ঈসা খান: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না) | |
(কোনও পার্থক্য নেই)
|
০৭:১৫, ১ আগস্ট ২০২১ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
ঈসা খান (১৫২৯-১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ) সরাইলের জমিদার, ভাটি অঞ্চলের শাসক এবং বারো ভূঁইয়াদের নেতা। ইসা খানের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে।
ঈসা খানের পিতামহ বাইশ রাজপুত সম্প্রদায়ভুক্ত ভগীরথ প্রথমে অযোধ্যা থেকে বাংলায় আসেন এবং বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ-এর অধীনে দীউয়ান হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র কালিদাস গজদানী পিতার দীউয়ান পদ লাভ করেন। পরবর্তীতে কালিদাস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোলায়মান নাম ধারণ করেন। সোলায়মান সুলতানের কন্যা সৈয়দা মোমেনা খাতুনকে বিয়ে করেন এবং সরাইলের জমিদারি লাভ করেন। এ সরাইলেই সোলায়মানের পুত্র ঈসা খান জন্মগ্রহণ করেন।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের মৃত্যুর পর জামাতা সোলায়মান খান নিজেকে বৈধ উত্তরাধিকারী দাবি করে নব প্রতিষ্ঠিত আফগান শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রাহ ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি প্রায় স্বাধীনভাবেই ভাটি অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন এবং তাঁর রাজ্য শাসনের কেন্দ্র বিন্দু ছিল সরাইল।
১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করে বাংলাকে একটি একক প্রশাসনিক শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু সোলায়মান খান ইসলাম শাহের ব্যবস্থা মেনে নিতে অস্বীকার করলে ইসলাম শাহ তাজ খান ও দরিয়া খান নামে দু’জন সেনাপতিকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। সোলায়মান খান তাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত ও নিহত হন এবং তার দুই পুত্র ঈসা ও ইসমাইলকে বন্দি করে ইরানী বণিকদের নিকট দাসরূপে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে তাজ খান কররানী বাংলা ও বিহারের শাসন ক্ষমতা গ্রহন করলে, ঈসা খানের চাচা কুতুব খান তার অনুগ্রভাজন হন এবং দরবারি কাজে নিযুক্তি লাভ করেন। এ সময়ে তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র দ্বয়ের (ঈসা ও ইসমাইল) খোঁজ পেয়ে অর্থের বিনিময়ে ইরানী বণিকের কাছ থেকে তাদের মুক্ত করে আনেন।
ঈসা খান দেশে ফিরে এসে চাচা কুতুব খানের প্রচেষ্টায় তার পিতার সরাইলস্থ জমিদারি লাভ করেন। ১৫৬৫ সালে তাজ খান কররানীর মৃত্যুর পর ঈসা খান আফগান শাসকদের মুগল আক্রমণ মুকাবিলায় সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে আসছিলেন। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ত্রিপুরার রাজা উদয়মানিক্যের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম অভিযানে দাউদ খানকে সাহায্য করেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সোনারগাঁও-এর পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে মুগল নৌবহরকে বিতাড়িত করতেও দাউদখানের সেনাপতিকে সাহায্য করেন।
১৫৭৬ সালে রাজামহলের নিকটবর্তী আগমহলের যুদ্ধে দাউদ খান কররানী পরাজিত ও নিহত হলে কার্যত বাংলায় আফগান শাসনের অবসান হলেও ঈসা খান এ সময়ে প্রায় স্বাধীনভাবেই তাঁর রাজ্য পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু তিনি যথার্থভাবেই অনুধাবন করেন যে, তিনি নিজের সীমিত শক্তি দিয়ে একা মুগলদের মুকাবিলা করতে পারবেন না। তাই তিনি পার্শ্ববর্তী জমিদার ও আফগান দলপতিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদের সঙ্গে মুগল বিরোধী রাজনৈতিক ও সামরিক মৈত্রী গঠন করেন। তিনি প্রতিবেশী ত্রিপুরা ও কামরূপ এর রাজা যথাক্রমে অমরমাণিক্য ও রঘুদেবের সঙ্গেও বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপন করেন। এ ছাড়াও ঈসা খান তার সামরিক শক্তির প্রধান অবলম্বন রণতরীগুলির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করেন।
১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে মুগল সুবাহদার খান জাহান ঈসা খানের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে ভাওয়ালে সৈন্য শিবির স্থাপন করলে ঈসা খান সরাইল সন্নিকটবর্তী কাস্তলে (কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত) মুগল বাহিনী মুকাবিলা করেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে ঈসা খান পরাজিত হয়ে ত্রিপুরা রাজ অমর মাণিক্যের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ত্রিপুরার সাহায্য আসলে মুগল বাহিনী পশ্চাদপসরণ করে। রাজমালার বর্ণনা অনুসারে আনুমানিক ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা অমর মাণিক্যের ‘অমর সাগর দিঘি’ খননের জন্য অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হলে তার অনুরোধে সারা দিয়ে বাংলার অন্যান্য জমিদারের সঙ্গে সরাইলের জমিদার ঈসা খান এক হাজার শ্রমিক পাঠিয়ে ত্রিপুরার রাজাকে সাহায্য করেছিলেন। তা ছাড়াও, ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি অমর মানিক্যের নৌ-বাহিনীর অধ্যক্ষরূপে তরফের জমিদার ফতেহ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে মুগল সেনাপতিদের বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে ঈসা খান পূর্ব বাংলায় তাঁর শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। তিনি ১৫৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে ভাটি অঞ্চলের অধিপতি হিসেবে ঘোষণা দেন এবং নিজেই ‘মসনদ-ঈ-আলা উপাধি’ গ্রহণ করেন। সূত্র অনুযায়ী, এ সময় তিনি তাঁর প্রশাসনিক কেন্দ্র সরাইল থেকে সোনারগাঁও-এ স্থানান্তর করেন এবং সোনারগাঁও এর নিকটবর্তী কাত্রাবো, কলাগাছিয়া ও খিজিরপুরে দুর্গ নির্মাণ করেন।
ইতোমধ্যে সম্রাট আকবরের দুই বিদ্রোহী সেনাপতি মাসুম খান কাবুলী ও কতলু খান ঈসা খানের সাথে যোগ দেন। সম্রাট আকবর ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি আজমকে বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত করে মুগল সেনাপতিদ্বয়ের আশ্রয়দাতা ঈসা খান মসনদ-ই-আলার বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ দেন। এ সময় মুগল সেনাপতি শাহবাজ খানের সাথে টোকে এবং তারসুন খানের সাথে বাজিতপুরে ঈসা খানের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুগল বাহিনী পরাজিত হয়। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মুগল সেনাপতি শাহবাজ খান পুনরায় ঈসা খানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় যুদ্ধ ক্ষেত্র ঢাকা, বিক্রমপুর, সোনারগাঁও, কাত্রাবো প্রভৃতি এলাকায় বিস্তৃত ছিল। মুগলদের সাথে সংঘর্ষের এ পর্বেও ঈসা খান সাফল্য লাভ করেন। এ সময়ে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ ভাটি এলাকায় নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করে লক্ষ্যানদীর তীরে কাত্রাবোয় তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই ঈসা খান বারো ভূঁইয়ার নেতৃত্ব লাভ করেন। ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে রঞ্ঝালফ ফিচ এর বর্ণনায়ও অনুরুপ তথ্য পাওয়া যায়।
১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে ঈসা খান কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ীর সামন্তরাজা লহ্মণ হাজরাকে পরাজিত করেন। এ বছর মুগল সুবাহদার শাহবাজ খান পুনরায় ঈসা খানের বিরুদ্ধে ভাটিতে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু মুগলদের এ অভিযানও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল বলে মনে হয়। অত:পর প্রায় দশ বছর পর্যন্ত মুগলদের সাথে ঈসা খানের আর কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি।
১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের সাথে ঈসা খানের যুদ্ধ হয়। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহ সুবাহদার নিযুক্ত হয়ে বাংলায় আসেন এবং ঈসা খানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণে সচেষ্ট হন। ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মানসিংহ রাজমহল থেকে ঈসা খানের বিরুদ্ধে যাত্রা করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোনো যুদ্ধ হয়নি। ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মানসিংহ ঈসা খানের বিরুদ্ধে স্থল ও জলপথে দু’টি বাহিনী প্রেরণ করেন। মানসিংহের পুত্র দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে মুগল বাহিনী প্রথম দিকে কিছুটা সাফল্য অর্জন করেন। এমন কি তারা ঈসা খানের রাজধানী কাত্রাবোও আক্রমণ করে। ঈসা তার মিত্র বাহিনীসহ অনেক নৌকা নিয়ে বিক্রমপুর থেকে ছয় ক্রোশ দূরে উপস্থিত হন এবং মুগল নৌ-বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললে উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয় (সেপ্টেম্বর, ১৫৯৭)। যুদ্ধে দুর্জন সিংহ সহ মুগল বাহিনীর অনেকে নিহত হয় এবং অনেক মুগল সৈন্য ঈসা খানের হাতে বন্দি হয়। এরপরে মুগলবাহিনীর সাথে ঈসা খানের আর কোনো যুদ্ধ হয়নি।
ঈসা খানের জীবদ্দশায় মুগল সম্রাট আকবর পূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চলে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এ সময়ে ঈসা খান ভাটির বিশাল অংশে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে সে অঞ্চলকে একটি স্বাধীন রাজ্যে পরিণত করেন। সূত্র মতে, সে সময় ভাটি অঞ্চলের ২২টি পরগনা সরাসরি ঈসা খানের শাসনাধীন ছিল। ঈসা খানের মৃত্যু ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে। [এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমদ]