ট্যানারি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(fix: image tag)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না)
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:Banglapedia]]
[[Category:Banglapedia]]
'''ট্যানারি'''  চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার প্রক্রিয়া বা প্রতিষ্ঠান। ট্যানারি বলতে চামড়া পাকা করার কার্যক্রম পরিচালিত হয় এমন কোন স্থান বা ইমারতকেও বোঝায়। ট্যানারিতে পশুর কাঁচা চামড়াকে পাকা করার পর জুতার উপরিভাগ, ব্যাগ, স্যুটকেস, বেল্ট, মানিব্যাগ, জ্যাকেট প্রভৃতি উৎপাদনের উপযোগী চামড়া তৈরি করা হয়। অতীতে কতিপয় দেশীয় রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে খালি হাতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হতো। এ অঞ্চলে ১৯৪০ সালে নারায়ণগঞ্জে প্রথম ট্যানারি স্থাপন করেন রণদাপ্রসাদ সাহা। পরবর্তীকালে ট্যানারিটি ঢাকার হাজারিবাগে স্থানান্তর করা হয়। এই ট্যানারিকে কেন্দ্র করেই হাজারিবাগ এলাকায় অনেকগুলি ট্যানারি গড়ে উঠে। দেশ বিভাগের পূর্বপর্যন্ত পূর্ববঙ্গে উৎপাদিত সকল কাঁচা চামড়া পশ্চিম বাংলায় বিশেষত, কলকাতায় রপ্তানি হতো। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় কোম্পানির অনুষঙ্গী প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ট্যানারি শিল্পের উন্নয়ন ধারা শুরু হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ট্যানারি শিল্প এবং চামড়া রপ্তানির কার্যক্রম মূলত অবাঙালি ব্যক্তিদের হাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। সে সময় যে গুটিকয়েক ট্যানারি ইউনিট বাঙালি উদ্যোক্তাদের মালিকানায় ছিল সেগুলি ক্ষুদ্র ও [[কুটির শিল্প|কুটির শিল্প]] পর্যায়ের। চামড়া প্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রম প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল দেশীয় বাজারের জন্য। ট্যানারির মালিকদের অধিকাংশ এদেশে চামড়াকে ওয়েট ব্লু-তে রূপান্তর করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিত। সেখানে পুনঃ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তা থেকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে পাকা চামড়া তৈরি করা হতো। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ট্যানারিগুলি কাঁচা চামড়ার গায়ে লবণ মাখিয়ে তারপর তা রোদে শুকিয়ে প্রক্রিয়াকরণ সম্পন্ন করত। প্রক্রিয়ায় তৈরি আধা পাকা চামড়াকে বলা হতো শাল্টু।  
'''ট্যানারি''' এক ধরনের কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান যেখানে জুতা, থলে বা ব্যাগ, স্যুটকেস, বেল্ট, মানিব্যাগ, জ্যাকেট প্রভৃতি উৎপাদন করা হয়। ১৯৪০ সালে প্রথম ট্যানারি স্থাপিত হয় নারায়নগঞ্জে যার উদ্যোক্তা ছিলেন আর.পি সাহা। এটি পরবর্তীকালে ঢাকার হাজারীবাগে স্থানান্তর করা হয়: যার উপর ভিত্তি করে এ এলাকায় বহু ট্যানারি গড়ে উঠে। দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত (১৯৪৭) পূর্ববঙ্গে উৎপাদিত সকল কাঁচা চামড়া পশ্চিম বাংলায় বিশেষত কলকাতায় রপ্তানি হতো। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পকিস্তানের কতিপয় কোম্পানির অনুষঙ্গী প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ট্যানারি শিল্পের অগ্রগতির ধারা শুরু হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ট্যানারি শিল্প এবং চামড়া রপ্তানির কার্যক্রম মূলত অবাঙালীদের হাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। সে সময় যে গুটিকয়েক ট্যানারি ইউনিট বাঙ্গালী উদ্যোক্তাদের মালিকানায় ছিল সেগুলোর আকার ছিল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পর্যায়ের। এ গুলোর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল দেশিয় বাজারের জন্য। ট্যানারি মালিকদের অধিকাংশ এদেশে চামড়াকে ওয়েট-ব্লু-তে রূপান্তর করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিত। সেখানে পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে পাকা চামড়া তৈরি করা হতো। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ট্যানারিগুলো কাঁচা চামড়ার গায়ে লবণ মাখিয়ে তারপর তা রোদে শুকিয়ে প্রক্রিয়াকরণ সম্পন্ন করতো। ধরনের প্রক্রিয়াকরণের ফলে চামড়া পচনের হাত থেকে রক্ষা পেত এবং একে বলা হতো শাল্টু।


১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অবাঙালি মালিকগণ প্রায় ৩০টি ট্যানারি ইউনিট পরিত্যক্ত হিসেবে ফেলে রেখে যায়। যুদ্ধের অব্যবহিত পর, স্বাধীন দেশের নতুন সরকার পরিত্যক্ত ট্যানারিগুলির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সদ্যগঠিত ট্যানারি কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত করে। আশা করা হয়েছিল যে, এ ধরনের ব্যবস্থাপনায় ট্যানারিগুলি পাকা চামড়া উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। অভিজ্ঞতার অভাব এবং দুর্নীতিসহ অন্যান্য কারণে কর্পোরেশন কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালে সরকার অধিকাংশ ট্যানারির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের নিকট হস্তান্তর করে এবং ট্যানারি কর্পোরেশন বিলুপ্ত করে। তবে তিনটি ট্যানারির দায়িত্ব মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে দেওয়া হয়। # #[[Image:ট্যানারি_html_88407781.png]]
[[Image:Tannery.jpg|thumb|400px|চামড়া প্রক্রিয়াজতকরণ]]
১৯৭১ সালে স্বধীনতা যুদ্ধের সময় অবাঙালী মালিকদের ৩০টি ট্যানারি ইউনিট রেখে যায়, যা স্বাধীন দেশের নতুন সরকার এগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সদ্যগঠিত ট্যানারি কর্পোরেশনের উপর ন্যাস্ত করে। আশা করা হয়েছিল যে, এ ধরনের ব্যবস্থাপনায় ট্যানারিগুলো পাকা-চামড়া উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাব এবং দুর্নীতিসহ নানান কারণে কর্পোরেশন কাঙ্খিত উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালে সরকার অধিকাংশ ট্যানারির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন এর নিকট হস্তান্তর করে এবং ট্যানারি কর্পোরেশন বিলুপ্ত করে। তবে ৩টি ট্যানারির দ্বায়িত্ব মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে দেয়া হয়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে উভয় কর্তৃপক্ষই ট্যানারিগুলির ব্যবস্থাপনায় দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। ১৯৮২ সালে সরকার বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতির আওতায় ট্যানারিগুলিকে ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করেন, যার ফলে কিছু উদ্যোগী বাঙালি যৎসামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে শিল্প ইউনিটগুলিতে ওয়েট-ব্লু উৎপাদন শুরু করে।


[[Image:Tannery.jpg|thumb|400px]]
বর্তমানে (২০২০) বাংলাদেশে প্রায় ২২০টি ট্যানারি ইউনিট রয়েছে, যেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতায় তারতম্য বিদ্যমান। এসবের মধ্যে ১৯০টি ঢাকার হাজারীবাগে ৬০ একর জমির উপর অবস্থিত। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রপ্তানি শুধুমাত্র ওয়েট-ব্লু’র মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সরকার উচ্চ মূল্যসম্পন্ন চামড়া রপ্তানিকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে ওয়েট-ব্লু রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরই ফলে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের উন্নয়নে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। এখান থেকেই ক্রাস্ট, ফিনিস্ড ও স্পি­ট চামড়া উৎপাদন ও রপ্তানির যাত্রা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ চামড়া সংগ্রহে আন্তর্জাতিক ব্রান্ড কোম্পানির কাঙ্খিত দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব চামড়া উৎপাদনে বাংলাদেশের ব্যর্থতা।


 # #চামড়া প্রক্রিয়াজতকরণ
উপর্যুক্ত বাধা কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে ট্যানারিগুলোকে সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায় ২০০ একর জমির উপর কেন্দ্রীয়ভাবে বর্জ্য শোধনাগার সুবিধাসহ স্থানান্তরের পবিকল্পনা নেয়া হয়। ইতোমধ্যে ১৫৫টি ট্যানারি স্থানান্তর হয়েছে। চামড়া চামড়াজাত পর্ণ্যরে আন্তর্জাতিক বাজার অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উৎপাদন স্তরের প্রতিটি ক্ষেত্রে মান অনুসরণ সংক্রান্ত বিধি-বিধান মেনে চলার নিশ্চয়তার উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ট্যানারস এসোসিয়েশনের মতে, এ শিল্পে প্রায় ২৫০০০ শ্রমিক এবং ১৫০ জন টেকনোলজিস্ট নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়া সমগ্র বাংলাদেশ থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ এবং পরবর্তীতে পাইকারি কেন্দ্র ঢাকার পোস্তায় পৌঁছানোর ব্যবসায় প্রায় ১৫০০ ব্যক্তি নিয়োজিত আছে। চামড়া শিল্পে যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় তা সরবরাহের কাজে প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠান জড়িত রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২০০-২২০ মিলিয়ন বর্গফুট কাঁচা চামড়া উৎপাদিত হয়; যার প্রায় ৮৫ শতাংশ ক্রাস্ট, ফিনিস্ড, স্পি­ট আকারে রপ্তানি হয়ে থাকে। বাকী অংশ দেশিয় বাজারে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হয়। চামড়া ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এ পণ্য থেকে রপ্তানি আয় তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। তবে একথা সত্য যে কাঁচা চামড়ার উৎপাদন পশু সম্পদ-এর প্রাপ্তি সাপেক্ষ এবং মাংসের চাহিদার উপর নির্ভর করে। ফলে স্বল্প মেয়াদে কাঁচা চামড়ার উৎপাদন ক্ষেত্রে তেমন একটা হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। ফলে এ শিল্প থেকে আয়-বৃদ্ধির একমাত্র পথ হচ্ছে উচ্চমানের চামড়া উৎপাদন এবং উচ্চ মূল্যসংযোজনী পণ্য রপ্তানি করা যার চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবর্ধমান। তবে মনে রাখতে হবে, চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার প্রায়শই উঠানামা করে যার ফলে রপ্তানি আয়ে ব্যাপক তারতম্য ঘটতে দেখা যায়। ২০০১ সাল পর্যন্ত এ শিল্প থেকে বাৎসরিক আয় ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে। কিন্তু ২০১৭-১৮ সালে আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫১৯.৯১ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের কতিপয় নামিদামি ট্যানারির মধ্যে রয়েছে-ঢাকা লেদার, এপেক্স ট্যানারি, লেক্সকো, করিম লেদার, সমতা ট্যানারি, বে-ট্যানারি, রিলায়েন্স, কালাম ব্রাদার্স, আল-মদিনা, মিল্লাত, প্রগতি, আনোয়ার, আমিন ক্রিসেন্ট কিড লেদার প্রভৃতি।  [বেলায়েত হোসেন]
 
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, উভয় কর্তৃপক্ষই ট্যানারিগুলির ব্যবস্থাপনায় দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। ১৯৮২ সালে সরকার বিলগ্নীকরণ নীতির আওতায় ট্যানারিগুলিকে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করে, যার ফলে কিছু উদ্যোগী বাঙালি যৎসামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে শিল্প ইউনিটগুলিতে ‘ওয়েট ব্লু’ উৎপাদন শুরু করেন।
 
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২০৬টি ট্যানারি ইউনিট রয়েছে। এগুলি সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় কাঁচা চামড়ার ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ১১৪টি স্থানীয় মানদন্ড অনুযায়ী বৃহৎ ও মাঝারি আকারের, এগুলি শিল্প অধিদপ্তরে তালিকাভুক্ত। বাকি ইউনিটগুলি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পর্যায়ের এবং এগুলি সরকারিভাবে নিবন্ধিত নয়। চামড়া শিল্পের সম্ভাব্যতার উপর ভিত্তি করে ইতোমধ্যে ৩৫টি ট্যানারি আধুনিক যন্ত্রপাতির সন্নিবেশ করেছে। এ ট্যানারিগুলি উন্নত ও আন্তর্জাতিক মানের পাকা চামড়া উৎপাদনে সক্ষম এবং দেশের মোট কাঁচা-চামড়া উৎপাদনের ৬০% গুণগত মানসম্পন্ন ফিনিশড চামড়া উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে। ঢাকার হাজারিবাগে ৬০ একর জমির উপর ১৯০টি ট্যানারি ইউনিট রয়েছে; এলাকাটি এখন ট্যানারি এলাকা হিসাবে সুপরিচিত। বাংলাদেশ ট্যানারি মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী এ শিল্পে প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। তাছাড়া বিদেশিসহ প্রায় ১০০ জন কারিগরি বিশেষজ্ঞও এসব ট্যানারিতে কর্মরত রয়েছেন। ট্যানারি শিল্পে মোট বিনিয়োজিত মূলধনের পরিমাণ প্রায় ২.৫ বিলিয়ন টাকা, যার মধ্যে সরকার/ব্যাংক অর্থায়নের পরিমাণ ১.২ বিলিয়ন টাকা। ট্যানারি শিল্পে কাঁচা চামড়া যোগান দেওয়ার জন্য সমগ্র দেশে প্রায় দেড় হাজার ব্যক্তি কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত। তাছাড়া প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠান ট্যানারি শিল্পে ব্যবহারের উদ্দেশে রাসায়নিক পদার্থ আমদানি ও সরবরাহ করে থাকে।
 
বাংলাদেশে প্রতিবছর আনুমানিক ২০০-২২০ মিলিয়ন ঘনফুট চামড়া উৎপাদিত হয়, যার প্রায় ৮০% ভাগ ক্রাস্ট ও পাকা চামড়ায় রূপান্তরিত হয়ে রপ্তানি হয়। অবশিষ্ট চামড়া দ্বারা দেশীয় চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করা হয়। চামড়া বাংলাদেশের প্রচলিত রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু অতীতে খাতের আয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় নি। যেহেতু চামড়ার উৎপাদন ও সরবরাহ পশুসম্পদের লভ্যতা বা মাংসের চাহিদার উপর নির্ভরশীল সেহেতু স্বল্পকালীন সময়ে মোট চামড়ার সরবরাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। তবে আন্তর্জাতিক চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে বলে চামড়া খাতে আয় বৃদ্ধির একমাত্র উপায় হচ্ছে অধিক মূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা খুবই উঠানামা করে বলে রপ্তানি আয়েও উত্থান-পতন ঘটে। ২০০১ সাল পর্যন্ত এ খাতের বাৎসরিক রপ্তানি আয় এক বিলিয়ন টাকা অতিক্রম করতে পারে নি। যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হলে এ খাতের আয়ের পরিমাণকে ৫ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত করা সম্ভব। বাংলাদেশে বর্তমানে যে কয়টি প্রতিষ্ঠিত ট্যানারি আছে সেগুলির মধ্যে ঢাকা লেদার, এপেক্স ট্যানারি, করিম লেদার, সমতা ট্যানারি, বে ট্যানারি, ল্যাক্সো ট্যানারি, রিলায়েন্স, কালাম ব্রাদার্স, আল মদিনা, মিল্লাত, প্রগতি, আনোয়ার, আমিন, ক্রিসেন্ট কিড লেদার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
 
ট্যানারি শিল্পকে সকল ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধার আওতায় আনা এবং পরিবেশ বান্ধব শিল্পে রূপান্তর করার লক্ষ্যে ঢাকার সাভারে গড়ে তোলা হয়েছে চামড়া শিল্প নগরী। যার ফলে ট্যানারি শিল্প জনবহুল হাজারীবাগ এলাকা থেকে সাভারে নিজস্ব শিল্প নগরীতে স্থানান্তর হতে যাচ্ছে।  [বেলায়েত হোসেন]


[[en:Tannery]]
[[en:Tannery]]

১১:৫৬, ২০ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

ট্যানারি এক ধরনের কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান যেখানে জুতা, থলে বা ব্যাগ, স্যুটকেস, বেল্ট, মানিব্যাগ, জ্যাকেট প্রভৃতি উৎপাদন করা হয়। ১৯৪০ সালে প্রথম ট্যানারি স্থাপিত হয় নারায়নগঞ্জে যার উদ্যোক্তা ছিলেন আর.পি সাহা। এটি পরবর্তীকালে ঢাকার হাজারীবাগে স্থানান্তর করা হয়: যার উপর ভিত্তি করে এ এলাকায় বহু ট্যানারি গড়ে উঠে। দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত (১৯৪৭) পূর্ববঙ্গে উৎপাদিত সকল কাঁচা চামড়া পশ্চিম বাংলায় বিশেষত কলকাতায় রপ্তানি হতো। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পকিস্তানের কতিপয় কোম্পানির অনুষঙ্গী প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ট্যানারি শিল্পের অগ্রগতির ধারা শুরু হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ট্যানারি শিল্প এবং চামড়া রপ্তানির কার্যক্রম মূলত অবাঙালীদের হাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। সে সময় যে গুটিকয়েক ট্যানারি ইউনিট বাঙ্গালী উদ্যোক্তাদের মালিকানায় ছিল সেগুলোর আকার ছিল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পর্যায়ের। এ গুলোর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল দেশিয় বাজারের জন্য। ট্যানারি মালিকদের অধিকাংশ এদেশে চামড়াকে ওয়েট-ব্লু-তে রূপান্তর করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিত। সেখানে পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে পাকা চামড়া তৈরি করা হতো। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ট্যানারিগুলো কাঁচা চামড়ার গায়ে লবণ মাখিয়ে তারপর তা রোদে শুকিয়ে প্রক্রিয়াকরণ সম্পন্ন করতো। এ ধরনের প্রক্রিয়াকরণের ফলে চামড়া পচনের হাত থেকে রক্ষা পেত এবং একে বলা হতো শাল্টু।

চামড়া প্রক্রিয়াজতকরণ

১৯৭১ সালে স্বধীনতা যুদ্ধের সময় অবাঙালী মালিকদের ৩০টি ট্যানারি ইউনিট রেখে যায়, যা স্বাধীন দেশের নতুন সরকার এগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সদ্যগঠিত ট্যানারি কর্পোরেশনের উপর ন্যাস্ত করে। আশা করা হয়েছিল যে, এ ধরনের ব্যবস্থাপনায় ট্যানারিগুলো পাকা-চামড়া উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাব এবং দুর্নীতিসহ নানান কারণে কর্পোরেশন কাঙ্খিত উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালে সরকার অধিকাংশ ট্যানারির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন এর নিকট হস্তান্তর করে এবং ট্যানারি কর্পোরেশন বিলুপ্ত করে। তবে ৩টি ট্যানারির দ্বায়িত্ব মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে দেয়া হয়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে উভয় কর্তৃপক্ষই ট্যানারিগুলির ব্যবস্থাপনায় দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। ১৯৮২ সালে সরকার বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতির আওতায় ট্যানারিগুলিকে ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করেন, যার ফলে কিছু উদ্যোগী বাঙালি যৎসামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে শিল্প ইউনিটগুলিতে ওয়েট-ব্লু উৎপাদন শুরু করে।

বর্তমানে (২০২০) বাংলাদেশে প্রায় ২২০টি ট্যানারি ইউনিট রয়েছে, যেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতায় তারতম্য বিদ্যমান। এসবের মধ্যে ১৯০টি ঢাকার হাজারীবাগে ৬০ একর জমির উপর অবস্থিত। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রপ্তানি শুধুমাত্র ওয়েট-ব্লু’র মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সরকার উচ্চ মূল্যসম্পন্ন চামড়া রপ্তানিকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে ওয়েট-ব্লু রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরই ফলে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের উন্নয়নে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। এখান থেকেই ক্রাস্ট, ফিনিস্ড ও স্পি­ট চামড়া উৎপাদন ও রপ্তানির যাত্রা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ চামড়া সংগ্রহে আন্তর্জাতিক ব্রান্ড কোম্পানির কাঙ্খিত দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব চামড়া উৎপাদনে বাংলাদেশের ব্যর্থতা।

উপর্যুক্ত বাধা কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে ট্যানারিগুলোকে সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায় ২০০ একর জমির উপর কেন্দ্রীয়ভাবে বর্জ্য শোধনাগার সুবিধাসহ স্থানান্তরের পবিকল্পনা নেয়া হয়। ইতোমধ্যে ১৫৫টি ট্যানারি স্থানান্তর হয়েছে। চামড়া ও চামড়াজাত পর্ণ্যরে আন্তর্জাতিক বাজার অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উৎপাদন স্তরের প্রতিটি ক্ষেত্রে মান অনুসরণ সংক্রান্ত বিধি-বিধান মেনে চলার নিশ্চয়তার উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ট্যানারস এসোসিয়েশনের মতে, এ শিল্পে প্রায় ২৫০০০ শ্রমিক এবং ১৫০ জন টেকনোলজিস্ট নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়া সমগ্র বাংলাদেশ থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ এবং পরবর্তীতে পাইকারি কেন্দ্র ঢাকার পোস্তায় পৌঁছানোর ব্যবসায় প্রায় ১৫০০ ব্যক্তি নিয়োজিত আছে। চামড়া শিল্পে যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় তা সরবরাহের কাজে প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠান জড়িত রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২০০-২২০ মিলিয়ন বর্গফুট কাঁচা চামড়া উৎপাদিত হয়; যার প্রায় ৮৫ শতাংশ ক্রাস্ট, ফিনিস্ড, স্পি­ট আকারে রপ্তানি হয়ে থাকে। বাকী অংশ দেশিয় বাজারে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হয়। চামড়া ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এ পণ্য থেকে রপ্তানি আয় তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। তবে একথা সত্য যে কাঁচা চামড়ার উৎপাদন পশু সম্পদ-এর প্রাপ্তি সাপেক্ষ এবং মাংসের চাহিদার উপর নির্ভর করে। ফলে স্বল্প মেয়াদে কাঁচা চামড়ার উৎপাদন ক্ষেত্রে তেমন একটা হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। ফলে এ শিল্প থেকে আয়-বৃদ্ধির একমাত্র পথ হচ্ছে উচ্চমানের চামড়া উৎপাদন এবং উচ্চ মূল্যসংযোজনী পণ্য রপ্তানি করা যার চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবর্ধমান। তবে মনে রাখতে হবে, চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার প্রায়শই উঠানামা করে যার ফলে রপ্তানি আয়ে ব্যাপক তারতম্য ঘটতে দেখা যায়। ২০০১ সাল পর্যন্ত এ শিল্প থেকে বাৎসরিক আয় ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে। কিন্তু ২০১৭-১৮ সালে আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫১৯.৯১ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের কতিপয় নামিদামি ট্যানারির মধ্যে রয়েছে-ঢাকা লেদার, এপেক্স ট্যানারি, লেক্সকো, করিম লেদার, সমতা ট্যানারি, বে-ট্যানারি, রিলায়েন্স, কালাম ব্রাদার্স, আল-মদিনা, মিল্লাত, প্রগতি, আনোয়ার, আমিন ক্রিসেন্ট কিড লেদার প্রভৃতি। [বেলায়েত হোসেন]