মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না)
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
'''মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা '''(Soil Management)  শস্য উৎপাদনের জন্য মৃত্তিকার অবস্থা উন্নত করার লক্ষ্যে পরিচালিত ভূমিকর্ষণ, চাষপদ্ধতি, সার প্রয়োগ, চুন প্রয়োগ ও পরিচর্যার সমষ্টি। সঠিক ব্যবস্থাপনা পরিচর্যার অভাবে বাংলাদেশের মৃত্তিকার উৎপাদন ক্ষমতা সাধারণভাবে হ্রাস পাচ্ছে। অধিকন্তু, মৃত্তিকার দুর্বল ব্যবস্থাপনা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশগত অবস্থার সৃষ্টি করে। এর পিছনে যে সত্যটি নিহীত তা হলো মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা চাপের কারণে ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে জনপ্রতি চাষাবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ ছিল মাত্র ০.০৮ হেক্টর। চাষাবাদযোগ্য ভূমির উপর এই বিশাল চাপ মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার অন্যান্য আর্থসামাজিক দিকের উপরও প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশে মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাকে উর্বরতা ব্যবস্থাপনা, মৃত্তিকার ভৌত ধর্মাবলির ব্যবস্থাপনা এবং সমস্যাসঙ্কুল মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাতে শ্রেণীবিভক্ত করা হয়।
'''মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা''' (Soil Management)  শস্য উৎপাদনের জন্য মৃত্তিকার অবস্থা উন্নত করার লক্ষ্যে পরিচালিত ভূমিকর্ষণ, চাষপদ্ধতি, সার প্রয়োগ, চুন প্রয়োগ ও পরিচর্যার সমষ্টি। সঠিক ব্যবস্থাপনা পরিচর্যার অভাবে বাংলাদেশের মৃত্তিকার উৎপাদন ক্ষমতা সাধারণভাবে হ্রাস পাচ্ছে। অধিকন্তু, মৃত্তিকার দুর্বল ব্যবস্থাপনা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশগত অবস্থার সৃষ্টি করে। এর পিছনে যে সত্যটি নিহীত তা হলো মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা চাপের কারণে ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে জনপ্রতি চাষাবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ ছিল মাত্র ০.০৮ হেক্টর। চাষাবাদযোগ্য ভূমির উপর এই বিশাল চাপ মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার অন্যান্য আর্থসামাজিক দিকের উপরও প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশে মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাকে উর্বরতা ব্যবস্থাপনা, মৃত্তিকার ভৌত ধর্মাবলির ব্যবস্থাপনা এবং সমস্যাসঙ্কুল মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাতে শ্রেণীবিভক্ত করা হয়।


'''উর্বরতা ব্যবস্থাপনা'''  বাংলাদেশের মৃত্তিকার উর্বরতার অবস্থা মধ্যম থেকে স্বল্প। মৃত্তিকাতে বিদ্যমান জৈবপদার্থের পরিমাণ অধিক নয় এবং এ মান অধিকাংশ ক্ষেত্রে ২ শতাংশেরও কম। উঁচু জমিতে জন্মে এমন ফসলের জন্য বাংলাদেশের ভূমির প্রায় ৫.৬, ৭.৫ ও ৮.৭ মিলিয়ন হেক্টরে যথাক্রমে ফসফরাস, পটাশিয়াম ও সালফারের ঘাটতি রয়েছে। প্রায় ১.৭৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে দস্তার অভাব শনাক্ত করা হয়েছে এবং বোরনের ঘাটতি ধীরে ধীরে মনোযোগ আকর্ষণ করছে। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান আবাদী শস্য মৃত্তিকা থেকে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি মৌল অপসারণ করে। উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান মৃত্তিকা থেকে যথাক্রমে ১০৮, ১৮, ১২০ ও ১১ কেজি/ হেক্টর নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও সালফার গ্রহণ করে। গম শস্যও মৃত্তিকা থেকে অধিক পরিমাণে নাইট্রোজেন ও পটাশিয়াম গ্রহণ করে। শস্য উৎপাদনের বর্তমান মাত্রার জন্য প্রায় ১.০ মিলিয়ন টন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও সালফার প্রতিবছর মৃত্তিকা থেকে অপসারিত হয়।
'''''উর্বরতা ব্যবস্থাপনা'''''  বাংলাদেশের মৃত্তিকার উর্বরতার অবস্থা মধ্যম থেকে স্বল্প। মৃত্তিকাতে বিদ্যমান জৈবপদার্থের পরিমাণ অধিক নয় এবং এ মান অধিকাংশ ক্ষেত্রে ২ শতাংশেরও কম। উঁচু জমিতে জন্মে এমন ফসলের জন্য বাংলাদেশের ভূমির প্রায় ৫.৬, ৭.৫ ও ৮.৭ মিলিয়ন হেক্টরে যথাক্রমে ফসফরাস, পটাশিয়াম ও সালফারের ঘাটতি রয়েছে। প্রায় ১.৭৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে দস্তার অভাব শনাক্ত করা হয়েছে এবং বোরনের ঘাটতি ধীরে ধীরে মনোযোগ আকর্ষণ করছে। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান আবাদী শস্য মৃত্তিকা থেকে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি মৌল অপসারণ করে। উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান মৃত্তিকা থেকে যথাক্রমে ১০৮, ১৮, ১২০ ও ১১ কেজি/ হেক্টর নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও সালফার গ্রহণ করে। গম শস্যও মৃত্তিকা থেকে অধিক পরিমাণে নাইট্রোজেন ও পটাশিয়াম গ্রহণ করে। শস্য উৎপাদনের বর্তমান মাত্রার জন্য প্রায় ১.০ মিলিয়ন টন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও সালফার প্রতিবছর মৃত্তিকা থেকে অপসারিত হয়।


বিগত কয়েক বছর যাবৎ এশিয়ায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পুষ্টি উপাদান সরবরাহের জন্য সারের ব্যবহার অপরিবর্তিত রয়েছে। বিরাজমান মৃত্তিকা ও ভূমি প্রকার এবং বিভিন্ন শস্য চাষপদ্ধতির উপর ভিত্তি করে এটা পরিমাপ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে ন্যূনতম ৪.০ মিলিয়ন টন সারের প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু বর্তমানে প্রায় ২.২৫ মিলিয়ন টন প্রয়োগ করা হচ্ছে, অর্থাৎ এ পরিমাণ মোট চাহিদার ৫৬ শতাংশ। সর্বাধিক অনুকূল মাত্রার চেয়ে কম সার প্রয়োগের ফলে বাংলাদেশের মৃত্তিকার উপর অবিরতভাবে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যবহূত প্রধান সারগুলো হচ্ছে ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (TSP), মিউরিয়েট অব পটাশ (MP) এবং জিপসাম।
বিগত কয়েক বছর যাবৎ এশিয়ায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পুষ্টি উপাদান সরবরাহের জন্য সারের ব্যবহার অপরিবর্তিত রয়েছে। বিরাজমান মৃত্তিকা ও ভূমি প্রকার এবং বিভিন্ন শস্য চাষপদ্ধতির উপর ভিত্তি করে এটা পরিমাপ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে ন্যূনতম ৪.০ মিলিয়ন টন সারের প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু বর্তমানে প্রায় ২.২৫ মিলিয়ন টন প্রয়োগ করা হচ্ছে, অর্থাৎ এ পরিমাণ মোট চাহিদার ৫৬ শতাংশ। সর্বাধিক অনুকূল মাত্রার চেয়ে কম সার প্রয়োগের ফলে বাংলাদেশের মৃত্তিকার উপর অবিরতভাবে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যবহূত প্রধান সারগুলো হচ্ছে ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (TSP), মিউরিয়েট অব পটাশ (MP) এবং জিপসাম।
১০ নং লাইন: ১০ নং লাইন:
অজৈব সার ছাড়া জৈব সারও বাংলাদেশের কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ। গৃহপালিত পশু প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে মল (গোবর ও মূত্র) ত্যাগ করে। গরুর গোবর প্রাণীজ জৈব সারের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে গোবর সারের এক বিরাট অংশ প্রধানত জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয়। বর্তমানে জৈব গ্যাস প্লান্ট বাংলাদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে। জৈব গ্যাস প্লান্টের বিয়োজিত জৈব পদার্থের অবশেষ সরাসরি মৃত্তিকাতে প্রয়োগ করা যায়। ধান ক্ষেতে অ্যাজোলার (Azolla) চাষ এদেশের জীবাণু সার ব্যবহারের প্রধান সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অন্যান্য জীবাণুসার যেমন- রাইজোবিয়াম (Rhizobium) ইনওকুলা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পাওয়া যায়।
অজৈব সার ছাড়া জৈব সারও বাংলাদেশের কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ। গৃহপালিত পশু প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে মল (গোবর ও মূত্র) ত্যাগ করে। গরুর গোবর প্রাণীজ জৈব সারের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে গোবর সারের এক বিরাট অংশ প্রধানত জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয়। বর্তমানে জৈব গ্যাস প্লান্ট বাংলাদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে। জৈব গ্যাস প্লান্টের বিয়োজিত জৈব পদার্থের অবশেষ সরাসরি মৃত্তিকাতে প্রয়োগ করা যায়। ধান ক্ষেতে অ্যাজোলার (Azolla) চাষ এদেশের জীবাণু সার ব্যবহারের প্রধান সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অন্যান্য জীবাণুসার যেমন- রাইজোবিয়াম (Rhizobium) ইনওকুলা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পাওয়া যায়।


'''মৃত্তিকার ভৌত ধর্মাবলির ব্যবস্থাপনা'''  বাংলাদেশের আবাদি শস্যের মধ্যে ধান প্রধান শস্য। এটি মূলত জলমগ্ন মৃত্তিকাতে জন্মে। ধান চাষের জন্য জমি তৈরির সাধারণ পদ্ধতি হলো কাদা করা (puddling)। এ প্রক্রিয়াতে জলমগ্ন অবস্থায় দেশী লাঙ্গল দিয়ে বাংরবার চাষ ও মই দিয়ে মৃত্তিকা সংযুতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। মৃত্তিকার পাডলিং-এর কারণে ৫ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার গভীরতায় প্লাউপ্যান (লাঙ্গল দ্বারা চাষের ফলে সৃষ্ট শক্ত স্তর) তৈরি হয়। এ দৃঢ় স্তর ধান চাষের জন্য অনুকূল, কিন্তু অন্যান্য আবাদি শস্যের জন্য নয়। অন্যান্য শস্য আবাদের জন্য মৃত্তিকাকে সাধারণত কয়েকবার চাষ ও মই দেওয়া হয়।
'''''মৃত্তিকার ভৌত ধর্মাবলির ব্যবস্থাপনা'''''  বাংলাদেশের আবাদি শস্যের মধ্যে ধান প্রধান শস্য। এটি মূলত জলমগ্ন মৃত্তিকাতে জন্মে। ধান চাষের জন্য জমি তৈরির সাধারণ পদ্ধতি হলো কাদা করা (puddling)। এ প্রক্রিয়াতে জলমগ্ন অবস্থায় দেশী লাঙ্গল দিয়ে বাংরবার চাষ ও মই দিয়ে মৃত্তিকা সংযুতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। মৃত্তিকার পাডলিং-এর কারণে ৫ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার গভীরতায় প্লাউপ্যান (লাঙ্গল দ্বারা চাষের ফলে সৃষ্ট শক্ত স্তর) তৈরি হয়। এ দৃঢ় স্তর ধান চাষের জন্য অনুকূল, কিন্তু অন্যান্য আবাদি শস্যের জন্য নয়। অন্যান্য শস্য আবাদের জন্য মৃত্তিকাকে সাধারণত কয়েকবার চাষ ও মই দেওয়া হয়।


সম্প্রতি বাংলাদেশে কর্ষণহীন (no-till) কৃষি ব্যবস্থার উপর গবেষণা শুরু হয়েছে। এ পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক কৃষকই জানে না। কর্ষণহীন কৃষি ব্যবস্থাতে কর্ষণের ব্যয় হ্রাস বাংলাদেশের কৃষির জন্য সম্ভাবনাময়।
সম্প্রতি বাংলাদেশে কর্ষণহীন (no-till) কৃষি ব্যবস্থার উপর গবেষণা শুরু হয়েছে। এ পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক কৃষকই জানে না। কর্ষণহীন কৃষি ব্যবস্থাতে কর্ষণের ব্যয় হ্রাস বাংলাদেশের কৃষির জন্য সম্ভাবনাময়।


'''সমস্যাসঙ্কুল মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা'''  বাংলাদেশের তিনটি সমস্যাসঙ্কুল মৃত্তিকা হলো: লবণাক্ত মৃত্তিকা, অম্ল সালফেট মৃত্তিকা এবং পিট। গড়ে প্রায় ০.৮২, ০.০৭ এবং ০.১৩ মিলিয়ন হেক্টর ভূমি যথাক্রমে লবণাক্ত, অম্ল সালফেট এবং পিট মৃত্তিকার অন্তর্ভুক্ত। এসব মৃত্তিকার ব্যবস্থাপনাতে বিভিন্ন পদ্ধতি (যেমন- সমূলে উৎপাটন, রূপান্তর, শস্য নির্বাচন ইত্যাদি) ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এসব মৃত্তিকাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অত্যন্ত কম গবেষণাই করা হয়েছে।  [টি.এইচ খান এবং এস.এম ফজলে রাবিব]
'''''সমস্যাসঙ্কুল মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা'''''  বাংলাদেশের তিনটি সমস্যাসঙ্কুল মৃত্তিকা হলো: লবণাক্ত মৃত্তিকা, অম্ল সালফেট মৃত্তিকা এবং পিট। গড়ে প্রায় ০.৮২, ০.০৭ এবং ০.১৩ মিলিয়ন হেক্টর ভূমি যথাক্রমে লবণাক্ত, অম্ল সালফেট এবং পিট মৃত্তিকার অন্তর্ভুক্ত। এসব মৃত্তিকার ব্যবস্থাপনাতে বিভিন্ন পদ্ধতি (যেমন- সমূলে উৎপাটন, রূপান্তর, শস্য নির্বাচন ইত্যাদি) ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এসব মৃত্তিকাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অত্যন্ত কম গবেষণাই করা হয়েছে।  [টি.এইচ খান এবং এস.এম ফজলে রাবিব]


[[en:Soil Management]]
[[en:Soil Management]]

০৫:১০, ৫ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা (Soil Management)  শস্য উৎপাদনের জন্য মৃত্তিকার অবস্থা উন্নত করার লক্ষ্যে পরিচালিত ভূমিকর্ষণ, চাষপদ্ধতি, সার প্রয়োগ, চুন প্রয়োগ ও পরিচর্যার সমষ্টি। সঠিক ব্যবস্থাপনা পরিচর্যার অভাবে বাংলাদেশের মৃত্তিকার উৎপাদন ক্ষমতা সাধারণভাবে হ্রাস পাচ্ছে। অধিকন্তু, মৃত্তিকার দুর্বল ব্যবস্থাপনা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশগত অবস্থার সৃষ্টি করে। এর পিছনে যে সত্যটি নিহীত তা হলো মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা চাপের কারণে ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে জনপ্রতি চাষাবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ ছিল মাত্র ০.০৮ হেক্টর। চাষাবাদযোগ্য ভূমির উপর এই বিশাল চাপ মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার অন্যান্য আর্থসামাজিক দিকের উপরও প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশে মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাকে উর্বরতা ব্যবস্থাপনা, মৃত্তিকার ভৌত ধর্মাবলির ব্যবস্থাপনা এবং সমস্যাসঙ্কুল মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাতে শ্রেণীবিভক্ত করা হয়।

উর্বরতা ব্যবস্থাপনা  বাংলাদেশের মৃত্তিকার উর্বরতার অবস্থা মধ্যম থেকে স্বল্প। মৃত্তিকাতে বিদ্যমান জৈবপদার্থের পরিমাণ অধিক নয় এবং এ মান অধিকাংশ ক্ষেত্রে ২ শতাংশেরও কম। উঁচু জমিতে জন্মে এমন ফসলের জন্য বাংলাদেশের ভূমির প্রায় ৫.৬, ৭.৫ ও ৮.৭ মিলিয়ন হেক্টরে যথাক্রমে ফসফরাস, পটাশিয়াম ও সালফারের ঘাটতি রয়েছে। প্রায় ১.৭৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে দস্তার অভাব শনাক্ত করা হয়েছে এবং বোরনের ঘাটতি ধীরে ধীরে মনোযোগ আকর্ষণ করছে। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান আবাদী শস্য মৃত্তিকা থেকে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি মৌল অপসারণ করে। উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান মৃত্তিকা থেকে যথাক্রমে ১০৮, ১৮, ১২০ ও ১১ কেজি/ হেক্টর নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও সালফার গ্রহণ করে। গম শস্যও মৃত্তিকা থেকে অধিক পরিমাণে নাইট্রোজেন ও পটাশিয়াম গ্রহণ করে। শস্য উৎপাদনের বর্তমান মাত্রার জন্য প্রায় ১.০ মিলিয়ন টন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও সালফার প্রতিবছর মৃত্তিকা থেকে অপসারিত হয়।

বিগত কয়েক বছর যাবৎ এশিয়ায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পুষ্টি উপাদান সরবরাহের জন্য সারের ব্যবহার অপরিবর্তিত রয়েছে। বিরাজমান মৃত্তিকা ও ভূমি প্রকার এবং বিভিন্ন শস্য চাষপদ্ধতির উপর ভিত্তি করে এটা পরিমাপ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে ন্যূনতম ৪.০ মিলিয়ন টন সারের প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু বর্তমানে প্রায় ২.২৫ মিলিয়ন টন প্রয়োগ করা হচ্ছে, অর্থাৎ এ পরিমাণ মোট চাহিদার ৫৬ শতাংশ। সর্বাধিক অনুকূল মাত্রার চেয়ে কম সার প্রয়োগের ফলে বাংলাদেশের মৃত্তিকার উপর অবিরতভাবে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যবহূত প্রধান সারগুলো হচ্ছে ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (TSP), মিউরিয়েট অব পটাশ (MP) এবং জিপসাম।

১৯৭১ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ব্যবহূত মোট সারের মধ্যে ইউরিয়ার পরিমাণ ৬৮.৭ শতাংশ, টিএসপি ২২.২ শতাংশ এবং এমপি ৫.২ শতাংশ। বাংলাদেশে সার ব্যবহারের প্রবণতা থেকে দেখা যায় যে, কৃষিকাজে নাইট্রোজেন সারের ব্যবহার সর্বোচ্চ। কৃষি ক্ষেত্রে সালফার ও দস্তার ব্যবহার শুরু হয়েছিল ১৯৮০-৮১ সালে এবং সে সময় থেকে এ দুটি সারের ব্যবহার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের উৎস হিসেবে ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেটের (DAP) ব্যবহার বাংলাদেশে এখন জনপ্রিয় হচ্ছে। ডাইঅ্যামোনিয়াম ফসফেটের ব্যবহার কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারও হ্রাস করছে।

অজৈব সার ছাড়া জৈব সারও বাংলাদেশের কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ। গৃহপালিত পশু প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে মল (গোবর ও মূত্র) ত্যাগ করে। গরুর গোবর প্রাণীজ জৈব সারের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে গোবর সারের এক বিরাট অংশ প্রধানত জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয়। বর্তমানে জৈব গ্যাস প্লান্ট বাংলাদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে। জৈব গ্যাস প্লান্টের বিয়োজিত জৈব পদার্থের অবশেষ সরাসরি মৃত্তিকাতে প্রয়োগ করা যায়। ধান ক্ষেতে অ্যাজোলার (Azolla) চাষ এদেশের জীবাণু সার ব্যবহারের প্রধান সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অন্যান্য জীবাণুসার যেমন- রাইজোবিয়াম (Rhizobium) ইনওকুলা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পাওয়া যায়।

মৃত্তিকার ভৌত ধর্মাবলির ব্যবস্থাপনা  বাংলাদেশের আবাদি শস্যের মধ্যে ধান প্রধান শস্য। এটি মূলত জলমগ্ন মৃত্তিকাতে জন্মে। ধান চাষের জন্য জমি তৈরির সাধারণ পদ্ধতি হলো কাদা করা (puddling)। এ প্রক্রিয়াতে জলমগ্ন অবস্থায় দেশী লাঙ্গল দিয়ে বাংরবার চাষ ও মই দিয়ে মৃত্তিকা সংযুতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। মৃত্তিকার পাডলিং-এর কারণে ৫ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার গভীরতায় প্লাউপ্যান (লাঙ্গল দ্বারা চাষের ফলে সৃষ্ট শক্ত স্তর) তৈরি হয়। এ দৃঢ় স্তর ধান চাষের জন্য অনুকূল, কিন্তু অন্যান্য আবাদি শস্যের জন্য নয়। অন্যান্য শস্য আবাদের জন্য মৃত্তিকাকে সাধারণত কয়েকবার চাষ ও মই দেওয়া হয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশে কর্ষণহীন (no-till) কৃষি ব্যবস্থার উপর গবেষণা শুরু হয়েছে। এ পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক কৃষকই জানে না। কর্ষণহীন কৃষি ব্যবস্থাতে কর্ষণের ব্যয় হ্রাস বাংলাদেশের কৃষির জন্য সম্ভাবনাময়।

সমস্যাসঙ্কুল মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা  বাংলাদেশের তিনটি সমস্যাসঙ্কুল মৃত্তিকা হলো: লবণাক্ত মৃত্তিকা, অম্ল সালফেট মৃত্তিকা এবং পিট। গড়ে প্রায় ০.৮২, ০.০৭ এবং ০.১৩ মিলিয়ন হেক্টর ভূমি যথাক্রমে লবণাক্ত, অম্ল সালফেট এবং পিট মৃত্তিকার অন্তর্ভুক্ত। এসব মৃত্তিকার ব্যবস্থাপনাতে বিভিন্ন পদ্ধতি (যেমন- সমূলে উৎপাটন, রূপান্তর, শস্য নির্বাচন ইত্যাদি) ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এসব মৃত্তিকাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অত্যন্ত কম গবেষণাই করা হয়েছে।  [টি.এইচ খান এবং এস.এম ফজলে রাবিব]