বিমান বন্দর: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত ৩টি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না) | |||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
[[Category:বাংলাপিডিয়া]] | [[Category:বাংলাপিডিয়া]] | ||
'''বিমান বন্দর''' | '''বিমান বন্দর''' দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সরকার বার্মায় রণাঙ্গনমুখী যুদ্ধবিমান চালনার জন্য ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় রয়্যাল ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের জন্য একটি সামরিক বিমান ঘাঁটি নির্মাণ করে, যা ১৯৪৩ সালে চালু হয়। তেজগাঁও বিমান বন্দরটিই ছিল পূর্ববঙ্গের প্রথম বেসামরিক বিমানবন্দর, এবং তা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ঘাঁটি হিসেবেও পরবর্তীতে ব্যবহৃত হতো। ঢাকার কুর্মিটোলায় (বালুরঘাট) একটি অবতরণ স্ট্রিপের নির্মাণও ব্রিটিশ সরকার প্রায় একই সময়ে শুরু করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশের ভূ-সীমায় ব্রিটিশ সরকার নির্মিত সামরিক বিমান ঘাঁটিগুলির বেশ কয়েকটিকে বেসামরিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করা হয়। তবে বিমান অবতরণের সুবিধা থাকলেও অপর কয়েকটিকে এখন পর্যন্ত বিমানবন্দরে রূপান্তর করা হয় নি। এগুলির মধ্যে আছে: লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, ফেনী, রাজেন্দ্রপুর, পাহাড় কাঞ্চনপুর এবং রসুলপুর। | ||
[[Image:AirNetworkWithAirports.jpg|thumb|right|400px]] | |||
বাংলাদেশে বর্তমানে তিনটি আন্তর্জাতিক ও পাঁচটি অভ্যন্তরীণ মিলিয়ে মোট আটটি বিমানবন্দর চালু আছে: হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা; শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম; ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সিলেট; বরিশাল বিমানবন্দর, কক্সবাজার বিমানবন্দর; যশোর বিমানবন্দর; শাহ মখদুম বিমানবন্দর, রাজশাহী; ও সৈয়দপুর বিমানবন্দর। এছাড়া তিনটি বিমানবন্দর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট অপারেশনের জন্য তৈরি হয়েছে যেগুলোর একটি ঢাকার তেজগাঁও-এ অবস্থিত পুরনো বিমানবন্দর। এটি বর্তমানে বিশেষ কাজে ব্যবহৃত হয় এবং এখানে বিমানচালকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এটিসহ বগুড়া ও সিলেটের শমসেরনগরে অবস্থিত অন্য দুটি বিমানবন্দর এখন অবধি বেসামরিক বিমান পরিবহন পরিচালনার সরকারি অনুমোদন পায়নি। বাংলাদেশে আরও তিনটি পুরনো এয়ারস্ট্রিপ আছে। কুমিল্লা, পাবনার ঈশ্বরদী এবং ঠাকুরগাঁও-এর এই এয়ারস্ট্রিপগুলি নিয়মিত বিমানবন্দর হিসেবে উন্নত হতে পারে। বাগেরহাটে খান জাহান আলী বিমানবন্দর নামে একটি নতুন বিমানবন্দর নির্মাণাধীন আছে। | |||
তাছাড়া বগুড়া, বাগেরহাট, টুঙ্গিপাড়া, হাতিয়া, রামগতি, নোয়াখালী প্রভৃতি স্থানে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বিবেচনাধীন আছে। দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই হেলিকপ্টার অবতরণের সুবিধা রয়েছে। | |||
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ঢাকা এবং বাংলার অন্যান্য অরক্ষিত স্থানে রাজকীয় ভারতীয় বিমান বাহিনীর ঘাঁটি নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৯৪১ সালে ঢাকা শহরে তেজগাঁও বিমান বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়, এবং একই সময়ে ঢাকার কুর্মিটোলায় বিমান অবতরণ ক্ষেত্র তৈরিও শুরু করা হয়। ব্রিটিশ বিমান বাহিনী তাদের যুদ্ধবিমান রাখার জন্য এই দুটি বিমানক্ষেত্র ব্যবহার করত। তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে মূলত সামরিক যুদ্ধবিমান অবতরণের সুবিধা ছিল। কুর্মিটোলাতেও মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি দল অবস্থান করছিল। ১৯৪৩ সালের শুরুতে তেজগাঁও-এর নির্মাণাধীন রানওয়েতে রাজকীয় ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি হালকা যুদ্ধবিমান অবতরণ করে। ব্রিটিশ বিমান বাহিনী ছাড়াও ইস্পাহানি গ্রুপ ও তার অংশীদারেরা ১৯৪৬-এ চালুকৃত ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ-এর বিমান চালনার জন্য এই বিমান বন্দরটি ব্যবহার করত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে তেজগাঁও বিমান বন্দরটি একাধারে আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ বিমান বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। কুর্মিটোলায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণ কাজও এ সময়ে এগিয়ে নেওয়া হয়। | |||
১৯৪৭ সালে তেজগাঁও বিমান বন্দর ব্যবহারকারী ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ-এর বহরে ডিসি-৩ (ডাকোটা) এবং ডিএইচসি-৬ (টুইন অটার) নামে ২টি পরিবহন বিমান ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় পতাকাবাহী পাকিস্তান আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স (পিআইএ) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে চলাচল শুরু হলে পাকিস্তান সরকার সামরিক এবং বেসামরিক বিমান চলাচল জাতীয়করণ করে। ফলে ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। স্থানীয় তরুণ পাইলিটদের বিমান চালনায় প্রশিক্ষিত করার লক্ষ্যে সরকার ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ফ্লাইং ক্লাব স্থাপন করে। পূর্ব পাকিস্তানে একটি শাখাসহ ১৯৫৬ সালে উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের ফ্লাইং উইংও স্থাপন করা হয়। এ সকল সংস্থাসহ পিআইএ-র বিমানবহরে সংযুক্ত ডাকোটা, ভাইকাউন্ট এবং ফকার বিমান ব্যবহারের মাধ্যমে তেজগাঁও বিমান বন্দর ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে পিআইএ-র বিমানবহরে বোয়িং, কমেট এবং ডিসি-৮-এর ন্যায় জেটবিমান সংযোজিত হয়। বিমান বন্দরটি ব্রিটিশ ওভারসিজ এয়ারওয়েজ করপোরেশন এবং প্যান আমেরিকান এয়ারওয়েজসহ বিদেশি বিমান সংস্থাসমূহকে সেবা প্রদান করতে থাকে। ১৯৬০ সালে পিআইএ বোয়িং জেট সার্ভিস চালু করে। | |||
আন্তর্জাতিক মানের সেবা ও সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং বিমান বন্দর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তেজগাঁও বিমান বন্দরের মানোন্নয়ন করে। যশোর, চট্টগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, ঈশ্বরদী এবং কুমিল্লায় দেশের অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর কার্যক্রম শুরু হয়। স্বাধীনতার পর তেজগাঁও বিমান বন্দরটি বিমান চলাচলের সার্বিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও অপ্রতুল বিবেচিত হওয়ায় কুর্মিটোলায় নতুন আন্তর্জার্তিক বিমান বন্দর নির্মাণের কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়। নতুন বিমান বন্দরটি ১৯৮১ সালে চালু হয়, এবং তখনই তেজগাঁও বিমান বন্দরটিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর নিকট হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নামে পরিচিত কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে বৃহৎ পরিসরের টার্মিনাল ভবন, হ্যাঙ্গার, কারিগরি প্রাঙ্গণ, পণ্যগুদাম বা কার্গো-ভিলেজ প্রভৃতিসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও যন্ত্রপাতি সংযোজিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি জাতীয় বিমান সংস্থা- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স' ফকার এফ-২৭ এবং এটিপি বিমান চালনার মাধ্যমে তার কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তী সময়ে সংস্থাটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট উড্ডয়নের জন্য প্রশস্ত পরিসরের টারবো জেট এবং অন্যান্য শ্রেণির বিমান ক্রয় করে। ২০০০ সালের মধ্যে বিমানের বহরে ৫টি ডিসি-১০, ৩টি এফ-২৮, ৩টি এয়ারবাস যুক্ত হয়। এ ছাড়া ছিল লিজ নেওয়া ১টি ডিসি-১০ এবং ১টি এয়ারবাস। ২০২০ সালে [[বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস|বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের]] বহরে ছিল ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, ২টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ৪টি বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার, ২টি বোয়িং ৭৮৭-৯২ ড্রিমলাইনার, এবং ৪টি ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ। অপরদিকে কয়েকটি বেসরকারি বিমানসংস্থাও ১৯৯৬ সালের পর কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে দেশে ৪টি ব্যক্তিখাতের বিমান চলালচল সংস্থাসহ ৫টি বেসামরিক এয়ারলাইন্স যাত্রী পরিবহনে নিয়োজিত আছে। | |||
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর বিশ্বের অধিকাংশ নগরীর সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে। তাছাড়া এটা ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, যশোর, সিলেট, ঈশ্বরদী, কক্সবাজার, সৈয়দপুর, রাজশাহী এবং বরিশালের অভ্যন্তরীণ বিমান বন্দরগুলিকে সংযুক্ত করেছে। ২০০০ সাল হতে দেশের ৩টি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ৪টি মহাদেশের ৩১টি গন্তব্যে নিয়মিত বিমান চলাচল চালু রাখা হয়েছে। গন্তব্যগুলির মধ্যে ছিল- কলকাতা, কাঠমন্ডু, লন্ডন, দুবাই, ব্যাংকক, করাচি, আবুধাবি, মুম্বাই, সিঙ্গাপুর, জেদ্দা, দোহা, আমস্টার্ডাম, কুয়েত সিটি, এথেন্স, ত্রিপোলি, মাস্কাট, কুয়ালালামপুর, রেঙ্গুন, দাহরান, রোম, বাগদাদ, বাহরাইন, প্যারিস, ফ্রাঙ্কফুর্ট, শারজাহ, টোকিও, রিয়াদ, মালটা এবং নিউইয়র্ক। | |||
বিমান | ১৯৯৬ সাল হতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বেসরকারি বিমান সংস্থাসমূহকে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লাইসেন্স প্রদান শুরু করে। তাছাড়া উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের এয়ার উইং এবং ফ্লাইং ক্লাবসমূহকে বেবিচকের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়। বেসরকারি বেসামরিক বিমান সংস্থাগুলির অপারেটিং অফিস স্থাপন এবং বিমানবন্দর ব্যবহারের জন্য বেবিচক-এর অনুমতি নিতে হয়। বর্তমানে বেবিচক দেশে ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ৭টি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, এবং ২টি শর্ট টেকঅফ ও ল্যান্ডিং (STOL) বন্দর পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত। তবে ২টি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর ও ২টি (STOL) বন্দর বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে না। | ||
বেসরকারি বিমান সংস্থাসমূহ শুরুতে তাদের অভ্যন্তরীণ সার্ভিসের ক্ষেত্রে স্টল (STOL) জাতীয় বিমান ব্যবহার করতো, যা ক্ষুদ্র বিমান বন্দরে ওঠানামা করতে পারে। তখন এই বিমান সংস্থাসমূহ ঢাকা কুর্মিটোলা এবং তেজগাঁও-এর বিমানবন্দর হতে কুমিল্লা, বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং শমসেরনগর-এর মধ্যে চলাচল করত। পরবর্তীকালে জিএমজি, বেস্ট এয়ার, ইউনাইটেড এয়ার-এর মতো বেসরকারি বিমান সংস্থা মাঝারি আকারের আকাশযান সংগ্রহ করে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পায়। বর্তমানে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলির মধ্যে মাত্র ৪টি যাত্রী পরিবহনে নিয়োজিত আছে। এগুলি হলো: ইউএস-বাংলা এয়ালাইন্স, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ, এয়ার অ্যাস্ট্রা এবং নভো এয়ার। এছাড়া দেশে রয়েছে ৪টি কার্গো এয়ারলাইন্স, ৮টি হেলিকপ্টার সার্ভিস, ২টি তফসিল-বহির্ভূত অ্যারোপ্লেন সার্ভিস, ৩টি ফ্লাইং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, এবং ২টি রক্ষণাবেক্ষণ প্রশিক্ষণ সংস্থা। | |||
বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের ৫৩টি দেশের বিমান চলাচল চুক্তি আছে। ২০২০ সালে ৩৯টি বিদেশি বিমান সংস্থা দেশে যাত্রী ও কার্গো সেবা প্রদান করছিল। উল্লেখযোগ্য এয়ারলাইন্সের মধ্যে ছিল: পাকিস্তান (পিআইএ), ভারত (আইএএল), জাপান (জেএএল), যুক্তরাজ্য (বিএ), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (প্যানঅ্যাম), কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব (সৌদিয়া), চীন (সিএএল), জার্মানি (লুফথানসা), ভুটান (ড্রুক), সংয্ক্তু আরব আমিরাত (এমিরেট্স, গালফ এয়ার), ফ্রান্স (এয়ার ফ্রান্স), রাশিয়া (অ্যারোফ্লট), নেদারল্যান্ডস (কেএলএম), সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, নেপাল, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, তাজিকিস্তান, মালয়েশিয়া (এমএএস), স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ (এসএসএস), ইউক্রেন, ইরান ও সুইজারল্যান্ড। [সৈয়দ মো সালেহউদ্দীন] | |||
[[en:Airports]] | [[en:Airports]] |
০৮:৫৯, ২১ মে ২০২৩ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
বিমান বন্দর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সরকার বার্মায় রণাঙ্গনমুখী যুদ্ধবিমান চালনার জন্য ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় রয়্যাল ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের জন্য একটি সামরিক বিমান ঘাঁটি নির্মাণ করে, যা ১৯৪৩ সালে চালু হয়। তেজগাঁও বিমান বন্দরটিই ছিল পূর্ববঙ্গের প্রথম বেসামরিক বিমানবন্দর, এবং তা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ঘাঁটি হিসেবেও পরবর্তীতে ব্যবহৃত হতো। ঢাকার কুর্মিটোলায় (বালুরঘাট) একটি অবতরণ স্ট্রিপের নির্মাণও ব্রিটিশ সরকার প্রায় একই সময়ে শুরু করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশের ভূ-সীমায় ব্রিটিশ সরকার নির্মিত সামরিক বিমান ঘাঁটিগুলির বেশ কয়েকটিকে বেসামরিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করা হয়। তবে বিমান অবতরণের সুবিধা থাকলেও অপর কয়েকটিকে এখন পর্যন্ত বিমানবন্দরে রূপান্তর করা হয় নি। এগুলির মধ্যে আছে: লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, ফেনী, রাজেন্দ্রপুর, পাহাড় কাঞ্চনপুর এবং রসুলপুর।
বাংলাদেশে বর্তমানে তিনটি আন্তর্জাতিক ও পাঁচটি অভ্যন্তরীণ মিলিয়ে মোট আটটি বিমানবন্দর চালু আছে: হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা; শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম; ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সিলেট; বরিশাল বিমানবন্দর, কক্সবাজার বিমানবন্দর; যশোর বিমানবন্দর; শাহ মখদুম বিমানবন্দর, রাজশাহী; ও সৈয়দপুর বিমানবন্দর। এছাড়া তিনটি বিমানবন্দর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট অপারেশনের জন্য তৈরি হয়েছে যেগুলোর একটি ঢাকার তেজগাঁও-এ অবস্থিত পুরনো বিমানবন্দর। এটি বর্তমানে বিশেষ কাজে ব্যবহৃত হয় এবং এখানে বিমানচালকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এটিসহ বগুড়া ও সিলেটের শমসেরনগরে অবস্থিত অন্য দুটি বিমানবন্দর এখন অবধি বেসামরিক বিমান পরিবহন পরিচালনার সরকারি অনুমোদন পায়নি। বাংলাদেশে আরও তিনটি পুরনো এয়ারস্ট্রিপ আছে। কুমিল্লা, পাবনার ঈশ্বরদী এবং ঠাকুরগাঁও-এর এই এয়ারস্ট্রিপগুলি নিয়মিত বিমানবন্দর হিসেবে উন্নত হতে পারে। বাগেরহাটে খান জাহান আলী বিমানবন্দর নামে একটি নতুন বিমানবন্দর নির্মাণাধীন আছে।
তাছাড়া বগুড়া, বাগেরহাট, টুঙ্গিপাড়া, হাতিয়া, রামগতি, নোয়াখালী প্রভৃতি স্থানে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বিবেচনাধীন আছে। দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই হেলিকপ্টার অবতরণের সুবিধা রয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ঢাকা এবং বাংলার অন্যান্য অরক্ষিত স্থানে রাজকীয় ভারতীয় বিমান বাহিনীর ঘাঁটি নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৯৪১ সালে ঢাকা শহরে তেজগাঁও বিমান বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়, এবং একই সময়ে ঢাকার কুর্মিটোলায় বিমান অবতরণ ক্ষেত্র তৈরিও শুরু করা হয়। ব্রিটিশ বিমান বাহিনী তাদের যুদ্ধবিমান রাখার জন্য এই দুটি বিমানক্ষেত্র ব্যবহার করত। তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে মূলত সামরিক যুদ্ধবিমান অবতরণের সুবিধা ছিল। কুর্মিটোলাতেও মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি দল অবস্থান করছিল। ১৯৪৩ সালের শুরুতে তেজগাঁও-এর নির্মাণাধীন রানওয়েতে রাজকীয় ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি হালকা যুদ্ধবিমান অবতরণ করে। ব্রিটিশ বিমান বাহিনী ছাড়াও ইস্পাহানি গ্রুপ ও তার অংশীদারেরা ১৯৪৬-এ চালুকৃত ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ-এর বিমান চালনার জন্য এই বিমান বন্দরটি ব্যবহার করত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে তেজগাঁও বিমান বন্দরটি একাধারে আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ বিমান বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। কুর্মিটোলায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণ কাজও এ সময়ে এগিয়ে নেওয়া হয়।
১৯৪৭ সালে তেজগাঁও বিমান বন্দর ব্যবহারকারী ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ-এর বহরে ডিসি-৩ (ডাকোটা) এবং ডিএইচসি-৬ (টুইন অটার) নামে ২টি পরিবহন বিমান ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় পতাকাবাহী পাকিস্তান আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স (পিআইএ) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে চলাচল শুরু হলে পাকিস্তান সরকার সামরিক এবং বেসামরিক বিমান চলাচল জাতীয়করণ করে। ফলে ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। স্থানীয় তরুণ পাইলিটদের বিমান চালনায় প্রশিক্ষিত করার লক্ষ্যে সরকার ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ফ্লাইং ক্লাব স্থাপন করে। পূর্ব পাকিস্তানে একটি শাখাসহ ১৯৫৬ সালে উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের ফ্লাইং উইংও স্থাপন করা হয়। এ সকল সংস্থাসহ পিআইএ-র বিমানবহরে সংযুক্ত ডাকোটা, ভাইকাউন্ট এবং ফকার বিমান ব্যবহারের মাধ্যমে তেজগাঁও বিমান বন্দর ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে পিআইএ-র বিমানবহরে বোয়িং, কমেট এবং ডিসি-৮-এর ন্যায় জেটবিমান সংযোজিত হয়। বিমান বন্দরটি ব্রিটিশ ওভারসিজ এয়ারওয়েজ করপোরেশন এবং প্যান আমেরিকান এয়ারওয়েজসহ বিদেশি বিমান সংস্থাসমূহকে সেবা প্রদান করতে থাকে। ১৯৬০ সালে পিআইএ বোয়িং জেট সার্ভিস চালু করে।
আন্তর্জাতিক মানের সেবা ও সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং বিমান বন্দর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তেজগাঁও বিমান বন্দরের মানোন্নয়ন করে। যশোর, চট্টগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, ঈশ্বরদী এবং কুমিল্লায় দেশের অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর কার্যক্রম শুরু হয়। স্বাধীনতার পর তেজগাঁও বিমান বন্দরটি বিমান চলাচলের সার্বিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও অপ্রতুল বিবেচিত হওয়ায় কুর্মিটোলায় নতুন আন্তর্জার্তিক বিমান বন্দর নির্মাণের কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়। নতুন বিমান বন্দরটি ১৯৮১ সালে চালু হয়, এবং তখনই তেজগাঁও বিমান বন্দরটিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর নিকট হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নামে পরিচিত কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে বৃহৎ পরিসরের টার্মিনাল ভবন, হ্যাঙ্গার, কারিগরি প্রাঙ্গণ, পণ্যগুদাম বা কার্গো-ভিলেজ প্রভৃতিসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও যন্ত্রপাতি সংযোজিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি জাতীয় বিমান সংস্থা- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স' ফকার এফ-২৭ এবং এটিপি বিমান চালনার মাধ্যমে তার কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তী সময়ে সংস্থাটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট উড্ডয়নের জন্য প্রশস্ত পরিসরের টারবো জেট এবং অন্যান্য শ্রেণির বিমান ক্রয় করে। ২০০০ সালের মধ্যে বিমানের বহরে ৫টি ডিসি-১০, ৩টি এফ-২৮, ৩টি এয়ারবাস যুক্ত হয়। এ ছাড়া ছিল লিজ নেওয়া ১টি ডিসি-১০ এবং ১টি এয়ারবাস। ২০২০ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে ছিল ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, ২টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ৪টি বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার, ২টি বোয়িং ৭৮৭-৯২ ড্রিমলাইনার, এবং ৪টি ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ। অপরদিকে কয়েকটি বেসরকারি বিমানসংস্থাও ১৯৯৬ সালের পর কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে দেশে ৪টি ব্যক্তিখাতের বিমান চলালচল সংস্থাসহ ৫টি বেসামরিক এয়ারলাইন্স যাত্রী পরিবহনে নিয়োজিত আছে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর বিশ্বের অধিকাংশ নগরীর সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে। তাছাড়া এটা ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, যশোর, সিলেট, ঈশ্বরদী, কক্সবাজার, সৈয়দপুর, রাজশাহী এবং বরিশালের অভ্যন্তরীণ বিমান বন্দরগুলিকে সংযুক্ত করেছে। ২০০০ সাল হতে দেশের ৩টি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ৪টি মহাদেশের ৩১টি গন্তব্যে নিয়মিত বিমান চলাচল চালু রাখা হয়েছে। গন্তব্যগুলির মধ্যে ছিল- কলকাতা, কাঠমন্ডু, লন্ডন, দুবাই, ব্যাংকক, করাচি, আবুধাবি, মুম্বাই, সিঙ্গাপুর, জেদ্দা, দোহা, আমস্টার্ডাম, কুয়েত সিটি, এথেন্স, ত্রিপোলি, মাস্কাট, কুয়ালালামপুর, রেঙ্গুন, দাহরান, রোম, বাগদাদ, বাহরাইন, প্যারিস, ফ্রাঙ্কফুর্ট, শারজাহ, টোকিও, রিয়াদ, মালটা এবং নিউইয়র্ক।
১৯৯৬ সাল হতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বেসরকারি বিমান সংস্থাসমূহকে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লাইসেন্স প্রদান শুরু করে। তাছাড়া উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের এয়ার উইং এবং ফ্লাইং ক্লাবসমূহকে বেবিচকের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়। বেসরকারি বেসামরিক বিমান সংস্থাগুলির অপারেটিং অফিস স্থাপন এবং বিমানবন্দর ব্যবহারের জন্য বেবিচক-এর অনুমতি নিতে হয়। বর্তমানে বেবিচক দেশে ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ৭টি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, এবং ২টি শর্ট টেকঅফ ও ল্যান্ডিং (STOL) বন্দর পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত। তবে ২টি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর ও ২টি (STOL) বন্দর বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে না।
বেসরকারি বিমান সংস্থাসমূহ শুরুতে তাদের অভ্যন্তরীণ সার্ভিসের ক্ষেত্রে স্টল (STOL) জাতীয় বিমান ব্যবহার করতো, যা ক্ষুদ্র বিমান বন্দরে ওঠানামা করতে পারে। তখন এই বিমান সংস্থাসমূহ ঢাকা কুর্মিটোলা এবং তেজগাঁও-এর বিমানবন্দর হতে কুমিল্লা, বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং শমসেরনগর-এর মধ্যে চলাচল করত। পরবর্তীকালে জিএমজি, বেস্ট এয়ার, ইউনাইটেড এয়ার-এর মতো বেসরকারি বিমান সংস্থা মাঝারি আকারের আকাশযান সংগ্রহ করে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পায়। বর্তমানে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলির মধ্যে মাত্র ৪টি যাত্রী পরিবহনে নিয়োজিত আছে। এগুলি হলো: ইউএস-বাংলা এয়ালাইন্স, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ, এয়ার অ্যাস্ট্রা এবং নভো এয়ার। এছাড়া দেশে রয়েছে ৪টি কার্গো এয়ারলাইন্স, ৮টি হেলিকপ্টার সার্ভিস, ২টি তফসিল-বহির্ভূত অ্যারোপ্লেন সার্ভিস, ৩টি ফ্লাইং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, এবং ২টি রক্ষণাবেক্ষণ প্রশিক্ষণ সংস্থা।
বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের ৫৩টি দেশের বিমান চলাচল চুক্তি আছে। ২০২০ সালে ৩৯টি বিদেশি বিমান সংস্থা দেশে যাত্রী ও কার্গো সেবা প্রদান করছিল। উল্লেখযোগ্য এয়ারলাইন্সের মধ্যে ছিল: পাকিস্তান (পিআইএ), ভারত (আইএএল), জাপান (জেএএল), যুক্তরাজ্য (বিএ), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (প্যানঅ্যাম), কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব (সৌদিয়া), চীন (সিএএল), জার্মানি (লুফথানসা), ভুটান (ড্রুক), সংয্ক্তু আরব আমিরাত (এমিরেট্স, গালফ এয়ার), ফ্রান্স (এয়ার ফ্রান্স), রাশিয়া (অ্যারোফ্লট), নেদারল্যান্ডস (কেএলএম), সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, নেপাল, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, তাজিকিস্তান, মালয়েশিয়া (এমএএস), স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ (এসএসএস), ইউক্রেন, ইরান ও সুইজারল্যান্ড। [সৈয়দ মো সালেহউদ্দীন]