দরসবাড়ি মসজিদ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
২ নং লাইন: ২ নং লাইন:
'''দরসবাড়ি মসজিদ'''  গৌড় লখনৌতির বাংলাদেশ অংশের মধ্যে সর্ববৃহৎ মসজিদ। বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত। এটি ছোট সোনা কোতোয়ালী দরওয়াজা রোডের পশ্চিমে মধ্যযুগীয় শহরের দরসবাড়ি এলাকায় অবস্থিত, যা বর্তমানে ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী একটি পতিত এলাকা। দরসবাড়ি নামটি দরস্বাড়ি বা বিদ্যাপীঠ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যা একটি মাদ্রাসাকে নির্দেশ করে। মসজিদের পূর্বদিকে একটি মাদ্রাসা আছে যা একটি বড় জলাধার দ্বারা মসজিদ থেকে বিচ্ছিন্ন। মসজিদ, মাদ্রাসা ও জলাধার- এসব মিলিয়ে একটি মুসলিম শিক্ষা কমপ্লেক্সের রূপ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এর  [[শিলালিপি|শিলালিপি]] অনুযায়ী মসজিদটি ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছে।
'''দরসবাড়ি মসজিদ'''  গৌড় লখনৌতির বাংলাদেশ অংশের মধ্যে সর্ববৃহৎ মসজিদ। বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত। এটি ছোট সোনা কোতোয়ালী দরওয়াজা রোডের পশ্চিমে মধ্যযুগীয় শহরের দরসবাড়ি এলাকায় অবস্থিত, যা বর্তমানে ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী একটি পতিত এলাকা। দরসবাড়ি নামটি দরস্বাড়ি বা বিদ্যাপীঠ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যা একটি মাদ্রাসাকে নির্দেশ করে। মসজিদের পূর্বদিকে একটি মাদ্রাসা আছে যা একটি বড় জলাধার দ্বারা মসজিদ থেকে বিচ্ছিন্ন। মসজিদ, মাদ্রাসা ও জলাধার- এসব মিলিয়ে একটি মুসলিম শিক্ষা কমপ্লেক্সের রূপ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এর  [[শিলালিপি|শিলালিপি]] অনুযায়ী মসজিদটি ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছে।


মসজিদটির বাইরের দিকের পরিমাপ ৩৪ মি × ২০.৬ মি এবং ভেতরের পরিমাপ ৩০.৩ মি × ১১.৭ মি। এটি মধ্যযুগীয় বাংলার বৈশিষ্ট্যধারী একটি জামে মসজিদ, যা ভেতরে ও বাইরে টেরাকোটা ফলক অলংকরণসহ ঈষৎলাল বর্ণের ইট প্রদর্শন করছে। বর্তমানে এটি আচ্ছাদনবিহীন এবং সামনে একটি ভেঙ্গে পড়া বারান্দা রয়েছে। মসজিদটির দুটি অংশ, একটি সামনের বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ, সম্পূর্ণ ইমারতটি পূর্ব-পশ্চিমে টানা একটি চওড়া ‘নেভ’ (nave) দ্বারা বিভক্ত। মূল প্রার্থনা কক্ষের ‘নেভের’ উপরের আচ্ছাদন তিনটি চৌচালা ভল্টের সাহায্যে তৈরি; যার মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড়।#[[Image:দরসবাড়ি মসজিদ_html_88407781.png]]
[[Image:DarashBariMosque.jpg|thumb|400px|right|দরসবাড়ি মসজিদ, গৌড়]]
 
মসজিদটির বাইরের দিকের পরিমাপ ৩৪ মি × ২০.৬ মি এবং ভেতরের পরিমাপ ৩০.৩ মি × ১১.৭ মি। এটি মধ্যযুগীয় বাংলার বৈশিষ্ট্যধারী একটি জামে মসজিদ, যা ভেতরে ও বাইরে টেরাকোটা ফলক অলংকরণসহ ঈষৎলাল বর্ণের ইট প্রদর্শন করছে। বর্তমানে এটি আচ্ছাদনবিহীন এবং সামনে একটি ভেঙ্গে পড়া বারান্দা রয়েছে। মসজিদটির দুটি অংশ, একটি সামনের বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ, সম্পূর্ণ ইমারতটি পূর্ব-পশ্চিমে টানা একটি চওড়া ‘নেভ’ (nave) দ্বারা বিভক্ত। মূল প্রার্থনা কক্ষের ‘নেভের’ উপরের আচ্ছাদন তিনটি চৌচালা ভল্টের সাহায্যে তৈরি; যার মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড়।
[[Image:DarashBariMosque.jpg]]
 
#দরসবাড়ি মসজিদ, গৌড়


নেভের প্রতিপার্শেত উল্টানো পেয়ালার আকৃতিতে তৈরি সারিবদ্ধভাবে নয়টি করে মোট ১৮টি গম্বুজ আছে। বারান্দার উপরও এরূপ চৌচালা আচ্ছাদন ও গম্বুজ রয়েছে। বারান্দার নেভের উপর কিছুটা ছোট চৌচালা আকৃতির আচ্ছাদন এবং এর উভয় পার্শ্বে তিনটি করে একই রকম গম্বুজ নির্মিত হয়েছে। ফলে মসজিদের উপরে সর্বমোট চারটি চৌচালা আচ্ছাদন ও ২৪টি গম্বুজ নির্মিত হয়েছে যার সব কয়টি এখন নিশ্চিহ্ন। ইট ও পাথরের স্তম্ভগুলি যথাযথভাবে এ ভল্ট এবং গম্বুজগুলির ভার বহন করত। সবগুলিই বর্তমানে ভেঙ্গে গেছে এবং উন্মুক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভের উপর থেকে সূচাঁলো খিলান তৈরি হয়েছিল যা গম্বুজের বর্গাকৃতি ভিত্তি সৃষ্টিকারী পেন্ডেন্টিভকে ধারণ করেছিল। এ মসজিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো মূল কক্ষের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত রাজকীয় গ্যালারি (কখনো এটাকে ভুলভাবে মহিলা গ্যালারি বলেও বর্ণনা করা হয়েছে)। বাইরে থেকে প্রবেশের জন্য ছিল সিঁড়িযুক্ত মঞ্চ, যা সশস্ত্র প্রহরী দ্বারা সুরক্ষিত থাকত। ঐ গ্যালারি এ মসজিদকে শহরের অন্যান্য মসজিদের মতো জামে মসজিদ বলে নির্দেশ করে। মসজিদের উত্তরে একটি প্রবেশপথ ছিল, এখন সেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা পাথর থেকে এর অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। প্রতি কোণে অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ নির্মাণ করে মসজিদকে মজবুত করা হয়েছিল; পূর্বেরগুলি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, শুধু ভিত্তির কিছু অংশ টিকে আছে।  
নেভের প্রতিপার্শেত উল্টানো পেয়ালার আকৃতিতে তৈরি সারিবদ্ধভাবে নয়টি করে মোট ১৮টি গম্বুজ আছে। বারান্দার উপরও এরূপ চৌচালা আচ্ছাদন ও গম্বুজ রয়েছে। বারান্দার নেভের উপর কিছুটা ছোট চৌচালা আকৃতির আচ্ছাদন এবং এর উভয় পার্শ্বে তিনটি করে একই রকম গম্বুজ নির্মিত হয়েছে। ফলে মসজিদের উপরে সর্বমোট চারটি চৌচালা আচ্ছাদন ও ২৪টি গম্বুজ নির্মিত হয়েছে যার সব কয়টি এখন নিশ্চিহ্ন। ইট ও পাথরের স্তম্ভগুলি যথাযথভাবে এ ভল্ট এবং গম্বুজগুলির ভার বহন করত। সবগুলিই বর্তমানে ভেঙ্গে গেছে এবং উন্মুক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভের উপর থেকে সূচাঁলো খিলান তৈরি হয়েছিল যা গম্বুজের বর্গাকৃতি ভিত্তি সৃষ্টিকারী পেন্ডেন্টিভকে ধারণ করেছিল। এ মসজিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো মূল কক্ষের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত রাজকীয় গ্যালারি (কখনো এটাকে ভুলভাবে মহিলা গ্যালারি বলেও বর্ণনা করা হয়েছে)। বাইরে থেকে প্রবেশের জন্য ছিল সিঁড়িযুক্ত মঞ্চ, যা সশস্ত্র প্রহরী দ্বারা সুরক্ষিত থাকত। ঐ গ্যালারি এ মসজিদকে শহরের অন্যান্য মসজিদের মতো জামে মসজিদ বলে নির্দেশ করে। মসজিদের উত্তরে একটি প্রবেশপথ ছিল, এখন সেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা পাথর থেকে এর অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। প্রতি কোণে অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ নির্মাণ করে মসজিদকে মজবুত করা হয়েছিল; পূর্বেরগুলি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, শুধু ভিত্তির কিছু অংশ টিকে আছে।  
১২ নং লাইন: ৯ নং লাইন:
এ মসজিদের অলংকরণ অত্যন্ত জমকালো। অনুভূমিকভাবে, ‘অফসেট’ ও ‘ইনসেট’ ও নকশার সাহায্যে বাইরের দেয়াল বিন্যস্ত। সাথে রয়েছে পোড়ামাটির ফলকের প্যানেল, যার মধ্যে ঝুলন্ত মোটিফের প্রাধান্য রয়েছে। ভেতর দিকে খিলান ও পেন্ডেন্টিভগুলিতে ইটের গাঁথনির মাধ্যমে সজ্জিত করা হয়েছে।  
এ মসজিদের অলংকরণ অত্যন্ত জমকালো। অনুভূমিকভাবে, ‘অফসেট’ ও ‘ইনসেট’ ও নকশার সাহায্যে বাইরের দেয়াল বিন্যস্ত। সাথে রয়েছে পোড়ামাটির ফলকের প্যানেল, যার মধ্যে ঝুলন্ত মোটিফের প্রাধান্য রয়েছে। ভেতর দিকে খিলান ও পেন্ডেন্টিভগুলিতে ইটের গাঁথনির মাধ্যমে সজ্জিত করা হয়েছে।  


মিহরাবগুলি কে প্রতিটি ‘বে’ বরাবর স্থাপন করা হয়েছে। মিহরাবগুলির খিলান লতাগুল্ম, পত্রসম্ভার, গোলাপ, চারাগাছ ও ঝুলন্ত নকশায় সজ্জিত পোড়ামাটির ফলকের ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত। খিলানগুলির অলংকরণ শৈলী গৌড়-লখনৌতির এ প্রকার অলংকরণ শৈলীর অতি উৎকৃষ্ট নমুনা। এ পোড়ামাটির ফলকগুলি অন্যান্য উদাহরণের চেয়ে উন্নতমানের এবং এগুলিতে কিছুটা ঔজ্জ্বল্যের আবরণ থাকাতে দেখতেও কিছুটা ভিন্ন ধরনের ও আকর্ষণীয়। পশ্চিম দেয়ালটি টিকে আছে, এবং দক্ষিণ দিকের দেয়ালে সংস্কারের ফলে পোড়ামাটির ফলকের আসল রূপ নষ্ট হয়ে গেছে। মসজিদের বক্র কার্নিসে ধাবমান সারিতে পতাকার আকারে  পোড়ামাটির ফলক স্থাপনের মধ্যে একটি আকর্ষণীয় উদ্দেশ্য রয়েছে, যা ঘোষণা করে মসজিদের নির্মাতা ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান ও বিশ্বাসীদের নেতা (আমীর''-''উল''- ''মুমিনীন )।  
মিহরাবগুলি কে প্রতিটি ‘বে’ বরাবর স্থাপন করা হয়েছে। মিহরাবগুলির খিলান লতাগুল্ম, পত্রসম্ভার, গোলাপ, চারাগাছ ও ঝুলন্ত নকশায় সজ্জিত পোড়ামাটির ফলকের ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত। খিলানগুলির অলংকরণ শৈলী গৌড়-লখনৌতির এ প্রকার অলংকরণ শৈলীর অতি উৎকৃষ্ট নমুনা। এ পোড়ামাটির ফলকগুলি অন্যান্য উদাহরণের চেয়ে উন্নতমানের এবং এগুলিতে কিছুটা ঔজ্জ্বল্যের আবরণ থাকাতে দেখতেও কিছুটা ভিন্ন ধরনের ও আকর্ষণীয়। পশ্চিম দেয়ালটি টিকে আছে, এবং দক্ষিণ দিকের দেয়ালে সংস্কারের ফলে পোড়ামাটির ফলকের আসল রূপ নষ্ট হয়ে গেছে। মসজিদের বক্র কার্নিসে ধাবমান সারিতে পতাকার আকারে  পোড়ামাটির ফলক স্থাপনের মধ্যে একটি আকর্ষণীয় উদ্দেশ্য রয়েছে, যা ঘোষণা করে মসজিদের নির্মাতা ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান ও বিশ্বাসীদের নেতা (আমীর-উল-মুমিনীন )।  


দরসবাড়ি মসজিদ একসময়ে [[গৌড়, নগর|গৌড়]] লখনৌতির সুলতানি আমলের মসজিদসমূহের মধ্যে অন্যতম সুন্দর উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত ছিলো। শহর স্থাপনের শুরুর দিকেই এটি নির্মিত হয়েছিল, অন্যান্য সমসাময়িক উদাহরণের মতো এটাও গৌড়ীয় রীতি’র অন্তর্ভুক্ত, যা পরে বাংলার অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং মধ্যযুগীয় স্বাধীন বাংলা রীতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।  [এ.বি.এম হোসেন]  
দরসবাড়ি মসজিদ একসময়ে [[গৌড়, নগর|গৌড়]] লখনৌতির সুলতানি আমলের মসজিদসমূহের মধ্যে অন্যতম সুন্দর উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত ছিলো। শহর স্থাপনের শুরুর দিকেই এটি নির্মিত হয়েছিল, অন্যান্য সমসাময়িক উদাহরণের মতো এটাও গৌড়ীয় রীতি’র অন্তর্ভুক্ত, যা পরে বাংলার অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং মধ্যযুগীয় স্বাধীন বাংলা রীতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।  [এ.বি.এম হোসেন]  


'''গ্রন্থপঞ্জি'''  ABM Husain (ed), ''Gawr-Lakhnawti'', Dhaka , 1997.    
'''গ্রন্থপঞ্জি'''  ABM Husain (ed), ''Gawr-Lakhnawti'', Dhaka , 1997.    
<!-- imported from file: দরসবাড়ি মসজিদ.html-->


[[en:Darasbari Mosque]]
[[en:Darasbari Mosque]]

০৭:০২, ৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

দরসবাড়ি মসজিদ  গৌড় লখনৌতির বাংলাদেশ অংশের মধ্যে সর্ববৃহৎ মসজিদ। বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত। এটি ছোট সোনা কোতোয়ালী দরওয়াজা রোডের পশ্চিমে মধ্যযুগীয় শহরের দরসবাড়ি এলাকায় অবস্থিত, যা বর্তমানে ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী একটি পতিত এলাকা। দরসবাড়ি নামটি দরস্বাড়ি বা বিদ্যাপীঠ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যা একটি মাদ্রাসাকে নির্দেশ করে। মসজিদের পূর্বদিকে একটি মাদ্রাসা আছে যা একটি বড় জলাধার দ্বারা মসজিদ থেকে বিচ্ছিন্ন। মসজিদ, মাদ্রাসা ও জলাধার- এসব মিলিয়ে একটি মুসলিম শিক্ষা কমপ্লেক্সের রূপ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এর  শিলালিপি অনুযায়ী মসজিদটি ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছে।

দরসবাড়ি মসজিদ, গৌড়

মসজিদটির বাইরের দিকের পরিমাপ ৩৪ মি × ২০.৬ মি এবং ভেতরের পরিমাপ ৩০.৩ মি × ১১.৭ মি। এটি মধ্যযুগীয় বাংলার বৈশিষ্ট্যধারী একটি জামে মসজিদ, যা ভেতরে ও বাইরে টেরাকোটা ফলক অলংকরণসহ ঈষৎলাল বর্ণের ইট প্রদর্শন করছে। বর্তমানে এটি আচ্ছাদনবিহীন এবং সামনে একটি ভেঙ্গে পড়া বারান্দা রয়েছে। মসজিদটির দুটি অংশ, একটি সামনের বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ, সম্পূর্ণ ইমারতটি পূর্ব-পশ্চিমে টানা একটি চওড়া ‘নেভ’ (nave) দ্বারা বিভক্ত। মূল প্রার্থনা কক্ষের ‘নেভের’ উপরের আচ্ছাদন তিনটি চৌচালা ভল্টের সাহায্যে তৈরি; যার মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড়।

নেভের প্রতিপার্শেত উল্টানো পেয়ালার আকৃতিতে তৈরি সারিবদ্ধভাবে নয়টি করে মোট ১৮টি গম্বুজ আছে। বারান্দার উপরও এরূপ চৌচালা আচ্ছাদন ও গম্বুজ রয়েছে। বারান্দার নেভের উপর কিছুটা ছোট চৌচালা আকৃতির আচ্ছাদন এবং এর উভয় পার্শ্বে তিনটি করে একই রকম গম্বুজ নির্মিত হয়েছে। ফলে মসজিদের উপরে সর্বমোট চারটি চৌচালা আচ্ছাদন ও ২৪টি গম্বুজ নির্মিত হয়েছে যার সব কয়টি এখন নিশ্চিহ্ন। ইট ও পাথরের স্তম্ভগুলি যথাযথভাবে এ ভল্ট এবং গম্বুজগুলির ভার বহন করত। সবগুলিই বর্তমানে ভেঙ্গে গেছে এবং উন্মুক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভের উপর থেকে সূচাঁলো খিলান তৈরি হয়েছিল যা গম্বুজের বর্গাকৃতি ভিত্তি সৃষ্টিকারী পেন্ডেন্টিভকে ধারণ করেছিল। এ মসজিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো মূল কক্ষের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত রাজকীয় গ্যালারি (কখনো এটাকে ভুলভাবে মহিলা গ্যালারি বলেও বর্ণনা করা হয়েছে)। বাইরে থেকে প্রবেশের জন্য ছিল সিঁড়িযুক্ত মঞ্চ, যা সশস্ত্র প্রহরী দ্বারা সুরক্ষিত থাকত। ঐ গ্যালারি এ মসজিদকে শহরের অন্যান্য মসজিদের মতো জামে মসজিদ বলে নির্দেশ করে। মসজিদের উত্তরে একটি প্রবেশপথ ছিল, এখন সেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা পাথর থেকে এর অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। প্রতি কোণে অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ নির্মাণ করে মসজিদকে মজবুত করা হয়েছিল; পূর্বেরগুলি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, শুধু ভিত্তির কিছু অংশ টিকে আছে।

এ মসজিদের অলংকরণ অত্যন্ত জমকালো। অনুভূমিকভাবে, ‘অফসেট’ ও ‘ইনসেট’ ও নকশার সাহায্যে বাইরের দেয়াল বিন্যস্ত। সাথে রয়েছে পোড়ামাটির ফলকের প্যানেল, যার মধ্যে ঝুলন্ত মোটিফের প্রাধান্য রয়েছে। ভেতর দিকে খিলান ও পেন্ডেন্টিভগুলিতে ইটের গাঁথনির মাধ্যমে সজ্জিত করা হয়েছে।

মিহরাবগুলি কে প্রতিটি ‘বে’ বরাবর স্থাপন করা হয়েছে। মিহরাবগুলির খিলান লতাগুল্ম, পত্রসম্ভার, গোলাপ, চারাগাছ ও ঝুলন্ত নকশায় সজ্জিত পোড়ামাটির ফলকের ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত। খিলানগুলির অলংকরণ শৈলী গৌড়-লখনৌতির এ প্রকার অলংকরণ শৈলীর অতি উৎকৃষ্ট নমুনা। এ পোড়ামাটির ফলকগুলি অন্যান্য উদাহরণের চেয়ে উন্নতমানের এবং এগুলিতে কিছুটা ঔজ্জ্বল্যের আবরণ থাকাতে দেখতেও কিছুটা ভিন্ন ধরনের ও আকর্ষণীয়। পশ্চিম দেয়ালটি টিকে আছে, এবং দক্ষিণ দিকের দেয়ালে সংস্কারের ফলে পোড়ামাটির ফলকের আসল রূপ নষ্ট হয়ে গেছে। মসজিদের বক্র কার্নিসে ধাবমান সারিতে পতাকার আকারে  পোড়ামাটির ফলক স্থাপনের মধ্যে একটি আকর্ষণীয় উদ্দেশ্য রয়েছে, যা ঘোষণা করে মসজিদের নির্মাতা ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান ও বিশ্বাসীদের নেতা (আমীর-উল-মুমিনীন )।

দরসবাড়ি মসজিদ একসময়ে গৌড় লখনৌতির সুলতানি আমলের মসজিদসমূহের মধ্যে অন্যতম সুন্দর উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত ছিলো। শহর স্থাপনের শুরুর দিকেই এটি নির্মিত হয়েছিল, অন্যান্য সমসাময়িক উদাহরণের মতো এটাও গৌড়ীয় রীতি’র অন্তর্ভুক্ত, যা পরে বাংলার অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং মধ্যযুগীয় স্বাধীন বাংলা রীতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।  [এ.বি.এম হোসেন]

গ্রন্থপঞ্জি  ABM Husain (ed), Gawr-Lakhnawti, Dhaka , 1997.