দনৌজ রায়, রাজা: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:Banglapedia]]
[[Category:Banglapedia]]
'''দনৌজ রায়'''''', ''''''রাজা'''  স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের রাজা। তাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। জিয়াউদ্দিন বরনীর তারিখ''-''''-''ফিরুযশাহী গ্রন্থেই প্রথম তাঁর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, সোনারগাঁয়ের রায় বা রাজা দনৌজ রায় ৬৮১ হিজরিতে (১২৮২ খ্রি.) দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সঙ্গে এক চুক্তি সম্পাদন করেন।  
'''দনৌজ রায়, রাজা'''  স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের রাজা। তাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। জিয়াউদ্দিন বরনীর তারিখ-ই-ফিরুযশাহী গ্রন্থেই প্রথম তাঁর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, সোনারগাঁয়ের রায় বা রাজা দনৌজ রায় ৬৮১ হিজরিতে (১২৮২ খ্রি.) দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সঙ্গে এক চুক্তি সম্পাদন করেন।  


বাংলার নরপতিদের বংশলতিকায় এই দনৌজ রায়ের পরিচয় সম্পর্কিত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। বারো শতকের শেষদিকে অথবা তেরো শতকের প্রথমভাগে কোনো একসময় মেঘনার পূর্ব তীরবর্তী এলাকায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দেব রাজবংশের দশরথদেবের সঙ্গে এই দনৌজ রায়কে অভিন্ন বলে অনুমান করা যায়। দশরথদেবের আদাবাড়ি [[১০২৩৯৫|তাম্রশাসন]] এ ভূমিদানকারী নৃপতিকে পরমেশ্বর, পরম-ভট্টারক মহারাজাধিরাজ অরিরাজ-দনৌজ-মাধব, যশস্বী দশরথদেব রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। দশরথদেবের অরিরাজ''-''দনৌজ''-''মাধব অভিধার নিরীখে ধারণা করা যায় যে, দশরথদেব এবং বাংলার বংশলতিকায় উল্লেখিত নৃপতি দনৌজ মাধব ও সোনারগাঁয়ের রাজা দনৌজ রায় এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। ইদিলপুরের ঘটকরা (বংশলতিকা প্রণেতা) প্রচলিত কাহিনী অনুসরণে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, চন্দ্রদ্বীপে (বর্তমান বৃহত্তর বরিশাল জেলা) একসময় দনৌজ রায় কায়স্থের অধীনে একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই লোককাহিনী অনেকটাই সত্য। এই দনৌজ রায় কায়স্থ সম্ভবত সোনারগাঁয়ের রাজা দনৌজ রায়ের সঙ্গে অভিন্ন।  
বাংলার নরপতিদের বংশলতিকায় এই দনৌজ রায়ের পরিচয় সম্পর্কিত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। বারো শতকের শেষদিকে অথবা তেরো শতকের প্রথমভাগে কোনো একসময় মেঘনার পূর্ব তীরবর্তী এলাকায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দেব রাজবংশের দশরথদেবের সঙ্গে এই দনৌজ রায়কে অভিন্ন বলে অনুমান করা যায়। দশরথদেবের আদাবাড়ি [[তাম্রশাসন|তাম্রশাসন]] এ ভূমিদানকারী নৃপতিকে পরমেশ্বর, পরম-ভট্টারক মহারাজাধিরাজ অরিরাজ-দনৌজ-মাধব, যশস্বী দশরথদেব রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। দশরথদেবের অরিরাজ-দনৌজ-মাধব অভিধার নিরীখে ধারণা করা যায় যে, দশরথদেব এবং বাংলার বংশলতিকায় উল্লেখিত নৃপতি দনৌজ মাধব ও সোনারগাঁয়ের রাজা দনৌজ রায় এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। ইদিলপুরের ঘটকরা (বংশলতিকা প্রণেতা) প্রচলিত কাহিনী অনুসরণে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, চন্দ্রদ্বীপে (বর্তমান বৃহত্তর বরিশাল জেলা) একসময় দনৌজ রায় কায়স্থের অধীনে একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই লোককাহিনী অনেকটাই সত্য। এই দনৌজ রায় কায়স্থ সম্ভবত সোনারগাঁয়ের রাজা দনৌজ রায়ের সঙ্গে অভিন্ন।  


তিনি সম্ভবত তুগ্রিল খানের শাসনামলের পূর্বে সোনারগাঁয়ের নিকটবর্তী সেনরাজাদের অধীনস্থ কোনো এলাকা অধিকার করেন। তুগিল খান ১২৬৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান [[১০১৪৯৪|গিয়াসউদ্দিন বলবন]] কর্তৃক বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। কাজেই চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের স্থপতি দশরথদেব দনৌজ মাধব ১২৬৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে সেনরাজ্যের কিয়দংশ অধিকার করে থাকবেন। মনে হয়, দেববংশের দশরথদেব মেঘনার পূর্ব তীরবর্তী তাঁর পৈত্রিক রাজ্য (বৃহত্তর কুমিল্লা নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলা সমন্বয়ে গঠিত) থেকে অথবা বৃহত্তর বরিশাল জেলায় বিস্তৃত স্বীয় প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য থেকে অভিযান চালিয়ে বিক্রমপুরের সেনরাজ্য অধিকার করেন। যেহেতু আদাবাড়ি তাম্রশাসন বিক্রমপুর থেকে জারি করা হয় এবং এই তাম্রশাসনে দানকৃত ভূমির অবস্থানও ছিল বিক্রমপুরের সন্নিকটে, কাজেই নিঃসন্দেহে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, দশরথদেব পূর্ববঙ্গের সেনরাজ্য অধিকার করেছিলেন। রাজা লক্ষণসেনের বংশধররা সম্ভবত ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করেন। কাজেই দশরথদেব ১২৬০ খ্রিস্টাব্দের পরে কোনো একসময় কেশবসেনের (১২২০-১২২৩) কোনো উত্তরাধিকারীর শাসনামলে বিক্রমপুর অধিকার করে থাকবেন। দশরথদেবের উপর এমন কিছু জাঁকালো উপাধি আরোপ করা হয়েছে যা  '''বিশ্বরূপসেন''' ও কেশবসেনের গৃহীত উপাধির অবিকল নকল। দুই সেন রাজার ’সেনকূল কমল-বিকাশ-ভাস্কর’ উপাধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দশরথদেবকে ভূষিত করা হয়েছে ’দেবন্বয়-কমল-বিকাশ-ভাস্কর’খেতাবে। এ ছাড়াও দশরথদেবের উপাধি ছিল ’অশ্বপতি-গজপতি-নরপতি-রাজত্রয়াধিপতি, সোমবংশ প্রদীপ’। বিশ্বরূপসেন ও [[১০৬১১৬|কেশবসেন]] অনুরূপ উপাধি ধারণ করেন। এরূপে দশরথদেব পতিত রাজবংশের রাজাদের উপাধি নিজে ধারণ করেন।  
তিনি সম্ভবত তুগ্রিল খানের শাসনামলের পূর্বে সোনারগাঁয়ের নিকটবর্তী সেনরাজাদের অধীনস্থ কোনো এলাকা অধিকার করেন। তুগিল খান ১২৬৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান [[গিয়াসউদ্দিন বলবন|গিয়াসউদ্দিন বলবন]] কর্তৃক বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। কাজেই চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের স্থপতি দশরথদেব দনৌজ মাধব ১২৬৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে সেনরাজ্যের কিয়দংশ অধিকার করে থাকবেন। মনে হয়, দেববংশের দশরথদেব মেঘনার পূর্ব তীরবর্তী তাঁর পৈত্রিক রাজ্য (বৃহত্তর কুমিল্লা নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলা সমন্বয়ে গঠিত) থেকে অথবা বৃহত্তর বরিশাল জেলায় বিস্তৃত স্বীয় প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য থেকে অভিযান চালিয়ে বিক্রমপুরের সেনরাজ্য অধিকার করেন। যেহেতু আদাবাড়ি তাম্রশাসন বিক্রমপুর থেকে জারি করা হয় এবং এই তাম্রশাসনে দানকৃত ভূমির অবস্থানও ছিল বিক্রমপুরের সন্নিকটে, কাজেই নিঃসন্দেহে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, দশরথদেব পূর্ববঙ্গের সেনরাজ্য অধিকার করেছিলেন। রাজা লক্ষণসেনের বংশধররা সম্ভবত ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করেন। কাজেই দশরথদেব ১২৬০ খ্রিস্টাব্দের পরে কোনো একসময় কেশবসেনের (১২২০-১২২৩) কোনো উত্তরাধিকারীর শাসনামলে বিক্রমপুর অধিকার করে থাকবেন। দশরথদেবের উপর এমন কিছু জাঁকালো উপাধি আরোপ করা হয়েছে যা  বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেনের গৃহীত উপাধির অবিকল নকল। দুই সেন রাজার ’সেনকূল কমল-বিকাশ-ভাস্কর’ উপাধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দশরথদেবকে ভূষিত করা হয়েছে ’দেবন্বয়-কমল-বিকাশ-ভাস্কর’খেতাবে। এ ছাড়াও দশরথদেবের উপাধি ছিল ’অশ্বপতি-গজপতি-নরপতি-রাজত্রয়াধিপতি, সোমবংশ প্রদীপ’। বিশ্বরূপসেন ও [[১০৬১১৬|কেশবসেন]] অনুরূপ উপাধি ধারণ করেন। এরূপে দশরথদেব পতিত রাজবংশের রাজাদের উপাধি নিজে ধারণ করেন।  


এটাই স্বাভাবিক যে, পূর্ববঙ্গ থেকে সেনদের বিতাড়নের পর দশরথদেব সেনদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী বিক্রমপুরে তাঁর প্রশাসনিক দপ্তর স্থাপন করেন এবং সেখান থেকেই তাঁর ভূমিদান লিপি জারি করা হয়। দশরথদেবের রাজত্বের তৃতীয় বর্ষে ভূমিদান মঞ্জুরী প্রদান করা হয়। দশরথদেব পরে বিক্রমপুর থেকে সুবর্ণগ্রামে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন। ঐ সময় সুবর্ণগ্রাম সম্ভবত ছিল বিক্রমপুর ভাগের একটি অংশ। অতএব এটা স্পষ্ট যে, সেনরাজ্যে তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠার পর তিনি অন্তত তিন বছর রাজধানী বিক্রমপুর থেকে রাজ্য শাসন করেন। এমন হতে পারে যে, মুসলিম অধিকার সম্প্রসারণের মোকাবিলায় পূর্ব বাংলায় তাঁর আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখার ক্ষেত্রে দশরথদেব তাঁর রাজধানী বিক্রমপুর থেকে কতকটা প্রতিরক্ষা ও সামরিক কৌশলগত অসুবিধার সম্মুখীন হন এবং তাঁর রাজধানী হিসেবে বেছে নেন শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা নদী বেষ্টিত প্রায় দুর্গম এবং সামরিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল সুবর্ণগ্রামকে।
এটাই স্বাভাবিক যে, পূর্ববঙ্গ থেকে সেনদের বিতাড়নের পর দশরথদেব সেনদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী বিক্রমপুরে তাঁর প্রশাসনিক দপ্তর স্থাপন করেন এবং সেখান থেকেই তাঁর ভূমিদান লিপি জারি করা হয়। দশরথদেবের রাজত্বের তৃতীয় বর্ষে ভূমিদান মঞ্জুরী প্রদান করা হয়। দশরথদেব পরে বিক্রমপুর থেকে সুবর্ণগ্রামে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন। ঐ সময় সুবর্ণগ্রাম সম্ভবত ছিল বিক্রমপুর ভাগের একটি অংশ। অতএব এটা স্পষ্ট যে, সেনরাজ্যে তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠার পর তিনি অন্তত তিন বছর রাজধানী বিক্রমপুর থেকে রাজ্য শাসন করেন। এমন হতে পারে যে, মুসলিম অধিকার সম্প্রসারণের মোকাবিলায় পূর্ব বাংলায় তাঁর আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখার ক্ষেত্রে দশরথদেব তাঁর রাজধানী বিক্রমপুর থেকে কতকটা প্রতিরক্ষা ও সামরিক কৌশলগত অসুবিধার সম্মুখীন হন এবং তাঁর রাজধানী হিসেবে বেছে নেন শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা নদী বেষ্টিত প্রায় দুর্গম এবং সামরিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল সুবর্ণগ্রামকে।


জিয়াউদ্দিন বারানির তারিখ''-''''-''ফিরূযশাহী গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, রাজা দনৌজ রায় ৬৮১ হিজরিতে (১২৮২ খ্রি) দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সঙ্গে এক চুক্তিপত্র (আহাদনামা) সম্পাদন করেন। চুক্তিপত্রে দনৌজ রায় সুলতানকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, [[১০৫৩৬১|লখনৌতি]] এর বিদ্রোহী শাসনকর্তা যাতে নদীপথে পালিয়ে যেতে না পারেন সে লক্ষ্যে তিনি নদীপথে প্রহরার ব্যবস্থা করবেন। সুলতান বলবন তাঁর বিদ্রোহী শাসনকর্তা তুগ্রিল খানকে শাস্তি দানের জন্য স্বয়ং বাংলায় অভিযান করেন। তিনি ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁর উপকণ্ঠে পৌঁছেন এবং সম্ভবত সোনারগাঁর রাজার সঙ্গে দূত বিনিময় করেন যাতে তারা তাদের উভয়ের শত্রু তুগ্রিল খানের বিরুদ্ধে যৌথ সমরাভিযান করতে পারেন। তুগ্রিল খান যাতে নদীপথে পালিয়ে যেতে না পারেন সে লক্ষ্যে নদী তীরবর্তী এলাকায় প্রহরার জন্য বলবন দনৌজ রায়ের সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করেন। অন্যদিকে লরিকল (কালীগঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী) পর্যন্ত বিস্তৃত পদ্মার দুই কূলবর্তী এলাকা অধিকার করে তুগ্রিলের ক্ষমতা বৃদ্ধি, সোনারগাঁয়ের সন্নিকটে তাঁর দুর্ভেদ্য নারকিলাহ দূর্গের অবস্থান এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সোনারগাঁয়ের রাজাকে অনেকটা কোনঠাসা করে ফেলেছিল।  
জিয়াউদ্দিন বারানির তারিখ-ই-ফিরূযশাহী গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, রাজা দনৌজ রায় ৬৮১ হিজরিতে (১২৮২ খ্রি) দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সঙ্গে এক চুক্তিপত্র (আহাদনামা) সম্পাদন করেন। চুক্তিপত্রে দনৌজ রায় সুলতানকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, [[লখনৌতি|লখনৌতি]] এর বিদ্রোহী শাসনকর্তা যাতে নদীপথে পালিয়ে যেতে না পারেন সে লক্ষ্যে তিনি নদীপথে প্রহরার ব্যবস্থা করবেন। সুলতান বলবন তাঁর বিদ্রোহী শাসনকর্তা তুগ্রিল খানকে শাস্তি দানের জন্য স্বয়ং বাংলায় অভিযান করেন। তিনি ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁর উপকণ্ঠে পৌঁছেন এবং সম্ভবত সোনারগাঁর রাজার সঙ্গে দূত বিনিময় করেন যাতে তারা তাদের উভয়ের শত্রু তুগ্রিল খানের বিরুদ্ধে যৌথ সমরাভিযান করতে পারেন। তুগ্রিল খান যাতে নদীপথে পালিয়ে যেতে না পারেন সে লক্ষ্যে নদী তীরবর্তী এলাকায় প্রহরার জন্য বলবন দনৌজ রায়ের সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করেন। অন্যদিকে লরিকল (কালীগঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী) পর্যন্ত বিস্তৃত পদ্মার দুই কূলবর্তী এলাকা অধিকার করে তুগ্রিলের ক্ষমতা বৃদ্ধি, সোনারগাঁয়ের সন্নিকটে তাঁর দুর্ভেদ্য নারকিলাহ দূর্গের অবস্থান এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সোনারগাঁয়ের রাজাকে অনেকটা কোনঠাসা করে ফেলেছিল।  


সমগ্র পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে দনৌজ রায়ের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। জিয়াউদ্দিন বারানির একটি মন্তব্য থেকে এর পরোক্ষ সমর্থন মেলে। বারানি বলেছেন যে, বাংলায় অভিযান শেষে বলবন যখন দিল্লিতে ফিরে যান (১২৮২ খ্রি) তখনও দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। আদাবাড়ি তাম্রলিপির ভাষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দশরথদেব পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তরবঙ্গে কয়েকবারই সফল অভিযান পরিচালনা করেন এবং মুসলিম অধিকৃত এলাকার কিয়দংশ জয় করেন।
সমগ্র পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে দনৌজ রায়ের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। জিয়াউদ্দিন বারানির একটি মন্তব্য থেকে এর পরোক্ষ সমর্থন মেলে। বারানি বলেছেন যে, বাংলায় অভিযান শেষে বলবন যখন দিল্লিতে ফিরে যান (১২৮২ খ্রি) তখনও দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। আদাবাড়ি তাম্রলিপির ভাষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দশরথদেব পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তরবঙ্গে কয়েকবারই সফল অভিযান পরিচালনা করেন এবং মুসলিম অধিকৃত এলাকার কিয়দংশ জয় করেন।
১৪ নং লাইন: ১৪ নং লাইন:
সেনবংশীয় রাজা বল্লালসেন ব্রাহ্ম্যসমাজে  কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন করেন। পরবর্তী  সময়ে এ প্রথায় সাময়িক শ্রেণিবিন্যাসের একটি প্রক্রিয়া চালু হয়। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয়েছে ’সমীকরণ’। এরূপ প্রথম দুটি সমীকরণ সম্পন্ন হয় রাজা লক্ষণসেনের শাসনকালে এবং পরবর্তী চারটি সমীকরণ ঘটে দনৌজ মাধবের শাসনামলে। কৌলিন্য প্রথার এই সমীকরণের আওতায় দনৌজ মাধব কায়স্থদের অন্তর্ভুক্ত করেন বলেও অভিমত রয়েছে। তিনি কৌলিন্য প্রথার কিছু বিধিবিধান সংস্কার করেন এবং নতুন কিছু বিধান চালু করেন। প্রখ্যাত বংশলিপিকার ও পন্ডিত হরিমিশ্র রাজা দনৌজ মাধবের সভাসদ ছিলেন। তেরো শতকে রচিত বংশলিপির মধ্যে হরিমিশ্র রচিত কারিকা পুরাণ সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য।  
সেনবংশীয় রাজা বল্লালসেন ব্রাহ্ম্যসমাজে  কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন করেন। পরবর্তী  সময়ে এ প্রথায় সাময়িক শ্রেণিবিন্যাসের একটি প্রক্রিয়া চালু হয়। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয়েছে ’সমীকরণ’। এরূপ প্রথম দুটি সমীকরণ সম্পন্ন হয় রাজা লক্ষণসেনের শাসনকালে এবং পরবর্তী চারটি সমীকরণ ঘটে দনৌজ মাধবের শাসনামলে। কৌলিন্য প্রথার এই সমীকরণের আওতায় দনৌজ মাধব কায়স্থদের অন্তর্ভুক্ত করেন বলেও অভিমত রয়েছে। তিনি কৌলিন্য প্রথার কিছু বিধিবিধান সংস্কার করেন এবং নতুন কিছু বিধান চালু করেন। প্রখ্যাত বংশলিপিকার ও পন্ডিত হরিমিশ্র রাজা দনৌজ মাধবের সভাসদ ছিলেন। তেরো শতকে রচিত বংশলিপির মধ্যে হরিমিশ্র রচিত কারিকা পুরাণ সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য।  


বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস ও মতাদর্শের প্রতি দনৌজ রায় উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। সেন রাজাদের শাসনামলে ক্রমবর্ধমান বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিগত নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে দনৌজ রায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। তেরো শতকের শেষ পাদে তাঁর রাজধানী শহরের উপকণ্ঠে ইসলামী ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ মওলানা [[১০৫৪৯২|শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা]] কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শিক্ষার বিখ্যাত পাদপীঠ এক মাদ্রাসার শ্রীবৃদ্ধি ও বিকাশ দনৌজ রায়ের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অসাম্প্রদায়িক নীতির সাক্ষ্য বহন করছে। স্বয়ং বৈষ্ণব মতাবলম্বী দনৌজ রায় বৈষ্ণব মতাদর্শকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন যাতে এই ধর্মবিশ্বাস তাঁর রাজ্যে প্রাধান্য লাভ করে। এমনটি ধারণা করা যায় যে, দনৌজ রায় সোনারগাঁয়ে সুফি মতবাদ ও বৈষ্ণব ভাবধারার মধ্যে মিথষ্ক্রিয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, যার ফলে একসময় সোনারগাঁ বৈষ্ণব  সাধকদের মিলনমেলা এবং মুসলিম ফকির ও সুফিদের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।  
বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস ও মতাদর্শের প্রতি দনৌজ রায় উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। সেন রাজাদের শাসনামলে ক্রমবর্ধমান বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিগত নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে দনৌজ রায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। তেরো শতকের শেষ পাদে তাঁর রাজধানী শহরের উপকণ্ঠে ইসলামী ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ মওলানা [[শরফুদ্দীন আবু তওয়ামা|শরফুদ্দীন আবু তওয়ামা]] কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শিক্ষার বিখ্যাত পাদপীঠ এক মাদ্রাসার শ্রীবৃদ্ধি ও বিকাশ দনৌজ রায়ের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অসাম্প্রদায়িক নীতির সাক্ষ্য বহন করছে। স্বয়ং বৈষ্ণব মতাবলম্বী দনৌজ রায় বৈষ্ণব মতাদর্শকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন যাতে এই ধর্মবিশ্বাস তাঁর রাজ্যে প্রাধান্য লাভ করে। এমনটি ধারণা করা যায় যে, দনৌজ রায় সোনারগাঁয়ে সুফি মতবাদ ও বৈষ্ণব ভাবধারার মধ্যে মিথষ্ক্রিয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, যার ফলে একসময় সোনারগাঁ বৈষ্ণব  সাধকদের মিলনমেলা এবং মুসলিম ফকির ও সুফিদের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।  


আমাদের জানামতে দনৌজ রায় ছিলেন পূর্ব বাংলার শেষ হিন্দু রাজা। ১২৮২ খ্রিস্টাব্দের পরে দনৌজ রায় সম্পর্কে তেমন বিশেষ কিছু জানা না গেলেও, এটা খুবই সম্ভব যে তিনি আরও কয়েক বছর সোনারগাঁয়ে রাজত্ব করেন, এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। সম্ভবত তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী সোনারগাঁ শাসন করেন এবং তিনিই ১৩০২ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম আক্রমণের মোকাবিলা করেন। মুসলিম অভিযানে সোনারগাঁয়ের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলায় স্বাধীন হিন্দু রাজত্বের অবসান ঘটে।  [মুয়ায্যম হুসায়ন খান]
আমাদের জানামতে দনৌজ রায় ছিলেন পূর্ব বাংলার শেষ হিন্দু রাজা। ১২৮২ খ্রিস্টাব্দের পরে দনৌজ রায় সম্পর্কে তেমন বিশেষ কিছু জানা না গেলেও, এটা খুবই সম্ভব যে তিনি আরও কয়েক বছর সোনারগাঁয়ে রাজত্ব করেন, এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। সম্ভবত তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী সোনারগাঁ শাসন করেন এবং তিনিই ১৩০২ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম আক্রমণের মোকাবিলা করেন। মুসলিম অভিযানে সোনারগাঁয়ের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলায় স্বাধীন হিন্দু রাজত্বের অবসান ঘটে।  [মুয়ায্যম হুসায়ন খান]


'''গ্রন্থপঞ্জি ''' Ziauddin Barani, ''Tarikh-i-Firuzshahi'', English translation in ''The History of India as Told by its own Historians'' by Elliot and Dowson, vol. iii, Allahabad, 1970; Jadu-nath Sarkar (ed), ''The History of Bengal'', vol. ii, Dhaka, 1948; Muazzam Hussain Khan, ''Thousand Years of Sonarganw'', Dhaka, 2009.
'''গ্রন্থপঞ্জি''' Ziauddin Barani, ''Tarikh-i-Firuzshahi'', English translation in ''The History of India as Told by its own Historians'' by Elliot and Dowson, vol. iii, Allahabad, 1970; Jadu-nath Sarkar (ed), ''The History of Bengal'', vol. ii, Dhaka, 1948; Muazzam Hussain Khan, ''Thousand Years of Sonarganw'', Dhaka, 2009.


<!-- imported from file: দনৌজ রায়, রাজা.html-->


[[en:Danauja Rai, Raja]]
[[en:Danauja Rai, Raja]]

০৫:৪৮, ৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

দনৌজ রায়, রাজা  স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের রাজা। তাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। জিয়াউদ্দিন বরনীর তারিখ-ই-ফিরুযশাহী গ্রন্থেই প্রথম তাঁর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, সোনারগাঁয়ের রায় বা রাজা দনৌজ রায় ৬৮১ হিজরিতে (১২৮২ খ্রি.) দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সঙ্গে এক চুক্তি সম্পাদন করেন।

বাংলার নরপতিদের বংশলতিকায় এই দনৌজ রায়ের পরিচয় সম্পর্কিত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। বারো শতকের শেষদিকে অথবা তেরো শতকের প্রথমভাগে কোনো একসময় মেঘনার পূর্ব তীরবর্তী এলাকায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দেব রাজবংশের দশরথদেবের সঙ্গে এই দনৌজ রায়কে অভিন্ন বলে অনুমান করা যায়। দশরথদেবের আদাবাড়ি তাম্রশাসন এ ভূমিদানকারী নৃপতিকে পরমেশ্বর, পরম-ভট্টারক মহারাজাধিরাজ অরিরাজ-দনৌজ-মাধব, যশস্বী দশরথদেব রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। দশরথদেবের অরিরাজ-দনৌজ-মাধব অভিধার নিরীখে ধারণা করা যায় যে, দশরথদেব এবং বাংলার বংশলতিকায় উল্লেখিত নৃপতি দনৌজ মাধব ও সোনারগাঁয়ের রাজা দনৌজ রায় এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। ইদিলপুরের ঘটকরা (বংশলতিকা প্রণেতা) প্রচলিত কাহিনী অনুসরণে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, চন্দ্রদ্বীপে (বর্তমান বৃহত্তর বরিশাল জেলা) একসময় দনৌজ রায় কায়স্থের অধীনে একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই লোককাহিনী অনেকটাই সত্য। এই দনৌজ রায় কায়স্থ সম্ভবত সোনারগাঁয়ের রাজা দনৌজ রায়ের সঙ্গে অভিন্ন।

তিনি সম্ভবত তুগ্রিল খানের শাসনামলের পূর্বে সোনারগাঁয়ের নিকটবর্তী সেনরাজাদের অধীনস্থ কোনো এলাকা অধিকার করেন। তুগিল খান ১২৬৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন কর্তৃক বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। কাজেই চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের স্থপতি দশরথদেব দনৌজ মাধব ১২৬৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে সেনরাজ্যের কিয়দংশ অধিকার করে থাকবেন। মনে হয়, দেববংশের দশরথদেব মেঘনার পূর্ব তীরবর্তী তাঁর পৈত্রিক রাজ্য (বৃহত্তর কুমিল্লা নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলা সমন্বয়ে গঠিত) থেকে অথবা বৃহত্তর বরিশাল জেলায় বিস্তৃত স্বীয় প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য থেকে অভিযান চালিয়ে বিক্রমপুরের সেনরাজ্য অধিকার করেন। যেহেতু আদাবাড়ি তাম্রশাসন বিক্রমপুর থেকে জারি করা হয় এবং এই তাম্রশাসনে দানকৃত ভূমির অবস্থানও ছিল বিক্রমপুরের সন্নিকটে, কাজেই নিঃসন্দেহে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, দশরথদেব পূর্ববঙ্গের সেনরাজ্য অধিকার করেছিলেন। রাজা লক্ষণসেনের বংশধররা সম্ভবত ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করেন। কাজেই দশরথদেব ১২৬০ খ্রিস্টাব্দের পরে কোনো একসময় কেশবসেনের (১২২০-১২২৩) কোনো উত্তরাধিকারীর শাসনামলে বিক্রমপুর অধিকার করে থাকবেন। দশরথদেবের উপর এমন কিছু জাঁকালো উপাধি আরোপ করা হয়েছে যা  বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেনের গৃহীত উপাধির অবিকল নকল। দুই সেন রাজার ’সেনকূল কমল-বিকাশ-ভাস্কর’ উপাধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দশরথদেবকে ভূষিত করা হয়েছে ’দেবন্বয়-কমল-বিকাশ-ভাস্কর’খেতাবে। এ ছাড়াও দশরথদেবের উপাধি ছিল ’অশ্বপতি-গজপতি-নরপতি-রাজত্রয়াধিপতি, সোমবংশ প্রদীপ’। বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন অনুরূপ উপাধি ধারণ করেন। এরূপে দশরথদেব পতিত রাজবংশের রাজাদের উপাধি নিজে ধারণ করেন।

এটাই স্বাভাবিক যে, পূর্ববঙ্গ থেকে সেনদের বিতাড়নের পর দশরথদেব সেনদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী বিক্রমপুরে তাঁর প্রশাসনিক দপ্তর স্থাপন করেন এবং সেখান থেকেই তাঁর ভূমিদান লিপি জারি করা হয়। দশরথদেবের রাজত্বের তৃতীয় বর্ষে ভূমিদান মঞ্জুরী প্রদান করা হয়। দশরথদেব পরে বিক্রমপুর থেকে সুবর্ণগ্রামে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন। ঐ সময় সুবর্ণগ্রাম সম্ভবত ছিল বিক্রমপুর ভাগের একটি অংশ। অতএব এটা স্পষ্ট যে, সেনরাজ্যে তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠার পর তিনি অন্তত তিন বছর রাজধানী বিক্রমপুর থেকে রাজ্য শাসন করেন। এমন হতে পারে যে, মুসলিম অধিকার সম্প্রসারণের মোকাবিলায় পূর্ব বাংলায় তাঁর আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখার ক্ষেত্রে দশরথদেব তাঁর রাজধানী বিক্রমপুর থেকে কতকটা প্রতিরক্ষা ও সামরিক কৌশলগত অসুবিধার সম্মুখীন হন এবং তাঁর রাজধানী হিসেবে বেছে নেন শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা নদী বেষ্টিত প্রায় দুর্গম এবং সামরিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল সুবর্ণগ্রামকে।

জিয়াউদ্দিন বারানির তারিখ-ই-ফিরূযশাহী গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, রাজা দনৌজ রায় ৬৮১ হিজরিতে (১২৮২ খ্রি) দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সঙ্গে এক চুক্তিপত্র (আহাদনামা) সম্পাদন করেন। চুক্তিপত্রে দনৌজ রায় সুলতানকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, লখনৌতি এর বিদ্রোহী শাসনকর্তা যাতে নদীপথে পালিয়ে যেতে না পারেন সে লক্ষ্যে তিনি নদীপথে প্রহরার ব্যবস্থা করবেন। সুলতান বলবন তাঁর বিদ্রোহী শাসনকর্তা তুগ্রিল খানকে শাস্তি দানের জন্য স্বয়ং বাংলায় অভিযান করেন। তিনি ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁর উপকণ্ঠে পৌঁছেন এবং সম্ভবত সোনারগাঁর রাজার সঙ্গে দূত বিনিময় করেন যাতে তারা তাদের উভয়ের শত্রু তুগ্রিল খানের বিরুদ্ধে যৌথ সমরাভিযান করতে পারেন। তুগ্রিল খান যাতে নদীপথে পালিয়ে যেতে না পারেন সে লক্ষ্যে নদী তীরবর্তী এলাকায় প্রহরার জন্য বলবন দনৌজ রায়ের সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করেন। অন্যদিকে লরিকল (কালীগঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী) পর্যন্ত বিস্তৃত পদ্মার দুই কূলবর্তী এলাকা অধিকার করে তুগ্রিলের ক্ষমতা বৃদ্ধি, সোনারগাঁয়ের সন্নিকটে তাঁর দুর্ভেদ্য নারকিলাহ দূর্গের অবস্থান এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সোনারগাঁয়ের রাজাকে অনেকটা কোনঠাসা করে ফেলেছিল।

সমগ্র পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে দনৌজ রায়ের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। জিয়াউদ্দিন বারানির একটি মন্তব্য থেকে এর পরোক্ষ সমর্থন মেলে। বারানি বলেছেন যে, বাংলায় অভিযান শেষে বলবন যখন দিল্লিতে ফিরে যান (১২৮২ খ্রি) তখনও দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। আদাবাড়ি তাম্রলিপির ভাষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দশরথদেব পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তরবঙ্গে কয়েকবারই সফল অভিযান পরিচালনা করেন এবং মুসলিম অধিকৃত এলাকার কিয়দংশ জয় করেন।

সেনবংশীয় রাজা বল্লালসেন ব্রাহ্ম্যসমাজে  কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন করেন। পরবর্তী  সময়ে এ প্রথায় সাময়িক শ্রেণিবিন্যাসের একটি প্রক্রিয়া চালু হয়। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয়েছে ’সমীকরণ’। এরূপ প্রথম দুটি সমীকরণ সম্পন্ন হয় রাজা লক্ষণসেনের শাসনকালে এবং পরবর্তী চারটি সমীকরণ ঘটে দনৌজ মাধবের শাসনামলে। কৌলিন্য প্রথার এই সমীকরণের আওতায় দনৌজ মাধব কায়স্থদের অন্তর্ভুক্ত করেন বলেও অভিমত রয়েছে। তিনি কৌলিন্য প্রথার কিছু বিধিবিধান সংস্কার করেন এবং নতুন কিছু বিধান চালু করেন। প্রখ্যাত বংশলিপিকার ও পন্ডিত হরিমিশ্র রাজা দনৌজ মাধবের সভাসদ ছিলেন। তেরো শতকে রচিত বংশলিপির মধ্যে হরিমিশ্র রচিত কারিকা পুরাণ সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য।

বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস ও মতাদর্শের প্রতি দনৌজ রায় উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। সেন রাজাদের শাসনামলে ক্রমবর্ধমান বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিগত নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে দনৌজ রায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। তেরো শতকের শেষ পাদে তাঁর রাজধানী শহরের উপকণ্ঠে ইসলামী ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ মওলানা শরফুদ্দীন আবু তওয়ামা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শিক্ষার বিখ্যাত পাদপীঠ এক মাদ্রাসার শ্রীবৃদ্ধি ও বিকাশ দনৌজ রায়ের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অসাম্প্রদায়িক নীতির সাক্ষ্য বহন করছে। স্বয়ং বৈষ্ণব মতাবলম্বী দনৌজ রায় বৈষ্ণব মতাদর্শকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন যাতে এই ধর্মবিশ্বাস তাঁর রাজ্যে প্রাধান্য লাভ করে। এমনটি ধারণা করা যায় যে, দনৌজ রায় সোনারগাঁয়ে সুফি মতবাদ ও বৈষ্ণব ভাবধারার মধ্যে মিথষ্ক্রিয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, যার ফলে একসময় সোনারগাঁ বৈষ্ণব  সাধকদের মিলনমেলা এবং মুসলিম ফকির ও সুফিদের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।

আমাদের জানামতে দনৌজ রায় ছিলেন পূর্ব বাংলার শেষ হিন্দু রাজা। ১২৮২ খ্রিস্টাব্দের পরে দনৌজ রায় সম্পর্কে তেমন বিশেষ কিছু জানা না গেলেও, এটা খুবই সম্ভব যে তিনি আরও কয়েক বছর সোনারগাঁয়ে রাজত্ব করেন, এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। সম্ভবত তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী সোনারগাঁ শাসন করেন এবং তিনিই ১৩০২ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম আক্রমণের মোকাবিলা করেন। মুসলিম অভিযানে সোনারগাঁয়ের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলায় স্বাধীন হিন্দু রাজত্বের অবসান ঘটে।  [মুয়ায্যম হুসায়ন খান]

গ্রন্থপঞ্জি Ziauddin Barani, Tarikh-i-Firuzshahi, English translation in The History of India as Told by its own Historians by Elliot and Dowson, vol. iii, Allahabad, 1970; Jadu-nath Sarkar (ed), The History of Bengal, vol. ii, Dhaka, 1948; Muazzam Hussain Khan, Thousand Years of Sonarganw, Dhaka, 2009.