জোনস, স্যার উইলিয়ম: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

সম্পাদনা সারাংশ নেই
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
১৯ নং লাইন: ১৯ নং লাইন:
একজন বিচারপতি হিসেবে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টে যোগদান করার পর জোনস প্রাচ্য বিষয়ে আগ্রহী সিভিলিয়নদের নিয়ে একটি সভা ডাকেন (১৫ জানুয়ারি ১৭৮৪)। সভায় উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি হাইড, জেনারেল জন ক্লার্ক, ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন, টমাস ল, জোনাথান ডানকান, চার্লস উইলকিনস্ এবং জর্জ বার্লো প্রমুখ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ। স্থাপন করা হলো এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা। সংগঠনের সভাপতির পদের জন্য জোনস গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে অনুরোধ জানান। কিন্তু হেস্টিংস এ পদ গ্রহণে অপারগতা জানালে উইলিয়ম জোনস নিজে সোসাইটি-এর প্রথম সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। সোসাইটির পরবর্তী সভায় জোনস একটি বার্ষিক ভাষণদানের রীতি প্রবর্তন করেন এবং এ ধারায় তিনি প্রথম যে ভাষণটি দেন সেটির শিরোনাম হলো ‘''A Discourse on the Institution of a Society for Inquiry into the History, Civil and Natural, the Antiquities, Arts, Sciences, and Literature, of Asia''’।
একজন বিচারপতি হিসেবে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টে যোগদান করার পর জোনস প্রাচ্য বিষয়ে আগ্রহী সিভিলিয়নদের নিয়ে একটি সভা ডাকেন (১৫ জানুয়ারি ১৭৮৪)। সভায় উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি হাইড, জেনারেল জন ক্লার্ক, ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন, টমাস ল, জোনাথান ডানকান, চার্লস উইলকিনস্ এবং জর্জ বার্লো প্রমুখ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ। স্থাপন করা হলো এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা। সংগঠনের সভাপতির পদের জন্য জোনস গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে অনুরোধ জানান। কিন্তু হেস্টিংস এ পদ গ্রহণে অপারগতা জানালে উইলিয়ম জোনস নিজে সোসাইটি-এর প্রথম সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। সোসাইটির পরবর্তী সভায় জোনস একটি বার্ষিক ভাষণদানের রীতি প্রবর্তন করেন এবং এ ধারায় তিনি প্রথম যে ভাষণটি দেন সেটির শিরোনাম হলো ‘''A Discourse on the Institution of a Society for Inquiry into the History, Civil and Natural, the Antiquities, Arts, Sciences, and Literature, of Asia''’।


জোনস ফার্সি ভাষার মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম বিষয়ক চর্চা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় [[১০০৬০০|চার্লস উইলকিন্স]] তাকে সংস্কৃত শেখার জন্য উৎসাহিত করেন। জোনস সস্ত্রীক পলাশী প্রান্তর পরিদর্শনে যান এবং সেখানে তিনটি কবিতা লিখে স্ত্রীকে নিবেদন করেন। কবিতাগুলি: (১) ''Plassey-Plain, a Ballad, Addressed to Lady Jones, by Her Husband'''';'' (২) ''Lines from the Arabic ''এবং (৩) ''Au Firmamen''t। তিনি ‘The Character of John Lord Ashburton’ শিরোনামে Ashburton সম্পর্কে একটি স্মারক নিবন্ধ লিখে সাময়িকীতে প্রকাশের জন্য বন্ধুবান্ধবের নিকট লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। ১৭৮৪ সালে জর্জ টাইলার বনাম কন্সটেবল ফ্রেডারিক ডিডকার-এর একটি মামলা বিচারের জন্য কোর্টে আসে। ডিডকারের অন্যায় আচরণ এবং প্রধান বিচারক চেম্বারস ও অন্য বিচারক হাইডের পক্ষপাতমূলক রায় জোনসকে ব্যাথিত করলেও তিনজন বিচারকের মধ্যে তিনি একা সংখ্যালঘু হওয়ায় ন্যায়দন্ড তুলে ধরতে না পারার ব্যাথা সইতে বাধ্য হন। ভারতীয় গাছপালার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি সুইডেনের উদ্ভিদবিজ্ঞানী Carolus Linnaeus (Carl Von Linne)-এর ''Systema Naturae''-এ অন্তর্ভুক্ত নয় এরকম অসংখ্য ভারতীয় গাছপালার একটি তালিকা তৈরি করে এর অন্তর্ভুক্ত করে তিনি ইউরোপে ভারতীয় উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন। সংস্কৃত শেখার লক্ষ্যে তিনি বেনারস গমন করেন এবং কয়েকজন পন্ডিতের সান্নিধ্য গ্রহণ করেন। সরকারের বিচার ব্যবস্থার সুবিধার্থে তিনি মনু ও ধর্মশাস্ত্রের ইংরেজি অনুবাদ করেন।  
জোনস ফার্সি ভাষার মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম বিষয়ক চর্চা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় [[উইলকিন্স, চার্লস]|চার্লস উইলকিন্স]] তাকে সংস্কৃত শেখার জন্য উৎসাহিত করেন। জোনস সস্ত্রীক পলাশী প্রান্তর পরিদর্শনে যান এবং সেখানে তিনটি কবিতা লিখে স্ত্রীকে নিবেদন করেন। কবিতাগুলি: (১) 'Plassey-Plain, a Ballad, Addressed to Lady Jones, by Her Husband'; (২) 'Lines from the Arabic' এবং (৩) 'Au Firmament' তিনি ‘The Character of John Lord Ashburton’ শিরোনামে Ashburton সম্পর্কে একটি স্মারক নিবন্ধ লিখে সাময়িকীতে প্রকাশের জন্য বন্ধুবান্ধবের নিকট লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। ১৭৮৪ সালে জর্জ টাইলার বনাম কন্সটেবল ফ্রেডারিক ডিডকার-এর একটি মামলা বিচারের জন্য কোর্টে আসে। ডিডকারের অন্যায় আচরণ এবং প্রধান বিচারক চেম্বারস ও অন্য বিচারক হাইডের পক্ষপাতমূলক রায় জোনসকে ব্যাথিত করলেও তিনজন বিচারকের মধ্যে তিনি একা সংখ্যালঘু হওয়ায় ন্যায়দন্ড তুলে ধরতে না পারার ব্যাথা সইতে বাধ্য হন। ভারতীয় গাছপালার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি সুইডেনের উদ্ভিদবিজ্ঞানী Carolus Linnaeus (Carl Von Linne)-এর ''Systema Naturae''-এ অন্তর্ভুক্ত নয় এরকম অসংখ্য ভারতীয় গাছপালার একটি তালিকা তৈরি করে এর অন্তর্ভুক্ত করে তিনি ইউরোপে ভারতীয় উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন। সংস্কৃত শেখার লক্ষ্যে তিনি বেনারস গমন করেন এবং কয়েকজন পন্ডিতের সান্নিধ্য গ্রহণ করেন। সরকারের বিচার ব্যবস্থার সুবিধার্থে তিনি মনু ও ধর্মশাস্ত্রের ইংরেজি অনুবাদ করেন।  


স্যার উইলিয়াম জোনস ১৭৮৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটিতে ‘''The Second Anniversary Discourse''’-এ তিনি ইউরোপীয়দের জানান যে, ভারতীয় সভ্যতা অনেক পুরনো এবং বিশ্বের যে কোনো বড় সভ্যতার সমকক্ষ। তিনি সদস্যদের আহবান জানান যে, তাঁরা যেন ভারতীয় উদ্ভিদ বিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র, শিল্প, এবং স্থাপত্যবিদ্যা গবেষণার উপর জোর দেন। তিনি আরও আহবান জানান যে, তাঁরা যেন প্রাচ্যের যাবতীয় গ্রন্থের একটি পূর্ণ তালিকা প্রণয়ন করেন। ভারতীয় দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে তিনি জোরালো বক্তব্য রাখেন, যদিও তিনি নিজে কয়েকজন দাস ক্রয় করেছিলেন। হিন্দু সভ্যতার বিভিন্ন দেবদেবী ও ঋষিকে বিষয় করে তিনি কয়েকটি কবিতা ''Asiatic Miscellany'' প্রকাশ করেন।
স্যার উইলিয়াম জোনস ১৭৮৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটিতে ‘The Second Anniversary Discourse’-এ তিনি ইউরোপীয়দের জানান যে, ভারতীয় সভ্যতা অনেক পুরনো এবং বিশ্বের যে কোনো বড় সভ্যতার সমকক্ষ। তিনি সদস্যদের আহবান জানান যে, তাঁরা যেন ভারতীয় উদ্ভিদ বিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র, শিল্প, এবং স্থাপত্যবিদ্যা গবেষণার উপর জোর দেন। তিনি আরও আহবান জানান যে, তাঁরা যেন প্রাচ্যের যাবতীয় গ্রন্থের একটি পূর্ণ তালিকা প্রণয়ন করেন। ভারতীয় দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে তিনি জোরালো বক্তব্য রাখেন, যদিও তিনি নিজে কয়েকজন দাস ক্রয় করেছিলেন। হিন্দু সভ্যতার বিভিন্ন দেবদেবী ও ঋষিকে বিষয় করে তিনি কয়েকটি কবিতা ''Asiatic Miscellany'' প্রকাশ করেন।


প্রাচ্য বিদ্যায় জোনস-এর খ্যাতি বিশ্বপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে যখন তিনি ১৭৮৬ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর তৃতীয় বার্ষিক বক্তৃতা প্রদান করেন (The Third Anniversary Discourse)। ঐ বক্তৃতায় তিনি প্রমাণাদিসহ দাবি করেন যে, ইউরোপীয় ভাষা এবং সংস্কৃতের তুলনামূলক আলোচনায় তিনি লক্ষ করেছেন যে, গ্রিক, ল্যাটিন, গথিক ও কেলটিক এবং সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষার উৎস একই। মিলের উপর ভিত্তি করে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করে তার ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন। আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর পন্ডিতগণ একমত হন যে, স্যার উইলিয়াম জোনস-এর ধারণা সঠিক। জোনস বিশ্ব ভাষাবিজ্ঞানের জনকের মর্যাদা লাভ করেন।  
প্রাচ্য বিদ্যায় জোনস-এর খ্যাতি বিশ্বপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে যখন তিনি ১৭৮৬ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর তৃতীয় বার্ষিক বক্তৃতা প্রদান করেন (The Third Anniversary Discourse)। ঐ বক্তৃতায় তিনি প্রমাণাদিসহ দাবি করেন যে, ইউরোপীয় ভাষা এবং সংস্কৃতের তুলনামূলক আলোচনায় তিনি লক্ষ করেছেন যে, গ্রিক, ল্যাটিন, গথিক ও কেলটিক এবং সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষার উৎস একই। মিলের উপর ভিত্তি করে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করে তার ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন। আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর পন্ডিতগণ একমত হন যে, স্যার উইলিয়াম জোনস-এর ধারণা সঠিক। জোনস বিশ্ব ভাষাবিজ্ঞানের জনকের মর্যাদা লাভ করেন।  
২৯ নং লাইন: ২৯ নং লাইন:
১৭৮৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জোনস তাঁর ‘The Fifth Anniversary Discourse’ প্রদান করেন। এটিতে তার মুখ্য আলোচনার বিষয় ছিল তাতার সভ্যতা। প্রাচ্যের লোকদের তিনি মোট তিনটি ভাগে ভাগ করেন: হিন্দু, আরব এবং তাতার। তাদের মধ্যকার বিভিন্ন এবং বিচিত্র শ্রেণি বিভক্তির কথাও তিনি উল্লেখ করেন। এ বছরে তিনি ঋণগ্রস্তদের সহায়তা দানের জন্য তাঁর কাছে থাকা লাইলী মজনু'', ''এ পার্সীয়ান পোয়েম অব হাতিফি -এ শিরোনামের গ্রন্থটির দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপিটি ইংরেজিতে একটি ভূমিকাসহ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। সংস্কৃতে নিজের জ্ঞানকে মোটামুটি যথেষ্ট মনে করে তিনি এ বছরই ''The Ordinances of Manu'' (১৭৯৪) অনুবাদ করা শুরু করেন।  
১৭৮৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জোনস তাঁর ‘The Fifth Anniversary Discourse’ প্রদান করেন। এটিতে তার মুখ্য আলোচনার বিষয় ছিল তাতার সভ্যতা। প্রাচ্যের লোকদের তিনি মোট তিনটি ভাগে ভাগ করেন: হিন্দু, আরব এবং তাতার। তাদের মধ্যকার বিভিন্ন এবং বিচিত্র শ্রেণি বিভক্তির কথাও তিনি উল্লেখ করেন। এ বছরে তিনি ঋণগ্রস্তদের সহায়তা দানের জন্য তাঁর কাছে থাকা লাইলী মজনু'', ''এ পার্সীয়ান পোয়েম অব হাতিফি -এ শিরোনামের গ্রন্থটির দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপিটি ইংরেজিতে একটি ভূমিকাসহ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। সংস্কৃতে নিজের জ্ঞানকে মোটামুটি যথেষ্ট মনে করে তিনি এ বছরই ''The Ordinances of Manu'' (১৭৯৪) অনুবাদ করা শুরু করেন।  


১৭৮৬ সালে জোনস তাঁর প্রবন্ধ ‘''A Dissertation on the Orthography of Asiatick Words in Roman Letters''’-এ সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষাকে রোমান হরফে প্রতিলিপি করণের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর পদ্ধতিটি জোনেসিয়ান সিস্টেম (Jonesian system) নামে পরিচিতি লাভ করে। এ পদ্ধতি ভাষার ধ্বনিবিজ্ঞান বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
১৭৮৬ সালে জোনস তাঁর প্রবন্ধ ‘A Dissertation on the Orthography of Asiatick Words in Roman Letters’-এ সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষাকে রোমান হরফে প্রতিলিপি করণের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর পদ্ধতিটি জোনেসিয়ান সিস্টেম (Jonesian system) নামে পরিচিতি লাভ করে। এ পদ্ধতি ভাষার ধ্বনিবিজ্ঞান বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।


১৭৮৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জোনস এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর ‘''The Sixth Discourse On the Persians''’ প্রদান করেন। এ ডিসকোর্সে তিনি পার্সিয়ান জাতি এবং ভাষা সম্পর্কে চারটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন যে, (১) এসিরিয়দের আগমনের পূর্বে পারস্যে একটি শক্তিশালী হিন্দু রাজবংশ রাজত্ব করত; (২) প্রথম পারস্য সাম্রাজ্যের ভাষা থেকে সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন এবং জার্মানিক উপভাষা উদ্ভুত হয়; (৩) সে সময় অন্যান্য প্রাচ্য জাতি বিকশিত হওয়ার পূর্বে পারস্য ছিল জনবসতি, জ্ঞান ও বিভিন্ন কলার কেন্দ্রভূমি; এবং (৪) আরব, তাতার এবং ভারতের প্রতিষ্ঠাতা জাতিরা আদিতে পারস্য থেকে স্থানান্তরিত হন। মূল শাহনামা পড়তে গিয়ে তিনি ফার্সি এবং সংস্কৃতের মধ্যে যে সব মিল লক্ষ করেন তা-ই ছিল তাঁর সিদ্ধান্তের উৎস বা ভিত্তি। ১৭৮৯ সালের শুরুতে তিনি একটি কাব্য নাটক গীত গোবিন্দ বা ''The Songs of Joyadeva'' অনুবাদ করেন।
১৭৮৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জোনস এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর ‘The Sixth Discourse On the Persians’ প্রদান করেন। এ ডিসকোর্সে তিনি পার্সিয়ান জাতি এবং ভাষা সম্পর্কে চারটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন যে, (১) এসিরিয়দের আগমনের পূর্বে পারস্যে একটি শক্তিশালী হিন্দু রাজবংশ রাজত্ব করত; (২) প্রথম পারস্য সাম্রাজ্যের ভাষা থেকে সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন এবং জার্মানিক উপভাষা উদ্ভুত হয়; (৩) সে সময় অন্যান্য প্রাচ্য জাতি বিকশিত হওয়ার পূর্বে পারস্য ছিল জনবসতি, জ্ঞান ও বিভিন্ন কলার কেন্দ্রভূমি; এবং (৪) আরব, তাতার এবং ভারতের প্রতিষ্ঠাতা জাতিরা আদিতে পারস্য থেকে স্থানান্তরিত হন। মূল শাহনামা পড়তে গিয়ে তিনি ফার্সি এবং সংস্কৃতের মধ্যে যে সব মিল লক্ষ করেন তা-ই ছিল তাঁর সিদ্ধান্তের উৎস বা ভিত্তি। ১৭৮৯ সালের শুরুতে তিনি একটি কাব্য নাটক গীত গোবিন্দ বা ''The Songs of Joyadeva'' অনুবাদ করেন।


ভারতে আসার পর জীবনের শেষের দিকের বছরগুলিতে জোনস এবং এ্যানা মারিয়ার স্বাস্থ্য ভালো কাটেনি। দুজনেই প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন আর সে সময় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কলকাতা শহরটি ছিল স্বাস্থ্যের জন্য বিপদজনক। ইতোমধ্যে তাঁরা ছয় বছরের কিছু বেশি সময় এখানে কাটিয়ে দিয়েছেন। দুজনের মধ্যে জোনসের স্বাস্থ্যই কিছুটা ভালো কেটেছে। ১৭৯০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি সোসাইটিতে তাঁর ''The Seventh Anniversary Discourse'' এবং ১৭৯১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘The Eigth Anniversary Discourse’ প্রদান করেন।
ভারতে আসার পর জীবনের শেষের দিকের বছরগুলিতে জোনস এবং এ্যানা মারিয়ার স্বাস্থ্য ভালো কাটেনি। দুজনেই প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন আর সে সময় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কলকাতা শহরটি ছিল স্বাস্থ্যের জন্য বিপদজনক। ইতোমধ্যে তাঁরা ছয় বছরের কিছু বেশি সময় এখানে কাটিয়ে দিয়েছেন। দুজনের মধ্যে জোনসের স্বাস্থ্যই কিছুটা ভালো কেটেছে। ১৭৯০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি সোসাইটিতে তাঁর ''The Seventh Anniversary Discourse'' এবং ১৭৯১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘The Eigth Anniversary Discourse’ প্রদান করেন।

১০:২৮, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

জোনস, স্যার উইলিয়ম (১৭৪৬-১৭৯৪)  প্রাচ্যবিদ, আইনবিদ, বহু ভাষাবিদ, কবি, তুলনামূলক ভাষা বিজ্ঞানের পথিকৃৎ, কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর ১৭৪৬। জন্মস্থান লন্ডন ওয়েস্টমিনস্টার। পিতা জোনস ছিলেন গণিতবিদ এবং গণিতে রয়েল সোসাইটির ফেলো।

স্যার উইলিয়ম জোনস

পারিবারিক পরিমন্ডলে জোনস শিখেছিলেন, ‘Read, and you will know’। চার বছর বয়সেই জোনস যে কোনো ইংরেজি বই পড়ে বুঝতে পারতেন। শেক্সপীয়রের নাটকের স্বগতোক্তি এবং গে-এর ফেবল মুখস্ত করে স্মরণ রাখার এক ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ১৭৫৩ সালে পাবলিক স্কুল হ্যারোতে ভর্তি হন। তেরো বছর বয়সে তিনি ‘Saul and David’ শিরোনামের একটি 'Ode' এবং 'Meleager' শিরোনামের একটি ট্রাজেডি লেখেন। স্কুলেই তিনি ল্যাটিন, গ্রিক এবং হিব্রু আয়ত্ব করেন। হিব্রু তাকে মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহান্বিত করে। তিনি আরবি ভাষার বুৎপত্তি অর্জন করেন।

১৭৬৪ সালে জোনস অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন। অক্সফোর্ডে তিনি আইনশাস্ত্র অধ্যয়নের পাশাপাশি আরবি এবং ফার্সি ভাষায় আরও গভীর ব্যুৎপত্তি অজর্ন করেন। ১৭৬৮ সালে তিনি পোলিশ কূটনীতিবিদ এবং পারস্যের কবি হাফিজের গজলের অনুবাদক কাউন্ট চার্লস রেভিস্জকির সঙ্গে পরিচিত হন। তাঁদের সান্নিধ্যে জোনসের মনে হলো যে, পিনডার, এনাক্রিয়ন, স্যাপো, আর্কিলোকাস, এলকেইয়াস এবং সাইমোনাইডস প্রমুখ কবিবৃন্দ হাফিজ, সাদী এবং ফেরদৌসির চেয়ে শ্রেয়তর নয়। তিনি হাফিজের বিশেষ ভক্ত হয়ে পড়েন। প্রাচ্যবিদ্যার চর্চায় খ্যাতির ফলে এবং সে সময় আরবি এবং ফার্সি এ দুটি ভাষাতেই পারদর্শী হওয়ায় তার খ্যাতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ হয় এবং রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত এ খ্যাতি পৌঁছে যায়। ১৭৬৮ সালে ডেনমার্কের রাজা অষ্টম খ্রিশ্চীয়ান মির্জা মাহাদী রচিত সম্রাট নাদীর শাহ-এর জীবনী Tarikh-i-Nadiri-এর পান্ডুলিপিটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদের লক্ষ্যে লন্ডনে এসে ব্রিটিশ সরকারের স্মরণাপন্ন হন। প্রায় বছর খানেক খেটে এটির অনুবাদ শেষ করেন এবং ল্যাটিন ভাষায় L’ Historie de Nader Chah নামের বইটি প্রকাশ করেন। ডেনমার্কের রাজা ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জকে একটি চিঠি লিখে জোনস সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। জোনসকে রয়েল সোসাইটি অব কোপেনহেগেন-এর সদস্য করে নেওয়া হয়। দুটি ঘটনাই জোনসকে প্রাচ্যচর্চাবিদ হিসেবে একেবারে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। এ অনুবাদ কর্মটির চাহিদা এত বৃদ্ধি পায় যে, ১৭৭৩ সালে জোনস এটির একটি সংক্ষিপ্ত ইংরেজি ভাষান্তর প্রকাশ করেন। ফ্রান্সের সম্রাট Luis XVI এই বলে প্রশংসা করেন যে জোনস তার চেয়ে শ্রেয়তর ফরাসি জানেন। জোনস ফরাসি অনুবাদটির সঙ্গে টীকা-টীপ্পনি ছাড়াও প্রাচ্য সাহিত্য সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ 'Treatise on ‘Oriental’ Poetry' সংযুক্ত করেন। এডওয়ার্ড গীবন তার প্রখ্যাত ইতিহাসে এ প্রবন্ধের প্রশংসা করেন। এ প্রবন্ধে জোনস আরবি ও ফার্সি সাহিত্যের উৎকর্ষ তুলে ধরেন। প্রাচ্য সাহিত্যের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় কুসংস্কার খন্ডন করে জোনস মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্যের নতুনতর গুণাবলিকে ইউরোপীয় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে উপযোগী বলে অভিমত পোষণ করেন। তিনি ইউরোপীয়দের নিকট ফেরদৌসির মহকাব্য শাহনামা, আরবি কবিতা সঙ্কলন মোয়াল্লাকাত এবং হামাসা, আত্মারের পান্ডেনামা এবং অন্ধ কবি আবুল আলা-এর প্রশংসামূলক কবিতার উল্লেখ করে বলেন যে, ইউরোপীয় সাহিত্যের মতো প্রাচ্যের সাহিত্যেরও বিভিন্ন শাখা রয়েছে। তিনি প্রাচ্য সাহিত্যের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যও তুলে ধরেন। এ সময় তিনি প্রকাশ করেন তার A Grammer of Persian Langauge (১৭৭১)। ১৭৭৩ সালে জোনস রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন।

১৭৭৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জোনস মিডল টেম্পলে আইন অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৭৭৬ সালে লর্ড চ্যান্সেলর বাথহার্স্ট জোনসকে ষাটজন দেউলিয়াত্ব বিষয়ক কমিশনারদের মধ্যে একজন হিসেবে নিয়োগ করেন। কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর জোনস চার শতকে গ্রিক বাগ্মী ইসায়াসের বক্তৃতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। বইটির পুরো শিরোনাম The Speeches of Isoeus in Causes Concerning the Law of Succession to Property at Athenes। এ বইতে তিনি তুলনামূলক আইন শাস্ত্র চর্চার পক্ষে জোরালো যুক্তি প্রদর্শন করেন।

১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট-এর অধীনে কলকাতা নগরীর ব্রিটিশ ও অন্যান্য কলকাতাবাসীদের বিচার কার্যের জন্য একটি সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। পুরো নাম  ‘Supreme Court of Judicature’। ১৭৭৭ সালে বিচারক Lemaistre-এর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর জোনস এই পদের জন্য আগ্রহী হন। কিন্তু পদটি তিনি পান নি। তবে পরবর্তী সুযোগের জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন। ১৭৮২ সালে তিনি আল্ মুলাক্কীন-এর বিখ্যাত উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইনগ্রন্থ বুগিয়াত আল-বাহিত (Bughyat al-Bahith) ইংরেজিতে অনুবাদ করেন-শিরোনাম The Mohamedan Law of Succession to the Property of Intestates। গ্রন্থটি কোম্পানি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

জোনস-এর আইন বিষয়ক জ্ঞান, ভারতীয় আইন বিষয়ক অনুবাদ কর্ম, প্রাচ্যবিদ হিসেবে তাঁর বিশ্বখ্যাতি এবং বন্ধুদের সুপারিশক্রমে ১৭৮৩ সালে জোনস স্যার (Sir) উপাধিতে ভূষিত হন। একই সময়ে তিনি কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদেও নিযুক্ত হন। কলকাতা যাত্রার প্রাক্কালে তিনি এ্যানা মারিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

কলকাতার পথে জাহাজে নববধু এ্যানা মারিয়ার সঙ্গে দাবা খেলে এবং গল্প করে ও পারস্য বিষয়ক অধ্যয়ন, আইন চর্চা এবং ভারত সম্পর্কিত বিষয়াদি পর্যালোচনা করে জোনস সময় কাটান। তাছাড়া, কলকাতা অবস্থানকালে তিনি প্রাচ্য বিষয়ক চর্চার ব্যাপারে বিচার বিষয় ছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে গবেষণা চালাবেন সে ব্যাপারেও একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনার শিরোনাম Objects of Enquiry during My Residence in Asia। শুধু তাই নয়, তিনি রয়েল সোসাইটির আদলে কলকাতায় একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের চিন্তাভাবনাও চূড়ান্ত করেন।

আগস্ট মাসে তার জাহাজ আরব সাগরে পৌঁছলে তিনি প্রাচ্য বিষয়ক ব্যাপক-ভিত্তিক গবেষণা ও চর্চার জন্য লন্ডনে অবস্থিত রয়েল সোসাইটির আদলে কলকাতায় একটি সোসাইটি প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন। তিনি যে বিপুল-বিস্তারী গবেষণার পরিকল্পনার কথা ভাবছিলেন সেগুলি যে এককভাবে কারও পক্ষেই কার্যকর করা সম্ভব নয় তা জোনস সুস্পষ্ট ভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন এবং এজন্যই তিনি ব্যাপক-ভিত্তিক একটি সহযোগিতামূলক ‘সোসাইটি’র কথা ভেবেছিলেন। জোনস অবহিত ছিলেন যে, ভারতে আগত ইংরেজরা তাদের জীবনাচরণ এবং ঔপনিবেশিক শক্তিসুলভ শ্রেয়তর এবং অগ্রসরমান মানুষ-এই বোধ তাড়িত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ভারতীয়দের নিকট অবিশ্বাসের পাত্র ছিল। ফলে তারা পরস্পরের কাছাকাছি এসে আস্থা ও সমঝোতার মাধ্যমে ফলপ্রসূ সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারছিল না। জোনস আশা করেছিলেন সুচিন্তিত পদক্ষেপের মাধ্যমে অবিশ্বাসের পরিবেশকে দূর করে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সভ্যতাকে উভয়ের নিকট গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখবেন এবং তার পরিকল্পিত সোসাইটি একটি সহায়ক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করবে।

একজন বিচারপতি হিসেবে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টে যোগদান করার পর জোনস প্রাচ্য বিষয়ে আগ্রহী সিভিলিয়নদের নিয়ে একটি সভা ডাকেন (১৫ জানুয়ারি ১৭৮৪)। সভায় উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি হাইড, জেনারেল জন ক্লার্ক, ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন, টমাস ল, জোনাথান ডানকান, চার্লস উইলকিনস্ এবং জর্জ বার্লো প্রমুখ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ। স্থাপন করা হলো এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা। সংগঠনের সভাপতির পদের জন্য জোনস গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে অনুরোধ জানান। কিন্তু হেস্টিংস এ পদ গ্রহণে অপারগতা জানালে উইলিয়ম জোনস নিজে সোসাইটি-এর প্রথম সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। সোসাইটির পরবর্তী সভায় জোনস একটি বার্ষিক ভাষণদানের রীতি প্রবর্তন করেন এবং এ ধারায় তিনি প্রথম যে ভাষণটি দেন সেটির শিরোনাম হলো ‘A Discourse on the Institution of a Society for Inquiry into the History, Civil and Natural, the Antiquities, Arts, Sciences, and Literature, of Asia’।

জোনস ফার্সি ভাষার মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম বিষয়ক চর্চা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় [[উইলকিন্স, চার্লস]|চার্লস উইলকিন্স]] তাকে সংস্কৃত শেখার জন্য উৎসাহিত করেন। জোনস সস্ত্রীক পলাশী প্রান্তর পরিদর্শনে যান এবং সেখানে তিনটি কবিতা লিখে স্ত্রীকে নিবেদন করেন। কবিতাগুলি: (১) 'Plassey-Plain, a Ballad, Addressed to Lady Jones, by Her Husband'; (২) 'Lines from the Arabic' এবং (৩) 'Au Firmament' । তিনি ‘The Character of John Lord Ashburton’ শিরোনামে Ashburton সম্পর্কে একটি স্মারক নিবন্ধ লিখে সাময়িকীতে প্রকাশের জন্য বন্ধুবান্ধবের নিকট লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। ১৭৮৪ সালে জর্জ টাইলার বনাম কন্সটেবল ফ্রেডারিক ডিডকার-এর একটি মামলা বিচারের জন্য কোর্টে আসে। ডিডকারের অন্যায় আচরণ এবং প্রধান বিচারক চেম্বারস ও অন্য বিচারক হাইডের পক্ষপাতমূলক রায় জোনসকে ব্যাথিত করলেও তিনজন বিচারকের মধ্যে তিনি একা সংখ্যালঘু হওয়ায় ন্যায়দন্ড তুলে ধরতে না পারার ব্যাথা সইতে বাধ্য হন। ভারতীয় গাছপালার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি সুইডেনের উদ্ভিদবিজ্ঞানী Carolus Linnaeus (Carl Von Linne)-এর Systema Naturae-এ অন্তর্ভুক্ত নয় এরকম অসংখ্য ভারতীয় গাছপালার একটি তালিকা তৈরি করে এর অন্তর্ভুক্ত করে তিনি ইউরোপে ভারতীয় উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন। সংস্কৃত শেখার লক্ষ্যে তিনি বেনারস গমন করেন এবং কয়েকজন পন্ডিতের সান্নিধ্য গ্রহণ করেন। সরকারের বিচার ব্যবস্থার সুবিধার্থে তিনি মনু ও ধর্মশাস্ত্রের ইংরেজি অনুবাদ করেন।

স্যার উইলিয়াম জোনস ১৭৮৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটিতে ‘The Second Anniversary Discourse’-এ তিনি ইউরোপীয়দের জানান যে, ভারতীয় সভ্যতা অনেক পুরনো এবং বিশ্বের যে কোনো বড় সভ্যতার সমকক্ষ। তিনি সদস্যদের আহবান জানান যে, তাঁরা যেন ভারতীয় উদ্ভিদ বিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র, শিল্প, এবং স্থাপত্যবিদ্যা গবেষণার উপর জোর দেন। তিনি আরও আহবান জানান যে, তাঁরা যেন প্রাচ্যের যাবতীয় গ্রন্থের একটি পূর্ণ তালিকা প্রণয়ন করেন। ভারতীয় দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে তিনি জোরালো বক্তব্য রাখেন, যদিও তিনি নিজে কয়েকজন দাস ক্রয় করেছিলেন। হিন্দু সভ্যতার বিভিন্ন দেবদেবী ও ঋষিকে বিষয় করে তিনি কয়েকটি কবিতা Asiatic Miscellany প্রকাশ করেন।

প্রাচ্য বিদ্যায় জোনস-এর খ্যাতি বিশ্বপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে যখন তিনি ১৭৮৬ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর তৃতীয় বার্ষিক বক্তৃতা প্রদান করেন (The Third Anniversary Discourse)। ঐ বক্তৃতায় তিনি প্রমাণাদিসহ দাবি করেন যে, ইউরোপীয় ভাষা এবং সংস্কৃতের তুলনামূলক আলোচনায় তিনি লক্ষ করেছেন যে, গ্রিক, ল্যাটিন, গথিক ও কেলটিক এবং সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষার উৎস একই। মিলের উপর ভিত্তি করে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করে তার ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন। আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর পন্ডিতগণ একমত হন যে, স্যার উইলিয়াম জোনস-এর ধারণা সঠিক। জোনস বিশ্ব ভাষাবিজ্ঞানের জনকের মর্যাদা লাভ করেন।

১৭৮৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জোনস সোসাইটিতে The Fourth Anniversary Discourse  প্রদান করেন। এ ডিসকোর্সে তার বিষয়বস্ত্ত ছিল হযরত মুহম্মদ-পূর্ব আরব সভ্যতা। এটিতে তিনি আরবি ও হিব্রু ভাষার নৈকট্যের ওপর আলোকপাত করেন। ভাষা গবেষণার পাশাপাশি জোনস ভারতীয় রসায়ন শাস্ত্র এবং উদ্ভিদ বিদ্যার চর্চা করেন। ইতোমধ্যে তিনি এক হাজার ভারতীয় গাছের সংস্কৃত নাম সংগ্রহ করেন। সংস্কৃত শেখার ফলে তিনি এ ভাষার সাহিত্যে হোমার, পিন্ডার এবং প্লেটোর সমকক্ষ সাহিত্যসেবী ও দার্শনিকের সন্ধান লাভ করেন। তিনি শকুন্তলা নাটকের লেখক কবি/নাট্যকার কালীদাসের মধ্যে শেক্সপীয়রের সমকক্ষ একজন কবি/নাট্যকারকে আবিষ্কার করেন। উইলকিনস অনূদিত ভগবতগীতা তাকে প্রভাবিত করে।

১৭৮৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জোনস তাঁর ‘The Fifth Anniversary Discourse’ প্রদান করেন। এটিতে তার মুখ্য আলোচনার বিষয় ছিল তাতার সভ্যতা। প্রাচ্যের লোকদের তিনি মোট তিনটি ভাগে ভাগ করেন: হিন্দু, আরব এবং তাতার। তাদের মধ্যকার বিভিন্ন এবং বিচিত্র শ্রেণি বিভক্তির কথাও তিনি উল্লেখ করেন। এ বছরে তিনি ঋণগ্রস্তদের সহায়তা দানের জন্য তাঁর কাছে থাকা লাইলী মজনু, এ পার্সীয়ান পোয়েম অব হাতিফি -এ শিরোনামের গ্রন্থটির দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপিটি ইংরেজিতে একটি ভূমিকাসহ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। সংস্কৃতে নিজের জ্ঞানকে মোটামুটি যথেষ্ট মনে করে তিনি এ বছরই The Ordinances of Manu (১৭৯৪) অনুবাদ করা শুরু করেন।

১৭৮৬ সালে জোনস তাঁর প্রবন্ধ ‘A Dissertation on the Orthography of Asiatick Words in Roman Letters’-এ সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষাকে রোমান হরফে প্রতিলিপি করণের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর পদ্ধতিটি জোনেসিয়ান সিস্টেম (Jonesian system) নামে পরিচিতি লাভ করে। এ পদ্ধতি ভাষার ধ্বনিবিজ্ঞান বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

১৭৮৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জোনস এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর ‘The Sixth Discourse On the Persians’ প্রদান করেন। এ ডিসকোর্সে তিনি পার্সিয়ান জাতি এবং ভাষা সম্পর্কে চারটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন যে, (১) এসিরিয়দের আগমনের পূর্বে পারস্যে একটি শক্তিশালী হিন্দু রাজবংশ রাজত্ব করত; (২) প্রথম পারস্য সাম্রাজ্যের ভাষা থেকে সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন এবং জার্মানিক উপভাষা উদ্ভুত হয়; (৩) সে সময় অন্যান্য প্রাচ্য জাতি বিকশিত হওয়ার পূর্বে পারস্য ছিল জনবসতি, জ্ঞান ও বিভিন্ন কলার কেন্দ্রভূমি; এবং (৪) আরব, তাতার এবং ভারতের প্রতিষ্ঠাতা জাতিরা আদিতে পারস্য থেকে স্থানান্তরিত হন। মূল শাহনামা পড়তে গিয়ে তিনি ফার্সি এবং সংস্কৃতের মধ্যে যে সব মিল লক্ষ করেন তা-ই ছিল তাঁর সিদ্ধান্তের উৎস বা ভিত্তি। ১৭৮৯ সালের শুরুতে তিনি একটি কাব্য নাটক গীত গোবিন্দ বা The Songs of Joyadeva অনুবাদ করেন।

ভারতে আসার পর জীবনের শেষের দিকের বছরগুলিতে জোনস এবং এ্যানা মারিয়ার স্বাস্থ্য ভালো কাটেনি। দুজনেই প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন আর সে সময় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কলকাতা শহরটি ছিল স্বাস্থ্যের জন্য বিপদজনক। ইতোমধ্যে তাঁরা ছয় বছরের কিছু বেশি সময় এখানে কাটিয়ে দিয়েছেন। দুজনের মধ্যে জোনসের স্বাস্থ্যই কিছুটা ভালো কেটেছে। ১৭৯০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি সোসাইটিতে তাঁর The Seventh Anniversary Discourse এবং ১৭৯১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘The Eigth Anniversary Discourse’ প্রদান করেন।

এগুলির মধ্যে তিনি প্রাচ্য ভাষা এবং সেগুলির উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করেন। এর ঠিক একবছর পর প্রদত্ত হয় নবম ডিসকোর্সটি। এতে তিনি সমগ্র এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বের মানুষের উৎপত্তির ব্যাপারে আলোকপাত করেন। এটির দ্বারা তিনি তুলনামূলক নৃবিজ্ঞান শাস্ত্রের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৭৯১ থেকে জোনস-এর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েও তিনি প্রাচ্য বিষয়ক গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। ১৭৯২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর Muhammedan Law of Inheritance এবং ১৭৯৪ সালে প্রকাশিত হয় Institutes of Hindu Laws। সে বছরই ২৭ এপ্রিল কলকাতায় স্যার উইলিয়াম জোনস এর মৃত্যু হয়।  [আবু তাহের মজুমদার]

গ্রন্থপঞ্জি Abu Taher Majumdar, Sir William Jones; Garland Cannon (ed.), Jones’s Letters (1970); Garland Cannon, Biography of Jones (1964).