গ্রামীণ ঘরবাড়ি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
২ নং লাইন: | ২ নং লাইন: | ||
'''গ্রামীণ ঘরবাড়ি''' (Rural Housing) কোনো একটি অঞ্চলের ঘরবাড়ি নির্মাণ কাঠামো ও বিন্যাস প্রকৃতি সে অঞ্চলের ভৌগোলিক নিয়ামক এবং অধিবাসীদের রুচি, পছন্দ, সহজলভ্যতা ও আর্থিক সামর্থ্য দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে। ভৌগোলিক নিয়ামক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটে থাকে বলে ঘরবাড়ির উপকরণ, নির্মাণশৈলী ও বিন্যাসেও পরিবর্তন সাধিত হয়ে থাকে। বসতির স্থান নির্বাচনে প্রধান নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে [[ভূ-প্রকৃতি|ভূ]][[ভূ-প্রকৃতি|-প্রকৃতি]]। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির প্রায় বেশিরভাগই বদ্বীপীয় সমতল প্লাবনভূমি যেখানে মৌসুমি প্লাবন ও বন্যা অনেকটা নিয়মিত ঘটনা হওয়ায় বাড়িঘর নির্মাণের সময় তুলনামূলকভাবে উঁচুজমি নির্বাচন করা হয়ে থাকে, অথবা হাওর এলাকার মতো নিচু জমিতে কৃত্রিম উপায়ে মাটি ভরাট করে উঁচু করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়। [[প্লাবনভূমি|প্লাবনভূমি]] এলাকায় নদীর প্রাকৃতিক বাঁধ বা কান্দাসমূহ সমভূমির তুলনায় উঁচু ভূমির সংস্থান করায় গ্রামীণ জনগণ ঘরবাড়ি নির্মাণে কান্দার জমিকেই প্রধান পছন্দ হিসেবে গ্রহণ করে। | '''গ্রামীণ ঘরবাড়ি''' (Rural Housing) কোনো একটি অঞ্চলের ঘরবাড়ি নির্মাণ কাঠামো ও বিন্যাস প্রকৃতি সে অঞ্চলের ভৌগোলিক নিয়ামক এবং অধিবাসীদের রুচি, পছন্দ, সহজলভ্যতা ও আর্থিক সামর্থ্য দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে। ভৌগোলিক নিয়ামক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটে থাকে বলে ঘরবাড়ির উপকরণ, নির্মাণশৈলী ও বিন্যাসেও পরিবর্তন সাধিত হয়ে থাকে। বসতির স্থান নির্বাচনে প্রধান নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে [[ভূ-প্রকৃতি|ভূ]][[ভূ-প্রকৃতি|-প্রকৃতি]]। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির প্রায় বেশিরভাগই বদ্বীপীয় সমতল প্লাবনভূমি যেখানে মৌসুমি প্লাবন ও বন্যা অনেকটা নিয়মিত ঘটনা হওয়ায় বাড়িঘর নির্মাণের সময় তুলনামূলকভাবে উঁচুজমি নির্বাচন করা হয়ে থাকে, অথবা হাওর এলাকার মতো নিচু জমিতে কৃত্রিম উপায়ে মাটি ভরাট করে উঁচু করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়। [[প্লাবনভূমি|প্লাবনভূমি]] এলাকায় নদীর প্রাকৃতিক বাঁধ বা কান্দাসমূহ সমভূমির তুলনায় উঁচু ভূমির সংস্থান করায় গ্রামীণ জনগণ ঘরবাড়ি নির্মাণে কান্দার জমিকেই প্রধান পছন্দ হিসেবে গ্রহণ করে। | ||
[[Image:RuralHouse01.jpg|thumb|right| | [[Image:RuralHouse01.jpg|thumb|right|400px]] | ||
আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন নিয়ামক, যেমন- পেশা, আয়, সামাজিক অবস্থান, পরিবারের আকার এবং সে সঙ্গে জনগোষ্ঠীর সাংষ্কৃতিক চর্চা বাড়িঘরের আকার, নকশা এবং রূপকে নির্ধারণ করে থাকে। বিশেষ করে, ঘরের দিক নির্ণয় কিংবা বিভিন্ন গৃহ এককগুলি কোনোটি কোনোদিকে থাকবে এ বিষয়গুলি আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন নিয়ামক দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, থাকার ঘর সাধারণত পূর্বমুখী ও দক্ষিণমুখী করে নির্মাণ করা হয় এবং রান্নাঘর নির্মাণ করা হয় পশ্চিমমুখী করে। ঘরে কোঠার সংখ্যা কয়টি হবে তা আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছাড়াও পরিবারের আকারের ওপর নির্ভর করে নির্ণীত হয়ে থাকে। চারকোণাকৃতি কোঠা বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা গেলেও কদাচিত এর ব্যত্যয়ও দেখা যায়। আয়তাকার কিংবা বর্গাকৃতি উঠানকে ঘিরে গ্রামের ঘরগুলি বিন্যস্ত থাকে। দেশের উত্তর এবং মধ্য-পশ্চিমাংশে বাড়ির ভেতরে ও বাইরে দু স্থানেই উঠান রাখার প্রচলন রয়েছে। গ্রামবাংলায় বাড়িঘরের সঙ্গে পুকুর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদী তীরবর্তী বাড়ীঘর ছাড়া পুকুরই গ্রামাঞ্চলে পানির সহজলভ্য উৎস। বসতবাড়ির চারপাশে আম, জাম, কাঁঠাল কুল, প্রভৃতি বহুবর্ষজীবী গাছ লাগানো গ্রামীণ এলাকার একটি সাধারণ রীতি। এসকল গাছ একদিকে যেমন মৌসুমি ফলের যোগান দেয়, আবার অন্যদিকে ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে বাড়িঘর রক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাড়ির গোপনীয়তা রক্ষার জন্য প্রায় প্রতিটি বাড়ির উন্মুক্ত অংশ কিংবা সম্মুখভাগ বাঁশ, খড়, পাটকাঠি, নলখাগড়া অথবা তালপাতা দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থরা টিন দিয়েও বেড়া দিয়ে থাকেন। | আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন নিয়ামক, যেমন- পেশা, আয়, সামাজিক অবস্থান, পরিবারের আকার এবং সে সঙ্গে জনগোষ্ঠীর সাংষ্কৃতিক চর্চা বাড়িঘরের আকার, নকশা এবং রূপকে নির্ধারণ করে থাকে। বিশেষ করে, ঘরের দিক নির্ণয় কিংবা বিভিন্ন গৃহ এককগুলি কোনোটি কোনোদিকে থাকবে এ বিষয়গুলি আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন নিয়ামক দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, থাকার ঘর সাধারণত পূর্বমুখী ও দক্ষিণমুখী করে নির্মাণ করা হয় এবং রান্নাঘর নির্মাণ করা হয় পশ্চিমমুখী করে। ঘরে কোঠার সংখ্যা কয়টি হবে তা আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছাড়াও পরিবারের আকারের ওপর নির্ভর করে নির্ণীত হয়ে থাকে। চারকোণাকৃতি কোঠা বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা গেলেও কদাচিত এর ব্যত্যয়ও দেখা যায়। আয়তাকার কিংবা বর্গাকৃতি উঠানকে ঘিরে গ্রামের ঘরগুলি বিন্যস্ত থাকে। দেশের উত্তর এবং মধ্য-পশ্চিমাংশে বাড়ির ভেতরে ও বাইরে দু স্থানেই উঠান রাখার প্রচলন রয়েছে। গ্রামবাংলায় বাড়িঘরের সঙ্গে পুকুর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদী তীরবর্তী বাড়ীঘর ছাড়া পুকুরই গ্রামাঞ্চলে পানির সহজলভ্য উৎস। বসতবাড়ির চারপাশে আম, জাম, কাঁঠাল কুল, প্রভৃতি বহুবর্ষজীবী গাছ লাগানো গ্রামীণ এলাকার একটি সাধারণ রীতি। এসকল গাছ একদিকে যেমন মৌসুমি ফলের যোগান দেয়, আবার অন্যদিকে ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে বাড়িঘর রক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাড়ির গোপনীয়তা রক্ষার জন্য প্রায় প্রতিটি বাড়ির উন্মুক্ত অংশ কিংবা সম্মুখভাগ বাঁশ, খড়, পাটকাঠি, নলখাগড়া অথবা তালপাতা দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থরা টিন দিয়েও বেড়া দিয়ে থাকেন। | ||
স্থানীয়ভাবে যে সকল নির্মাণ সামগ্রী সহজলভ্য সচরাচর সেগুলি দিয়েই গ্রামীণ ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ গৃহনির্মাণ সামগ্রীর মধ্যে প্রধান স্থান দখল করে আছে বাঁশ। বাঁশ ছাড়াও আবহমান কাল থেকে খড়, শন, পাটকাঠি, গোলপাতা, মাটি, প্রভৃতি সামগ্রীও ঘরবাড়ি তৈরীতে ব্যবহূত হয়ে আসছে। সামর্থ্যবান গৃহস্থরা আজকাল ঘর তৈরীতে ঢেউটিনই বেশি ব্যবহার করছেন। তবে যে সামগ্রীই ব্যবহার করা হোক না কেন ঘরের খুঁটি, রুয়া, পাইড় ইত্যাদি তথা ঘরের কাঠামো তৈরীতে বাঁশই অধিকহারে ব্যবহূত হয়ে থাকে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাঠও ব্যবহূত হয়। কোনো একটি উপাদান এককভাবে ব্যবহূত না হয়ে উপাদানগুলির সন্নিবেশ দ্বারা নির্মিত ঘরই দেশের গ্রামীণ এলাকার সর্বত্র দেখা যায়। যেমন: বাঁশের বেড়া ও টিনের চাল, শনের ছাউনি ও টিনের অথবা বাঁশের বেড়া, মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনি ইত্যাদি ধরনের গৃহ গ্রামবাংলার সাধারণ চিত্র। পর্বত পাদদেশীয় পললভূমি এলাকা, বিশেষ করে, রংপুর এলাকা; যশোরের মৃতপ্রায় বদ্বীপ এলাকা; হাওর অববাহিকা; গঙ্গা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও মেঘনা প্লাবনভূমি এলাকা এবং উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় বাঁশের বেড়া এবং শন অথবা খড়ের চৌচালা ছাউনি দেওয়া ঘর দেখা যায়। | স্থানীয়ভাবে যে সকল নির্মাণ সামগ্রী সহজলভ্য সচরাচর সেগুলি দিয়েই গ্রামীণ ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ গৃহনির্মাণ সামগ্রীর মধ্যে প্রধান স্থান দখল করে আছে বাঁশ। বাঁশ ছাড়াও আবহমান কাল থেকে খড়, শন, পাটকাঠি, গোলপাতা, মাটি, প্রভৃতি সামগ্রীও ঘরবাড়ি তৈরীতে ব্যবহূত হয়ে আসছে। সামর্থ্যবান গৃহস্থরা আজকাল ঘর তৈরীতে ঢেউটিনই বেশি ব্যবহার করছেন। তবে যে সামগ্রীই ব্যবহার করা হোক না কেন ঘরের খুঁটি, রুয়া, পাইড় ইত্যাদি তথা ঘরের কাঠামো তৈরীতে বাঁশই অধিকহারে ব্যবহূত হয়ে থাকে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাঠও ব্যবহূত হয়। কোনো একটি উপাদান এককভাবে ব্যবহূত না হয়ে উপাদানগুলির সন্নিবেশ দ্বারা নির্মিত ঘরই দেশের গ্রামীণ এলাকার সর্বত্র দেখা যায়। যেমন: বাঁশের বেড়া ও টিনের চাল, শনের ছাউনি ও টিনের অথবা বাঁশের বেড়া, মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনি ইত্যাদি ধরনের গৃহ গ্রামবাংলার সাধারণ চিত্র। পর্বত পাদদেশীয় পললভূমি এলাকা, বিশেষ করে, রংপুর এলাকা; যশোরের মৃতপ্রায় বদ্বীপ এলাকা; হাওর অববাহিকা; গঙ্গা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও মেঘনা প্লাবনভূমি এলাকা এবং উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় বাঁশের বেড়া এবং শন অথবা খড়ের চৌচালা ছাউনি দেওয়া ঘর দেখা যায়। | ||
[[Image: | [[Image:RuralHouse02.jpg|thumb|left|400px]] | ||
টিনের চালের সঙ্গে দেশের উত্তর-মধ্যভাগ এবং পূর্বাঞ্চলে সাধারণত শনের বেড়া; অধিকাংশ উত্তর ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলে এবং দক্ষিণাঞ্চলের উত্তরাংশে উলুখড়, খড়ি ও বেনাঘাসের বেড়া; দক্ষিণাঞ্চলের দক্ষিণাংশে গোলপাতার বেড়া; মধুপুর ও [[বরেন্দ্রভূমি|বরেন্দ্রভূমি]]র অনেক জায়গায় তালপাতার বেড়া দিয়ে ঘর তৈরি করতে দেখা যায়। দেশের সব জায়গায়ই সামর্থ্যহীনরা টিনের চালের সঙ্গে ঘরের বেড়া হিসেবে খড়ই ব্যবহার করে থাকেন। ঘরের আকৃতি দেশের সর্বত্রই প্রধানত আয়তাকার। রুচিবান গৃহস্থরা ঘরের সম্মুখভাগে ছোট বারান্দা রেখে থাকেন যাকে গ্রামাঞ্চলে দাওয়া বলা হয়। ঘরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলতে কখনও কখনও বারান্দায় ১/২ হাত উচ্চতাবিশিষ্ট বাঁশের অথবা কাঠের বেড়া দেওয়া হয়। বাঁশের ফালির বিনুনি বেড়ার উপর পুরু কাদার প্রলেপ দিয়ে তৈরী বেড়া দিয়ে ঘরের আবেষ্টন নির্মাণ করতে দেখা যায় দেশের উত্তরাঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে। একই ধরনের গৃহ নির্মাণশৈলী চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় এলাকায়, বিশেষ করে, সীতাকুন্ডের দক্ষিণে এবং দ্বীপাঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। [[ঢাকা জেলা|ঢাকা]], [[নারায়ণগঞ্জ জেলা|নারায়ণগঞ্জ]], [[চাঁদপুর জেলা|চাঁদপুর]] এবং [[পাবনা জেলা|পাবনা]] জেলার গ্রামীণ এলাকায় বাঁশের বেড়া এবং টিনের চাল দেওয়া ঘরই সচরাচর বেশি দেখা যায়। | টিনের চালের সঙ্গে দেশের উত্তর-মধ্যভাগ এবং পূর্বাঞ্চলে সাধারণত শনের বেড়া; অধিকাংশ উত্তর ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলে এবং দক্ষিণাঞ্চলের উত্তরাংশে উলুখড়, খড়ি ও বেনাঘাসের বেড়া; দক্ষিণাঞ্চলের দক্ষিণাংশে গোলপাতার বেড়া; মধুপুর ও [[বরেন্দ্রভূমি|বরেন্দ্রভূমি]]র অনেক জায়গায় তালপাতার বেড়া দিয়ে ঘর তৈরি করতে দেখা যায়। দেশের সব জায়গায়ই সামর্থ্যহীনরা টিনের চালের সঙ্গে ঘরের বেড়া হিসেবে খড়ই ব্যবহার করে থাকেন। ঘরের আকৃতি দেশের সর্বত্রই প্রধানত আয়তাকার। রুচিবান গৃহস্থরা ঘরের সম্মুখভাগে ছোট বারান্দা রেখে থাকেন যাকে গ্রামাঞ্চলে দাওয়া বলা হয়। ঘরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলতে কখনও কখনও বারান্দায় ১/২ হাত উচ্চতাবিশিষ্ট বাঁশের অথবা কাঠের বেড়া দেওয়া হয়। বাঁশের ফালির বিনুনি বেড়ার উপর পুরু কাদার প্রলেপ দিয়ে তৈরী বেড়া দিয়ে ঘরের আবেষ্টন নির্মাণ করতে দেখা যায় দেশের উত্তরাঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে। একই ধরনের গৃহ নির্মাণশৈলী চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় এলাকায়, বিশেষ করে, সীতাকুন্ডের দক্ষিণে এবং দ্বীপাঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। [[ঢাকা জেলা|ঢাকা]], [[নারায়ণগঞ্জ জেলা|নারায়ণগঞ্জ]], [[চাঁদপুর জেলা|চাঁদপুর]] এবং [[পাবনা জেলা|পাবনা]] জেলার গ্রামীণ এলাকায় বাঁশের বেড়া এবং টিনের চাল দেওয়া ঘরই সচরাচর বেশি দেখা যায়। | ||
দেশের পশ্চিম প্রান্ত বরাবর দিনাজপুর থেকে শুরু করে বগুড়া হয়ে যশোর এবং খুলনার কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের ভূমিরূপে বিশেষ ধরনের মাটির ঘর দেখতে পাওয়া যায়। বগুড়া, পাবনা, কুষ্টিয়া এবং যশোর এলাকায় মাটির দেয়ালঘেরা আয়তাকার ঘরগুলির চাল সাধারণত শনের অথবা টালি দিয়ে ছাওয়া হয়। নবাবগঞ্জ জেলায় (চাঁপাই নবাবগঞ্জ) মাটির ঘরের ছাদ বিশেষভাবে চুনসুরকি দিয়ে নির্মাণ করা হয় যা শুধু এ এলাকারই অনন্য বৈশিষ্ট্য। বগুড়া থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় মাটির ঘরের চাল টিন অথবা কেরোসিন তেলের শুন্য টিন কেটে সমান করে ব্যবহার করতেও দেখা যায়। মাটির ঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে সাধারণত কাদামাটির ব্লক তৈরি করে সেগুলিকে রোদে শুকিয়ে দেওয়াল তোলা হয়। ব্লকগুলির মধ্যকার ফাঁকা স্থানগুলি কাদা দিয়ে ভরে দেওয়া হয়। বন্যামুক্ত ভূমি, তুলনামূলকভাবে কম বৃষ্টিপাত ও শুষ্ক জলবায়ু এবং শুকনা অবস্থায় খুবই কঠিন রূপ ধারণ করে এমন ল্যাটেরাইট জাতীয় মৃত্তিকার সহজলভ্যতা এসকল এলাকায় মাটির ঘর নির্মাণের জন্য অন্যতম প্রধান কারণ। চট্টগ্রাম অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে দু অথবা তিনস্তরবিশিষ্ট চাল দেওয়া মাটির ঘর দেখা যায়। ঘরের চালগুলি প্রায়ই টিনের হয়ে থাকে। মধুপুর এলাকার বেশিরভাগ ঘরবাড়িই দীর্ঘাকৃতির শনঘাসে ছাওয়া চালবিশিষ্ট এবং দেয়াল মাটির দ্বারা তৈরী। ঢাকার উত্তর ও পশ্চিমাংশ এবং টাঙ্গাইল জেলার দক্ষিণাংশেও মাটির ঘর দেখা যায়, তবে এসকল এলাকায় ঘরের চাল সাধারণত টিনের হয়ে থাকে। | দেশের পশ্চিম প্রান্ত বরাবর দিনাজপুর থেকে শুরু করে বগুড়া হয়ে যশোর এবং খুলনার কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের ভূমিরূপে বিশেষ ধরনের মাটির ঘর দেখতে পাওয়া যায়। বগুড়া, পাবনা, কুষ্টিয়া এবং যশোর এলাকায় মাটির দেয়ালঘেরা আয়তাকার ঘরগুলির চাল সাধারণত শনের অথবা টালি দিয়ে ছাওয়া হয়। নবাবগঞ্জ জেলায় (চাঁপাই নবাবগঞ্জ) মাটির ঘরের ছাদ বিশেষভাবে চুনসুরকি দিয়ে নির্মাণ করা হয় যা শুধু এ এলাকারই অনন্য বৈশিষ্ট্য। বগুড়া থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় মাটির ঘরের চাল টিন অথবা কেরোসিন তেলের শুন্য টিন কেটে সমান করে ব্যবহার করতেও দেখা যায়। মাটির ঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে সাধারণত কাদামাটির ব্লক তৈরি করে সেগুলিকে রোদে শুকিয়ে দেওয়াল তোলা হয়। ব্লকগুলির মধ্যকার ফাঁকা স্থানগুলি কাদা দিয়ে ভরে দেওয়া হয়। বন্যামুক্ত ভূমি, তুলনামূলকভাবে কম বৃষ্টিপাত ও শুষ্ক জলবায়ু এবং শুকনা অবস্থায় খুবই কঠিন রূপ ধারণ করে এমন ল্যাটেরাইট জাতীয় মৃত্তিকার সহজলভ্যতা এসকল এলাকায় মাটির ঘর নির্মাণের জন্য অন্যতম প্রধান কারণ। চট্টগ্রাম অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে দু অথবা তিনস্তরবিশিষ্ট চাল দেওয়া মাটির ঘর দেখা যায়। ঘরের চালগুলি প্রায়ই টিনের হয়ে থাকে। মধুপুর এলাকার বেশিরভাগ ঘরবাড়িই দীর্ঘাকৃতির শনঘাসে ছাওয়া চালবিশিষ্ট এবং দেয়াল মাটির দ্বারা তৈরী। ঢাকার উত্তর ও পশ্চিমাংশ এবং টাঙ্গাইল জেলার দক্ষিণাংশেও মাটির ঘর দেখা যায়, তবে এসকল এলাকায় ঘরের চাল সাধারণত টিনের হয়ে থাকে। | ||
[[Image:RuralHouse03.jpg|thumb|right|400px]] | |||
বনভূমি কাছাকাছি বলে মধুপুর গড় এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেখা যায় কাঠের তৈরী ঘরবাড়ি। চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণাংশ ব্যতীত অন্যত্র কাঠের ঘরগুলি সচরাচর দ্বিতলবিশিষ্ট। ঘরের সম্মুখভাগ প্রায় ক্ষেত্রেই কাঠের উপর খোদাই করা নকশাদার ও বর্ণিল রঙে সজ্জিত করা থাকে। চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণভাগে রাখাইন ও মগ সম্প্রদায়ের লোকেরাও কাঠের ঘর তৈরি করে, তবে তাদের ঘরগুলি কাঠের পাটাতনের উপর নির্মাণ করা হয় এবং এগুলি সচরাচর একতলাবিশিষ্ট। অবস্থাসম্পন্ন মগেরা বারান্দাসহ কাঠের দোতলা ঘর নির্মাণ করে বসবাস করে এবং ঘরের চৌকাঠগুলি নানা ধরনের খোদাই করা নকশায় সজ্জিত করে থাকে। | বনভূমি কাছাকাছি বলে মধুপুর গড় এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেখা যায় কাঠের তৈরী ঘরবাড়ি। চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণাংশ ব্যতীত অন্যত্র কাঠের ঘরগুলি সচরাচর দ্বিতলবিশিষ্ট। ঘরের সম্মুখভাগ প্রায় ক্ষেত্রেই কাঠের উপর খোদাই করা নকশাদার ও বর্ণিল রঙে সজ্জিত করা থাকে। চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণভাগে রাখাইন ও মগ সম্প্রদায়ের লোকেরাও কাঠের ঘর তৈরি করে, তবে তাদের ঘরগুলি কাঠের পাটাতনের উপর নির্মাণ করা হয় এবং এগুলি সচরাচর একতলাবিশিষ্ট। অবস্থাসম্পন্ন মগেরা বারান্দাসহ কাঠের দোতলা ঘর নির্মাণ করে বসবাস করে এবং ঘরের চৌকাঠগুলি নানা ধরনের খোদাই করা নকশায় সজ্জিত করে থাকে। | ||
২৪ নং লাইন: | ১৯ নং লাইন: | ||
দেশের প্রধান নদনদী বরাবর বন্যা এবং নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত এলাকাগুলিতে লোকজন ঘরবাড়ি তৈরীতে খুব বেশি অর্থ খরচে উৎসাহী হয় না। এ সকল এলাকার ঘরবাড়িগুলি প্রায়ই কাদালেপা পাটকাঠির বেড়া এবং খড়ের ছাউনির হয়ে থাকে। হাওর অববাহিকা, চলন বিল এলাকা এবং চর এলাকাসমূহে সস্তা নির্মাণ সামগ্রী যেমন, নলখাগড়া, লম্বা শন, পাটকাঠি প্রভৃতি ঘরের বেড়া এবং ছাউনি হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়। চর ও বিল এলাকায় এসকল উপাদান প্রচুর পরিমাণে জন্মে বলেই এদের ব্যবহারও বেশি। | দেশের প্রধান নদনদী বরাবর বন্যা এবং নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত এলাকাগুলিতে লোকজন ঘরবাড়ি তৈরীতে খুব বেশি অর্থ খরচে উৎসাহী হয় না। এ সকল এলাকার ঘরবাড়িগুলি প্রায়ই কাদালেপা পাটকাঠির বেড়া এবং খড়ের ছাউনির হয়ে থাকে। হাওর অববাহিকা, চলন বিল এলাকা এবং চর এলাকাসমূহে সস্তা নির্মাণ সামগ্রী যেমন, নলখাগড়া, লম্বা শন, পাটকাঠি প্রভৃতি ঘরের বেড়া এবং ছাউনি হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়। চর ও বিল এলাকায় এসকল উপাদান প্রচুর পরিমাণে জন্মে বলেই এদের ব্যবহারও বেশি। | ||
[[Image:RuralHouse04.jpg|thumb|left|400px]] | |||
গ্রামাঞ্চলে থাকার ঘর ভালভাবে নির্মাণ করা হলেও রান্নাঘর, গোয়ালঘর, হাঁসমুরগির ঘর প্রভৃতি সচরাচর একটু পৃথক করে এবং নিম্নমানের উপাদান দিয়ে নির্মাণ করা হয়। যেনতেন প্রকারের রান্নাঘর সাধারণত খোলা থাকে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই চাল দেওয়া হয়। প্রায়ই থাকার ঘরের তুলনায় এক-অষ্টমাংশ থেকে এক-চতুর্থাংশ জায়গায় রান্নাঘর নির্মাণ করা হয়ে থাকে। দেশের সর্বত্রই গোয়াল ঘরগুলি ছাপড়ার মতো করে তৈরি করা হয়। তবে দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিমাংশে গোয়াল ঘরের ছাদ উত্তমরূপে শন বা খড় দিয়ে ছাওয়া হয় এবং তুলনামূলকভাবে একটু উঁচু ভিটির উপর তৈরি করা হয়। | গ্রামাঞ্চলে থাকার ঘর ভালভাবে নির্মাণ করা হলেও রান্নাঘর, গোয়ালঘর, হাঁসমুরগির ঘর প্রভৃতি সচরাচর একটু পৃথক করে এবং নিম্নমানের উপাদান দিয়ে নির্মাণ করা হয়। যেনতেন প্রকারের রান্নাঘর সাধারণত খোলা থাকে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই চাল দেওয়া হয়। প্রায়ই থাকার ঘরের তুলনায় এক-অষ্টমাংশ থেকে এক-চতুর্থাংশ জায়গায় রান্নাঘর নির্মাণ করা হয়ে থাকে। দেশের সর্বত্রই গোয়াল ঘরগুলি ছাপড়ার মতো করে তৈরি করা হয়। তবে দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিমাংশে গোয়াল ঘরের ছাদ উত্তমরূপে শন বা খড় দিয়ে ছাওয়া হয় এবং তুলনামূলকভাবে একটু উঁচু ভিটির উপর তৈরি করা হয়। | ||
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিরা তাদের নিজস্ব সংষ্কৃতিতে দেশের সমতল অংশ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক শৈলির গৃহ নির্মাণ করে থাকে। দেশের সমতল অংশ থেকে এ অঞ্চলের ভূমিরূপ এবং অধিবাসীদের জীবনযাত্রা উল্লেখযোগ্যরূপে আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়ায় গৃহনির্মাণের এ আলাদা ঢং গড়ে উঠেছে। হাল আমলে যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমতলের সংষ্কৃতি পার্বত্য অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছে, তবুও এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এবং প্রাধান্য বিস্তারকারী গৃহ হচ্ছে মাচা-ঘর। পাহাড়ি বনভূমির হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে বাঁচার জন্য পাহাড়ের অধিবাসীরা প্রধানত বাঁশের খুঁটি দিয়ে তিন-চার হাত উঁচু করে একটি মাচা তৈরি করে সামনের দিকে মাচার কিছু অংশ খোলা রেখে দোচালা ঘর তৈরি করে। ঘরের মেঝে বা পাটাতন এবং বেড়া বাঁশের ফালির আর চালও বাঁশের ফালি অথবা শন কিংবা তালপাতা দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে বর্তমানে ঢেউটিনের চালও দেখা যায়। মাচার খোলা অংশে তাঁত বোনা, ঝুড়ি বোনা ইত্যাদি সাংসারিক ও অর্থনৈতিক কাজকর্ম করা হয়, আবার এটি বৈঠকখানা হিসেবেও ব্যবহূত হয়। মাচায় ওঠানামা করার জন্য কাঠের গুঁড়িতে খাঁজ কেটে কিংবা বাঁশ দিয়ে মইয়ের মতো করে সিড়ি লাগানো থাকে। পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বাঁশ জন্মে, যার ফলে এখানকার অধিবাসীরা বাঁশকেই তাদের প্রধান গৃহনির্মাণ সামগ্রী হিসেবে বেছে নিয়েছে। লুসাই, পাঙ্খো, বম প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতিরা কাঠের পাটাতন এবং গাছের গুঁড়ির দেওয়াল দিয়ে ঘর নির্মাণ করে থাকে। গারো পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত অধিবাসীরাও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের মতো মাচার উপর বাঁশ অথবা কাঠ দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকে। ধনী ও সচ্ছল লোকেরা গ্রামেগঞ্জেও শহরের ন্যায় পাকা ও সুদর্শন বাড়িঘর কদাচিৎ তৈরি করে থাকেন। অর্থনৈতিক উন্নতির সহিত এর সংখ্যা বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে দিনদিন বেড়েই চলেছে। [মোঃ মাহবুব মোর্শেদ] | পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিরা তাদের নিজস্ব সংষ্কৃতিতে দেশের সমতল অংশ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক শৈলির গৃহ নির্মাণ করে থাকে। দেশের সমতল অংশ থেকে এ অঞ্চলের ভূমিরূপ এবং অধিবাসীদের জীবনযাত্রা উল্লেখযোগ্যরূপে আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়ায় গৃহনির্মাণের এ আলাদা ঢং গড়ে উঠেছে। হাল আমলে যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমতলের সংষ্কৃতি পার্বত্য অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছে, তবুও এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এবং প্রাধান্য বিস্তারকারী গৃহ হচ্ছে মাচা-ঘর। পাহাড়ি বনভূমির হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে বাঁচার জন্য পাহাড়ের অধিবাসীরা প্রধানত বাঁশের খুঁটি দিয়ে তিন-চার হাত উঁচু করে একটি মাচা তৈরি করে সামনের দিকে মাচার কিছু অংশ খোলা রেখে দোচালা ঘর তৈরি করে। ঘরের মেঝে বা পাটাতন এবং বেড়া বাঁশের ফালির আর চালও বাঁশের ফালি অথবা শন কিংবা তালপাতা দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে বর্তমানে ঢেউটিনের চালও দেখা যায়। মাচার খোলা অংশে তাঁত বোনা, ঝুড়ি বোনা ইত্যাদি সাংসারিক ও অর্থনৈতিক কাজকর্ম করা হয়, আবার এটি বৈঠকখানা হিসেবেও ব্যবহূত হয়। মাচায় ওঠানামা করার জন্য কাঠের গুঁড়িতে খাঁজ কেটে কিংবা বাঁশ দিয়ে মইয়ের মতো করে সিড়ি লাগানো থাকে। পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বাঁশ জন্মে, যার ফলে এখানকার অধিবাসীরা বাঁশকেই তাদের প্রধান গৃহনির্মাণ সামগ্রী হিসেবে বেছে নিয়েছে। লুসাই, পাঙ্খো, বম প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতিরা কাঠের পাটাতন এবং গাছের গুঁড়ির দেওয়াল দিয়ে ঘর নির্মাণ করে থাকে। গারো পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত অধিবাসীরাও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের মতো মাচার উপর বাঁশ অথবা কাঠ দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকে। ধনী ও সচ্ছল লোকেরা গ্রামেগঞ্জেও শহরের ন্যায় পাকা ও সুদর্শন বাড়িঘর কদাচিৎ তৈরি করে থাকেন। অর্থনৈতিক উন্নতির সহিত এর সংখ্যা বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে দিনদিন বেড়েই চলেছে। [মোঃ মাহবুব মোর্শেদ] | ||
''' | '''গ্রন্থপঞ্জি''' সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ''আর্থনীতিক ভূগোল: বিশ্ব ও বাংলাদেশ'', ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৮৮; Haroun Er Rashid, ''Geography of Bangladesh'', University Press Ltd, Dhaka, 1991; Sabiha Sultana, ''Rural Settlement Pattern in Bangladesh'', Graphosman, Dhaka, 1993; Abdul Baqee, ''Grameen Bashati'' (in Bangla), Banga Prokashani, Dhaka, 1998. | ||
[[en:Rural House]] | [[en:Rural House]] |
০৯:২২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
গ্রামীণ ঘরবাড়ি (Rural Housing) কোনো একটি অঞ্চলের ঘরবাড়ি নির্মাণ কাঠামো ও বিন্যাস প্রকৃতি সে অঞ্চলের ভৌগোলিক নিয়ামক এবং অধিবাসীদের রুচি, পছন্দ, সহজলভ্যতা ও আর্থিক সামর্থ্য দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে। ভৌগোলিক নিয়ামক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটে থাকে বলে ঘরবাড়ির উপকরণ, নির্মাণশৈলী ও বিন্যাসেও পরিবর্তন সাধিত হয়ে থাকে। বসতির স্থান নির্বাচনে প্রধান নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে ভূ-প্রকৃতি। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির প্রায় বেশিরভাগই বদ্বীপীয় সমতল প্লাবনভূমি যেখানে মৌসুমি প্লাবন ও বন্যা অনেকটা নিয়মিত ঘটনা হওয়ায় বাড়িঘর নির্মাণের সময় তুলনামূলকভাবে উঁচুজমি নির্বাচন করা হয়ে থাকে, অথবা হাওর এলাকার মতো নিচু জমিতে কৃত্রিম উপায়ে মাটি ভরাট করে উঁচু করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়। প্লাবনভূমি এলাকায় নদীর প্রাকৃতিক বাঁধ বা কান্দাসমূহ সমভূমির তুলনায় উঁচু ভূমির সংস্থান করায় গ্রামীণ জনগণ ঘরবাড়ি নির্মাণে কান্দার জমিকেই প্রধান পছন্দ হিসেবে গ্রহণ করে।
আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন নিয়ামক, যেমন- পেশা, আয়, সামাজিক অবস্থান, পরিবারের আকার এবং সে সঙ্গে জনগোষ্ঠীর সাংষ্কৃতিক চর্চা বাড়িঘরের আকার, নকশা এবং রূপকে নির্ধারণ করে থাকে। বিশেষ করে, ঘরের দিক নির্ণয় কিংবা বিভিন্ন গৃহ এককগুলি কোনোটি কোনোদিকে থাকবে এ বিষয়গুলি আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন নিয়ামক দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, থাকার ঘর সাধারণত পূর্বমুখী ও দক্ষিণমুখী করে নির্মাণ করা হয় এবং রান্নাঘর নির্মাণ করা হয় পশ্চিমমুখী করে। ঘরে কোঠার সংখ্যা কয়টি হবে তা আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছাড়াও পরিবারের আকারের ওপর নির্ভর করে নির্ণীত হয়ে থাকে। চারকোণাকৃতি কোঠা বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা গেলেও কদাচিত এর ব্যত্যয়ও দেখা যায়। আয়তাকার কিংবা বর্গাকৃতি উঠানকে ঘিরে গ্রামের ঘরগুলি বিন্যস্ত থাকে। দেশের উত্তর এবং মধ্য-পশ্চিমাংশে বাড়ির ভেতরে ও বাইরে দু স্থানেই উঠান রাখার প্রচলন রয়েছে। গ্রামবাংলায় বাড়িঘরের সঙ্গে পুকুর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদী তীরবর্তী বাড়ীঘর ছাড়া পুকুরই গ্রামাঞ্চলে পানির সহজলভ্য উৎস। বসতবাড়ির চারপাশে আম, জাম, কাঁঠাল কুল, প্রভৃতি বহুবর্ষজীবী গাছ লাগানো গ্রামীণ এলাকার একটি সাধারণ রীতি। এসকল গাছ একদিকে যেমন মৌসুমি ফলের যোগান দেয়, আবার অন্যদিকে ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে বাড়িঘর রক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাড়ির গোপনীয়তা রক্ষার জন্য প্রায় প্রতিটি বাড়ির উন্মুক্ত অংশ কিংবা সম্মুখভাগ বাঁশ, খড়, পাটকাঠি, নলখাগড়া অথবা তালপাতা দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থরা টিন দিয়েও বেড়া দিয়ে থাকেন।
স্থানীয়ভাবে যে সকল নির্মাণ সামগ্রী সহজলভ্য সচরাচর সেগুলি দিয়েই গ্রামীণ ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ গৃহনির্মাণ সামগ্রীর মধ্যে প্রধান স্থান দখল করে আছে বাঁশ। বাঁশ ছাড়াও আবহমান কাল থেকে খড়, শন, পাটকাঠি, গোলপাতা, মাটি, প্রভৃতি সামগ্রীও ঘরবাড়ি তৈরীতে ব্যবহূত হয়ে আসছে। সামর্থ্যবান গৃহস্থরা আজকাল ঘর তৈরীতে ঢেউটিনই বেশি ব্যবহার করছেন। তবে যে সামগ্রীই ব্যবহার করা হোক না কেন ঘরের খুঁটি, রুয়া, পাইড় ইত্যাদি তথা ঘরের কাঠামো তৈরীতে বাঁশই অধিকহারে ব্যবহূত হয়ে থাকে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাঠও ব্যবহূত হয়। কোনো একটি উপাদান এককভাবে ব্যবহূত না হয়ে উপাদানগুলির সন্নিবেশ দ্বারা নির্মিত ঘরই দেশের গ্রামীণ এলাকার সর্বত্র দেখা যায়। যেমন: বাঁশের বেড়া ও টিনের চাল, শনের ছাউনি ও টিনের অথবা বাঁশের বেড়া, মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনি ইত্যাদি ধরনের গৃহ গ্রামবাংলার সাধারণ চিত্র। পর্বত পাদদেশীয় পললভূমি এলাকা, বিশেষ করে, রংপুর এলাকা; যশোরের মৃতপ্রায় বদ্বীপ এলাকা; হাওর অববাহিকা; গঙ্গা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও মেঘনা প্লাবনভূমি এলাকা এবং উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় বাঁশের বেড়া এবং শন অথবা খড়ের চৌচালা ছাউনি দেওয়া ঘর দেখা যায়।
টিনের চালের সঙ্গে দেশের উত্তর-মধ্যভাগ এবং পূর্বাঞ্চলে সাধারণত শনের বেড়া; অধিকাংশ উত্তর ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলে এবং দক্ষিণাঞ্চলের উত্তরাংশে উলুখড়, খড়ি ও বেনাঘাসের বেড়া; দক্ষিণাঞ্চলের দক্ষিণাংশে গোলপাতার বেড়া; মধুপুর ও বরেন্দ্রভূমির অনেক জায়গায় তালপাতার বেড়া দিয়ে ঘর তৈরি করতে দেখা যায়। দেশের সব জায়গায়ই সামর্থ্যহীনরা টিনের চালের সঙ্গে ঘরের বেড়া হিসেবে খড়ই ব্যবহার করে থাকেন। ঘরের আকৃতি দেশের সর্বত্রই প্রধানত আয়তাকার। রুচিবান গৃহস্থরা ঘরের সম্মুখভাগে ছোট বারান্দা রেখে থাকেন যাকে গ্রামাঞ্চলে দাওয়া বলা হয়। ঘরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলতে কখনও কখনও বারান্দায় ১/২ হাত উচ্চতাবিশিষ্ট বাঁশের অথবা কাঠের বেড়া দেওয়া হয়। বাঁশের ফালির বিনুনি বেড়ার উপর পুরু কাদার প্রলেপ দিয়ে তৈরী বেড়া দিয়ে ঘরের আবেষ্টন নির্মাণ করতে দেখা যায় দেশের উত্তরাঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে। একই ধরনের গৃহ নির্মাণশৈলী চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় এলাকায়, বিশেষ করে, সীতাকুন্ডের দক্ষিণে এবং দ্বীপাঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর এবং পাবনা জেলার গ্রামীণ এলাকায় বাঁশের বেড়া এবং টিনের চাল দেওয়া ঘরই সচরাচর বেশি দেখা যায়।
দেশের পশ্চিম প্রান্ত বরাবর দিনাজপুর থেকে শুরু করে বগুড়া হয়ে যশোর এবং খুলনার কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের ভূমিরূপে বিশেষ ধরনের মাটির ঘর দেখতে পাওয়া যায়। বগুড়া, পাবনা, কুষ্টিয়া এবং যশোর এলাকায় মাটির দেয়ালঘেরা আয়তাকার ঘরগুলির চাল সাধারণত শনের অথবা টালি দিয়ে ছাওয়া হয়। নবাবগঞ্জ জেলায় (চাঁপাই নবাবগঞ্জ) মাটির ঘরের ছাদ বিশেষভাবে চুনসুরকি দিয়ে নির্মাণ করা হয় যা শুধু এ এলাকারই অনন্য বৈশিষ্ট্য। বগুড়া থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় মাটির ঘরের চাল টিন অথবা কেরোসিন তেলের শুন্য টিন কেটে সমান করে ব্যবহার করতেও দেখা যায়। মাটির ঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে সাধারণত কাদামাটির ব্লক তৈরি করে সেগুলিকে রোদে শুকিয়ে দেওয়াল তোলা হয়। ব্লকগুলির মধ্যকার ফাঁকা স্থানগুলি কাদা দিয়ে ভরে দেওয়া হয়। বন্যামুক্ত ভূমি, তুলনামূলকভাবে কম বৃষ্টিপাত ও শুষ্ক জলবায়ু এবং শুকনা অবস্থায় খুবই কঠিন রূপ ধারণ করে এমন ল্যাটেরাইট জাতীয় মৃত্তিকার সহজলভ্যতা এসকল এলাকায় মাটির ঘর নির্মাণের জন্য অন্যতম প্রধান কারণ। চট্টগ্রাম অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে দু অথবা তিনস্তরবিশিষ্ট চাল দেওয়া মাটির ঘর দেখা যায়। ঘরের চালগুলি প্রায়ই টিনের হয়ে থাকে। মধুপুর এলাকার বেশিরভাগ ঘরবাড়িই দীর্ঘাকৃতির শনঘাসে ছাওয়া চালবিশিষ্ট এবং দেয়াল মাটির দ্বারা তৈরী। ঢাকার উত্তর ও পশ্চিমাংশ এবং টাঙ্গাইল জেলার দক্ষিণাংশেও মাটির ঘর দেখা যায়, তবে এসকল এলাকায় ঘরের চাল সাধারণত টিনের হয়ে থাকে।
বনভূমি কাছাকাছি বলে মধুপুর গড় এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেখা যায় কাঠের তৈরী ঘরবাড়ি। চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণাংশ ব্যতীত অন্যত্র কাঠের ঘরগুলি সচরাচর দ্বিতলবিশিষ্ট। ঘরের সম্মুখভাগ প্রায় ক্ষেত্রেই কাঠের উপর খোদাই করা নকশাদার ও বর্ণিল রঙে সজ্জিত করা থাকে। চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণভাগে রাখাইন ও মগ সম্প্রদায়ের লোকেরাও কাঠের ঘর তৈরি করে, তবে তাদের ঘরগুলি কাঠের পাটাতনের উপর নির্মাণ করা হয় এবং এগুলি সচরাচর একতলাবিশিষ্ট। অবস্থাসম্পন্ন মগেরা বারান্দাসহ কাঠের দোতলা ঘর নির্মাণ করে বসবাস করে এবং ঘরের চৌকাঠগুলি নানা ধরনের খোদাই করা নকশায় সজ্জিত করে থাকে।
সিলেট জেলায় বিশেষ করে, জেলার পূর্বাংশে বিশেষ ধরনের গৃহ দেখতে পাওয়া যায়। ঘরের মেঝে এবং কখনও কখনও অল্প উচ্চতা পর্যন্ত দেয়াল ইট দিয়ে তৈরি করে দেয়ালের অবশিষ্ট অংশ ইকরাজাতীয় নলখাগড়া অথবা বাঁশের বেড়ার উপর উভয়পাশে সিমেন্ট অথবা কাদা দিয়ে লেপে তার উপর সাদা রং করা হয়ে থাকে। ঘরের খুঁটিগুলি হয় কালো রং করা কাঠের এবং চাল সাধারণত ঢেউটিন অথবা খড় দিয়ে ছাওয়া হয়। সিলেট অঞ্চলের উত্তরাংশ যেখানে দেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয় সে এলাকায় ঢেউটিনের চাল দেওয়া ঘরের সংখ্যাই বেশি দেখতে পাওয়া যায়। ঘরের দেয়ালও ঢেউটিনের অথবা পাকা। অর্থবিত্ত অথবা আভিজাত্যের ওপর নির্ভর করে ঘরের চাল চার চালবিশিষ্ট চৌচালা অথবা দুই চালবিশিষ্ট দোচালা হয়ে থাকে। চৌচালা ঘরের ক্ষেত্রে সাধারণত বারান্দা সংযুক্ত থাকে। সম্ভবত উপনিবেশিক আমলে এ অঞ্চলে চা বাগানে ইংরেজদের নির্মিত টিনের বাংলো থেকে টিনের এ ধরনের ঘর নির্মাণের ঐতিহ্য বিস্তৃতি লাভ করেছে।
দেশের প্রধান নদনদী বরাবর বন্যা এবং নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত এলাকাগুলিতে লোকজন ঘরবাড়ি তৈরীতে খুব বেশি অর্থ খরচে উৎসাহী হয় না। এ সকল এলাকার ঘরবাড়িগুলি প্রায়ই কাদালেপা পাটকাঠির বেড়া এবং খড়ের ছাউনির হয়ে থাকে। হাওর অববাহিকা, চলন বিল এলাকা এবং চর এলাকাসমূহে সস্তা নির্মাণ সামগ্রী যেমন, নলখাগড়া, লম্বা শন, পাটকাঠি প্রভৃতি ঘরের বেড়া এবং ছাউনি হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়। চর ও বিল এলাকায় এসকল উপাদান প্রচুর পরিমাণে জন্মে বলেই এদের ব্যবহারও বেশি।
গ্রামাঞ্চলে থাকার ঘর ভালভাবে নির্মাণ করা হলেও রান্নাঘর, গোয়ালঘর, হাঁসমুরগির ঘর প্রভৃতি সচরাচর একটু পৃথক করে এবং নিম্নমানের উপাদান দিয়ে নির্মাণ করা হয়। যেনতেন প্রকারের রান্নাঘর সাধারণত খোলা থাকে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই চাল দেওয়া হয়। প্রায়ই থাকার ঘরের তুলনায় এক-অষ্টমাংশ থেকে এক-চতুর্থাংশ জায়গায় রান্নাঘর নির্মাণ করা হয়ে থাকে। দেশের সর্বত্রই গোয়াল ঘরগুলি ছাপড়ার মতো করে তৈরি করা হয়। তবে দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিমাংশে গোয়াল ঘরের ছাদ উত্তমরূপে শন বা খড় দিয়ে ছাওয়া হয় এবং তুলনামূলকভাবে একটু উঁচু ভিটির উপর তৈরি করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিরা তাদের নিজস্ব সংষ্কৃতিতে দেশের সমতল অংশ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক শৈলির গৃহ নির্মাণ করে থাকে। দেশের সমতল অংশ থেকে এ অঞ্চলের ভূমিরূপ এবং অধিবাসীদের জীবনযাত্রা উল্লেখযোগ্যরূপে আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়ায় গৃহনির্মাণের এ আলাদা ঢং গড়ে উঠেছে। হাল আমলে যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমতলের সংষ্কৃতি পার্বত্য অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছে, তবুও এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এবং প্রাধান্য বিস্তারকারী গৃহ হচ্ছে মাচা-ঘর। পাহাড়ি বনভূমির হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে বাঁচার জন্য পাহাড়ের অধিবাসীরা প্রধানত বাঁশের খুঁটি দিয়ে তিন-চার হাত উঁচু করে একটি মাচা তৈরি করে সামনের দিকে মাচার কিছু অংশ খোলা রেখে দোচালা ঘর তৈরি করে। ঘরের মেঝে বা পাটাতন এবং বেড়া বাঁশের ফালির আর চালও বাঁশের ফালি অথবা শন কিংবা তালপাতা দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে বর্তমানে ঢেউটিনের চালও দেখা যায়। মাচার খোলা অংশে তাঁত বোনা, ঝুড়ি বোনা ইত্যাদি সাংসারিক ও অর্থনৈতিক কাজকর্ম করা হয়, আবার এটি বৈঠকখানা হিসেবেও ব্যবহূত হয়। মাচায় ওঠানামা করার জন্য কাঠের গুঁড়িতে খাঁজ কেটে কিংবা বাঁশ দিয়ে মইয়ের মতো করে সিড়ি লাগানো থাকে। পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বাঁশ জন্মে, যার ফলে এখানকার অধিবাসীরা বাঁশকেই তাদের প্রধান গৃহনির্মাণ সামগ্রী হিসেবে বেছে নিয়েছে। লুসাই, পাঙ্খো, বম প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতিরা কাঠের পাটাতন এবং গাছের গুঁড়ির দেওয়াল দিয়ে ঘর নির্মাণ করে থাকে। গারো পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত অধিবাসীরাও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের মতো মাচার উপর বাঁশ অথবা কাঠ দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকে। ধনী ও সচ্ছল লোকেরা গ্রামেগঞ্জেও শহরের ন্যায় পাকা ও সুদর্শন বাড়িঘর কদাচিৎ তৈরি করে থাকেন। অর্থনৈতিক উন্নতির সহিত এর সংখ্যা বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে দিনদিন বেড়েই চলেছে। [মোঃ মাহবুব মোর্শেদ]
গ্রন্থপঞ্জি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আর্থনীতিক ভূগোল: বিশ্ব ও বাংলাদেশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৮৮; Haroun Er Rashid, Geography of Bangladesh, University Press Ltd, Dhaka, 1991; Sabiha Sultana, Rural Settlement Pattern in Bangladesh, Graphosman, Dhaka, 1993; Abdul Baqee, Grameen Bashati (in Bangla), Banga Prokashani, Dhaka, 1998.