মন্দির স্থাপত্য: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না) | |||
৩ নং লাইন: | ৩ নং লাইন: | ||
ভারতে প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে মন্দির স্থাপত্যের সূচনা হয়। ইট ও কাঠের নির্মিত প্রাচীনতম মন্দিরের অস্তিত্ব এখন আর টিকে না থাকলেও পরবর্তীকালের পাথর নির্মিত মন্দিরগুলো অনেকাংশেই টিকে আছে। কাঠামোগত ভাবে কোন একটি মন্দির বৈদিক নৈবেদ্যতা থেকে ভক্তি বা ভালোবাসার ধর্মে রূপান্তরিত হয় এবং তা থেকে একটি সম্প্রদায়ের বা ব্যক্তি বিশেষের বিশ্বাসে পরিণত হওয়ার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে দক্ষিণ এশীয় মন্দির ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মন্দির সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আবার পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের মন্দির স্থাপত্যের মধ্যে চমৎকার অভিন্ন ধারা গড়ে উঠেছে। গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলের পাথরের স্বল্পতার কারণে এ অঞ্চলের মন্দির নির্মাতাদের পাথর ব্যাতীত অন্যান্য নির্মাণ উপকরণের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ফলে পোড়ামাটির ইটের গাঁথুনীতে গড়া মন্দিরের দেয়াল অলংকরণে পোড়ামাটির ফলকের ব্যবহারও হয়েছে যা বাংলার মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রে অনন্য বৈচিত্র্য দান করেছে। | ভারতে প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে মন্দির স্থাপত্যের সূচনা হয়। ইট ও কাঠের নির্মিত প্রাচীনতম মন্দিরের অস্তিত্ব এখন আর টিকে না থাকলেও পরবর্তীকালের পাথর নির্মিত মন্দিরগুলো অনেকাংশেই টিকে আছে। কাঠামোগত ভাবে কোন একটি মন্দির বৈদিক নৈবেদ্যতা থেকে ভক্তি বা ভালোবাসার ধর্মে রূপান্তরিত হয় এবং তা থেকে একটি সম্প্রদায়ের বা ব্যক্তি বিশেষের বিশ্বাসে পরিণত হওয়ার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে দক্ষিণ এশীয় মন্দির ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মন্দির সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আবার পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের মন্দির স্থাপত্যের মধ্যে চমৎকার অভিন্ন ধারা গড়ে উঠেছে। গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলের পাথরের স্বল্পতার কারণে এ অঞ্চলের মন্দির নির্মাতাদের পাথর ব্যাতীত অন্যান্য নির্মাণ উপকরণের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ফলে পোড়ামাটির ইটের গাঁথুনীতে গড়া মন্দিরের দেয়াল অলংকরণে পোড়ামাটির ফলকের ব্যবহারও হয়েছে যা বাংলার মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রে অনন্য বৈচিত্র্য দান করেছে। | ||
বাংলার নির্মাণকুশলী ও শিল্পিবৃন্দ নয়-এগারো শতক সময়ের মধ্যে পাল ও সেন শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় অসংখ্য মন্দির ও মন্দির সংশ্লিষ্ট ভাস্কর্য নির্মাণ করেছে। পরবর্তী প্রায় পাঁচ শতককাল এই শ্রেণিই মুসলিম শাসকদের অধীনে ইটের গাঁথুনীর মসজিদ ও সমাধি গড়ে তুলেছে; যার অধিকাংশ গড়ে উঠেছিল গৌড় নগরে। এ সময়ের মন্দির স্থাপত্যে সন্নিবেশিত হয়েছে চমৎকার বাঙালি স্থাপত্যিক কৌশল যার মধ্যে স্থানীয় রীতির সঙ্গে নবাগত ইসলামী রীতির কাঠামোগত মিশ্রণ ঘটেছে। যেমন গম্বুজ ও খিলান এর সম্মিলিত স্থাপত্যিক ধারার সঙ্গে স্থানীয় নির্মাণ ধারা হিসেবে যোগ হয় বক্রাকার কার্নিশ, অষ্টভূজ মিনার এবং ইটের অলংকরণ। সতেরো শতকে নির্মাণশিল্পে হিন্দু সমাজপতিদের পৃষ্ঠপোষকতা পুনরায় আরম্ভ হলে স্থাপত্য চর্চায় পরীক্ষামূলক যুগের সূচনা হয় এবং বিষ্ণুপুরে ব্যতিক্রমী ধারায় বেশ কিছু মন্দির গড়ে উঠতে দেখা যায়। সর্বশেষ ধারায়, হিন্দু মন্দির স্থাপত্যের মধ্যে ইসলামী গম্বুজ, ভল্ট ও খিলানের ব্যবহারের পাশাপাশি হিন্দু উপকরণ হিসেবে অষ্টভূজাকৃতির খিলান, দেহসর্বস্ব ভাস্কর্য ও উড়িষ্যার স্থাপত্যশৈলীর টারেট যুক্ত হয়েছে। এ ধারার মন্দিরসমূহ আপাতত একে অপরের থেকে পৃথক মনে হলেও শুধুমাত্র মন্দিরের ছাদ বা তার সার্বিক কাঠামোতেই পার্থক্যসমূহ বেশি লক্ষনীয়। তাছাড়া অধিকাংশ মন্দিরেরই প্রবেশদ্বারের কাঠামোতে খিলান যুক্ত হয়েছে। সাধারনত মধ্যবর্তী ভারী অষ্টভূজাকৃতির কলামের উপর তিন স্তর বিশিষ্ট খিলান যুক্ত হতে দেখা গেছে। অবশ্য একক খিলানবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারও সাধারণভাবে চোখে পড়ে। মন্দিরের অভ্যন্তরভাগ সাধারন একটি গম্বুজদ্বারা আবৃত (যদিও বাংলার মন্দির শুধুমাত্র ভল্ট দ্বারা আবৃত) এবং বারান্দাটি ভল্ট দ্বারা আবৃত। অন্যান্য সাধারণ গঠনশৈলীতে রয়েছে বক্রাকার কার্নিশ ও প্যারাপেট। এ ধারা বাংলার কুড়ে ঘরের বাঁকানো চালার অনুকরণে নির্মিত। তবে মন্দিরের ক্ষেত্রে তাতে পোড়ামাটির অলংকরণ যুক্ত হয়েছে। | বাংলার নির্মাণকুশলী ও শিল্পিবৃন্দ নয়-এগারো শতক সময়ের মধ্যে পাল ও সেন শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় অসংখ্য মন্দির ও মন্দির সংশ্লিষ্ট ভাস্কর্য নির্মাণ করেছে। পরবর্তী প্রায় পাঁচ শতককাল এই শ্রেণিই মুসলিম শাসকদের অধীনে ইটের গাঁথুনীর মসজিদ ও সমাধি গড়ে তুলেছে; যার অধিকাংশ গড়ে উঠেছিল গৌড় নগরে। এ সময়ের মন্দির স্থাপত্যে সন্নিবেশিত হয়েছে চমৎকার বাঙালি স্থাপত্যিক কৌশল যার মধ্যে স্থানীয় রীতির সঙ্গে নবাগত ইসলামী রীতির কাঠামোগত মিশ্রণ ঘটেছে। যেমন গম্বুজ ও খিলান এর সম্মিলিত স্থাপত্যিক ধারার সঙ্গে স্থানীয় নির্মাণ ধারা হিসেবে যোগ হয় বক্রাকার কার্নিশ, অষ্টভূজ মিনার এবং ইটের অলংকরণ। সতেরো শতকে নির্মাণশিল্পে হিন্দু সমাজপতিদের পৃষ্ঠপোষকতা পুনরায় আরম্ভ হলে স্থাপত্য চর্চায় পরীক্ষামূলক যুগের সূচনা হয় এবং বিষ্ণুপুরে ব্যতিক্রমী ধারায় বেশ কিছু মন্দির গড়ে উঠতে দেখা যায়। সর্বশেষ ধারায়, হিন্দু মন্দির স্থাপত্যের মধ্যে ইসলামী গম্বুজ, ভল্ট ও খিলানের ব্যবহারের পাশাপাশি হিন্দু উপকরণ হিসেবে অষ্টভূজাকৃতির খিলান, দেহসর্বস্ব ভাস্কর্য ও উড়িষ্যার স্থাপত্যশৈলীর টারেট যুক্ত হয়েছে। এ ধারার মন্দিরসমূহ আপাতত একে অপরের থেকে পৃথক মনে হলেও শুধুমাত্র মন্দিরের ছাদ বা তার সার্বিক কাঠামোতেই পার্থক্যসমূহ বেশি লক্ষনীয়। তাছাড়া অধিকাংশ মন্দিরেরই প্রবেশদ্বারের কাঠামোতে খিলান যুক্ত হয়েছে। সাধারনত মধ্যবর্তী ভারী অষ্টভূজাকৃতির কলামের উপর তিন স্তর বিশিষ্ট খিলান যুক্ত হতে দেখা গেছে। অবশ্য একক খিলানবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারও সাধারণভাবে চোখে পড়ে। মন্দিরের অভ্যন্তরভাগ সাধারন একটি গম্বুজদ্বারা আবৃত (যদিও বাংলার মন্দির শুধুমাত্র ভল্ট দ্বারা আবৃত) এবং বারান্দাটি ভল্ট দ্বারা আবৃত। অন্যান্য সাধারণ গঠনশৈলীতে রয়েছে বক্রাকার কার্নিশ ও প্যারাপেট। এ ধারা বাংলার কুড়ে ঘরের বাঁকানো চালার অনুকরণে নির্মিত। তবে মন্দিরের ক্ষেত্রে তাতে পোড়ামাটির অলংকরণ যুক্ত হয়েছে। | ||
২৩ নং লাইন: | ২১ নং লাইন: | ||
বাংলার মন্দির স্থাপত্যের শ্রেণি বিভাজনের ক্ষেত্রে ডেভিড ম্যাকাচন প্রথম পথ প্রদর্শন করেছেন (১৯৩০-১৯৭২)। তিনি ভিন্ন ধারা অবলম্বন করে বাংলার মন্দির স্থাপত্যকে চারভাগে ভাগ করেছেন, যেমন: | বাংলার মন্দির স্থাপত্যের শ্রেণি বিভাজনের ক্ষেত্রে ডেভিড ম্যাকাচন প্রথম পথ প্রদর্শন করেছেন (১৯৩০-১৯৭২)। তিনি ভিন্ন ধারা অবলম্বন করে বাংলার মন্দির স্থাপত্যকে চারভাগে ভাগ করেছেন, যেমন: | ||
১. ঐতিহ্যিক: রেখা দেউল ও পিড়া দেউল। | ১. ঐতিহ্যিক: রেখা দেউল ও পিড়া দেউল। | ||
৩৫ নং লাইন: | ৩০ নং লাইন: | ||
৪. ইউরোপীয় স্থাপত্য দ্বারা প্রভাবিত মন্দির, যার অধিকাংশই গড়ে উঠেছে উনিশ শতকে। এ শতকে সমতল ছাদ বিশিষ্ট মন্দিরও গড়ে উঠে। ছোট সমতল ছাদ বিশিষ্ট মন্দিরকে বলা হয় ‘চাঁদনী’ এবং বৃহদাকারটির নাম হয় ‘দালান’। সমতল ছাদ বিশিষ্ট মন্দিরের কাঠামোর উপরেই পঞ্চরত্ন ও নবরত্ন ধরনের মন্দির নির্মিত হয়েছে। | ৪. ইউরোপীয় স্থাপত্য দ্বারা প্রভাবিত মন্দির, যার অধিকাংশই গড়ে উঠেছে উনিশ শতকে। এ শতকে সমতল ছাদ বিশিষ্ট মন্দিরও গড়ে উঠে। ছোট সমতল ছাদ বিশিষ্ট মন্দিরকে বলা হয় ‘চাঁদনী’ এবং বৃহদাকারটির নাম হয় ‘দালান’। সমতল ছাদ বিশিষ্ট মন্দিরের কাঠামোর উপরেই পঞ্চরত্ন ও নবরত্ন ধরনের মন্দির নির্মিত হয়েছে। | ||
[[Image:TampleDochala.jpg|thumb|right|400px|দো-চালা মন্দির]] | |||
বারান্দা সহযোগে আর এক ভিন্ন ধরণের মন্দিরের অস্তিত্ব বাংলায় রয়েছে। উড়িষ্যার মন্দির স্থাপত্যের প্রভাবে এ ধারার সৃষ্টি হয়। উড়িষ্যা ধারায় মন্দিরের গর্ভগৃহের সম্মুখে একটি মন্ডপ নির্মিত হত। বাংলার মন্দির স্থাপত্যে বারান্দাসহযোগে মন্দির সাধারণত একক ছাদ বিশিষ্ট হয়ে থাকে। তাছাড়াও আঠারো ও উনিশ শতকে দোলমঞ্চ ও রাশমঞ্চ সহকারে দালানও ছিল খুবই সাধারণ স্থাপত্যিক ধারায় নির্মিত। দোলমঞ্চের তুলনায় রাশমঞ্চগুলো আকারে বড় হত ও গঠনে ছিল অষ্টভূজাকৃতি। উঁচু একটি বেদীর উপর নির্মিত রাশমঞ্চটির ছাদ নবরত্ন ও পঞ্চরত্ন- টাওয়ার এর সঙ্গে রেখা বিশিষ্ট টারেট দ্বারা অলংকৃত করা হতো। | বারান্দা সহযোগে আর এক ভিন্ন ধরণের মন্দিরের অস্তিত্ব বাংলায় রয়েছে। উড়িষ্যার মন্দির স্থাপত্যের প্রভাবে এ ধারার সৃষ্টি হয়। উড়িষ্যা ধারায় মন্দিরের গর্ভগৃহের সম্মুখে একটি মন্ডপ নির্মিত হত। বাংলার মন্দির স্থাপত্যে বারান্দাসহযোগে মন্দির সাধারণত একক ছাদ বিশিষ্ট হয়ে থাকে। তাছাড়াও আঠারো ও উনিশ শতকে দোলমঞ্চ ও রাশমঞ্চ সহকারে দালানও ছিল খুবই সাধারণ স্থাপত্যিক ধারায় নির্মিত। দোলমঞ্চের তুলনায় রাশমঞ্চগুলো আকারে বড় হত ও গঠনে ছিল অষ্টভূজাকৃতি। উঁচু একটি বেদীর উপর নির্মিত রাশমঞ্চটির ছাদ নবরত্ন ও পঞ্চরত্ন- টাওয়ার এর সঙ্গে রেখা বিশিষ্ট টারেট দ্বারা অলংকৃত করা হতো। | ||
বাংলো ধরনের মন্দির বা কুঁড়ে ঘরের আকারে নির্মিত মন্দিরের গঠন ছিল সাদামাটা। সাধারণ মানুষের বসবাসের উপযোগী মাটির ঘরের আকারে বাংলা ধারার মন্দির নির্মিত হত। দেবতাদের বসবাস সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি- সম্ভবত এরূপ অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ভক্তরা এমন মন্দির নির্মাণ করতো। এ কারণে এক বাংলা, জোড় বাংলা, দোচালা, চারচালা ও আটচালা ধারায় মন্দির নির্মিত হয়েছে। দোচালা মন্দির বা জোড়বাংলা মন্দির সাধারণত একটি একক ভিত্তির উপর নির্মিত চতুষ্কোণ ঘরের উপর দু’দিকে ক্রমশ ঢালু হওয়া ছাদের সঙ্গে বাঁকানো কার্নিশ বিশিষ্ট মন্দির। এ ধারার মন্দির স্থাপত্যে বাংলার স্থানীয় কুঁড়ে ঘর নির্মাণের ধারাকে অনুসরণ করেছে। এ ধারার প্রথম সংযোজন হয় মুসলিম স্থাপত্যে। বাংলাদেশের যশোর অঞ্চল ব্যতীত অন্যান্য অঞ্চলে সহজে এ ধরণের স্থাপত্য দেখা যায় না। মুর্শিদাবাদে রাণী ভবানী কর্তৃক নির্মিত অনেকগুলো মন্দির এই ধারায় নির্মিত। ভারতীয় প্রভাবে শিখর ধরনের বা রেখা ধারায় নাগারা স্টাইলেও মন্দির নির্মিত হয়েছে। | বাংলো ধরনের মন্দির বা কুঁড়ে ঘরের আকারে নির্মিত মন্দিরের গঠন ছিল সাদামাটা। সাধারণ মানুষের বসবাসের উপযোগী মাটির ঘরের আকারে বাংলা ধারার মন্দির নির্মিত হত। দেবতাদের বসবাস সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি- সম্ভবত এরূপ অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ভক্তরা এমন মন্দির নির্মাণ করতো। এ কারণে এক বাংলা, জোড় বাংলা, দোচালা, চারচালা ও আটচালা ধারায় মন্দির নির্মিত হয়েছে। দোচালা মন্দির বা জোড়বাংলা মন্দির সাধারণত একটি একক ভিত্তির উপর নির্মিত চতুষ্কোণ ঘরের উপর দু’দিকে ক্রমশ ঢালু হওয়া ছাদের সঙ্গে বাঁকানো কার্নিশ বিশিষ্ট মন্দির। এ ধারার মন্দির স্থাপত্যে বাংলার স্থানীয় কুঁড়ে ঘর নির্মাণের ধারাকে অনুসরণ করেছে। এ ধারার প্রথম সংযোজন হয় মুসলিম স্থাপত্যে। বাংলাদেশের যশোর অঞ্চল ব্যতীত অন্যান্য অঞ্চলে সহজে এ ধরণের স্থাপত্য দেখা যায় না। মুর্শিদাবাদে রাণী ভবানী কর্তৃক নির্মিত অনেকগুলো মন্দির এই ধারায় নির্মিত। ভারতীয় প্রভাবে শিখর ধরনের বা রেখা ধারায় নাগারা স্টাইলেও মন্দির নির্মিত হয়েছে। | ||
'''চারচালা''' মন্দির স্থাপত্যে চারটি ত্রিকোণী ছাদকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে এনে মেলানো হয় এবং আবার নিচের অংশে তা কার্নিশের বক্রাধারে এসে মিশে যায়। এ ধরনের মন্দির নির্মিত হয় সাধারণত একটি আয়াতাকৃতির ভিত্তির উপর লম্বালম্বিভাবে বর্ধিত একটি কক্ষের উপর এবং তাতে যুক্ত হয় চারচালা যা একটি খিলান ও সরু করবেল্টের ভল্টের দ্বারা যা কেন্দ্রীয় গম্বুজের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। মাদারীপুরে খলিয়ায় অবস্থিত রাজারাম রায়ের মন্দিরটি জোড়া বাংলা বা চার চালা ধরণের মন্দিরের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। যদিও এ ধরণের মন্দির বাংলায় বিরল তথাপি বাংলাদেশের ফরিদপুর, পাবনা, যশোর জেলায় এবং পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলায় এ প্রকার মন্দিরের অস্তিত্ব টিকে আছে। | '''''চারচালা''''' মন্দির স্থাপত্যে চারটি ত্রিকোণী ছাদকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে এনে মেলানো হয় এবং আবার নিচের অংশে তা কার্নিশের বক্রাধারে এসে মিশে যায়। এ ধরনের মন্দির নির্মিত হয় সাধারণত একটি আয়াতাকৃতির ভিত্তির উপর লম্বালম্বিভাবে বর্ধিত একটি কক্ষের উপর এবং তাতে যুক্ত হয় চারচালা যা একটি খিলান ও সরু করবেল্টের ভল্টের দ্বারা যা কেন্দ্রীয় গম্বুজের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। মাদারীপুরে খলিয়ায় অবস্থিত রাজারাম রায়ের মন্দিরটি জোড়া বাংলা বা চার চালা ধরণের মন্দিরের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। যদিও এ ধরণের মন্দির বাংলায় বিরল তথাপি বাংলাদেশের ফরিদপুর, পাবনা, যশোর জেলায় এবং পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলায় এ প্রকার মন্দিরের অস্তিত্ব টিকে আছে। | ||
'''আটচালা''' মন্দির আঠারো ও উনিশ শতকে বাংলায়, বিশেষ করে হুগলী ও হাওড়া জেলার নির্মাণশিল্পি ও পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ ধারার মন্দির চারচালা মন্দিরেরই অনুরূপ, তবে তার সঙ্গে একটি অতিরিক্ত ক্ষুদ্রাকৃতির ছাদের গঠন জোড়া দিয়ে মন্দিরের উচ্চতা বৃদ্ধি করা হয়। বৃহত্তর আট চালা মন্দিরে সাধারণত তিনটি প্রবেশদ্বার থাকে। আঠারো শতকে নির্মিত নালন্দায় অবস্থিত রামেশ্বরী মন্দিরের বাইরের দু’পাশের দেয়াল পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অলংকৃত এবং এতে রয়েছে পাঁচটি প্রবেশদ্বার। এ ছাড়াও আটচালা মন্দিরের অন্যান্য উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে যশোরের গুঞ্জনাথ শিব মন্দির (১৭৪০), বাগেরহাটের জোড় শিব মন্দির (১৮ শতক) কুমিল্লার চান্দিনার শিব মন্দির (১৯ শতক) প্রভৃতি। | '''''আটচালা''''' মন্দির আঠারো ও উনিশ শতকে বাংলায়, বিশেষ করে হুগলী ও হাওড়া জেলার নির্মাণশিল্পি ও পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ ধারার মন্দির চারচালা মন্দিরেরই অনুরূপ, তবে তার সঙ্গে একটি অতিরিক্ত ক্ষুদ্রাকৃতির ছাদের গঠন জোড়া দিয়ে মন্দিরের উচ্চতা বৃদ্ধি করা হয়। বৃহত্তর আট চালা মন্দিরে সাধারণত তিনটি প্রবেশদ্বার থাকে। আঠারো শতকে নির্মিত নালন্দায় অবস্থিত রামেশ্বরী মন্দিরের বাইরের দু’পাশের দেয়াল পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অলংকৃত এবং এতে রয়েছে পাঁচটি প্রবেশদ্বার। এ ছাড়াও আটচালা মন্দিরের অন্যান্য উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে যশোরের গুঞ্জনাথ শিব মন্দির (১৭৪০), বাগেরহাটের জোড় শিব মন্দির (১৮ শতক) কুমিল্লার চান্দিনার শিব মন্দির (১৯ শতক) প্রভৃতি। | ||
'''রত্ন ধারা '''মন্দির সাধারণ স্থাপত্যের বিভিন্ন ধারার সম্মিলিত রূপ বলা চলে। এ ধরনের মন্দির স্থাপত্যে বাংলা ও শিখর- এ দু’ধারার মিশ্রণ ঘটেছে। এরূপ মন্দিরের নিম্নাংশের ছাদে রয়েছে বাঁকানো কার্নিশ এবং ছাদে ক্ষুদ্রাকৃতির সূক্ষ্ম মোচাকার চূড়া যা বিশেষায়িত হয় রত্ন বা কিয়স্ক দ্বারা। বাংলাদেশের মন্দিরের ক্ষেত্রে এ মিশ্রধারার মন্দির স্থাপত্য এক সাধারণ চিত্র। | '''''রত্ন ধারা''''' মন্দির সাধারণ স্থাপত্যের বিভিন্ন ধারার সম্মিলিত রূপ বলা চলে। এ ধরনের মন্দির স্থাপত্যে বাংলা ও শিখর- এ দু’ধারার মিশ্রণ ঘটেছে। এরূপ মন্দিরের নিম্নাংশের ছাদে রয়েছে বাঁকানো কার্নিশ এবং ছাদে ক্ষুদ্রাকৃতির সূক্ষ্ম মোচাকার চূড়া যা বিশেষায়িত হয় রত্ন বা কিয়স্ক দ্বারা। বাংলাদেশের মন্দিরের ক্ষেত্রে এ মিশ্রধারার মন্দির স্থাপত্য এক সাধারণ চিত্র। | ||
'''নবরত্ন''' বা নয় চূড়ার মন্দির দেশের প্রায় সর্বত্র দেখা যায়। দিনাজপুরের কান্তনগর মন্দির, পাবনার হাতিকুমরুল মন্দির, খুলনার ধামারেলী মন্দির প্রভৃতি সবই নবরত্ন মন্দিরের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। এ ধারার মন্দিরসমূহের মধ্যে কান্তনগর মন্দিরটি সর্বাধিক অলংকৃত স্থাপত্যিক নির্দশন। ১৫.৮৫মি. আয়তনের বর্গাকার মন্দিরটি ৭৩ মি × ৩৭ মি প্রাঙ্গনের উপর স্থাপিত।মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ১৫ মিটারেরও বেশি এবং তিনতলা দালানের সমান। স্থানীয় রাজা প্রাণনাথ ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এটি নির্মাণ করেন। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর দত্তক পুত্র রামনাথ মন্দিরের পরবর্তী কাজ করে তা সম্পূর্ণ করেন। মন্দিরের প্রথম দু’টি তলার ছাদে প্রত্যেক চার কোণে চারটি করে মোট আটটি রত্ন এবং শীর্ষের ছাদের একটি রত্ন মিলিয়ে মোট নয়টি রত্ন সহযোগে মন্দিরটির অলংকরণ সম্পন্ন হয়েছিল। যদিও ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের ফলে মন্দিরের নয়টি রত্নই ভেঙে পড়ে। ফলে বর্তমানে তার কোন অস্তিত্ব নেই। মন্দির গাত্রের বাইরের দেয়ালের নিচু অংশ থেকে চূড়া পর্যন্ত প্রত্যেক ইঞ্চি পোড়ামাটির ফলক দ্বারা শোভিত। ফলকে অংকিত রয়েছে পৌরানীক কাহিনী চিত্র (রামায়ণ ও মহাভারত) ফুল, লতা-পাতা, জ্যামিতিক বিভিন্ন কাঠামো, মধ্যযুগীয় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সমাজ জীবন (সম্ভবত মুগল সম্ভ্রান্তদের চিত্র) এবং অল্প কিছু ইউরোপীয় নৌকার চিত্র। | [[Image:KantanagarTemple.jpg|thumb|right|400px|কান্তনগর নবরত্ন মন্দির]] | ||
'''''নবরত্ন''''' বা নয় চূড়ার মন্দির দেশের প্রায় সর্বত্র দেখা যায়। দিনাজপুরের কান্তনগর মন্দির, পাবনার হাতিকুমরুল মন্দির, খুলনার ধামারেলী মন্দির প্রভৃতি সবই নবরত্ন মন্দিরের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। এ ধারার মন্দিরসমূহের মধ্যে কান্তনগর মন্দিরটি সর্বাধিক অলংকৃত স্থাপত্যিক নির্দশন। ১৫.৮৫মি. আয়তনের বর্গাকার মন্দিরটি ৭৩ মি × ৩৭ মি প্রাঙ্গনের উপর স্থাপিত।মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ১৫ মিটারেরও বেশি এবং তিনতলা দালানের সমান। স্থানীয় রাজা প্রাণনাথ ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এটি নির্মাণ করেন। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর দত্তক পুত্র রামনাথ মন্দিরের পরবর্তী কাজ করে তা সম্পূর্ণ করেন। মন্দিরের প্রথম দু’টি তলার ছাদে প্রত্যেক চার কোণে চারটি করে মোট আটটি রত্ন এবং শীর্ষের ছাদের একটি রত্ন মিলিয়ে মোট নয়টি রত্ন সহযোগে মন্দিরটির অলংকরণ সম্পন্ন হয়েছিল। যদিও ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের ফলে মন্দিরের নয়টি রত্নই ভেঙে পড়ে। ফলে বর্তমানে তার কোন অস্তিত্ব নেই। মন্দির গাত্রের বাইরের দেয়ালের নিচু অংশ থেকে চূড়া পর্যন্ত প্রত্যেক ইঞ্চি পোড়ামাটির ফলক দ্বারা শোভিত। ফলকে অংকিত রয়েছে পৌরানীক কাহিনী চিত্র (রামায়ণ ও মহাভারত) ফুল, লতা-পাতা, জ্যামিতিক বিভিন্ন কাঠামো, মধ্যযুগীয় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সমাজ জীবন (সম্ভবত মুগল সম্ভ্রান্তদের চিত্র) এবং অল্প কিছু ইউরোপীয় নৌকার চিত্র। | |||
'''পঞ্চরত্ন''' মন্দির যশোর, পুঠিয়া (রাজশাহী), দিনাজপুর ও খুলনা জেলায় দেখতে পাওয়া যায়। উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই রাজশাহীর পুঠিয়ায় গোবিন্দ মন্দিরটি নির্মিত হয়। দ্বিতল এই পঞ্চরত্ন মন্দিরের প্রথম তলের ছাদের চারকোণে চারটি এবং দ্বিতলের ছাদে একটি করে মোট পাঁচটি রত্ন দ্বারা শোভিত। এ মন্দিরটির বাইরের দেয়ালও হিন্দু মহাকাব্য ও রাধাকৃষ্ণের জীবনগাঁথা অবলম্বনে পোড়ামাটির ফলকে অলংকৃত হয়েছে। | '''''পঞ্চরত্ন''''' মন্দির যশোর, পুঠিয়া (রাজশাহী), দিনাজপুর ও খুলনা জেলায় দেখতে পাওয়া যায়। উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই রাজশাহীর পুঠিয়ায় গোবিন্দ মন্দিরটি নির্মিত হয়। দ্বিতল এই পঞ্চরত্ন মন্দিরের প্রথম তলের ছাদের চারকোণে চারটি এবং দ্বিতলের ছাদে একটি করে মোট পাঁচটি রত্ন দ্বারা শোভিত। এ মন্দিরটির বাইরের দেয়ালও হিন্দু মহাকাব্য ও রাধাকৃষ্ণের জীবনগাঁথা অবলম্বনে পোড়ামাটির ফলকে অলংকৃত হয়েছে। | ||
বাংলাদেশে আরো এমন অনেক মন্দির স্থাপত্য গড়ে উঠেছে যাকে মন্দিরের সাধারন শ্রেণিকরণের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এগুলো অধিকাংশ চালা ও রত্ন ধারার মন্দিরের সমন্বয়ে ভিন্ন নির্মাণশৈলীতে নির্মিত। [নাসরীন আক্তার] | বাংলাদেশে আরো এমন অনেক মন্দির স্থাপত্য গড়ে উঠেছে যাকে মন্দিরের সাধারন শ্রেণিকরণের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এগুলো অধিকাংশ চালা ও রত্ন ধারার মন্দিরের সমন্বয়ে ভিন্ন নির্মাণশৈলীতে নির্মিত। [নাসরীন আক্তার] |
০৪:১৮, ৩ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
মন্দির স্থাপত্য গড়ে উঠেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা বিশ্বাসীদের ধর্মীয় আচার পালনের নিমিত্তে। দেবতার গৃহ বা দেবালয়কে এক কথায় বলা হয় ‘মন্দির’। ভারতবর্ষের সর্বত্র এর সাধারণ নাম ‘মন্দির’। স্থানীয় প্রভাবে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া মন্দিরের গঠন সাধারনত এক হলেও হিন্দু মন্দির স্থাপত্য গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ প্রেক্ষাপট। ভারতের ইতিহাসের ব্রোঞ্জযুগ থেকে মন্দিরের গঠন প্রক্রিয়ার শুরু। সাধারণত মন্দিরের অভ্যন্তরে ভক্তদের দেবতার প্রতিকৃতি বা মূর্তি স্থাপিত থাকে। কিছু কিছু মন্দিরে দেব-দেবীর মূর্তির পরিবর্তে দেবতার প্রতীকী উপস্থিতি থাকে। সাধারণত পর্বতের চূড়া, ঝর্ণা, পাহাড়ের গুহা বা নদী তীরবর্তী স্থানে মন্দির স্থাপত্য গড়ে উঠতে দেখা গেছে।
ভারতে প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে মন্দির স্থাপত্যের সূচনা হয়। ইট ও কাঠের নির্মিত প্রাচীনতম মন্দিরের অস্তিত্ব এখন আর টিকে না থাকলেও পরবর্তীকালের পাথর নির্মিত মন্দিরগুলো অনেকাংশেই টিকে আছে। কাঠামোগত ভাবে কোন একটি মন্দির বৈদিক নৈবেদ্যতা থেকে ভক্তি বা ভালোবাসার ধর্মে রূপান্তরিত হয় এবং তা থেকে একটি সম্প্রদায়ের বা ব্যক্তি বিশেষের বিশ্বাসে পরিণত হওয়ার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে দক্ষিণ এশীয় মন্দির ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মন্দির সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আবার পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের মন্দির স্থাপত্যের মধ্যে চমৎকার অভিন্ন ধারা গড়ে উঠেছে। গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলের পাথরের স্বল্পতার কারণে এ অঞ্চলের মন্দির নির্মাতাদের পাথর ব্যাতীত অন্যান্য নির্মাণ উপকরণের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ফলে পোড়ামাটির ইটের গাঁথুনীতে গড়া মন্দিরের দেয়াল অলংকরণে পোড়ামাটির ফলকের ব্যবহারও হয়েছে যা বাংলার মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রে অনন্য বৈচিত্র্য দান করেছে।
বাংলার নির্মাণকুশলী ও শিল্পিবৃন্দ নয়-এগারো শতক সময়ের মধ্যে পাল ও সেন শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় অসংখ্য মন্দির ও মন্দির সংশ্লিষ্ট ভাস্কর্য নির্মাণ করেছে। পরবর্তী প্রায় পাঁচ শতককাল এই শ্রেণিই মুসলিম শাসকদের অধীনে ইটের গাঁথুনীর মসজিদ ও সমাধি গড়ে তুলেছে; যার অধিকাংশ গড়ে উঠেছিল গৌড় নগরে। এ সময়ের মন্দির স্থাপত্যে সন্নিবেশিত হয়েছে চমৎকার বাঙালি স্থাপত্যিক কৌশল যার মধ্যে স্থানীয় রীতির সঙ্গে নবাগত ইসলামী রীতির কাঠামোগত মিশ্রণ ঘটেছে। যেমন গম্বুজ ও খিলান এর সম্মিলিত স্থাপত্যিক ধারার সঙ্গে স্থানীয় নির্মাণ ধারা হিসেবে যোগ হয় বক্রাকার কার্নিশ, অষ্টভূজ মিনার এবং ইটের অলংকরণ। সতেরো শতকে নির্মাণশিল্পে হিন্দু সমাজপতিদের পৃষ্ঠপোষকতা পুনরায় আরম্ভ হলে স্থাপত্য চর্চায় পরীক্ষামূলক যুগের সূচনা হয় এবং বিষ্ণুপুরে ব্যতিক্রমী ধারায় বেশ কিছু মন্দির গড়ে উঠতে দেখা যায়। সর্বশেষ ধারায়, হিন্দু মন্দির স্থাপত্যের মধ্যে ইসলামী গম্বুজ, ভল্ট ও খিলানের ব্যবহারের পাশাপাশি হিন্দু উপকরণ হিসেবে অষ্টভূজাকৃতির খিলান, দেহসর্বস্ব ভাস্কর্য ও উড়িষ্যার স্থাপত্যশৈলীর টারেট যুক্ত হয়েছে। এ ধারার মন্দিরসমূহ আপাতত একে অপরের থেকে পৃথক মনে হলেও শুধুমাত্র মন্দিরের ছাদ বা তার সার্বিক কাঠামোতেই পার্থক্যসমূহ বেশি লক্ষনীয়। তাছাড়া অধিকাংশ মন্দিরেরই প্রবেশদ্বারের কাঠামোতে খিলান যুক্ত হয়েছে। সাধারনত মধ্যবর্তী ভারী অষ্টভূজাকৃতির কলামের উপর তিন স্তর বিশিষ্ট খিলান যুক্ত হতে দেখা গেছে। অবশ্য একক খিলানবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারও সাধারণভাবে চোখে পড়ে। মন্দিরের অভ্যন্তরভাগ সাধারন একটি গম্বুজদ্বারা আবৃত (যদিও বাংলার মন্দির শুধুমাত্র ভল্ট দ্বারা আবৃত) এবং বারান্দাটি ভল্ট দ্বারা আবৃত। অন্যান্য সাধারণ গঠনশৈলীতে রয়েছে বক্রাকার কার্নিশ ও প্যারাপেট। এ ধারা বাংলার কুড়ে ঘরের বাঁকানো চালার অনুকরণে নির্মিত। তবে মন্দিরের ক্ষেত্রে তাতে পোড়ামাটির অলংকরণ যুক্ত হয়েছে।
মন্দির স্থাপত্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দিকটি হল মন্দিরের বাইরের দেয়ালে ব্যাপক পোড়ামাটির ফলকের অলংকরণ। কোনো কোনো মন্দিরের প্রত্যেক ইঞ্চি (এমনকি অভ্যন্তরের দেয়ালেও) পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অলংকৃত হত। সারিবাঁধা পোড়ামাটির ফলকের ছোট ছোট ব্লকে দেবদেবীর অবয়ব বা জ্যামিতিকি মোটিফ সহকারে নির্দিষ্ট ধারায় মন্দিরের দেয়ালের নির্দিষ্ট অংশে স্থাপন করে একত্রে একটি বৃহৎ ভাস্কর্য সৃষ্টি করা হতো। বাংলায় এরূপ অলংকরণের ধারা আঠারো শতকে পূর্ণতা পায়। তখন মন্দিরসমূহ প্রায় একই অলংকরিক ধারায় নির্মিত হতে শুরু করে। এক্ষেত্রে দিনাজপুরের কান্তনগর মন্দিরটি উল্লেখযোগ্য। এ মন্দিরের বাইরের দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী পোড়ামাটির ফলক চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
মন্দির স্থাপত্য ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলার নির্মাণশিল্পের ক্ষেত্রে অনন্য এক স্থান দখল করে আছে। বাংলায় (আধুনিক বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বঙ্গের প্রদেশ) ষোল থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত মন্দির স্থাপত্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এ সময়ে নতুন স্থাপত্যধারায় শতাধিক ইট নির্মিত মন্দির গড়ে উঠেছে। পনেরো শতকে বাংলায় শ্রী চৈতন্য কর্তৃক গৌরীয় বৈষ্ণব মতবাদ প্রসারের ফলে মন্দির স্থাপত্যরীতিতে সৃজনশীলতার ধারায় এ ধরনের নতুন উন্মাদনা প্রকাশ পায়। ভক্তের ভক্তিপ্রদর্শনের জন্য নব্য বৈষ্ণববাদে রূপান্তরিত জমিদারদের অনেকেই মন্দির নির্মাণের জন্য অনুদান প্রদান করতে শুরু করলে এ ধারার জন্ম হয়।
সাধারণভাবে মন্দির স্থাপত্যকে চারটি ধারায় বিভক্ত করা হয়ে থাকে:
১. রেখা দেউল বা শিখর
২. পিড়া দেউল বা ভদ্র
৩. স্তূপ শীর্ষ বা ভদ্র
৪. সুখ শীর্ষ ভদ্র বা রেখা
বাংলার মন্দির স্থাপত্যের শ্রেণি বিভাজনের ক্ষেত্রে ডেভিড ম্যাকাচন প্রথম পথ প্রদর্শন করেছেন (১৯৩০-১৯৭২)। তিনি ভিন্ন ধারা অবলম্বন করে বাংলার মন্দির স্থাপত্যকে চারভাগে ভাগ করেছেন, যেমন:
১. ঐতিহ্যিক: রেখা দেউল ও পিড়া দেউল।
২. কুঁড়েঘর: মন্দিরের সর্বাধিক সাধারণ ও সহজ ধরন এটি। কুঁড়ে ঘর মন্দির দুইভাগে বিভক্ত (ক) বাংলা মন্দির- এক বাংলা (দো-চালা/জোড় বাংলা) এবং (খ) চালা ধরন- চার চালা, আট চালা এবং বারো চালা মন্দির।
৩. ইন্দো-ইসলামি: পরবর্তী মধ্যযুগীয় মন্দির স্থাপত্যে হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যিক ধারার মিশ্রণ লক্ষণীয়। এ ধারায় দু’ধরনের মন্দির গড়ে উঠেছে: (ক) রত্ন মন্দির ও (খ) গম্বুজ সম্বলিত প্রাসাদ ধরন মন্দির।
৪. ইউরোপীয় স্থাপত্য দ্বারা প্রভাবিত মন্দির, যার অধিকাংশই গড়ে উঠেছে উনিশ শতকে। এ শতকে সমতল ছাদ বিশিষ্ট মন্দিরও গড়ে উঠে। ছোট সমতল ছাদ বিশিষ্ট মন্দিরকে বলা হয় ‘চাঁদনী’ এবং বৃহদাকারটির নাম হয় ‘দালান’। সমতল ছাদ বিশিষ্ট মন্দিরের কাঠামোর উপরেই পঞ্চরত্ন ও নবরত্ন ধরনের মন্দির নির্মিত হয়েছে।
বারান্দা সহযোগে আর এক ভিন্ন ধরণের মন্দিরের অস্তিত্ব বাংলায় রয়েছে। উড়িষ্যার মন্দির স্থাপত্যের প্রভাবে এ ধারার সৃষ্টি হয়। উড়িষ্যা ধারায় মন্দিরের গর্ভগৃহের সম্মুখে একটি মন্ডপ নির্মিত হত। বাংলার মন্দির স্থাপত্যে বারান্দাসহযোগে মন্দির সাধারণত একক ছাদ বিশিষ্ট হয়ে থাকে। তাছাড়াও আঠারো ও উনিশ শতকে দোলমঞ্চ ও রাশমঞ্চ সহকারে দালানও ছিল খুবই সাধারণ স্থাপত্যিক ধারায় নির্মিত। দোলমঞ্চের তুলনায় রাশমঞ্চগুলো আকারে বড় হত ও গঠনে ছিল অষ্টভূজাকৃতি। উঁচু একটি বেদীর উপর নির্মিত রাশমঞ্চটির ছাদ নবরত্ন ও পঞ্চরত্ন- টাওয়ার এর সঙ্গে রেখা বিশিষ্ট টারেট দ্বারা অলংকৃত করা হতো।
বাংলো ধরনের মন্দির বা কুঁড়ে ঘরের আকারে নির্মিত মন্দিরের গঠন ছিল সাদামাটা। সাধারণ মানুষের বসবাসের উপযোগী মাটির ঘরের আকারে বাংলা ধারার মন্দির নির্মিত হত। দেবতাদের বসবাস সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি- সম্ভবত এরূপ অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ভক্তরা এমন মন্দির নির্মাণ করতো। এ কারণে এক বাংলা, জোড় বাংলা, দোচালা, চারচালা ও আটচালা ধারায় মন্দির নির্মিত হয়েছে। দোচালা মন্দির বা জোড়বাংলা মন্দির সাধারণত একটি একক ভিত্তির উপর নির্মিত চতুষ্কোণ ঘরের উপর দু’দিকে ক্রমশ ঢালু হওয়া ছাদের সঙ্গে বাঁকানো কার্নিশ বিশিষ্ট মন্দির। এ ধারার মন্দির স্থাপত্যে বাংলার স্থানীয় কুঁড়ে ঘর নির্মাণের ধারাকে অনুসরণ করেছে। এ ধারার প্রথম সংযোজন হয় মুসলিম স্থাপত্যে। বাংলাদেশের যশোর অঞ্চল ব্যতীত অন্যান্য অঞ্চলে সহজে এ ধরণের স্থাপত্য দেখা যায় না। মুর্শিদাবাদে রাণী ভবানী কর্তৃক নির্মিত অনেকগুলো মন্দির এই ধারায় নির্মিত। ভারতীয় প্রভাবে শিখর ধরনের বা রেখা ধারায় নাগারা স্টাইলেও মন্দির নির্মিত হয়েছে।
চারচালা মন্দির স্থাপত্যে চারটি ত্রিকোণী ছাদকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে এনে মেলানো হয় এবং আবার নিচের অংশে তা কার্নিশের বক্রাধারে এসে মিশে যায়। এ ধরনের মন্দির নির্মিত হয় সাধারণত একটি আয়াতাকৃতির ভিত্তির উপর লম্বালম্বিভাবে বর্ধিত একটি কক্ষের উপর এবং তাতে যুক্ত হয় চারচালা যা একটি খিলান ও সরু করবেল্টের ভল্টের দ্বারা যা কেন্দ্রীয় গম্বুজের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। মাদারীপুরে খলিয়ায় অবস্থিত রাজারাম রায়ের মন্দিরটি জোড়া বাংলা বা চার চালা ধরণের মন্দিরের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। যদিও এ ধরণের মন্দির বাংলায় বিরল তথাপি বাংলাদেশের ফরিদপুর, পাবনা, যশোর জেলায় এবং পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলায় এ প্রকার মন্দিরের অস্তিত্ব টিকে আছে।
আটচালা মন্দির আঠারো ও উনিশ শতকে বাংলায়, বিশেষ করে হুগলী ও হাওড়া জেলার নির্মাণশিল্পি ও পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ ধারার মন্দির চারচালা মন্দিরেরই অনুরূপ, তবে তার সঙ্গে একটি অতিরিক্ত ক্ষুদ্রাকৃতির ছাদের গঠন জোড়া দিয়ে মন্দিরের উচ্চতা বৃদ্ধি করা হয়। বৃহত্তর আট চালা মন্দিরে সাধারণত তিনটি প্রবেশদ্বার থাকে। আঠারো শতকে নির্মিত নালন্দায় অবস্থিত রামেশ্বরী মন্দিরের বাইরের দু’পাশের দেয়াল পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অলংকৃত এবং এতে রয়েছে পাঁচটি প্রবেশদ্বার। এ ছাড়াও আটচালা মন্দিরের অন্যান্য উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে যশোরের গুঞ্জনাথ শিব মন্দির (১৭৪০), বাগেরহাটের জোড় শিব মন্দির (১৮ শতক) কুমিল্লার চান্দিনার শিব মন্দির (১৯ শতক) প্রভৃতি।
রত্ন ধারা মন্দির সাধারণ স্থাপত্যের বিভিন্ন ধারার সম্মিলিত রূপ বলা চলে। এ ধরনের মন্দির স্থাপত্যে বাংলা ও শিখর- এ দু’ধারার মিশ্রণ ঘটেছে। এরূপ মন্দিরের নিম্নাংশের ছাদে রয়েছে বাঁকানো কার্নিশ এবং ছাদে ক্ষুদ্রাকৃতির সূক্ষ্ম মোচাকার চূড়া যা বিশেষায়িত হয় রত্ন বা কিয়স্ক দ্বারা। বাংলাদেশের মন্দিরের ক্ষেত্রে এ মিশ্রধারার মন্দির স্থাপত্য এক সাধারণ চিত্র।
নবরত্ন বা নয় চূড়ার মন্দির দেশের প্রায় সর্বত্র দেখা যায়। দিনাজপুরের কান্তনগর মন্দির, পাবনার হাতিকুমরুল মন্দির, খুলনার ধামারেলী মন্দির প্রভৃতি সবই নবরত্ন মন্দিরের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। এ ধারার মন্দিরসমূহের মধ্যে কান্তনগর মন্দিরটি সর্বাধিক অলংকৃত স্থাপত্যিক নির্দশন। ১৫.৮৫মি. আয়তনের বর্গাকার মন্দিরটি ৭৩ মি × ৩৭ মি প্রাঙ্গনের উপর স্থাপিত।মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ১৫ মিটারেরও বেশি এবং তিনতলা দালানের সমান। স্থানীয় রাজা প্রাণনাথ ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এটি নির্মাণ করেন। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর দত্তক পুত্র রামনাথ মন্দিরের পরবর্তী কাজ করে তা সম্পূর্ণ করেন। মন্দিরের প্রথম দু’টি তলার ছাদে প্রত্যেক চার কোণে চারটি করে মোট আটটি রত্ন এবং শীর্ষের ছাদের একটি রত্ন মিলিয়ে মোট নয়টি রত্ন সহযোগে মন্দিরটির অলংকরণ সম্পন্ন হয়েছিল। যদিও ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের ফলে মন্দিরের নয়টি রত্নই ভেঙে পড়ে। ফলে বর্তমানে তার কোন অস্তিত্ব নেই। মন্দির গাত্রের বাইরের দেয়ালের নিচু অংশ থেকে চূড়া পর্যন্ত প্রত্যেক ইঞ্চি পোড়ামাটির ফলক দ্বারা শোভিত। ফলকে অংকিত রয়েছে পৌরানীক কাহিনী চিত্র (রামায়ণ ও মহাভারত) ফুল, লতা-পাতা, জ্যামিতিক বিভিন্ন কাঠামো, মধ্যযুগীয় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সমাজ জীবন (সম্ভবত মুগল সম্ভ্রান্তদের চিত্র) এবং অল্প কিছু ইউরোপীয় নৌকার চিত্র।
পঞ্চরত্ন মন্দির যশোর, পুঠিয়া (রাজশাহী), দিনাজপুর ও খুলনা জেলায় দেখতে পাওয়া যায়। উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই রাজশাহীর পুঠিয়ায় গোবিন্দ মন্দিরটি নির্মিত হয়। দ্বিতল এই পঞ্চরত্ন মন্দিরের প্রথম তলের ছাদের চারকোণে চারটি এবং দ্বিতলের ছাদে একটি করে মোট পাঁচটি রত্ন দ্বারা শোভিত। এ মন্দিরটির বাইরের দেয়ালও হিন্দু মহাকাব্য ও রাধাকৃষ্ণের জীবনগাঁথা অবলম্বনে পোড়ামাটির ফলকে অলংকৃত হয়েছে।
বাংলাদেশে আরো এমন অনেক মন্দির স্থাপত্য গড়ে উঠেছে যাকে মন্দিরের সাধারন শ্রেণিকরণের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এগুলো অধিকাংশ চালা ও রত্ন ধারার মন্দিরের সমন্বয়ে ভিন্ন নির্মাণশৈলীতে নির্মিত। [নাসরীন আক্তার]
গ্রন্থপঞ্জি fergusson, J. 1972 (reprint). History of Indian and Eastern Architecture. voll.II. New Delhi ; McCutchion, D.J.1972. Late medieval Temples of Bengal Origin and Classification. Calcutta ; Ahmed, Dr. Nazimuddin, Discover The Monuments of Bangladesh, 1984. Dhaka.