বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
[[Category:বাংলাপিডিয়া]] | [[Category:বাংলাপিডিয়া]] | ||
'''বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি''' (এডিপি) | '''বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি''' (এডিপি) কোনো একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রক্ষেপিত সরকারি খাতের উন্নয়ন নীতিমালা, কর্মসূচি, বিনিয়োগ এবং লক্ষ্যমাত্রাসমূহ পরিচালনা ও অর্জনের জন্য ঐ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কোন একটি নির্দিষ্ট বছরে বাস্তবায়নযোগ্য বিভিন্ন খাতের প্রকল্পসমূহের তালিকা এবং তাদের জন্য আর্থিক বরাদ্দসহ প্রণীত কর্মসূচি। প্রচলিত নিয়মানুযায়ী প্রতিটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে লক্ষ্য অর্জনের সুবিধার্থে পাঁচটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিভক্ত করা হয় এবং প্রত্যেকটি প্রকল্পের জন্য স্থানীয় ও বৈদেশিক উভয় মুদ্রায় বরাদ্দ রাখা হয়। প্রতি বছরের এডিপি সে বছরের জন্য জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত উন্নয়ন বাজেটের ভিত্তিতে প্রণীত হয়। একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বর্ণিত ও নির্ধারিত মৌলিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহের আলোকে দেশের পরিকল্পনা কমিশন বাংলাদেশ সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির খসড়া প্রণয়ন করে। অতঃপর প্রণীত খসড়া জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়। নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পাওয়ার পর পরিকল্পনা কমিশন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বিস্তারিতভাবে মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নকালে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত খাত এবং প্রকল্পসমূহ অধিকতর গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় মুদ্রা ও বৈদেশিক উৎস হতে প্রাপ্ত তহবিল ব্যবহার করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলের জন্য বাংলাদেশ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে। এর ফলে এডিপি প্রণয়নের সময় বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্যতার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। | ||
এডিপির মাধ্যমে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৫৫-৬০) সময়কাল হতে চালু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৬০-৬৫) অধীনে বাস্তবায়িত ১৯৬২-৬৩ সালের এডিপিতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১,৩৫৮.৩৩ মিলিয়ন রুপি। ১৯৬২-৬৩ সালের এডিপিতে ৩টি প্রধান অংশ ছিল। প্রথম অংশের অন্তর্ভুক্ত খাতসমূহ ছিল পানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, সমাজসেবা, কৃষি, হাউজিং ও সেটেলমেন্ট, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, সড়ক ও যোগাযোগ, শিল্প, এবং জনশক্তি ও কর্মসংস্থান। পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন ও পূর্বাঞ্চলীয় রেল বিভাগসহ বৃহৎ শিল্পগুলি ছিল দ্বিতীয় অংশের অন্তর্ভুক্ত। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক স্থানান্তরিত স্কিমসমূহের জন্য উক্ত এডিপির তৃতীয় অংশ নির্ধারিত ছিল। | এডিপির মাধ্যমে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৫৫-৬০) সময়কাল হতে চালু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৬০-৬৫) অধীনে বাস্তবায়িত ১৯৬২-৬৩ সালের এডিপিতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১,৩৫৮.৩৩ মিলিয়ন রুপি। ১৯৬২-৬৩ সালের এডিপিতে ৩টি প্রধান অংশ ছিল। প্রথম অংশের অন্তর্ভুক্ত খাতসমূহ ছিল পানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, সমাজসেবা, কৃষি, হাউজিং ও সেটেলমেন্ট, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, সড়ক ও যোগাযোগ, শিল্প, এবং জনশক্তি ও কর্মসংস্থান। পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন ও পূর্বাঞ্চলীয় রেল বিভাগসহ বৃহৎ শিল্পগুলি ছিল দ্বিতীয় অংশের অন্তর্ভুক্ত। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক স্থানান্তরিত স্কিমসমূহের জন্য উক্ত এডিপির তৃতীয় অংশ নির্ধারিত ছিল। | ||
পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৬৫-৭০) অধীনে বাস্তবায়িত প্রথম এডিপির (১৯৬৫-৬৬) কাঠামো পূর্ববর্তী এডিপিসমূহের কাঠামো অপেক্ষা ভিন্ন ও সহজতর ছিল। বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করার পরিবর্তে ১৯৬৫-৬৬ সালের এডিপিতে নতুন ধাঁচে সরাসরি ১২টি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং মোট বরাদ্দের ১,৯৫১.৩০ মিলিয়ন রুপি উক্ত খাতগুলিতে বণ্টন করা হয়। এসব খাতগুলি ছিল পানি, বিদ্যুৎ, কৃষি, শিল্প, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, | পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৬৫-৭০) অধীনে বাস্তবায়িত প্রথম এডিপির (১৯৬৫-৬৬) কাঠামো পূর্ববর্তী এডিপিসমূহের কাঠামো অপেক্ষা ভিন্ন ও সহজতর ছিল। বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করার পরিবর্তে ১৯৬৫-৬৬ সালের এডিপিতে নতুন ধাঁচে সরাসরি ১২টি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং মোট বরাদ্দের ১,৯৫১.৩০ মিলিয়ন রুপি উক্ত খাতগুলিতে বণ্টন করা হয়। এসব খাতগুলি ছিল পানি, বিদ্যুৎ, কৃষি, শিল্প, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, পরিবহন ও যোগাযোগ, ভৌত পরিকল্পনা ও গৃহায়ণ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, জনশক্তি ও কর্মসংস্থান, সার্ভে ও পরিসংখ্যান এবং পূর্ত। | ||
১৯৭২-৭৩ সালের | ১৯৭২-৭৩ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৫.০১ বিলিয়ন টাকা, যার শতকরা ৭৫ ভাগই ছিল বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত। এডিপির আকার বা বরাদ্দের পরিমাণ পরবর্তী বৎসরসমূহে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৫-৭৬ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৯.৫ বিলিয়ন টাকা যা পরবর্তী সময়ে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৯-৮০ সালে ২১.২৩ বিলিয়ন, ১৯৮৭-৮৮ সালে ৫০.৪৬ বিলিয়ন এবং ১৯৯৫-৯৬ সালে ১২১ বিলিয়ন টাকাতে দাঁড়ায়। শুরু থেকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর হয়ে পড়ে। ১৯৭৯-৮০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বরাদ্দের শতকরা ৭০ ভাগই আসত বৈদেশিক সাহায্য তহবিল হিসেবে। পরবর্তী দু’বছরে বৈদেশিক সাহায্যের অংশ কমে এলেও ৩ বছর পর তা বৃদ্ধি পেয়ে শতকরা ৮০ ভাগে উন্নীত হয়। ১৯৮৭-৮৮ এবং ১৯৯০-৯১ বৎসরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল মোট বরাদ্দের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ। পরবর্তী বৎসরসমূহে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসে ১৯৯৫-৯৬ বছরে শতকরা ৬৬ ভাগ-এ দাঁড়ায়। ২০০০-২০০১ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ১৭৫ বিলিয়ন টাকা যার মধ্যে শতকরা ৪৩ ভাগ বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের মাধ্যমে সংস্থান করা হয়। ২০১১ অর্থবছরে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির শতকরা ২৫.৪ ভাগ বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে সংস্থান করা হয়। তবে, ২০২১ অর্থবছরে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে সংস্থানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৪০.৬ ভাগ এবং ২০২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ ধরা হয়েছে শতকরা ৪৮.৬ ভাগ (চার্ট ১ দেখুন)। | ||
[[Image:ADPChart(2010-2022)B.jpg|right|thumbnail|400px]] | |||
উপরোক্ত চিত্রটি থেকে আমরা দেখতে পাই যে, এডিপিতে দেশীয় সম্পদের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশীয় উৎস থেকে সম্পদ বরাদ্দের এই ধারা অব্যাহত রাখলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে। অন্যদিকে, ২০১০ এবং ২০২২ অর্থবছর ব্যতীত বাহ্যিক উৎসের অর্থ অভ্যন্তরীণ উৎস -এর তুলনায় ততটা তুলনামূলক নয়। | |||
প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল ব্যবহারে ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণে দাতা সংস্থাগুলি প্রায়শ বৈদেশিক সাহায্যের অর্থ ছাড়করণে বিলম্ব করে থাকে। ফলে সরকার কর্তৃক প্রায় প্রতিবছরেই মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি পরিবর্তন করে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নের রেওয়াজ চলে আসছে। অনেক সময় নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্তকরণ অথবা কোন প্রকল্প বাদ দেওয়ার জন্যও মূল এডিপিতে পরিবর্তন সাধন করতে হয়। প্রায়শই প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব অথবা যথাযথ কাঠামোগত সুযোগ সৃষ্টি না করার কারণেও মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সংশোধন করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এছাড়া প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত সমস্যা এবং টাকা কাউন্টার পার্ট তহবিলে ঘাটতির কারণেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সংশোধন করতে হয়। অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কর্তৃক অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়ার ফলে স্থানীয় ও বৈদেশিক মুদ্রার যথাযথ বণ্টনের জন্য এডিপি পরিবর্তন করা হয় এবং ঐসব অতিরিক্ত চাহিদাকৃত অর্থ বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের অপ্রত্যাশিত ব্যয়ের খাত হতে মেটানো হয়। উল্লেখ্য যে, এডিপিতে কোন নির্দিষ্ট বছরের সবগুলি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয় না। কিছু কিছু প্রকল্প এডিপি-বহির্ভূত রাখা হয় এবং নির্দিষ্ট বছরের রাজস্ব বাজেট হতে অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। সকল প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দিষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করে। উক্ত নীতিমালার আলোকে মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া মনিটর করা হয়। | |||
দেশের আর্থসামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, মানব সম্পদের গুণগত মান বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস ও আয় বৃদ্ধির জন্য গৃহীত সুনির্দিষ্ট জাতীয় কৌশলের পটভূমিতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রতিবছরই বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। | |||
২০১১ হতে ২০২১ অর্থবছরে প্রতিটি বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দের পরিমাণ গড়ে ২০ ভাগের অধিক হারে বেড়েছে। বিগত দশকের মধ্যে ২০১৭ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দের অংশ ছিল মোট বাজেটের ২১ ভাগ যা সর্বনিম্ন। এর পর থেকে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ২০২১ অর্থবছরে মোট বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অংশ ছিল শতকরা ৪০.৬ ভাগ। ২০২২ অর্থবছরের জন্য তা শতকরা ৪৮.৫ ভাগ। ধারার সাথে নিজস্ব উৎসের সংস্থান সক্ষমতার ধারা অব্যাহত থাকলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্ননকে ত্বরাণ্বিত করবে। | |||
২০২১ অর্থবছরে এডিপির মোট পরিমাণ টাকা ২.২১ ট্রিলিয়ন। এই অর্থবছরে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দের অংশসহ উক্ত খাতসমূহ হচ্ছে: পরিবহন ও যোগাযোগ (২৫.২%), শিক্ষা ও প্রযুক্তি (১৯.৪%), স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন (১৫.৭%), বিদ্যুত ও জ্বালানি (১২.৪%), কৃষি (৫.৫%) এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ (৩.১%)। এছাড়া বিবিধ খাতে শতকরা ৭.১ ভাগ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এর জন্য ২.৪৬ ট্রিলিয়ন টাকা অনুমোদনের পরিকল্পনা নিয়েছিল এবং এই বাজেটের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মহামারীর বিপর্যয় থেকে অর্থনীতির দ্রুত পুনরুদ্ধার করা। [আবুল কালাম আজাদ] | |||
[[en:Annual Development Programme]] | [[en:Annual Development Programme]] |
০৮:৪৪, ১০ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কোনো একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রক্ষেপিত সরকারি খাতের উন্নয়ন নীতিমালা, কর্মসূচি, বিনিয়োগ এবং লক্ষ্যমাত্রাসমূহ পরিচালনা ও অর্জনের জন্য ঐ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কোন একটি নির্দিষ্ট বছরে বাস্তবায়নযোগ্য বিভিন্ন খাতের প্রকল্পসমূহের তালিকা এবং তাদের জন্য আর্থিক বরাদ্দসহ প্রণীত কর্মসূচি। প্রচলিত নিয়মানুযায়ী প্রতিটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে লক্ষ্য অর্জনের সুবিধার্থে পাঁচটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিভক্ত করা হয় এবং প্রত্যেকটি প্রকল্পের জন্য স্থানীয় ও বৈদেশিক উভয় মুদ্রায় বরাদ্দ রাখা হয়। প্রতি বছরের এডিপি সে বছরের জন্য জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত উন্নয়ন বাজেটের ভিত্তিতে প্রণীত হয়। একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বর্ণিত ও নির্ধারিত মৌলিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহের আলোকে দেশের পরিকল্পনা কমিশন বাংলাদেশ সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির খসড়া প্রণয়ন করে। অতঃপর প্রণীত খসড়া জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়। নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পাওয়ার পর পরিকল্পনা কমিশন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বিস্তারিতভাবে মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নকালে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত খাত এবং প্রকল্পসমূহ অধিকতর গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় মুদ্রা ও বৈদেশিক উৎস হতে প্রাপ্ত তহবিল ব্যবহার করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলের জন্য বাংলাদেশ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে। এর ফলে এডিপি প্রণয়নের সময় বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্যতার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
এডিপির মাধ্যমে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৫৫-৬০) সময়কাল হতে চালু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৬০-৬৫) অধীনে বাস্তবায়িত ১৯৬২-৬৩ সালের এডিপিতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১,৩৫৮.৩৩ মিলিয়ন রুপি। ১৯৬২-৬৩ সালের এডিপিতে ৩টি প্রধান অংশ ছিল। প্রথম অংশের অন্তর্ভুক্ত খাতসমূহ ছিল পানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, সমাজসেবা, কৃষি, হাউজিং ও সেটেলমেন্ট, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, সড়ক ও যোগাযোগ, শিল্প, এবং জনশক্তি ও কর্মসংস্থান। পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন ও পূর্বাঞ্চলীয় রেল বিভাগসহ বৃহৎ শিল্পগুলি ছিল দ্বিতীয় অংশের অন্তর্ভুক্ত। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক স্থানান্তরিত স্কিমসমূহের জন্য উক্ত এডিপির তৃতীয় অংশ নির্ধারিত ছিল।
পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৬৫-৭০) অধীনে বাস্তবায়িত প্রথম এডিপির (১৯৬৫-৬৬) কাঠামো পূর্ববর্তী এডিপিসমূহের কাঠামো অপেক্ষা ভিন্ন ও সহজতর ছিল। বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করার পরিবর্তে ১৯৬৫-৬৬ সালের এডিপিতে নতুন ধাঁচে সরাসরি ১২টি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং মোট বরাদ্দের ১,৯৫১.৩০ মিলিয়ন রুপি উক্ত খাতগুলিতে বণ্টন করা হয়। এসব খাতগুলি ছিল পানি, বিদ্যুৎ, কৃষি, শিল্প, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, পরিবহন ও যোগাযোগ, ভৌত পরিকল্পনা ও গৃহায়ণ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, জনশক্তি ও কর্মসংস্থান, সার্ভে ও পরিসংখ্যান এবং পূর্ত।
১৯৭২-৭৩ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৫.০১ বিলিয়ন টাকা, যার শতকরা ৭৫ ভাগই ছিল বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত। এডিপির আকার বা বরাদ্দের পরিমাণ পরবর্তী বৎসরসমূহে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৫-৭৬ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৯.৫ বিলিয়ন টাকা যা পরবর্তী সময়ে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৯-৮০ সালে ২১.২৩ বিলিয়ন, ১৯৮৭-৮৮ সালে ৫০.৪৬ বিলিয়ন এবং ১৯৯৫-৯৬ সালে ১২১ বিলিয়ন টাকাতে দাঁড়ায়। শুরু থেকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর হয়ে পড়ে। ১৯৭৯-৮০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বরাদ্দের শতকরা ৭০ ভাগই আসত বৈদেশিক সাহায্য তহবিল হিসেবে। পরবর্তী দু’বছরে বৈদেশিক সাহায্যের অংশ কমে এলেও ৩ বছর পর তা বৃদ্ধি পেয়ে শতকরা ৮০ ভাগে উন্নীত হয়। ১৯৮৭-৮৮ এবং ১৯৯০-৯১ বৎসরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল মোট বরাদ্দের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ। পরবর্তী বৎসরসমূহে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসে ১৯৯৫-৯৬ বছরে শতকরা ৬৬ ভাগ-এ দাঁড়ায়। ২০০০-২০০১ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ১৭৫ বিলিয়ন টাকা যার মধ্যে শতকরা ৪৩ ভাগ বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের মাধ্যমে সংস্থান করা হয়। ২০১১ অর্থবছরে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির শতকরা ২৫.৪ ভাগ বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে সংস্থান করা হয়। তবে, ২০২১ অর্থবছরে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে সংস্থানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৪০.৬ ভাগ এবং ২০২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ ধরা হয়েছে শতকরা ৪৮.৬ ভাগ (চার্ট ১ দেখুন)।
উপরোক্ত চিত্রটি থেকে আমরা দেখতে পাই যে, এডিপিতে দেশীয় সম্পদের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশীয় উৎস থেকে সম্পদ বরাদ্দের এই ধারা অব্যাহত রাখলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে। অন্যদিকে, ২০১০ এবং ২০২২ অর্থবছর ব্যতীত বাহ্যিক উৎসের অর্থ অভ্যন্তরীণ উৎস -এর তুলনায় ততটা তুলনামূলক নয়।
প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল ব্যবহারে ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণে দাতা সংস্থাগুলি প্রায়শ বৈদেশিক সাহায্যের অর্থ ছাড়করণে বিলম্ব করে থাকে। ফলে সরকার কর্তৃক প্রায় প্রতিবছরেই মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি পরিবর্তন করে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নের রেওয়াজ চলে আসছে। অনেক সময় নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্তকরণ অথবা কোন প্রকল্প বাদ দেওয়ার জন্যও মূল এডিপিতে পরিবর্তন সাধন করতে হয়। প্রায়শই প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব অথবা যথাযথ কাঠামোগত সুযোগ সৃষ্টি না করার কারণেও মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সংশোধন করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এছাড়া প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত সমস্যা এবং টাকা কাউন্টার পার্ট তহবিলে ঘাটতির কারণেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সংশোধন করতে হয়। অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কর্তৃক অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়ার ফলে স্থানীয় ও বৈদেশিক মুদ্রার যথাযথ বণ্টনের জন্য এডিপি পরিবর্তন করা হয় এবং ঐসব অতিরিক্ত চাহিদাকৃত অর্থ বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের অপ্রত্যাশিত ব্যয়ের খাত হতে মেটানো হয়। উল্লেখ্য যে, এডিপিতে কোন নির্দিষ্ট বছরের সবগুলি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয় না। কিছু কিছু প্রকল্প এডিপি-বহির্ভূত রাখা হয় এবং নির্দিষ্ট বছরের রাজস্ব বাজেট হতে অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। সকল প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দিষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করে। উক্ত নীতিমালার আলোকে মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া মনিটর করা হয়।
দেশের আর্থসামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, মানব সম্পদের গুণগত মান বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস ও আয় বৃদ্ধির জন্য গৃহীত সুনির্দিষ্ট জাতীয় কৌশলের পটভূমিতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রতিবছরই বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০১১ হতে ২০২১ অর্থবছরে প্রতিটি বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দের পরিমাণ গড়ে ২০ ভাগের অধিক হারে বেড়েছে। বিগত দশকের মধ্যে ২০১৭ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দের অংশ ছিল মোট বাজেটের ২১ ভাগ যা সর্বনিম্ন। এর পর থেকে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ২০২১ অর্থবছরে মোট বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অংশ ছিল শতকরা ৪০.৬ ভাগ। ২০২২ অর্থবছরের জন্য তা শতকরা ৪৮.৫ ভাগ। ধারার সাথে নিজস্ব উৎসের সংস্থান সক্ষমতার ধারা অব্যাহত থাকলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্ননকে ত্বরাণ্বিত করবে।
২০২১ অর্থবছরে এডিপির মোট পরিমাণ টাকা ২.২১ ট্রিলিয়ন। এই অর্থবছরে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দের অংশসহ উক্ত খাতসমূহ হচ্ছে: পরিবহন ও যোগাযোগ (২৫.২%), শিক্ষা ও প্রযুক্তি (১৯.৪%), স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন (১৫.৭%), বিদ্যুত ও জ্বালানি (১২.৪%), কৃষি (৫.৫%) এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ (৩.১%)। এছাড়া বিবিধ খাতে শতকরা ৭.১ ভাগ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এর জন্য ২.৪৬ ট্রিলিয়ন টাকা অনুমোদনের পরিকল্পনা নিয়েছিল এবং এই বাজেটের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মহামারীর বিপর্যয় থেকে অর্থনীতির দ্রুত পুনরুদ্ধার করা। [আবুল কালাম আজাদ]