রহমান, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
[[Category:বাংলাপিডিয়া]] | [[Category:বাংলাপিডিয়া]] | ||
'''রহমান, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর''' শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও বিচারক। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমার দয়ারামপুর গ্রামে ১৯২৮ সালে তাঁর জন্ম। | [[Image:RahmanJusticeMohammadHabibur.jpg|thumb|right|বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান]] | ||
'''রহমান, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর''' (১৯২৮-২০১৪) শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও বিচারক। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমার দয়ারামপুর গ্রামে ১৯২৮ সালে তাঁর জন্ম। পিতা মৌলভী জহিরউদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন আইনজীবী এবং তাঁর মাতা গুল হাবিবা। হাবিবুর রহমান জঙ্গীপুর হাইস্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে আই.এ পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ সালে ইতিহাসে বি.এ (অনার্স) এবং ১৯৫১ সালে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উরস্টার কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে আধুনিক ইতিহাসে বি.এ (অনার্স) এবং ১৯৬২ সালে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে লিঙ্কনস ইন থেকে বার-এট-ল সম্পন্ন করেন। | |||
হাবিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের লেকচারার হিসেবে ১৯৫২ সালে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬০ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে আইন অনুষদের ডীন (১৯৬১) এবং পরে ইতিহাসের রিডার (১৯৬২-৬৪) পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। আইন পেশায় তিনি সহকারি অ্যাডভোকেট জেনারেল (১৯৬৯), হাইকোর্ট আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি (১৯৭২) এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য (১৯৭২) ছিলেন। | হাবিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের লেকচারার হিসেবে ১৯৫২ সালে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬০ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে আইন অনুষদের ডীন (১৯৬১) এবং পরে ইতিহাসের রিডার (১৯৬২-৬৪) পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। আইন পেশায় তিনি সহকারি অ্যাডভোকেট জেনারেল (১৯৬৯), হাইকোর্ট আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি (১৯৭২) এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য (১৯৭২) ছিলেন। | ||
হাবিবুর রহমান ১৯৭৬ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে নিয়োগ লাভ করেন এবং ১৯৫৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৯০-৯১ সালে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ছিলেন এবং ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদে অভিষিক্ত হন। | হাবিবুর রহমান ১৯৭৬ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে নিয়োগ লাভ করেন এবং ১৯৫৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৯০-৯১ সালে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ছিলেন এবং ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদে অভিষিক্ত হন। অ্যাডমিরাল্টি জুরিস্ডিকশন, সংবিধানের সংশোধনী, নাগরিকত্ব, হেবিয়াস কর্পাস, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও কোর্টের এখতিয়ার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বহু রায়ে তাঁর প্রদত্ত অভিমত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিচারপতি হিসেবে তাঁর দক্ষতার পরিচায়ক। | ||
অ্যাডমিরাল্টি জুরিস্ডিকশন, সংবিধানের সংশোধনী, নাগরিকত্ব, হেবিয়াস কর্পাস, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও কোর্টের এখতিয়ার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বহু রায়ে তাঁর প্রদত্ত অভিমত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিচারপতি হিসেবে তাঁর দক্ষতার পরিচায়ক। | |||
হাবিবুর রহমান আইনজীবী ও বিচারকদের বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে অনুষ্ঠিত এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের চীফ জাস্টিসদের সম্মেলন (১৯৯১), নাইজেরিয়ার আবুযায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ কমনওয়েলথ চীফ জাস্টিসদের সম্মেলন (১৯৯২), নেপালের কাঠমন্ডুতে অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক চীফ জাস্টিসদের সম্মেলন (১৯৯৫)। এছাড়াও তিনি ব্রাজিলের সাওপাওলো, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, যুক্তরাষ্ট্রের বার্লিংটন ও জর্জিয়া, ফ্রান্সের এথেন্স, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড এবং ভারতের | হাবিবুর রহমান আইনজীবী ও বিচারকদের বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে অনুষ্ঠিত এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের চীফ জাস্টিসদের সম্মেলন (১৯৯১), নাইজেরিয়ার আবুযায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ কমনওয়েলথ চীফ জাস্টিসদের সম্মেলন (১৯৯২), নেপালের কাঠমন্ডুতে অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক চীফ জাস্টিসদের সম্মেলন (১৯৯৫)। এছাড়াও তিনি ব্রাজিলের সাওপাওলো, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, যুক্তরাষ্ট্রের বার্লিংটন ও জর্জিয়া, ফ্রান্সের এথেন্স, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড এবং ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক সম্মেলন ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। | ||
হাবিবুর রহমান ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধানের ধারা মোতাবেক শেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। অত্যন্ত | হাবিবুর রহমান ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধানের ধারা মোতাবেক শেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা যখন হুমকির সম্মুখীন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সংশয় ও অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের আশঙ্কা যখন প্রকট তেমনি এক সংকটময় সময়ে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্ব তখন তাঁরই উপর ন্যস্ত। তিনি প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার সঙ্গে এ সমস্যার মোকাবেলা করে দেশে গণতন্ত্রের সুরা নিশ্চিত করেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করেন। | ||
মননশীল লেখক হিসেবে হাবিবুর রহমানের আগ্রহ ও দখল ছিল বিচিত্র বিষয়ে। রেনেসাঁর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি আজীবন জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তার গবেষণার ক্ষেত্রে বিস্তৃত ছিল সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজ প্রভৃতি বিচিত্র পরিসরে। তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবক্তা। হাবিবুর রহমান তাঁর গবেষণায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকে বিচিত্র ও অভিনব রূপে তুলে ধরেছেন। তিনি ছিলেন কবি ও সুন্দরের পূজারী, ধর্মপরায়ণ অথচ অসাম্প্রদায়িক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ''Law of Requisition'' (১৯৬৬), ''যথাশব্দ'' (১৯৭৪), ''রবীন্দ্র-প্রবন্ধে সংজ্ঞা ও পার্থক্য বিচার'' (১৯৮৩), ''মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ'' (১৯৮৩), ''কোরানসূত্র'' (১৯৮৪), ''বচন ও প্রবচন'' (১৯৮৫), ''গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ'' (১৯৮৫), ''রবীন্দ্র-রচনার রবীন্দ্র-ব্যাখ্যা'' (১৯৮৬), ''রবীন্দ্রকাব্যে আর্ট, সঙ্গীত ও সাহিত্য'' (১৯৮৬), ''আমরা কি যাব না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে'' (১৯৯৬), ''বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক'' (১৯৯৬), ''তেরই ভাদ্র শীতের জন্ম'' (১৯৯৬), ''কলম এখন নাগালের বাইরে'' (১৯৯৬), ''আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা'' (১৯৯৭), ''বাংলাদেশ সংবিধানের শব্দ ও খন্ডবাক্য'' (১৯৯৭), ''বাংলাদেশের তারিখ'' (১৯৯৮), ''মনের আগাছা পুড়িয়ে'' (১৯৯৮), ''বং বঙ্গ বাঙ্গালা বাংলাদেশ'' (১৯৯৯), ''সরকার সংবিধান ও অধিকার'' (১৯৯৯), ''কবি তুমি নহ গুরুদেব'' (১৯৯৯), ''একুশে ফেব্রুয়ারী সকল ভাষার কথা কয়'' (১৯৯৯), ''মৌসুমী ভাবনা'' (১৯৯৯), ''মিত্রাক্ষর'' (২০০০), ''জাগো ওঠো দাঁড়াও বাংলাদেশ'' (২০০০), ''নির্বাচিত প্রবন্ধ'' (২০০০), ''কোরান শরীফের সরল বঙ্গানুবাদ'' (২০০০), ''চাওয়া পাওয়া ও না পাওয়ার হিসেব'' (২০০১), ''স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন ও বোবার স্বপ্ন'' (২০০২), ''রবীন্দ্র রচনায় আইনী ভাবনা'' (২০০২), ''বিষণ্ণ বিষয় ও বাংলাদেশ'' (২০০৩), ''প্রথমে মাতৃভাষা পরভাষা পরে'' (২০০৪), ''রবীন্দ্রনাথ ও সভ্যতার সংকট'' (২০০৪), ''সব দেশের মহড়া'' (২০০৪), ''উন্নত মম শির'' (২০০৫), ''এক ভারতীয় বাঙালির আত্মসমালোচনা'' (২০০৫), ''দায়মুক্তি'' (২০০৫), ''কত ভাগ্যে বাংলাদেশ, কোথায় দাঁড়ায়ে বাংলাদেশ'' (২০০৬), ''শিক্ষার্থী ও শিক্ষাদাতাদের জয় হোক'' (২০০৭), ''জাতিধর্মবর্ণ নারী পুরুষ নির্বিশেষে'' (২০০৭), ''বাংলার সূর্য আজ আর অস্ত যায় না'' (২০০৭), ''মানুষের জন্য খাঁচা বানিও না'' (২০০৭), ''স্বাধীনতার দায়ভার'' (২০০৭), ''রাজার চিঠির প্রতিক্ষায়'' (২০০৭), ''উদয়ের পথে আমাদের ভাবনা'' (২০০৮), ''যার যা ধর্ম'' (২০০৮), ''বাংলাদেশের তারিখ'', ২য় খন্ড (২০০৮), ''দেশের ভালোমন্দ'' (২০০৮), ''বাজার ও অদৃশ্য হস্ত'' (২০০৮), ''একমুঠো সমুদ্রের গর্জন'' (২০০৮), ''সৃজনশীল গণতন্ত্র'' (২০০৮), ''লাইনচ্যুত রেলগাড়ি'' (২০০৮), ''গঙ্গাঋদ্ধি'' (২০০৮), ''সুভাষিত'' (২০০৯), ''রাজনৈতিক কবিতা'' (২০১০), ''ইতিহাস বিষয়ক'' (২০১০), ''রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা'' (২০১০), ''তোরা কেমন করে পারলি'' (২০১০), ''তাও তি চিং-এর অনুবাদ'' (২০১০), ''আইন-অধিকার ও বিরোধ ও মীমাংসা'' (২০১০), ''নির্বাচিত চীনা কবিতা'' (২০১০), ''আইন শব্দকোষ'' (২০০৭), ''On Rights and Remedies'', ''The Road Map to Peace but Nowhere to go''। | |||
বিচারপতি হাবিবুর রহমান ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার | বিচারপতি হাবিবুর রহমান ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৭ সালে একুশে পদক এবং আরো বহু সংস্থার পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি ছিলেন [[বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি|বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি]]র ফেলো, [[বাংলা একাডেমী|বাংলা একাডেমী]]র ফেলো, লিংকন্স ইন-এর অনরারি বেঞ্চার, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উরস্টার কলেজের অনরারি ফেলো। | ||
[মুয়ায্যম হুসায়ন খান] | [মুয়ায্যম হুসায়ন খান] |
০৬:২৩, ৩ জুলাই ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
রহমান, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর (১৯২৮-২০১৪) শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও বিচারক। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমার দয়ারামপুর গ্রামে ১৯২৮ সালে তাঁর জন্ম। পিতা মৌলভী জহিরউদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন আইনজীবী এবং তাঁর মাতা গুল হাবিবা। হাবিবুর রহমান জঙ্গীপুর হাইস্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে আই.এ পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ সালে ইতিহাসে বি.এ (অনার্স) এবং ১৯৫১ সালে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উরস্টার কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে আধুনিক ইতিহাসে বি.এ (অনার্স) এবং ১৯৬২ সালে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে লিঙ্কনস ইন থেকে বার-এট-ল সম্পন্ন করেন।
হাবিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের লেকচারার হিসেবে ১৯৫২ সালে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬০ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে আইন অনুষদের ডীন (১৯৬১) এবং পরে ইতিহাসের রিডার (১৯৬২-৬৪) পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। আইন পেশায় তিনি সহকারি অ্যাডভোকেট জেনারেল (১৯৬৯), হাইকোর্ট আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি (১৯৭২) এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য (১৯৭২) ছিলেন।
হাবিবুর রহমান ১৯৭৬ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে নিয়োগ লাভ করেন এবং ১৯৫৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৯০-৯১ সালে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ছিলেন এবং ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদে অভিষিক্ত হন। অ্যাডমিরাল্টি জুরিস্ডিকশন, সংবিধানের সংশোধনী, নাগরিকত্ব, হেবিয়াস কর্পাস, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও কোর্টের এখতিয়ার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বহু রায়ে তাঁর প্রদত্ত অভিমত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিচারপতি হিসেবে তাঁর দক্ষতার পরিচায়ক।
হাবিবুর রহমান আইনজীবী ও বিচারকদের বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে অনুষ্ঠিত এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের চীফ জাস্টিসদের সম্মেলন (১৯৯১), নাইজেরিয়ার আবুযায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ কমনওয়েলথ চীফ জাস্টিসদের সম্মেলন (১৯৯২), নেপালের কাঠমন্ডুতে অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক চীফ জাস্টিসদের সম্মেলন (১৯৯৫)। এছাড়াও তিনি ব্রাজিলের সাওপাওলো, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, যুক্তরাষ্ট্রের বার্লিংটন ও জর্জিয়া, ফ্রান্সের এথেন্স, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড এবং ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক সম্মেলন ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।
হাবিবুর রহমান ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধানের ধারা মোতাবেক শেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা যখন হুমকির সম্মুখীন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সংশয় ও অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের আশঙ্কা যখন প্রকট তেমনি এক সংকটময় সময়ে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্ব তখন তাঁরই উপর ন্যস্ত। তিনি প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার সঙ্গে এ সমস্যার মোকাবেলা করে দেশে গণতন্ত্রের সুরা নিশ্চিত করেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করেন।
মননশীল লেখক হিসেবে হাবিবুর রহমানের আগ্রহ ও দখল ছিল বিচিত্র বিষয়ে। রেনেসাঁর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি আজীবন জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তার গবেষণার ক্ষেত্রে বিস্তৃত ছিল সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজ প্রভৃতি বিচিত্র পরিসরে। তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবক্তা। হাবিবুর রহমান তাঁর গবেষণায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকে বিচিত্র ও অভিনব রূপে তুলে ধরেছেন। তিনি ছিলেন কবি ও সুন্দরের পূজারী, ধর্মপরায়ণ অথচ অসাম্প্রদায়িক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে Law of Requisition (১৯৬৬), যথাশব্দ (১৯৭৪), রবীন্দ্র-প্রবন্ধে সংজ্ঞা ও পার্থক্য বিচার (১৯৮৩), মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৩), কোরানসূত্র (১৯৮৪), বচন ও প্রবচন (১৯৮৫), গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ (১৯৮৫), রবীন্দ্র-রচনার রবীন্দ্র-ব্যাখ্যা (১৯৮৬), রবীন্দ্রকাব্যে আর্ট, সঙ্গীত ও সাহিত্য (১৯৮৬), আমরা কি যাব না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে (১৯৯৬), বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক (১৯৯৬), তেরই ভাদ্র শীতের জন্ম (১৯৯৬), কলম এখন নাগালের বাইরে (১৯৯৬), আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা (১৯৯৭), বাংলাদেশ সংবিধানের শব্দ ও খন্ডবাক্য (১৯৯৭), বাংলাদেশের তারিখ (১৯৯৮), মনের আগাছা পুড়িয়ে (১৯৯৮), বং বঙ্গ বাঙ্গালা বাংলাদেশ (১৯৯৯), সরকার সংবিধান ও অধিকার (১৯৯৯), কবি তুমি নহ গুরুদেব (১৯৯৯), একুশে ফেব্রুয়ারী সকল ভাষার কথা কয় (১৯৯৯), মৌসুমী ভাবনা (১৯৯৯), মিত্রাক্ষর (২০০০), জাগো ওঠো দাঁড়াও বাংলাদেশ (২০০০), নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০০০), কোরান শরীফের সরল বঙ্গানুবাদ (২০০০), চাওয়া পাওয়া ও না পাওয়ার হিসেব (২০০১), স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন ও বোবার স্বপ্ন (২০০২), রবীন্দ্র রচনায় আইনী ভাবনা (২০০২), বিষণ্ণ বিষয় ও বাংলাদেশ (২০০৩), প্রথমে মাতৃভাষা পরভাষা পরে (২০০৪), রবীন্দ্রনাথ ও সভ্যতার সংকট (২০০৪), সব দেশের মহড়া (২০০৪), উন্নত মম শির (২০০৫), এক ভারতীয় বাঙালির আত্মসমালোচনা (২০০৫), দায়মুক্তি (২০০৫), কত ভাগ্যে বাংলাদেশ, কোথায় দাঁড়ায়ে বাংলাদেশ (২০০৬), শিক্ষার্থী ও শিক্ষাদাতাদের জয় হোক (২০০৭), জাতিধর্মবর্ণ নারী পুরুষ নির্বিশেষে (২০০৭), বাংলার সূর্য আজ আর অস্ত যায় না (২০০৭), মানুষের জন্য খাঁচা বানিও না (২০০৭), স্বাধীনতার দায়ভার (২০০৭), রাজার চিঠির প্রতিক্ষায় (২০০৭), উদয়ের পথে আমাদের ভাবনা (২০০৮), যার যা ধর্ম (২০০৮), বাংলাদেশের তারিখ, ২য় খন্ড (২০০৮), দেশের ভালোমন্দ (২০০৮), বাজার ও অদৃশ্য হস্ত (২০০৮), একমুঠো সমুদ্রের গর্জন (২০০৮), সৃজনশীল গণতন্ত্র (২০০৮), লাইনচ্যুত রেলগাড়ি (২০০৮), গঙ্গাঋদ্ধি (২০০৮), সুভাষিত (২০০৯), রাজনৈতিক কবিতা (২০১০), ইতিহাস বিষয়ক (২০১০), রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা (২০১০), তোরা কেমন করে পারলি (২০১০), তাও তি চিং-এর অনুবাদ (২০১০), আইন-অধিকার ও বিরোধ ও মীমাংসা (২০১০), নির্বাচিত চীনা কবিতা (২০১০), আইন শব্দকোষ (২০০৭), On Rights and Remedies, The Road Map to Peace but Nowhere to go।
বিচারপতি হাবিবুর রহমান ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৭ সালে একুশে পদক এবং আরো বহু সংস্থার পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো, বাংলা একাডেমীর ফেলো, লিংকন্স ইন-এর অনরারি বেঞ্চার, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উরস্টার কলেজের অনরারি ফেলো।
[মুয়ায্যম হুসায়ন খান]