদ্ভব ঘটায় তাকে সেপ্টিসিমিক প্লেগ (septicaemic plague) বলা হয়। এতে রোগীর শ্বসন নিষ্ক্রিয় হওয়ার কারণে দেহের বর্ণ কালচে লাল হয়ে যায় এবং চিকিৎসা না হলে রোগীর মৃত্যু অবধারিত হয়। এজন্যে প্লেগের আরেক নাম ' ব্ল্যাক ডেথ ' (black death)। | প্লেগ আক্রান্ত মানুষে যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গ প্রকাশ পায় সেটি হলো লসিকা গ্রন্থির স্ফীতি। এ অবস্থাকে বলা হয় ‘বুবো’ (bubo) বা গ্রন্থিস্ফীতি। লসিকা গ্রন্থির তীব্র প্রদাহের সঙ্গে জ্বর ও ব্যথা থাকে। এই অবস্থায় এটি বুবোনিক প্লেগ (bubonic plague) হিসেবে পরিচিত হয়। রোগের আক্রমণ মৃদু হলে সংক্রমণ প্রক্রিয়া আপেক্ষিকভাবে লসিকা গ্রন্থির মধ্যে সীমিত থাকে, কিন্তু কিছু রোগীতে ফুসফুস সংক্রমিত হয়ে নিউমোনিয়ার সঞ্চার হয়। রোগের এই ধরনের অবস্থাকে নিউমোনিক প্লেগ (pneumonic plague) নামে বর্ণনা করা হয়। এ অবস্থা রোগের দ্রুত বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ, আক্রান্ত রোগী বাইরে যে কফ ফেলে তার মধ্যে ব্যাকটেরিয়া থাকে। ব্যাকটেরিয়া সুস্থ মানুষের নাসিকা পথে সহজে ঢুকে পড়ে ও দেহে সংক্রমণ ঘটায়। অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধের সাহায্যে নিউমোনিক প্লেগের চিকিৎসা না হলে তা মারাত্মক আকার নিতে পারে। মাঝে মাঝে রোগীর রক্তেও এই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটায়। সংক্রমিত রক্ত দেহের নানা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে মুক্তভাবে চলাচল করে যে প্লেগ রোগের উদ্ভব ঘটায় তাকে সেপ্টিসিমিক প্লেগ (septicaemic plague) বলা হয়। এতে রোগীর শ্বসন নিষ্ক্রিয় হওয়ার কারণে দেহের বর্ণ কালচে লাল হয়ে যায় এবং চিকিৎসা না হলে রোগীর মৃত্যু অবধারিত হয়। এজন্যে প্লেগের আরেক নাম 'ব্ল্যাক ডেথ ' (black death)। | ||
সম্প্রতিকালে বাংলাদেশে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কোন রেকর্ড নেই। ১৯৯৪ সালে ভারতে দু'বার প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল যার বিস্তার দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল ব্যাকটেরিয়ার বাহক ফ্লি উচ্ছেদের লক্ষ্যে ইঁদুর মেরে এবং প্লেগ আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত শনাক্ত করে তাদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ ও অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে। সে সময় বাংলাদেশেও পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। এসবের মধ্যে ছিল সচেতনতামূলক কর্মসূচি এবং সন্দেহজনক ক্ষেত্রে তা সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের দৃষ্টিগোচরে আনা ইত্যাদি। সে সময় বাংলাদেশে প্লেগে আক্রান্ত কোন রোগী শনাক্ত করা যায় নি। | সম্প্রতিকালে বাংলাদেশে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কোন রেকর্ড নেই। ১৯৯৪ সালে ভারতে দু'বার প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল যার বিস্তার দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল ব্যাকটেরিয়ার বাহক ফ্লি উচ্ছেদের লক্ষ্যে ইঁদুর মেরে এবং প্লেগ আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত শনাক্ত করে তাদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ ও অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে। সে সময় বাংলাদেশেও পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। এসবের মধ্যে ছিল সচেতনতামূলক কর্মসূচি এবং সন্দেহজনক ক্ষেত্রে তা সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের দৃষ্টিগোচরে আনা ইত্যাদি। সে সময় বাংলাদেশে প্লেগে আক্রান্ত কোন রোগী শনাক্ত করা যায় নি। [জিয়া উদ্দিন আহমেদ] | ||
[ | ''আরও দেখুন'' [[ইঁদুর|ইঁদুর]]; [[ফ্লি|ফ্লি]]। | ||
[[en:Plague]] | [[en:Plague]] |
০৮:৪৭, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
প্লেগ (Plague) Yersinia pestis নামক ব্যাকটেরিয়াঘটিত মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয় তাই ব্যাপক প্রাণসংহারকারী বা অনিস্টকর কোন পরিস্তিতি বর্ণনায় ‘প্লেগ’ শব্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। প্লেগ অতি প্রাচীনকালীন এক ব্যাধি, প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে এর অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। ইতিহাস সূত্রে জানা যায় মধ্য যুগে বহু রাজ্য এ রোগ দ্বারা ধ্বংসাত্মক পরিণতির শিকার হয়েছে।
Y. pestis একটি গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া যা ইঁদুরের ফ্লি Xenopsylla chaeopis নামক পতঙ্গের অন্ত্রে বাস করে। ফ্লি ইঁদুর ও ইঁদুরজাতীয় প্রাণীর বহিঃপরজীবী এবং পোষকের ত্বকে দংশনের মাধ্যমে এর অন্ত্র থেকে ব্যাকটেরিয়াকে পোষকের দেহে চালান করে। কাজেই, ফ্লি ইঁদুর থেকে ইঁদুরে, কখনও কখনও ইঁদুর থেকে মানুষে প্লেগ জীবাণু স্থানান্তরের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে এবং রোগের উপসর্গ সৃষ্টি করে। একজন নিউমোনিক প্লেগে সংক্রমিত মানুষ অন্য মানুষে রোগ ছড়ায় এবং এভাবে প্লেগ মহামারীর আকার পায়।
অনুমান করা হয় যে চর্তুদশ শতকে ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা অর্থ্যাৎ প্রায় ২৫,০০০,০০০ মানুষ প্লেগে আকান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। এরপর বিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয় যে, চৌদ্দ শতকের দ্বিতীয় মহামারীর সূত্রপাত হয় মধ্য এশিয়ায়, যা পরে ইউরোপ, ভারত এবং চীনে বিস্তৃতি লাভ করে। ১৬৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত The Great Plague of London কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমগ্র ইউরোপে এ রোগ মাঝে মধ্যেই দেখা দিয়েছে পনেরো, ষোল এবং সতেরো শতকে।
এক সময় অনেকেই বিশ্বাস করত যে সিন্ধু নদীর পূর্বাঞ্চলে প্লেগ কখনও দেখা দেয় না। কিন্তু উনিশ শতকে ভারতের একাধিক জেলায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। প্রায় তিন বছর প্রচন্ড দুর্ভিক্ষের পর ১৮১৫ সালে গুজরাট, কাথিওয়ার এবং কুচ এলাকায় প্লেগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। পরের বছরের শুরুতেই ঐ এলাকাগুলিতে এ রোগ আবার আঘাত হানে এবং ক্রমে তা সিন্ধু প্রদেশ ও হায়দ্রাবাদসহ দক্ষিণ-পূর্বে আহমাদাবাদ ও ধলেরা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। পরে এসব এলাকা থেকে ১৮২০ সালে অথবা অথবা ১৮২১ সালের প্রথমভাগে এ রোগ তিরোহিত হয় এবং ১৮৩৬ সালের জুলাই পর্যন্ত আর দেখা যায় নি। ১৮৩৬ সালের শেষভাগে রাজপুতনার পালি শহরে প্লেগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। ক্রমে পালি থেকে আজমীর-মারওয়ারাতে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। পরে ১৮৩৭ সালের গ্রীষ্মকালে ঐ এলাকা থেকে প্লেগ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ১৮৪৯, ১৮৫০ এবং ১৮৫২ সালে এ রোগ আবার মারাত্মকভাবে দেখা দেয় এবং দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করে। ১৮৭৬-৭৭ সালের প্রাদুর্ভাব এমন মারাত্মকভাবে দেখা দেয় যে ভারতীয়রা এ রোগকে মাহামারী (maha murree or mahamari) নামে আখ্যায়িত করে।
দক্ষিণ চীনের বন্দরগুলিকে অনেকেই প্লেগ বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করেন। ১৮৯৪ এবং ১৯২২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এ রোগ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়ের কোন কোন মহামারী পূর্বগুলির তুলনায় অনেক ব্যাপক ও মারাত্মক ছিল। ভারতের অনেক স্থানের মধ্যে ১৮৯৬ সালে মুম্বাই-এ এবং ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। অনেক দেশের তুলনায় ভারতে প্রাণহানি হয় বেশি। এক তথ্য থেকে জানা যায় ১৮৯৬ এবং ১৯১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৯৩,১৫,৮৯২ জন, অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রতি হাজারে ৫.১৬ জন। সৌভাগ্যবশত এর পরের ২৫ বছর তেমন মৃত্যু ঘটে নি। ১৯২৩ সালে মৃত্যু সংখ্যা ছিল ২৫০,০০০; ১৯৪২-এ ১০,৫৭৭; ১৯৪৭-এ ৪১,৭৪৫; ১৯৪৮-এ ৯,৭৫৭ এবং ১৯৫২-তে ১,০০৭ জন। একটি অসম্পূর্ণ তথ্য থেকে জানা যায় বার্মায় (মায়ানমার) ১৯৫৪ সালে মারা যায় ১৫৭ জন এবং ভারতে ৫৪৭ জন।
প্লেগ আক্রান্ত মানুষে যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গ প্রকাশ পায় সেটি হলো লসিকা গ্রন্থির স্ফীতি। এ অবস্থাকে বলা হয় ‘বুবো’ (bubo) বা গ্রন্থিস্ফীতি। লসিকা গ্রন্থির তীব্র প্রদাহের সঙ্গে জ্বর ও ব্যথা থাকে। এই অবস্থায় এটি বুবোনিক প্লেগ (bubonic plague) হিসেবে পরিচিত হয়। রোগের আক্রমণ মৃদু হলে সংক্রমণ প্রক্রিয়া আপেক্ষিকভাবে লসিকা গ্রন্থির মধ্যে সীমিত থাকে, কিন্তু কিছু রোগীতে ফুসফুস সংক্রমিত হয়ে নিউমোনিয়ার সঞ্চার হয়। রোগের এই ধরনের অবস্থাকে নিউমোনিক প্লেগ (pneumonic plague) নামে বর্ণনা করা হয়। এ অবস্থা রোগের দ্রুত বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ, আক্রান্ত রোগী বাইরে যে কফ ফেলে তার মধ্যে ব্যাকটেরিয়া থাকে। ব্যাকটেরিয়া সুস্থ মানুষের নাসিকা পথে সহজে ঢুকে পড়ে ও দেহে সংক্রমণ ঘটায়। অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধের সাহায্যে নিউমোনিক প্লেগের চিকিৎসা না হলে তা মারাত্মক আকার নিতে পারে। মাঝে মাঝে রোগীর রক্তেও এই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটায়। সংক্রমিত রক্ত দেহের নানা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে মুক্তভাবে চলাচল করে যে প্লেগ রোগের উদ্ভব ঘটায় তাকে সেপ্টিসিমিক প্লেগ (septicaemic plague) বলা হয়। এতে রোগীর শ্বসন নিষ্ক্রিয় হওয়ার কারণে দেহের বর্ণ কালচে লাল হয়ে যায় এবং চিকিৎসা না হলে রোগীর মৃত্যু অবধারিত হয়। এজন্যে প্লেগের আরেক নাম 'ব্ল্যাক ডেথ ' (black death)।
সম্প্রতিকালে বাংলাদেশে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কোন রেকর্ড নেই। ১৯৯৪ সালে ভারতে দু'বার প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল যার বিস্তার দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল ব্যাকটেরিয়ার বাহক ফ্লি উচ্ছেদের লক্ষ্যে ইঁদুর মেরে এবং প্লেগ আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত শনাক্ত করে তাদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ ও অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে। সে সময় বাংলাদেশেও পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। এসবের মধ্যে ছিল সচেতনতামূলক কর্মসূচি এবং সন্দেহজনক ক্ষেত্রে তা সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের দৃষ্টিগোচরে আনা ইত্যাদি। সে সময় বাংলাদেশে প্লেগে আক্রান্ত কোন রোগী শনাক্ত করা যায় নি। [জিয়া উদ্দিন আহমেদ]