রহমান, আজাদ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

("right|thumbnail|200px|Azad Rahman'']] '''Rahman, Azad'''" দিয়ে পাতা তৈরি)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না)
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Image:RahmanAzad.jpg|right|thumbnail|200px|Azad Rahman]]'']]
[[Image:RahmanAzad.jpg|right|thumbnail|200px|আজাদ রহমান]]
'''Rahman, Azad'''
'''রহমান, আজাদ''' (১৯৪৪-২০২০)  সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান ১৯৪৪ সালের ১লা জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খলিলুর রহমান এবং মাতার নাম আশরাফা খাতুন। পিতা খলিলুর রহমানের কাছে খুব ছোট বয়সে তাঁর সঙ্গীতের হাতে খড়ি। সে সময় বর্ধমানের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ও সঙ্গীত চর্চা খুবই উন্নত ছিল। পঞ্চাশ ও ষাট দশকে আজাদ রহমানের ছাত্রজীবনে কলকাতা এবং বর্ধমানে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের ব্যাপক চর্চা ছিল। শৈশবে বর্ধমানের ‘গোপেশ্বর সঙ্গীত সংসদ’-এ সঙ্গীত বিষয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৬৪ সালে কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে (খেয়াল) প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং স্বর্ণপদকে ভূষিত হন।
 
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন সমাপ্ত করে সঙ্গীত শিক্ষালয় বর্ধমানের গোপেশ্বর সঙ্গীত সংসদের অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ষাট দশকের মধ্যভাগে ভারতে প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন ‘মিস প্রিয়ংবদা’ ছবিতে। এই ছবিতে তিনি যুগ্মভাবে সুরকার হিসেবে কাজ করেন সুবিখ্যাত সুবীর সেনের সাথে। এর পরপরই পশ্চিম বাংলা ছেড়ে তিনি চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৬৭ সালে সঙ্গীত শিক্ষক, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে তিনি রেডিওর চাকরিতে যোগদান করেন। একই সাথে ছায়ানট সঙ্গীত সংগঠন-এ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত-এর শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। বেতারে কাজ করার পাশাপাশি ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজে তিনি জড়িয়ে পড়েন। আশির দশকে তিনি সরকারি চাকরিতে মনোনিবেশ করেন। জাতীয় পারফর্মিং আর্টস একাডেমির এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক, সরকারি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন। দ্বিতীয়বার তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ২০০০ সালে চাকরিজীবন থেকে অবসরে যান।
 
সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় খেয়াল গান রচনায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। বাংলা একাডেমি তাঁর লেখা খেয়াল-এর রচনা নিয়ে ১৯৯৯ সালে দুখণ্ডের বই বের করেছে- বাংলা খেয়াল প্রথম খণ্ড ও বাংলা খেয়াল দ্বিতীয় খণ্ড। আশির দশকে তাঁর গাওয়া বাংলা খেয়ালের লং প্লে প্রকাশিত হয়।
 
বাংলাদেশের সুরস্রস্টাদের একত্রিত করে সঙ্গীতের সামগ্রিক সমৃদ্ধি এবং সঙ্গীতকারদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ২০১৯ এ গড়ে তোলেন ‘Music Composers Association of Bangladesh’.
 
তাঁর রচিত পুস্তকসমূহের মধ্যে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা খেয়াল প্রথম খণ্ড’ (১৯৯৯); ‘বাংলা খেয়াল দ্বিতীয় খণ্ড’ (১৯৯৯) ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমী প্রকাশিত ‘মাছের গপ্পো’ এবং ‘বাংলা খেয়াল’ (১৯৮৮), ‘বাংলা কাওয়ালি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
 
সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান বাংলা ভাষায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত প্রবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান দিক উচ্চাঙ্গসঙ্গীত। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের উৎকৃষ্ট বিষয়- ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল- হিন্দি, উর্দু, তেলেগু, পাঞ্জাবি ও অন্যান্য ভাষায় চর্চা হচ্ছে। সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় এর প্রায় অনুপস্থিতির অনাকাক্সিক্ষত বিষয়টি সম্পর্কে দীর্ঘদিন প্রচুর অধ্যবসায় এবং গবেষণার মাধ্যমে সকল প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে বাস্তবায়িত করেছেন ‘বাংলা খেয়াল’। বাংলা একাডেমি তাঁর লেখা খেয়ালের রচনা নিয়ে দু’খণ্ডের বই বের করেছে যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আশি'র দশকে তাঁর গাওয়া বাংলা খেয়াল এর লং প্লে প্রকাশিত হয়।
 
বাংলাদেশে অসংখ্য ছায়াছবিতে আজাদ রহমান সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। আজাদ রহমান ধারাবাহিকভাবে চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। আজাদ রহমান-এর স্বকণ্ঠের কয়েকটি গান এখনও শ্রোতার হৃদয়ে অমলিন হয়ে আয়ে। মাসুদ রানা (১৯৭৪) ছবিতে গাওয়া ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়, এপার ওপার (১৯৭৫) ছবিতে গাওয়া ‘ভালবাসার মূল্য কত, আমি কিছু জানিনা’, ডুমুরের ফুল (১৯৭৮) ছবিতে গাওয়া ‘কর মনে ভক্ত মায়ের হাতে থাকতে দিন’- গানগুলো কালজয়ী। ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অশোক ঘোষ পরিচালিত মাস্তান ছবিতে আব্দুল জব্বারের দরদী কণ্ঠে গাওয়া ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি কেন একা বয়ে বেড়াও’ আজাদ রহমানের সুরের এ গান এখনও প্রতিটি শ্রোতার হৃদয়ে নতুন আলোড়ন তোলে।
 
আজাদ রহমানের অনবদ্য হৃদয়কাড়া যে গানের সুর আমাদেরকে আরও বিমোহিত করে সেটি হলো-নঈম গওহরের কথায় কিংবদন্তি ফিরোজা বেগম ও সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের আগেই উনি সুর করেন ‘পুবের ওই আকাশে সূর্য উঠেছে আলোকে আলোকময়, জয় জয় জয় জয় বাংলা’ (কথা নঈম গওহর) ও ‘সংগ্রাম চলবে চলবে’ (কথা ফজল এ খোদা)। ১৯৭১-এর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে প্রকাশিত ই.এম.আই থেকে প্রকাশিত রেকর্ডে আজাদ রহমান-এর সুরে পাওয়া যায় চারটি গান, যথা- ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ (কথা মো মনিরুজ্জামান), ‘মোদের জীবন মোদের’ (কথা আজিজুর রহমান), ‘কেঁদোনা মাগো’ (কথা আবু হায়দার সাজেদুর রহমান) ও ‘এসো গড়ি ভাগ্যটা’ (কথা জেবুন্নেসা জামাল)।
 
বাংলাদেশ বেতারের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন আজাদ রহমান। চলচ্চিত্রের বাইরে বাংলাদেশ বেতারের জন্য অনেক আধুনিক গানে সুর করেন রেডিওতে জেবুন্নেসা জামালের লেখা বেশির ভাগ গানের সুরকার আজাদ রহমান।
 
বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম শিশুদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’র সূচনা সঙ্গীত ‘আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি’ গানটির সুরকার আজাদ রহমান, কথা লিখেছেন কবি গোলাম মোস্তাফা। ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠানের জন্য তিনি লিখেছেন অসংখ্য শিক্ষামূলক গান।
 
বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে বিশেষ করে সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারায় আজাদ রহমানের সৃজনশীল মেধা এবং কর্মের ব্যাপকতা ঈর্ষণীয়। সঙ্গীত ও সংস্কৃতি চর্চার প্রসার, সংরক্ষণ ও উন্নয়নে নিবেদিত এই প্রতিভাধর শিল্পী লোকসঙ্গীত থেকে শুরু করে ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরি, গজল, কাওয়ালি, আধুনিক গানে সমান সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এই প্রতিভাবান শিল্পী আজাদ রহমান তাঁর প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্রে রাগ পরিবেশনের মাধ্যমেও।
 
চলচ্চিত্রকার আজাদ রহমান বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। কয়েক যুগ ধরে তিনি শুভেচ্ছা ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া, তিনি ইউনিভার্সিটির মিউজিক সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান (১৯৮৪-১৯৯০), ন্যাশনাল মিউজিক কম্পিটিশন কমিটির সম্মানিত বিচারক, ন্যাশনাল কালচারাল এডভাইজার্স বোর্ডের সদস্য (১৯৭০-১৯৯০), চলচ্চিত্র সেন্সর আপিল বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
 
আজাদ রহমান শ্রেষ্ঠকণ্ঠশিল্পী, শ্রেষ্ঠসুরকার, শ্রেষ্ঠসঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছেন। এছাড়াও, জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৫), পূর্বানী চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৫), চিত্রালী চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৫), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (১৯৭৮), দেশ চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৮), জাতীয় অর্কেস্ট্রা পুরস্কার (১৯৮০), রেডিও স্টাফ আর্টিস্ট পুরস্কার (১৯৮২), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার (১৯৯৬), নবাব সলিমুল্লাহ স্মারক সম্মাননা (২০০৮), ‘মাছের গল্প’ নাটকের জন্য শ্রেষ্ঠ নাট্যকার অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার ইত্যাদি লাভ করেন। সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান ১৯৯০ সালে সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ‘সংস্কৃতি কেন্দ্র’ (Centre for Education, Creative and Performing Arts) শুরু করেন। সংস্কৃতি কেন্দ্র মূলত ‘বাংলা খেয়াল’ প্রশিক্ষণ এবং কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রসার ও প্রচারে কাজ করে যাচ্ছে।
 
সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান ১৬ মে ২০২০ এ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে আজাদ রহমান-এর সহধর্মিণী শিল্পী সেলিনা আজাদ সংস্কৃতি কেন্দ্র-এর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক। তাঁদের তিন কন্যা সন্তান রয়েছে। তাদের মধ্যে ডা. রুমানা আজাদ একজন চিকিৎসক এবং সুরকার ও গীতিকার। দ্বিতীয় সন্তান রোজানা আজাদ University of Southern Queensland এ কর্মরত এবং একজন সঙ্গীতশিল্পী ও কনিষ্ঠ সন্তান নাফিসা আজাদ সরকারি চাকরিতে কর্মরত (অস্ট্রেলিয়া) এবং সঙ্গীতশিল্পী।  [জেবউননেছা]
 
[[en:Rahman, Azad]]

১৬:০৬, ৪ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

আজাদ রহমান

রহমান, আজাদ (১৯৪৪-২০২০) সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান ১৯৪৪ সালের ১লা জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খলিলুর রহমান এবং মাতার নাম আশরাফা খাতুন। পিতা খলিলুর রহমানের কাছে খুব ছোট বয়সে তাঁর সঙ্গীতের হাতে খড়ি। সে সময় বর্ধমানের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ও সঙ্গীত চর্চা খুবই উন্নত ছিল। পঞ্চাশ ও ষাট দশকে আজাদ রহমানের ছাত্রজীবনে কলকাতা এবং বর্ধমানে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের ব্যাপক চর্চা ছিল। শৈশবে বর্ধমানের ‘গোপেশ্বর সঙ্গীত সংসদ’-এ সঙ্গীত বিষয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৬৪ সালে কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে (খেয়াল) প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং স্বর্ণপদকে ভূষিত হন।

রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন সমাপ্ত করে সঙ্গীত শিক্ষালয় বর্ধমানের গোপেশ্বর সঙ্গীত সংসদের অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ষাট দশকের মধ্যভাগে ভারতে প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন ‘মিস প্রিয়ংবদা’ ছবিতে। এই ছবিতে তিনি যুগ্মভাবে সুরকার হিসেবে কাজ করেন সুবিখ্যাত সুবীর সেনের সাথে। এর পরপরই পশ্চিম বাংলা ছেড়ে তিনি চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৬৭ সালে সঙ্গীত শিক্ষক, সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে তিনি রেডিওর চাকরিতে যোগদান করেন। একই সাথে ছায়ানট সঙ্গীত সংগঠন-এ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত-এর শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। বেতারে কাজ করার পাশাপাশি ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজে তিনি জড়িয়ে পড়েন। আশির দশকে তিনি সরকারি চাকরিতে মনোনিবেশ করেন। জাতীয় পারফর্মিং আর্টস একাডেমির এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক, সরকারি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন। দ্বিতীয়বার তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ২০০০ সালে চাকরিজীবন থেকে অবসরে যান।

সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় খেয়াল গান রচনায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। বাংলা একাডেমি তাঁর লেখা খেয়াল-এর রচনা নিয়ে ১৯৯৯ সালে দুখণ্ডের বই বের করেছে- বাংলা খেয়াল প্রথম খণ্ড ও বাংলা খেয়াল দ্বিতীয় খণ্ড। আশির দশকে তাঁর গাওয়া বাংলা খেয়ালের লং প্লে প্রকাশিত হয়।

বাংলাদেশের সুরস্রস্টাদের একত্রিত করে সঙ্গীতের সামগ্রিক সমৃদ্ধি এবং সঙ্গীতকারদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ২০১৯ এ গড়ে তোলেন ‘Music Composers Association of Bangladesh’.

তাঁর রচিত পুস্তকসমূহের মধ্যে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা খেয়াল প্রথম খণ্ড’ (১৯৯৯); ‘বাংলা খেয়াল দ্বিতীয় খণ্ড’ (১৯৯৯) ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমী প্রকাশিত ‘মাছের গপ্পো’ এবং ‘বাংলা খেয়াল’ (১৯৮৮), ‘বাংলা কাওয়ালি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান বাংলা ভাষায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত প্রবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান দিক উচ্চাঙ্গসঙ্গীত। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের উৎকৃষ্ট বিষয়- ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল- হিন্দি, উর্দু, তেলেগু, পাঞ্জাবি ও অন্যান্য ভাষায় চর্চা হচ্ছে। সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় এর প্রায় অনুপস্থিতির অনাকাক্সিক্ষত বিষয়টি সম্পর্কে দীর্ঘদিন প্রচুর অধ্যবসায় এবং গবেষণার মাধ্যমে সকল প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে বাস্তবায়িত করেছেন ‘বাংলা খেয়াল’। বাংলা একাডেমি তাঁর লেখা খেয়ালের রচনা নিয়ে দু’খণ্ডের বই বের করেছে যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আশি'র দশকে তাঁর গাওয়া বাংলা খেয়াল এর লং প্লে প্রকাশিত হয়।

বাংলাদেশে অসংখ্য ছায়াছবিতে আজাদ রহমান সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। আজাদ রহমান ধারাবাহিকভাবে চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। আজাদ রহমান-এর স্বকণ্ঠের কয়েকটি গান এখনও শ্রোতার হৃদয়ে অমলিন হয়ে আয়ে। মাসুদ রানা (১৯৭৪) ছবিতে গাওয়া ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়, এপার ওপার (১৯৭৫) ছবিতে গাওয়া ‘ভালবাসার মূল্য কত, আমি কিছু জানিনা’, ডুমুরের ফুল (১৯৭৮) ছবিতে গাওয়া ‘কর মনে ভক্ত মায়ের হাতে থাকতে দিন’- গানগুলো কালজয়ী। ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অশোক ঘোষ পরিচালিত মাস্তান ছবিতে আব্দুল জব্বারের দরদী কণ্ঠে গাওয়া ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি কেন একা বয়ে বেড়াও’ আজাদ রহমানের সুরের এ গান এখনও প্রতিটি শ্রোতার হৃদয়ে নতুন আলোড়ন তোলে।

আজাদ রহমানের অনবদ্য হৃদয়কাড়া যে গানের সুর আমাদেরকে আরও বিমোহিত করে সেটি হলো-নঈম গওহরের কথায় কিংবদন্তি ফিরোজা বেগম ও সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের আগেই উনি সুর করেন ‘পুবের ওই আকাশে সূর্য উঠেছে আলোকে আলোকময়, জয় জয় জয় জয় বাংলা’ (কথা নঈম গওহর) ও ‘সংগ্রাম চলবে চলবে’ (কথা ফজল এ খোদা)। ১৯৭১-এর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে প্রকাশিত ই.এম.আই থেকে প্রকাশিত রেকর্ডে আজাদ রহমান-এর সুরে পাওয়া যায় চারটি গান, যথা- ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ (কথা মো মনিরুজ্জামান), ‘মোদের জীবন মোদের’ (কথা আজিজুর রহমান), ‘কেঁদোনা মাগো’ (কথা আবু হায়দার সাজেদুর রহমান) ও ‘এসো গড়ি ভাগ্যটা’ (কথা জেবুন্নেসা জামাল)।

বাংলাদেশ বেতারের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন আজাদ রহমান। চলচ্চিত্রের বাইরে বাংলাদেশ বেতারের জন্য অনেক আধুনিক গানে সুর করেন রেডিওতে জেবুন্নেসা জামালের লেখা বেশির ভাগ গানের সুরকার আজাদ রহমান।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম শিশুদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’র সূচনা সঙ্গীত ‘আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি’ গানটির সুরকার আজাদ রহমান, কথা লিখেছেন কবি গোলাম মোস্তাফা। ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠানের জন্য তিনি লিখেছেন অসংখ্য শিক্ষামূলক গান।

বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে বিশেষ করে সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারায় আজাদ রহমানের সৃজনশীল মেধা এবং কর্মের ব্যাপকতা ঈর্ষণীয়। সঙ্গীত ও সংস্কৃতি চর্চার প্রসার, সংরক্ষণ ও উন্নয়নে নিবেদিত এই প্রতিভাধর শিল্পী লোকসঙ্গীত থেকে শুরু করে ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরি, গজল, কাওয়ালি, আধুনিক গানে সমান সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এই প্রতিভাবান শিল্পী আজাদ রহমান তাঁর প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্রে রাগ পরিবেশনের মাধ্যমেও।

চলচ্চিত্রকার আজাদ রহমান বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। কয়েক যুগ ধরে তিনি শুভেচ্ছা ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া, তিনি ইউনিভার্সিটির মিউজিক সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান (১৯৮৪-১৯৯০), ন্যাশনাল মিউজিক কম্পিটিশন কমিটির সম্মানিত বিচারক, ন্যাশনাল কালচারাল এডভাইজার্স বোর্ডের সদস্য (১৯৭০-১৯৯০), চলচ্চিত্র সেন্সর আপিল বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আজাদ রহমান শ্রেষ্ঠকণ্ঠশিল্পী, শ্রেষ্ঠসুরকার, শ্রেষ্ঠসঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছেন। এছাড়াও, জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৫), পূর্বানী চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৫), চিত্রালী চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৫), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (১৯৭৮), দেশ চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৮), জাতীয় অর্কেস্ট্রা পুরস্কার (১৯৮০), রেডিও স্টাফ আর্টিস্ট পুরস্কার (১৯৮২), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার (১৯৯৬), নবাব সলিমুল্লাহ স্মারক সম্মাননা (২০০৮), ‘মাছের গল্প’ নাটকের জন্য শ্রেষ্ঠ নাট্যকার অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার ইত্যাদি লাভ করেন। সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান ১৯৯০ সালে সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ‘সংস্কৃতি কেন্দ্র’ (Centre for Education, Creative and Performing Arts) শুরু করেন। সংস্কৃতি কেন্দ্র মূলত ‘বাংলা খেয়াল’ প্রশিক্ষণ এবং কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রসার ও প্রচারে কাজ করে যাচ্ছে।

সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান ১৬ মে ২০২০ এ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে আজাদ রহমান-এর সহধর্মিণী শিল্পী সেলিনা আজাদ সংস্কৃতি কেন্দ্র-এর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক। তাঁদের তিন কন্যা সন্তান রয়েছে। তাদের মধ্যে ডা. রুমানা আজাদ একজন চিকিৎসক এবং সুরকার ও গীতিকার। দ্বিতীয় সন্তান রোজানা আজাদ University of Southern Queensland এ কর্মরত এবং একজন সঙ্গীতশিল্পী ও কনিষ্ঠ সন্তান নাফিসা আজাদ সরকারি চাকরিতে কর্মরত (অস্ট্রেলিয়া) এবং সঙ্গীতশিল্পী। [জেবউননেছা]