হরিণ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
৫ নং লাইন: | ৫ নং লাইন: | ||
হরিণেরা নিশাচর বা দিবাচর। ঘাস, লতাপাতা ও ফুলফল এদের প্রধান খাদ্য। এরা ছোট ছোট দলে বাস করে। এক-দুই বছরেই যৌনতাপ্রাপ্তি ঘটে। সাত-আট মাস গর্ভধারণের পর একটি, দৈবাৎ দুটি বাচ্চা প্রসব করে। | হরিণেরা নিশাচর বা দিবাচর। ঘাস, লতাপাতা ও ফুলফল এদের প্রধান খাদ্য। এরা ছোট ছোট দলে বাস করে। এক-দুই বছরেই যৌনতাপ্রাপ্তি ঘটে। সাত-আট মাস গর্ভধারণের পর একটি, দৈবাৎ দুটি বাচ্চা প্রসব করে। | ||
পুরুষ হরিণের ওপরের পাটির কর্তন দাঁত লম্বা, পুরুষ হরিণের মাথার শিং (pedicle) খুব ছোট। হরিণীর শিং নেই, শুধুই লোমে-ঢাকা বৃন্তিকা। দেহের রং নানা রকম, গাঢ়-বাদামি থেকে হলদেটে কিংবা ধূসর-বাদামি আর তাতে হালকা হলুদ বা সাদা দাগ, পেটের দিক প্রায় সাদা। শরীর ছোট নরম লোমে ঢাকা, কানে সামান্য ছড়ানো লোম আছে। ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, নেপাল থেকে দক্ষিণ চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার (সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও) বনেজঙ্গলে মায়াহরিণের বাস। বাংলাদেশে সুন্দরবন, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখা যায়। বন ও গভীর জঙ্গলই এদের পছন্দ। ঘাস খাওয়ার জন্য বনের কিনারে বা খোলা জায়গায় আসে। নিশাচর ও নিঃসঙ্গ, কিন্তু প্রায়ই একসঙ্গে ২-৩টি দেখা যায়। চলে ধীরে ও সতর্কভাবে। কখনও ঠায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। খায় পাতা, কুঁড়ি, ঘাস ও বুনো ফল। | [[Image:DeerBarking.jpg|thumb|400px|right|মায়াহরিণ]] | ||
'''''মায়াহরিণ''''' (Barking deer) ছোটখাটো আকারের হরিণ ''Muntiacus muntjac''। কাঁধ পর্যন্ত উচ্চতা মাত্র ৪০-৬২ সেমি। পুরুষ হরিণের ওপরের পাটির কর্তন দাঁত লম্বা, পুরুষ হরিণের মাথার শিং (pedicle) খুব ছোট। হরিণীর শিং নেই, শুধুই লোমে-ঢাকা বৃন্তিকা। দেহের রং নানা রকম, গাঢ়-বাদামি থেকে হলদেটে কিংবা ধূসর-বাদামি আর তাতে হালকা হলুদ বা সাদা দাগ, পেটের দিক প্রায় সাদা। শরীর ছোট নরম লোমে ঢাকা, কানে সামান্য ছড়ানো লোম আছে। ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, নেপাল থেকে দক্ষিণ চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার (সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও) বনেজঙ্গলে মায়াহরিণের বাস। বাংলাদেশে সুন্দরবন, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখা যায়। বন ও গভীর জঙ্গলই এদের পছন্দ। ঘাস খাওয়ার জন্য বনের কিনারে বা খোলা জায়গায় আসে। নিশাচর ও নিঃসঙ্গ, কিন্তু প্রায়ই একসঙ্গে ২-৩টি দেখা যায়। চলে ধীরে ও সতর্কভাবে। কখনও ঠায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। খায় পাতা, কুঁড়ি, ঘাস ও বুনো ফল। | |||
দূর থেকে মায়াহরিণের ডাক কুকুরের ডাকের মতো শোনায়। ভয় পেলে ভাঙা ভাঙা স্বরে চেঁচায়। হরিণী প্রজনন মরসুমে ডাকে তীক্ষ্ণ মিউ মিউ স্বরে এবং হরিণ ঘণ্টাধ্বনির শব্দে। এক বছরের মধ্যেই হরিণী প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে। গর্ভকাল প্রায় ৭ মাস। সাধারণত ১-২টি বাচ্চা প্রসব করে। | দূর থেকে মায়াহরিণের ডাক কুকুরের ডাকের মতো শোনায়। ভয় পেলে ভাঙা ভাঙা স্বরে চেঁচায়। হরিণী প্রজনন মরসুমে ডাকে তীক্ষ্ণ মিউ মিউ স্বরে এবং হরিণ ঘণ্টাধ্বনির শব্দে। এক বছরের মধ্যেই হরিণী প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে। গর্ভকাল প্রায় ৭ মাস। সাধারণত ১-২টি বাচ্চা প্রসব করে। | ||
[[Image:DeerSambar.jpg|thumb|400px|সাম্বার]] | [[Image:DeerSambar.jpg|thumb|400px|left|সাম্বার]] | ||
'''সাম্বার''' (Sambar) হরিণ গোষ্ঠীর আরেক সদস্য সাম্বার (''Cerveus unicolor'') উপমহাদেশের বৃহত্তম হরিণ, ঘাড়ের কাছে উচ্চতা ১৫০ সেমি, লোম পুরু ও রুক্ষ। পুরুষ সাম্বারের ঘাড় ও গলার কাছাকাছি কেশর গজায়। গরমের সময় এদের শরীর থেকে অধিকাংশ লোম ঝরে যায়। সাধারণত সাম্বারের গায়ের রং হলুদাভ বা নীলচে আভাযুক্ত ধূসর। বুক ও উদরের রং অপেক্ষাকৃত ফ্যাকাশে। বয়স্ক সাম্বারের দেহের রং ক্রমে কালো হতে থাকে, কখনও প্রায় কালো হয়ে যায়। শিং অন্য সব হরিণের শিঙের চেয়ে জাঁকাল, মজবুত ও রুক্ষ। | '''''সাম্বার''''' (Sambar) হরিণ গোষ্ঠীর আরেক সদস্য সাম্বার (''Cerveus unicolor'') উপমহাদেশের বৃহত্তম হরিণ, ঘাড়ের কাছে উচ্চতা ১৫০ সেমি, লোম পুরু ও রুক্ষ। পুরুষ সাম্বারের ঘাড় ও গলার কাছাকাছি কেশর গজায়। গরমের সময় এদের শরীর থেকে অধিকাংশ লোম ঝরে যায়। সাধারণত সাম্বারের গায়ের রং হলুদাভ বা নীলচে আভাযুক্ত ধূসর। বুক ও উদরের রং অপেক্ষাকৃত ফ্যাকাশে। বয়স্ক সাম্বারের দেহের রং ক্রমে কালো হতে থাকে, কখনও প্রায় কালো হয়ে যায়। শিং অন্য সব হরিণের শিঙের চেয়ে জাঁকাল, মজবুত ও রুক্ষ। | ||
বাংলাদেশ ছাড়াও সাম্বার ভারত, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার ও মালয় দেশসমূহের মধ্য দিয়ে পূর্ব ফিলিপাইন পর্যন্ত বিস্তৃত। এই হরিণ বৃক্ষবহুল ও ঘন বনাঞ্চলে এবং ফসলের জমির কাছাকাছি পাহাড়ি এলাকায় থাকতে পছন্দ করে ও ৪-২০টি একত্রে চলে। বাংলাদেশের উত্তরে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও সিলেটের চিরহরিৎ বনাঞ্চলে এদের দেখা যায়। সাম্বারের দৃষ্টিশক্তি মাঝারি এবং শ্রবণশক্তি তীক্ষ্ণ। স্বভাবগতভাবে এরা লাজুক এবং ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নিঃশব্দে চলে, সানন্দে পানিতে নামে ও শরীর ডুবিয়ে সাঁতার কাটে। | বাংলাদেশ ছাড়াও সাম্বার ভারত, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার ও মালয় দেশসমূহের মধ্য দিয়ে পূর্ব ফিলিপাইন পর্যন্ত বিস্তৃত। এই হরিণ বৃক্ষবহুল ও ঘন বনাঞ্চলে এবং ফসলের জমির কাছাকাছি পাহাড়ি এলাকায় থাকতে পছন্দ করে ও ৪-২০টি একত্রে চলে। বাংলাদেশের উত্তরে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও সিলেটের চিরহরিৎ বনাঞ্চলে এদের দেখা যায়। সাম্বারের দৃষ্টিশক্তি মাঝারি এবং শ্রবণশক্তি তীক্ষ্ণ। স্বভাবগতভাবে এরা লাজুক এবং ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নিঃশব্দে চলে, সানন্দে পানিতে নামে ও শরীর ডুবিয়ে সাঁতার কাটে। | ||
১৯ নং লাইন: | ১৮ নং লাইন: | ||
মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বেশির ভাগ পুরুষ সাম্বারের শিং ঝরে পড়ে। ঘাস, পাতা ও নানা প্রকারের বন্যফলই প্রধান খাদ্য। এরা প্রধানত নিশাচর এবং ভোরে ঘন বনের ভিতরে চলে যায়, সচরাচর সন্ধ্যার আগে বের হয় না। পুরুষ সাম্বার আপন এলাকা দখলে রাখে। কিছু পছন্দসই জায়গা পুরো দখলে রাখার জন্য পুরুষ সাম্বারের মধ্যে লড়াই বাঁধে। নভেম্বর ও ডিসেম্বর প্রজননকাল। গর্ভধারণকাল প্রায় ৮ মাস। প্রতিবার একটিমাত্র শাবক জন্মে, কদাচিৎ দুটি। | মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বেশির ভাগ পুরুষ সাম্বারের শিং ঝরে পড়ে। ঘাস, পাতা ও নানা প্রকারের বন্যফলই প্রধান খাদ্য। এরা প্রধানত নিশাচর এবং ভোরে ঘন বনের ভিতরে চলে যায়, সচরাচর সন্ধ্যার আগে বের হয় না। পুরুষ সাম্বার আপন এলাকা দখলে রাখে। কিছু পছন্দসই জায়গা পুরো দখলে রাখার জন্য পুরুষ সাম্বারের মধ্যে লড়াই বাঁধে। নভেম্বর ও ডিসেম্বর প্রজননকাল। গর্ভধারণকাল প্রায় ৮ মাস। প্রতিবার একটিমাত্র শাবক জন্মে, কদাচিৎ দুটি। | ||
[[Image:DeerSpotted.jpg|thumb|400px|চিত্রাহরিণ]] | [[Image:DeerSpotted.jpg|thumb|right|400px|চিত্রাহরিণ]] | ||
'''চিত্রাহরিণ''' (Spotted deer) মাঝারি আকারের হরিণ Cervus axis। চিত্রাহরিণ উচ্চতায় ঘাড়ের কাছে ৭০-৯৫ সেমি। দেহের লালচে বাদামি লোমের উপর সাদা সাদা ফোটা দাগ থাকে বলে স্থানীয়ভাবে এই প্রজাতি চিত্রা বা চিতল হরিণ নামে পরিচিত। পিঠের উপর দিয়ে কালো রঙের এক ফালি গ্রীবা থেকে লেজের আগা পর্যন্ত প্রসারিত থাকে। পেট, গলা, পায়ের ভিতরের অংশ, পশ্চাৎভাগ, লেজ ও কান সাদা রঙের। মুখ ও নাকের চারপাশ ঘিরে কালো রঙের একটি বড় ফালি থাকে। পূর্ণবয়স্ক এই হরিণের ওজন হয় প্রায় ৮৫ কিলোগ্রাম। | '''''চিত্রাহরিণ''''' (Spotted deer) মাঝারি আকারের হরিণ Cervus axis। চিত্রাহরিণ উচ্চতায় ঘাড়ের কাছে ৭০-৯৫ সেমি। দেহের লালচে বাদামি লোমের উপর সাদা সাদা ফোটা দাগ থাকে বলে স্থানীয়ভাবে এই প্রজাতি চিত্রা বা চিতল হরিণ নামে পরিচিত। পিঠের উপর দিয়ে কালো রঙের এক ফালি গ্রীবা থেকে লেজের আগা পর্যন্ত প্রসারিত থাকে। পেট, গলা, পায়ের ভিতরের অংশ, পশ্চাৎভাগ, লেজ ও কান সাদা রঙের। মুখ ও নাকের চারপাশ ঘিরে কালো রঙের একটি বড় ফালি থাকে। পূর্ণবয়স্ক এই হরিণের ওজন হয় প্রায় ৮৫ কিলোগ্রাম। | ||
প্রাপ্তবয়স্ক চিত্রা হরিণের শিং তিন শাখাবিশিষ্ট। ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়ও চিত্রাহরিণ পাওয়া যায়। একসময় বাংলাদেশের সকল বনাঞ্চলে চিত্রাহরিণ দেখা যেত, বর্তমানে আছে কেবল সুন্দরবনে। বনের কিনারায় ও বৃক্ষঘন এলাকায় বসবাস এদের পছন্দ। দু’তিনটি পুরুষ হরিণসহ এরা ১০-৩০টি একত্রে দলবদ্ধ থাকে। অবশ্য সুন্দরবনে একসঙ্গে কয়েকশ চিত্রাহরিণের পালও দেখা যায়। সকল ঋতুতে ছোট ঘাসই প্রধান খাদ্য। | প্রাপ্তবয়স্ক চিত্রা হরিণের শিং তিন শাখাবিশিষ্ট। ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়ও চিত্রাহরিণ পাওয়া যায়। একসময় বাংলাদেশের সকল বনাঞ্চলে চিত্রাহরিণ দেখা যেত, বর্তমানে আছে কেবল সুন্দরবনে। বনের কিনারায় ও বৃক্ষঘন এলাকায় বসবাস এদের পছন্দ। দু’তিনটি পুরুষ হরিণসহ এরা ১০-৩০টি একত্রে দলবদ্ধ থাকে। অবশ্য সুন্দরবনে একসঙ্গে কয়েকশ চিত্রাহরিণের পালও দেখা যায়। সকল ঋতুতে ছোট ঘাসই প্রধান খাদ্য। | ||
২৬ নং লাইন: | ২৫ নং লাইন: | ||
এদের প্রজননের র্নিদিষ্ট কোন ঋতু নেই। মাংস ও চামড়ার জন্য যদৃচ্ছা শিকারের কারণে ৫০-এর দশক থেকে হরিণের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে। বাংলাদেশ সরকারের বনবিভাগ ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অধ্যাদেশ বলবৎ করায় সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। চিত্রাহরিণের গর্ভাধারণকাল ৭ মাস। প্রতিবারে একটি বাচ্চা প্রসব করে। দু’তিন বছরের মধ্যে এরা যৌনতা লাভ করে। | এদের প্রজননের র্নিদিষ্ট কোন ঋতু নেই। মাংস ও চামড়ার জন্য যদৃচ্ছা শিকারের কারণে ৫০-এর দশক থেকে হরিণের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে। বাংলাদেশ সরকারের বনবিভাগ ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অধ্যাদেশ বলবৎ করায় সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। চিত্রাহরিণের গর্ভাধারণকাল ৭ মাস। প্রতিবারে একটি বাচ্চা প্রসব করে। দু’তিন বছরের মধ্যে এরা যৌনতা লাভ করে। | ||
'''বারোশিঙা''' (Swamp deer) দাঁড়ানো অবস্থায় ঘাড়ের কাছে প্রায় ১২০ সেমি উঁচু ও সুঠামদেহী হরিণ (''Cervus duvauceli'')। বারোশিঙার মুখমন্ডল অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ ও সরু। দেহের লোম মোটামুটি মসৃণ তবে অংশত পশমতুল্য, রং হালকা কালচে বাদামি, হলুদাভ বাদামি বা ধূসর। | '''''বারোশিঙা''''' (Swamp deer) দাঁড়ানো অবস্থায় ঘাড়ের কাছে প্রায় ১২০ সেমি উঁচু ও সুঠামদেহী হরিণ (''Cervus duvauceli'')। বারোশিঙার মুখমন্ডল অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ ও সরু। দেহের লোম মোটামুটি মসৃণ তবে অংশত পশমতুল্য, রং হালকা কালচে বাদামি, হলুদাভ বাদামি বা ধূসর। | ||
এশিয়ার গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলসমূহের সকল হরিণের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বারোশিঙার শিং বলিষ্ঠতম ও বহুশাখাবিশিষ্ট। স্থানীয় নাম বারোশিঙা, অর্থাৎ শিঙে বারোটি শাখা, যদিও নয়টি বা দশটি শাখাও থাকে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে বারোশিঙার শিং ঝরতে শুরু করে এবং এপ্রিলের মধ্যে শিংবিহীন হয়ে পড়ে। | এশিয়ার গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলসমূহের সকল হরিণের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বারোশিঙার শিং বলিষ্ঠতম ও বহুশাখাবিশিষ্ট। স্থানীয় নাম বারোশিঙা, অর্থাৎ শিঙে বারোটি শাখা, যদিও নয়টি বা দশটি শাখাও থাকে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে বারোশিঙার শিং ঝরতে শুরু করে এবং এপ্রিলের মধ্যে শিংবিহীন হয়ে পড়ে। |
০৪:০৬, ২৯ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
হরিণ Artiodactyla বর্গের Cervidae গোত্রের রোমন্থক একদল স্তন্যপায়ী। গোত্রের সব সদস্যই স্বভাব ও গড়নের দিক থেকে প্রায় অভিন্ন। পুরুষ হরিণের মাথায় থাকে এক জোড়া শিং। এগুলি প্রথমে কোমল ভেলভেট-এর মতো রোমশ চামড়া দিয়ে ঢাকা থাকে এবং পরে পরিণত বয়সে চামড়া শুকিয়ে যায় ও এক সময় খসে পড়ে।
বাংলাদেশের কয়েক প্রজাতির হরিণের মধ্যে সাম্বার (Cervus unicolar) বৃহত্তম এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের বনে বাস করে। সবচেয়ে সুন্দর ও পরিচিত প্রজাতি হলো চিত্রা হরিণ (C. axis)। এর হলুদ, হালকা বা গাঢ় বাদামি পিঠ জুড়ে থাকে সাদা রঙের গোল গোল ফোঁটা। এদের আবাস প্রধানত সুন্দরবন। এক সময় সিলেটের বনাঞ্চলে নাত্রিনি হরিণ (hog deer, C. porcinus) দেখা গেলেও বাংলাদেশে এটি এখন আর টিকে নেই। মায়াহরিণ (Muntiacus muntjac) আকারে সবচেয়ে ছোট। সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ ছাড়া বাংলাদেশের অন্য সবগুলি হরিণের সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। যদৃচ্ছা শিকার, মানুষের হস্তক্ষেপ ও আবাসভূমি ধ্বংসের জন্য বনের এসব সুদর্শন প্রাণী আজ বিপন্ন। বারশিঙা (C. duvanceli) এদেশে এখন আর নেই।
হরিণেরা নিশাচর বা দিবাচর। ঘাস, লতাপাতা ও ফুলফল এদের প্রধান খাদ্য। এরা ছোট ছোট দলে বাস করে। এক-দুই বছরেই যৌনতাপ্রাপ্তি ঘটে। সাত-আট মাস গর্ভধারণের পর একটি, দৈবাৎ দুটি বাচ্চা প্রসব করে।
মায়াহরিণ (Barking deer) ছোটখাটো আকারের হরিণ Muntiacus muntjac। কাঁধ পর্যন্ত উচ্চতা মাত্র ৪০-৬২ সেমি। পুরুষ হরিণের ওপরের পাটির কর্তন দাঁত লম্বা, পুরুষ হরিণের মাথার শিং (pedicle) খুব ছোট। হরিণীর শিং নেই, শুধুই লোমে-ঢাকা বৃন্তিকা। দেহের রং নানা রকম, গাঢ়-বাদামি থেকে হলদেটে কিংবা ধূসর-বাদামি আর তাতে হালকা হলুদ বা সাদা দাগ, পেটের দিক প্রায় সাদা। শরীর ছোট নরম লোমে ঢাকা, কানে সামান্য ছড়ানো লোম আছে। ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, নেপাল থেকে দক্ষিণ চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার (সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও) বনেজঙ্গলে মায়াহরিণের বাস। বাংলাদেশে সুন্দরবন, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখা যায়। বন ও গভীর জঙ্গলই এদের পছন্দ। ঘাস খাওয়ার জন্য বনের কিনারে বা খোলা জায়গায় আসে। নিশাচর ও নিঃসঙ্গ, কিন্তু প্রায়ই একসঙ্গে ২-৩টি দেখা যায়। চলে ধীরে ও সতর্কভাবে। কখনও ঠায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। খায় পাতা, কুঁড়ি, ঘাস ও বুনো ফল।
দূর থেকে মায়াহরিণের ডাক কুকুরের ডাকের মতো শোনায়। ভয় পেলে ভাঙা ভাঙা স্বরে চেঁচায়। হরিণী প্রজনন মরসুমে ডাকে তীক্ষ্ণ মিউ মিউ স্বরে এবং হরিণ ঘণ্টাধ্বনির শব্দে। এক বছরের মধ্যেই হরিণী প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে। গর্ভকাল প্রায় ৭ মাস। সাধারণত ১-২টি বাচ্চা প্রসব করে।
সাম্বার (Sambar) হরিণ গোষ্ঠীর আরেক সদস্য সাম্বার (Cerveus unicolor) উপমহাদেশের বৃহত্তম হরিণ, ঘাড়ের কাছে উচ্চতা ১৫০ সেমি, লোম পুরু ও রুক্ষ। পুরুষ সাম্বারের ঘাড় ও গলার কাছাকাছি কেশর গজায়। গরমের সময় এদের শরীর থেকে অধিকাংশ লোম ঝরে যায়। সাধারণত সাম্বারের গায়ের রং হলুদাভ বা নীলচে আভাযুক্ত ধূসর। বুক ও উদরের রং অপেক্ষাকৃত ফ্যাকাশে। বয়স্ক সাম্বারের দেহের রং ক্রমে কালো হতে থাকে, কখনও প্রায় কালো হয়ে যায়। শিং অন্য সব হরিণের শিঙের চেয়ে জাঁকাল, মজবুত ও রুক্ষ।
বাংলাদেশ ছাড়াও সাম্বার ভারত, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার ও মালয় দেশসমূহের মধ্য দিয়ে পূর্ব ফিলিপাইন পর্যন্ত বিস্তৃত। এই হরিণ বৃক্ষবহুল ও ঘন বনাঞ্চলে এবং ফসলের জমির কাছাকাছি পাহাড়ি এলাকায় থাকতে পছন্দ করে ও ৪-২০টি একত্রে চলে। বাংলাদেশের উত্তরে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও সিলেটের চিরহরিৎ বনাঞ্চলে এদের দেখা যায়। সাম্বারের দৃষ্টিশক্তি মাঝারি এবং শ্রবণশক্তি তীক্ষ্ণ। স্বভাবগতভাবে এরা লাজুক এবং ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নিঃশব্দে চলে, সানন্দে পানিতে নামে ও শরীর ডুবিয়ে সাঁতার কাটে।
মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বেশির ভাগ পুরুষ সাম্বারের শিং ঝরে পড়ে। ঘাস, পাতা ও নানা প্রকারের বন্যফলই প্রধান খাদ্য। এরা প্রধানত নিশাচর এবং ভোরে ঘন বনের ভিতরে চলে যায়, সচরাচর সন্ধ্যার আগে বের হয় না। পুরুষ সাম্বার আপন এলাকা দখলে রাখে। কিছু পছন্দসই জায়গা পুরো দখলে রাখার জন্য পুরুষ সাম্বারের মধ্যে লড়াই বাঁধে। নভেম্বর ও ডিসেম্বর প্রজননকাল। গর্ভধারণকাল প্রায় ৮ মাস। প্রতিবার একটিমাত্র শাবক জন্মে, কদাচিৎ দুটি।
চিত্রাহরিণ (Spotted deer) মাঝারি আকারের হরিণ Cervus axis। চিত্রাহরিণ উচ্চতায় ঘাড়ের কাছে ৭০-৯৫ সেমি। দেহের লালচে বাদামি লোমের উপর সাদা সাদা ফোটা দাগ থাকে বলে স্থানীয়ভাবে এই প্রজাতি চিত্রা বা চিতল হরিণ নামে পরিচিত। পিঠের উপর দিয়ে কালো রঙের এক ফালি গ্রীবা থেকে লেজের আগা পর্যন্ত প্রসারিত থাকে। পেট, গলা, পায়ের ভিতরের অংশ, পশ্চাৎভাগ, লেজ ও কান সাদা রঙের। মুখ ও নাকের চারপাশ ঘিরে কালো রঙের একটি বড় ফালি থাকে। পূর্ণবয়স্ক এই হরিণের ওজন হয় প্রায় ৮৫ কিলোগ্রাম।
প্রাপ্তবয়স্ক চিত্রা হরিণের শিং তিন শাখাবিশিষ্ট। ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়ও চিত্রাহরিণ পাওয়া যায়। একসময় বাংলাদেশের সকল বনাঞ্চলে চিত্রাহরিণ দেখা যেত, বর্তমানে আছে কেবল সুন্দরবনে। বনের কিনারায় ও বৃক্ষঘন এলাকায় বসবাস এদের পছন্দ। দু’তিনটি পুরুষ হরিণসহ এরা ১০-৩০টি একত্রে দলবদ্ধ থাকে। অবশ্য সুন্দরবনে একসঙ্গে কয়েকশ চিত্রাহরিণের পালও দেখা যায়। সকল ঋতুতে ছোট ঘাসই প্রধান খাদ্য।
এদের প্রজননের র্নিদিষ্ট কোন ঋতু নেই। মাংস ও চামড়ার জন্য যদৃচ্ছা শিকারের কারণে ৫০-এর দশক থেকে হরিণের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে। বাংলাদেশ সরকারের বনবিভাগ ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অধ্যাদেশ বলবৎ করায় সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। চিত্রাহরিণের গর্ভাধারণকাল ৭ মাস। প্রতিবারে একটি বাচ্চা প্রসব করে। দু’তিন বছরের মধ্যে এরা যৌনতা লাভ করে।
বারোশিঙা (Swamp deer) দাঁড়ানো অবস্থায় ঘাড়ের কাছে প্রায় ১২০ সেমি উঁচু ও সুঠামদেহী হরিণ (Cervus duvauceli)। বারোশিঙার মুখমন্ডল অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ ও সরু। দেহের লোম মোটামুটি মসৃণ তবে অংশত পশমতুল্য, রং হালকা কালচে বাদামি, হলুদাভ বাদামি বা ধূসর।
এশিয়ার গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলসমূহের সকল হরিণের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বারোশিঙার শিং বলিষ্ঠতম ও বহুশাখাবিশিষ্ট। স্থানীয় নাম বারোশিঙা, অর্থাৎ শিঙে বারোটি শাখা, যদিও নয়টি বা দশটি শাখাও থাকে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে বারোশিঙার শিং ঝরতে শুরু করে এবং এপ্রিলের মধ্যে শিংবিহীন হয়ে পড়ে।
এক সময় বাংলাদেশে বারোশিঙা থাকলেও এখন বনে জঙ্গলে এদের আর দেখা যায় না। বর্তমানে উত্তর ও মধ্য ভারতে এবং নেপালে বারোশিঙা পাওয়া যায়। জলাভূমি, তৃণময় সমভূমি ও ভাসমান তৃণাঞ্চল বারোশিঙার প্রিয় আবাসস্থল, তবে আবাসস্থলের আশেপাশে জলাশয় থাকা চাই। অপেক্ষাকৃত ঠান্ডার দিনগুলিতে এরা পাল ধরে বিচরণ করে। ঘাসই এদের প্রধান খাদ্য, তবে কখনও কখনও গাছের পাতা, ফল এবং ফুলও খায়। মে থেকে জুলাই মাসের মধ্যে অধিকাংশ শাবকের জন্ম হয়। গর্ভধারণকাল আট মাস। একটি, কদাচিৎ দুটি শাবক প্রসব করে। [নুরজাহান সরকার]